মুজাফ্‌ফর আহমেদ, কমরেড
(আগস্ট ৫, ১৮৮৯- ডিসেম্বর ১৮, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)

ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং বঙ্গদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের সদর জেলা- চট্টগ্রাম জেলা অন্তর্গত সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামের এক দরিদ্র অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মনসুর আলি ছিলেন সন্দ্বীপের এক স্বল্প আয়ের মোক্তার ছিলেন। মায়ের নাম চুনাবিবি। উল্লেখ্য, চুনাবিবি তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সন্দীপের হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে (পরে কাগিল হাইস্কুল) ভর্তি হন। এই সময় পিতার মোক্তারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে, বেতনাদি না দেওয়ার কারণে স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়। সে সময় মাদ্রাসা শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। এই সময় তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি পারিবারিক কৃষিকাজে সাহায্য করতেন। সন্দীপের কাগিল হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুজফ্‌ফর আহমদের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সম্পাদিত 'সাপ্তাহিক সুলতান' পত্রিকায় সন্দীপের স্থানীয় সাংবাদিকের কাজ করতেন ।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এই সময় তিনি নোয়াখালীর বামনী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি কিছুকাল বরিশালে গৃহশিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি আবার নিজ গ্রামে ফিরে স্কুলে ভর্তি হন।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে পারিবারিক চাপে তিনি বিয়ে করতে বাধ্য হন। তার স্ত্রীর নাম হাফেজা খাতুন।

১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কাগিল হাইস্কুল ছেড়ে নোয়াখালী জেলা স্কুলে ভর্তি হন।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে এ সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল। সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন।

১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এই বছরেই তিনি হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে থাকাকালে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটায়, সে বৎসরই তিনি বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে তিনি আই এ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। এরই মধ্য দিয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর্ব শেষ হয়ে যায়। তবে এই সময় থেকে তিনি কলকাতায় বসবাস করতে থাকেন।

প্রথমে হুগলি কলেজ এবং পরে বঙ্গবাসী কলেজে কলা শাখায় ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মুজাফ্ফর আহমেদ রাইটার্স বিল্ডিং-এর ছাপাখানার চাকরিতে যোগ দেন। এরপর তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা, সভা-সেমিনার-মিছিলে অংশ করা শুরু করেন। এই সময় থেকে তিনি সক্রীয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি,
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র কার্যকরী সভায় একটি সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সূত্রে এই সমিতির উদ্যোগে বের হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। মোজাফ্‌ফর আহমেদ এই পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। এই সময় পত্রিকার পক্ষ থেকে চিঠিপত্রের আদান-প্রদানের সূত্রে কবি কাজী নজরুল ইসলামের  সাথে পরিচয় হয়।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার অনুষ্ঠিত আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে ৪৯ নং বাঙালী পল্টন সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া হল। পূর্বের কথামত কাজী নজরুল ইসলাম করাচী থেকে সোজা চলে আসেন শৈলজানন্দের রামাকান্ত বোস স্ট্রিটের পলিটেকনিক বোর্ডিং-এ। এখানে এক চাকর নজরুলের এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করায় এবং নজরুলের অবস্থানে মেসের অন্যান্য বাসিন্দার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হওয়ায় তিনি নীরবে সে স্থান ত্যাগ করে  বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসে চলে এসেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সময় কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র অফিসে কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ, অফিসেই থাকতেন। এরই মধ্য উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। এই দলটি গঠন করেছিলেন বাঙালি নেতা মানবেন্দ্র নাথ রায়। এর মাত্র একমাসের মধ্যে বঙ্গদেশেও সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। এই সংগঠনের পুরোধা ছিলেন মুজফ্‌ফর আহমদ। তাঁর মাধ্যমেই বঙ্গদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যাত্রা শুরু করে।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনিত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই বছরের শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হকের কাছে একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা জানান। ফজলুল হক এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য করতে রাজি হলে,  কাজী নজরুল ইসলামের সহযোগিতায়  "নবযুগ" নামক সান্ধ্যকালীন পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১২ই জুলাই। পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন কাজী নজুরল ইসলাম।  এই সময় মুজাফ্ফর আহমেদ এই পত্রিকায় কর্মজীবী মানুষের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ফিচার লেখেন।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি নবযুগ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ই মে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুখপত্র
The Vanguard of the Indian Independence শিরোনামে পার্টির প্রথম  প্রকাশিত হয়। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে মুজাফ্ফর আহমেদ কমরেড আব্দুল হালিমের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁরা যৌথভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এই সময় তিনি কর্মজীবী শ্রেণি আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এর কিছুদিন পর কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই সূত্রে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে কিছুকাল পর তিনি যক্ষ্মা রোগে অসুস্থতার কারণে মুক্তি পান।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের
১২ আগস্ট থেকে তিনি 'গণবাণী' নামক একটি  একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন কাজী নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত  লাঙল পত্রিকাটি, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ (বৃহস্পতিবার ১৫ এপ্রিল ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ) পত্রিকাটির পঞ্চদশ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় এরপর পত্রিকাটি 'গণবাণী' সাথে একীভূত হয়ে যায়।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে মার্চ মুজাফ্ফর আহমেদ কলকাতায় মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পুনরায় গ্রেফতার হন। তাঁকে সব মিলিয়ে প্রায় ২০ বছর ব্রিটিশ ও কংগ্রেস সরকারের জেলে অতিবাহিত করতে হয়। জেলে থাকাকালীন তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে দুবার অনশন ধর্মঘট করেন।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ব্যতীত পার্টির সব কংগ্রেসেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি নির্বাচিত হন।

১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত বাংলার ২৮টি জেলাতেই ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার সদস্য এতে যোগ দিতে শুরু করে। ট্রেড ইউনিয়ন ও কিষাণ সভা গড়ে উঠতে থাকে সর্বত্র। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের পর মুজফ্ফর আহমদ ভারতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৪  খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে ভাগ হওয়ার আগে মুজফ্ফর আহমদ পার্টির অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাদি


সূত্র: