দেওয়ান রামকমল সেন
১৭৮৩-১৮১২ খ্রিষ্টাব্দ
প্রখ্যাত বাঙালি শিক্ষাবিদ, অভিধান প্রণেতা।

১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ (শনিবার ৪ চৈত্র ১১৮৯ বঙ্গাব্দ), তৎকালীন ২৪ পরগণার ভাগীরথী তীরস্থ গৌরিফা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম গোকুলচন্দ্র সেন। রামকমল ছিলেন তিন ভাইয়ের নাম মধ্যম। বড় ভাইয়ের নাম ছিল মদন এবং ছোট ভাইয়ের নাম ছিল রামধন। উল্লেখ্য, এঁরা ছিলেন রাজা বল্লালসেনের বংশধর। পরবর্তী সময়ে এঁদেরই একটি শাখা  কলকাতার কলুয়াটোলা অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুন নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা বাংলার অধিকর্তা হয়ে উঠেছিল। এই সময় কলকাতাকে ইংরেজরা প্রশাসনিক ও ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা শুরু করে। এই সূত্রে স্থানীয় বহু মানুষ ইংরেজদের অধীন বিভিন্ন পদে চাকরির সুযোগ পায়। অনেকে ইংরেজেদের সাথে ব্যবসা করে ধনী হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে নেয়। ইংরেজদের সাথে যোগাযোগের জন্য এই সময় কলকাতায় অনেক ইংরেজি শিক্ষার স্কুল গড়ে উঠে। কলুয়াটোলে সে সময়ে এরূপ দু একটি স্কুল চালু হয়েছিল। এসব স্কুলের মধ্যে রাজময় দত্তের ইংলিশ স্কুল বেশ প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ বৎসর বয়সে রামকমল এই রাজময় দত্তের ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। রামকমলের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, সে সময় স্কুলের পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো ইংরেজিতে লেখা 'তুতিনামা' ও আরব্য উপন্যাস। এই সময় বিদ্যালয়ে ইংরেজি অভিধান বা ব্যাকরণ পড়ানো ব্যবস্থা ছিল না। আরিথিক অসুবিধার জন্য এই স্কুলের ব্যয়ভার বহন করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তাই তিনি চাকরির সন্ধান শুরু করেন।

১৮০২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর (শুক্রবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১২০৯) তিনি কলকাতার তৎকালীন প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট ব্ল্যাকোয়ারের সহকারী
Namey -এর অধীনে কাজ শুরু করেন। এর ঠিক একবছর পরে ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর (শনিবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১২১০) বিবাহ করেন। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, তাঁর পিতা গোকুলচন্দ্র সেন রামকমলকে তৎকালীন সরকারি স্থপতি আর. ব্লেকিনডেনের কাছে নিয়ে যান এবং গোকুলচন্দ্র সেনের অনুরোধে, ব্লেকিনডেন শিক্ষানবীশ হিসেবে গ্রহণ করেন। সম্ভবত এখানে বিশেষ আর্থিক সুবিধা না পাওয়ায় ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক ৮ টাকা বেতনে হিন্দুস্থানী প্রেসে কম্পোজিটরের হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন।

১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হিন্দুস্থানী প্রেসের কাজ ছেড়ে দিয়ে চাঁদনী হাসপাতালে চাকরি গ্রহণ করেন। তবে এখানে তিনি কোন পদে ছিলেন তা জানা যায় না।

১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে হাসপাতালের চাকরি ত্যাগ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্নেল রামজের অধীনে একটি চাকরি নেন। এই চাকরিতে থাকাবস্থায় কর্মদক্ষতা, অধ্যাবস্যায় এবং সংস্কৃত ভাষার উপর অসাধারণ দখল দেখে- সংস্কৃতভাষার পণ্ডিত এইচ, এইচ উইলসন মুগ্ধ হন। উইলসন তাঁকে এসিয়াটিক সোসাইটির অফিসে মাসিক ১২টাকা বেতনে কেরানির চাকরি দেন। ক্র্মক্ষেত্রে অসামান্য সুফল দেখানোর কারণে ধীরে ধীরে তিনি সোসাইটির স্থানীয় বিভাগের সম্পাদকের পদ লাভ করেন। পরে তিনি সোসাইটির কাউন্সিলারের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন।

১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি (শুক্রবার, ২৮ পৌষ ১২২৩) হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। এই কলেজে স্থাপনে রামকমল সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন। পরে এই কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সভার সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা স্কুল সোসাইটি গঠিত হয়। এই সোসাইটির তিনি সদস্য ছিলেন। এই সোসাইটিতে থাকার সময় তিনি ইংরেজি বাংলা অভিধানের প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করেন। এই বছরে ১৩১টি গল্পের তাঁর সংকলন- 'নীতকথা' প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। অবশ্য এই গ্রন্থ প্রণয়নে তাঁর সহযোগী ছিলেন তারিণী মিত্র।

১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল 'হিতোপদেশ' অনুবাদগ্রন্থ।

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত লোক শিক্ষার্থ সাধারণ সমিতি। এই সমিতি প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পরে তিনি এই সদস্যর সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে রামকমল প্রণীত ইংরেজি-বাংলা অভিধান প্রকাশিত হয়। এর পত্র সংখ্যা ছিল ৭০০।

কর্মদক্ষতা ও সততার বিচারে নিজেকে উচ্চতর স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এই সূত্রে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে রামকমল কলকাতার টাকশালের দেওয়ান পদে চাকরি পান। এই নতুন ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য দেখানোর কারণে, ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান পদ লাভ করেন। এই সময় তাঁর মাসিক বেতন ছিল দুই হাজার টাকা। এই সময় তিনি বেঙ্গল ব্যাঙ্কের সেক্রেটারির জর্জ উদনীর ঘনিষ্ট সহযোগী ও সহকর্মী হয়ে উঠেন। কিন্তু একসময়ে উভয়ের ভিতরে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত মীমাংশার জন্য ব্যাঙ্কের ডিরেক্টের বোর্ডে উত্থাপিত হয়। বিচারে রামকমল বিজয়ী হন।

১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এগ্রি-হটিকলাচার সোসাইটির সাথে গভীরভাবে যুক্ত হন। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই সোসাইটির সহাকারী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

দেশীয় জনসাধারণের শিক্ষার পাশাপাশি বিদেশীদের শিক্ষার বিষয়ে উদ্যোগী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্যাটার্নাল একাডেমি। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই একাডেমীর সহকারী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রামকমল কাউন্সিল অব এডুকেশান বোর্ডের সদস্য হন।

১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ২রা আগষ্ট (১৯ শ্রাবণ ১২৫১) কলকাতায় মৃত্যবরণ করেন।

রামকমলের সন্তানাদি
সূত্র: