সক্রেটিস
গ্রিক
Σωκράτης

গ্রিক দার্শনিক। এঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে প্রাচীন গ্রিসের কোনো জীবনীকারের লেখা থেকে জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তার উৎসগুলো হলো প্লেটোর কথপোকথন সমূহ, এরিস্টোফেনিসের নাটকসমূহ এবং জেনোফোন-এর কথপোকথন সমূহ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে গ্রিসের এথেন্স নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্লেটো মতে, তাঁর পিতার নাম ছিল সোফ্রোনিস্কাস (Sophroniscus)। পেশায় তাঁর বাবা ছিলেন একজন ভাস্কর। সে হিসেবে তার প্রথম জীবন কেটেছে ভাস্করের কাজ করে। প্রাচীনকালে অনেকেই মনে করতো গ্রিসের অ্যাক্রোপলিসে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত বিরাজমান ঈশ্বরের করুণা চিহ্নিতকারী মূর্তিগুলো সক্রেটিসের হাতে তৈরি। অবশ্য এর স্বপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। সক্রেটিসের মায়ের নাম ফিনারিটি (Phaenarete)। ইনি পেশায় ছিলেন ধাত্রী।

তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল জ্যান্থিপ্পে (Xanthippe)। বয়সের বিচারে জ্যান্থিপ্পে সক্রেটিসের থেকে অনেক ছোটো ছিলেন। এঁদের তিনটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। এঁদের নাম লামপ্রোক্লিস (Lamprocles), সফ্রোনিস্কাস (Sophroniscus) এবং মেনেজেনাস (Menexenus)।

এরিস্টোফেনিসের বর্ণনায় দেখা যায় যে, সেকালের এথেন্সের প্রথামত সক্রেটিস শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নিতেন। এই সময় তিনি গ্রিসের চেরিফোনে একটি সোফিস্ট বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। কিন্তু প্লেটোর অ্যাপোলজি (Apology) এবং জেনোফোনের সিম্পোজিয়াম (Symposium) থেকে জানা যায়, সক্রেটিস কখনই শিক্ষা প্রদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করেন নি।

প্লেটোর বর্ণনায় পাওয়া যায়
তিনি তিনটি সামারিক অভিযানে এথেনীয় সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। এই অভিযানগুলো সংঘটিত হয়েছিল যথাক্রমে পটিডিয়া (Potidaea), অ্যাম্‌ফিপোলিস (Amphipolis) এবং ডেলিয়াম (Delium)-এ। ডেলিয়ামের যুদ্ধে বেশ বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন এ বিষয়ে বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়।

বিভিন্ন রচনা থেকে জানা যায়, সক্রেটিসকে  সুদর্শন ছিলেন না। তাঁর মাথায় টাক ছিল, নাক একটু চ্যাপ্টা ছিল, চোখের গড়ন ছিল ছোট। তিনি ছিলেন খর্বাকার এবং স্ফীত উদরবিশিষ্ট কদাকার। মুখমণ্ডলের বিবরণ অনুযায়ী তাঁকে গ্রিক না ভেবে মঙ্গোলীয় বলে মনে হয়। তিন বেশ রসিক ছিলেন। নিজের মুখের গড়ন নিয়ে তিনি রঙ্গ করে বলতেন নাসারন্ধ্রটি বড় হওয়ায় ঘ্রাণ নেয়ার বিশেষ সুবিধা হয়েছে বেশি, আর নাকটি বেশি চ্যাপ্টা হওয়াতে দৃষ্টি কোথাও বাঁধা পায় না।

তিনি চমৎকার বাক্যালাপ করতে পারতেন। অধিকাংশ সময় তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে শ্রোতার কাছ থেকে শুনতেন এবং ক্রমাগত প্রশ্ন করে করে বক্তার বক্তব্যকে অসাড় প্রমাণিত করতেন। দর্শন অনুশীলন করতে গিয়ে সংসার ও জীবিকা সম্পর্কে তিনি খুবই উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন। অর্থাগম হয়, তিনি এমন কোনো কাজই করতেন না। যার ফলে অত্যন্ত দরিদ্র দশায় জীবন যাপন করতেন। বেশিরভাগ সময়েই তিনি তাঁর শিষ্যদের বাড়িতে পানাহার করতেন। ফলে তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরা প্রায় অভুক্ত থাকতো। স্বভাবতই এই কারণে স্ত্রী জ্যান্থিপ্পের কাছে তিনি ছিলেন রীতিমতো অবজ্ঞার পাত্র। তবে সক্রেটিসের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী যেভাবে শোক প্রকাশ করেছিলেন, তাতে মনে হয় তিনি সক্রেটিসকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।

১৭৮৭ সালে জ্যাক লুই ডেভিড কর্তৃক অংকিত চিত্র 'দ্য ডেথ অফ সক্রেটিস'

পলিনেশিয়ান যুদ্ধে স্পার্টা এবং তার মিত্র বাহিনীর কাছে এথেন্সের হেরে যাওয়ার পর, এথেন্সে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এরপর এথেন্সের শাসক গোষ্ঠী এথেন্সের পুনর্গঠনের কাজ হাত দেন। এই সময় সক্রেটিস এই প্রচেষ্টার খারাপ দিক তুলে ধরে সমালোচনা করেন। এছাড়া তিনি এথেন্সের ঘোরতর শত্রু স্পার্টার নানা দিক সম্পর্কে প্রশংসা করেন। যদিও সেকালের বিচারে সক্রেটিসের এই মূল্যায়ন যথার্থ ছিল, কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর জন্য তা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তিনি তৎকালীন বিচার ব্যবস্থারও তীব্র সমালোচক ছিলেন। এথেনীয়দের সুবিচারের প্রতি নিষ্ঠা বাড়ানোর চেষ্টা করার জন্য, এথেন্সের অভিজাত শ্রেণী এবং বিচারকদের কাছে তিনি শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর জ্ঞানের জন্য সমকালীন সমস্ত দার্শনিকদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এই কারণে অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে তাঁর নিরব-সরব দুই ধরনের দ্বন্দ্বই ছিল। কথিত আছে সক্রেটিসের বন্ধু চেরিফোন একদিন ডেলফির মন্দিরে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন যে, সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ আছে কি-না। উত্তর পাওয়া যায় সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ নেই। মূলত ডেলফির মন্দিরে ভবিষ্যৎ বাণী করা হতো ভাগ্য সম্পর্কে। ব্যক্তি চরিত্রের উপর এই উত্তর পেয়ে এথেন্সবাসীরা ডেলফির মন্দিরের বাণীর সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরপর সক্রেটিসের সাথে নন্দন তত্ত্বের নানাবিধ দিক নিয়ে এথেন্সের জ্ঞানী ব্যক্তিরা কথা বলেন এবং তাঁরা পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। এই সকল কারণে এথেন্সের সকল ধরনের ক্ষমতাধর মানুষদের কাছে তিনি অসহ্য হয়ে উঠেছিলেন। মূলত এঁরা আগে থেকেই তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল। বিচারটা ছিল একটি প্রহসন মাত্র।

বিচারে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানো। বিচারে সাব্যস্ত হয়, হেমলক গাছের রস (হেমলক বিষ) পান করিয়ে তাঁকে মৃত্য দেওয়া হবে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে তিনি এই বিষ গ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করেন।


সূত্র
পাশ্চাত্ত্য দর্শনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রাচীন যুগ থেলস-অ্যারিস্টটল। ব্যানার্জী পাবলিশার্স। সেপ্টেম্বর ১৯৯৭।
http://www.britannica.com/EBchecked/topic/551948/Socrates