শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(১৮৭৬ -১৯৩৮) খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক, ও গল্পকার। অপরাজেয় কথাশিল্পী' নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।

১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার ৩১ ভাদ্র ১২৮৩), ভারতের  পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের হুগলি জেলার সরস্বতী নদীর তীরস্থ দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের আদি নিবাস ছিল  বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকট মামুদপুরে। মতিলাল আর্থিক অনটনের জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠন। উল্লেখ্য শরৎচন্দ্রের মা  ভুবনমোহিনী দেবী ছিলেন- উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালিশহরের রামধন গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা। গঙ্গোপাধ্যায়রা কালক্রমে ভাগলপুর নিবাসী হন৷

পাঁচ ভাই আর বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তার দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তার দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তার এক বোন ছিলেন।

১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন, যেখানে তিনি দু-তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভাগলপুরে থাকাকালে তাঁর মামা তাঁকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মতিলালের ডিহিরির চাকরি চলে যান। এই সময় শরৎচন্দ্র জেলা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলের ফি দিতে না-পারার কারণে তাকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি 'কাশীনাথ' ও 'ব্রহ্মদৈত্য' নামে দুটি গল্প লেখেন।

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মতিলাল পুনরায় ভাগলপুর ফিরে গেলে প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষালাভের প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহ লক্ষ্য করে তাকে তাঁর বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয় ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন এবং তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তাঁর মাতামহের ছোটো ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়াতেন, তার বিনিময়ে অঘোরনাথ তার কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন। এই সময় তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর মতিলালের সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বিরোধ হলে তিনি এঁদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাভাবে তিনি পড়াশুনায় ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।

এই সময় ভাগলপুরের তৎকালীন সাবজজের পুত্র বিভূতিভূষণ ভট্টের সাথে শরৎচন্দ্রের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়।
তিনি এখানকার আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলো ও অভিনয় করে সময় কাটাতে শুরু করেন। এই সূত্রে তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি হয় এখানে। এই সময় এই বন্ধুমহল প্রকাশিত থেকে হাতে লিখা পত্রিকা 'ছায়া'-তে লিখতেন। পর বিভূতিভূষণের পিতা চাকরির সূত্রে অন্যত্র চলে গেলে এই সাহিত্য চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি কলকাতায় চাকরির সূত্রে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন। এই সময় তিনি বনেলী রাজ-এস্টেটে কয়েকদিন চাকরি করেন। কিন্তু পিতার ওপর কোনো কারণে অভিমানবশত তিনি সন্ন্যাসী সেজে ঘর ছেড়ে চলে যান। তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তিনি ভাগলপুর ফিরে এসে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে কলকাতা যাত্রা করেন, সেখানে তিনি কলকাতা উচ্চ আদালতের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি তর্জমা করার জন্য মাসে ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি পান। এই সময়, তিনি 'মন্দির' নামে একটি গল্প লিখে 'কুন্তলীন' প্রতিযোগিতায় পাঠালে তা বিজয়ী ঘোষিত হয়।

পরে তিনি চাকরি ছেড়ে ভবঘুরের মতো কিছুদন ঘুরে বেড়ান। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রেঙ্গুনে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভগ্নিপতি উকিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে চলে যান। অঘোরনাথ তাঁকে বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে একটি অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে পচাত্তর টাকা মাইনের কেরেনিগিরির চাকরি লাভ করেন। এই সময় তিনি রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে বসবাস করতেন। তাঁর বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বসবাস করতেন। তাঁর পিতা তার সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ের ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন এবং শরৎচন্দ্র তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। তাঁদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রনাথ মিত্রের সাহায্যে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে এই অফিসে চাকরি পান ও পরবর্তী দশ বছর এই চাকরি করেন। এই সময় রেঙ্গুনে বসবাসরত কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। এঁদের কোনো সন্তান হয় নি।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে এলে 'যমুনা' নামে পত্রিকার সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পাল তাঁকে পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। পরে তিনি রেঙ্গুনে ফিরে গিয়ে রামের সুমতি গল্পটি পাঠিয়ে দেন। গল্পটি যমুনা পত্রিকায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার জন্যেও লেখা পাঠাতে শুরু করেন। ফনীন্দ্রনাথ পাল তার উপন্যাস বড়দিদি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স তার উপন্যাসগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এই সময়ের রচিত গ্রন্থগুলো ছিল- এই সময় রচিত উপন্যাসগুলি হলো- বড়দিদি (১৯১৩), বিরাজ বৌ (১৯১৪), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৫),  বৈকুন্ঠের উইল (১৯১৫), পল্লীসমাজ (১৯১৬), চন্দ্রনাথ (১৯১৬),  অরক্ষণীয়া (১৯১৬)।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছুটি নিয়ে মনোমালিন্যের কারণে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রেঙ্গুন ত্যাগ করে বাংলায় ফিরে আসেন। বার্মার পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর থেকে উপন্যাস ছাড়াও তিনি প্রচুর ছোট-বড় গল্প রচনা করেন। বার্মাতে তিনি ভ্রমণকাহিনী হিসাবে শ্রীকান্ত রচনা শুরু করেন, পরে তা কলকাতায় শেষ করেছিলেন।

শেষ বয়সে শরৎচন্দ্র হাওড়া জেলার পানিত্রাস (সামতাবেড়) গ্রামের মাটির বাড়িতে বাস করতেন। স্থানটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দেউলটি স্টেশন থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটারের পথ সামতাবেড়ের বাড়িটা রূপনারায়ণ নদের তীরে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের বন্যায় পাশাপাশি সব গাঁয়ের মাটির বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়িটা রূপনারায়ণের কূলে থেকেও আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা পেয়ে যায়। এরপর শরৎচন্দ্র শিবপুরে চলে আসেন। এই কারণে বর্তমানে শিবপুর ব্যাতাইতলা বাজার থেকে চ্যাটার্জিহাট পর্যন্ত রাস্তা শরৎচন্দ্রের নামে নামকরণ করা হয়েছে।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়া শুরু করেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে তিন চার মাস কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন। চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেহে অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল দশটায় শরৎচন্দ্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তাঁর রচিত সাহিত্যকর্মের তালিকা দেওয়া হলো।
 
উপন্যাস গল্প গ্রন্থিত অপ্রকাশিত রচনা
অরক্ষণীয়া
গৃহদাহ
চন্দ্রনাথ
চরিত্রহীন
দত্তা
দেনা-পাওনা

দেবদাস (১৯১৭)  
নব-বিধান
নিষ্কৃতি
পথের দাবী
ণ্ডিতমশাই
পরিনীতা
পল্লী-সমাজ
বামুনের মেয়ে
বিপ্রদাস
বিরাজবউ
বৈকুন্ঠের উইল
বড়দিদি
শুভদা (অধ্যায় ১)
শুভদা (অধ্যায় ২)
শেষ প্রশ্ন
শেষের পরিচয় (অসমাপ্ত উপন্যাস)
শ্রীকান্ত (চতুর্থ পর্ব)
শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব)
শ্রীকান্ত (দ্বিতীয় পর্ব)
শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব)

 
নাটক

বিজয়া
রমা
ষোড়শী

প্রবন্ধ

তরুণের বিদ্রোহ
নারীর মুল্য
স্বদেশ ও সাহিত্য

অনুপমার প্রেম
অনুরাধা
অভাগীর স্বর্গ
আঁধারে আলো
আলো ও ছায়া
একাদশী বৈরাগী
কাশীনাথ
ছবি
ছেলেধরা
দর্পচূর্ণ
পথ-নির্দেশ
পরেশ
বছর-পঞ্চাশ পূর্বের একটা কাহিনী
বাল্য-স্মৃতি
বিন্দুর ছেলে
বিলাসী
বোঝা
মন্দির
মহেশ
মামলার ফল
মেজদিদি
রামের সুমতি
লালু ১
লালু ২
লালু ৩
সতী
স্বামী
হরিচরণ
হরিলক্ষ্মী








 
'সাহিত্যের মাত্রা'
অপ্রকাশিত খণ্ডরচনা
আগামীকাল
আত্মকথা
আসার আশায়
কানকাটা
ক্ষুদ্রের গৌরব
জলধর-সম্বর্ধনা
জাগরণ
দিন-কয়েকের ভ্রমণ-কাহিনী
নারীর লেখা
নূতন প্রোগ্রাম
বর্তমান রাজনৈতিক প্রসঙ্গ
বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা
বাংলা নাটক
বাংলা বইয়ের দুঃখ
বাল্য-স্মৃতি
বেতার-সঙ্গীত
ভাগ্য-বিড়ম্বিত লেখক-সম্প্রদায়
মহাত্মাজী
মহাত্মার পদত্যাগ
মুসলিম সাহিত্য-সমাজ
যুব-সঙ্ঘ
রবীন্দ্র-জয়ন্তী উপলক্ষে মানপত্র
রস-সেবায়েৎ
রসচক্র
শুভেচ্ছা
সত্য ও মিথ্যা
সত্যাশ্রয়ী
সধবার একাদশী
সমাজ-ধর্মের মূল্য
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা (এক)
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা (দুই)
সাহিত্য সম্মিলনের রূপ
সাহিত্যের আর একটা দিক


 

অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি

'বামুনের মেয়ে'র নাট্যরুপ
'বিপ্রদাস'-এর পরিত্যক্ত এক পৃষ্ঠা
'শেষের পরিচয়' - এর অপ্রকাশিত অংশ
'শ্রীকান্ত'র পরিত্যক্ত অংশ
অন্তর্যামী
একটি অসমাপ্ত গল্প
কোরেল
দু'টি আবেদন
দুটি অসমাপ্ত প্রবন
দেশসেবা
বারোয়ারি উপন্যাস
বিচার
ভালমন্দ
মাতৃভাষা এবং সাহিত্য
৫৭তম জন্মদিনে প্রতিভাষণ