জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশের ইতিহাস

এককথায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশ বলতেই উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের কথা। রবীন্দ্রনাথের মতো একজন কালজয়ী পুরুষ এই বংশে জন্মগ্রহণ না করলে, হয়তো এই বংশের কথা ততটা গুরুত্ব পেতো না। যদিও তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ এবং তাঁর ব্রাহ্মসমাজ এক সময় বঙ্গদেশে, বিশেষ করে কলকাতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কিম্বা আকারমাত্রিক স্বরলিপির স্রষ্টা, গীতিকার, নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে আলোড়ন তুলেছিল, কিন্তু এতকাল পড়েও এই বংশের ইতিহাসের সন্ধান লোকে করে, রবীন্দ্রনাথের জন্যই।

ভারতীয় গবেষকদের মতে, খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের অধিকাংশ সময়, বঙ্গদেশে বৌদ্ধদের প্রভাব ছিল অত্যধিক। ফলে সনাতন হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠান প্রায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল। হিন্দু ধর্মের আচারানুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করার জন্য, মহারাজ আদিশূর কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ এনেছিলেন। এই পঞ্চব্রাহ্মণই নাকি বঙ্গদেশের সকল ব্রাহ্মণের আদিপুরুষ। অবশ্য অনেকে আদিশূরের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ করে থাকেন। যাঁরা এই কাহিনি বিশ্বাস করেন, তাঁদের ভিতর আবার পাঁজজন ব্রাহ্মণের নাম নিয়ে মতভেদ আছে।

১২০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে কিছু কিছু মুসলমান সাধক বঙ্গদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য এসেছিলেন। এর ফলে কোনো কোনো স্থানে কিছু নিম্নবর্ণের হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তবে বৃহত্তর বঙ্গদেশে তা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে নি।
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নামক জনৈক তুর্কি সেনাপতি আকস্মিকভাব সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর অস্থায়ী রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করে দখল করে নেন। এই সময়  লক্ষ্মণসেন পালিয়ে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে বঙ্গদেশে মুসলমানদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। এই সময়ের পর থেকে নিম্নশ্রেণীর বহু হিন্দু ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে। মুসলমান শাসকদের অত্যাচারে বা তাদের সংস্পর্শে এসে অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দু তাদের জাত খোয়ায়। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এই সব 'জাত খোয়ানো' উচ্চবর্ণের লোকেদের সাথে সকল ধরনের সংশ্রব ত্যাগ করে। নব্য ঠাকুর বংশের আদি পুরুষের জন্ম হয়েছিল এমনি একটি 'জাত খোয়ানো' বংশ থেকে।

খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামঝি সময়ে, যশোহর জেলার চেঙ্গুটিয়ার জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চার পুত্রের (কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব) প্রথম দুজন মুসলিম শাসক মামুদ তাহির বা পীর আলির চক্রান্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। অপর দুই ভাই, রতিদেব ও শুকদেব হিন্দু ধর্মে থেকে গেলেও সেই সময়কার সমাজনীতি অনুসারে তাঁরা সমাজচ্যুত হয়ে যান। স্থানীয়ভাবে এঁরা পিরালি-ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত হন। সে সময়ে অন্য ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সকল সম্পর্ক নষ্ট হয়। ধর্মকর্মে বা আচারানুষ্ঠানে তাঁরা ভিন্ন হয়ে গেলেও, সম্পদশালী এই জাত-খোয়ানো পরিবারে  জীবন নির্বাহে ততটা প্রভাব পড়ে নি। কিন্তু পরিবারের বিবাহযোগ্য সদস্যদের জন্য পাত্র-পাত্রী যোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে এঁরা তাঁরা পুত্র-কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন আরম্ভ করলেন। বিশেষ করে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁরা দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এই চেষ্টায় শুকদেব তাঁর বোন রত্মমালার সাথে মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের সাথে বিবাহ দেন এবং তাঁর থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দেন। অন্যদিকে শুকদেব তাঁর কন্যাকে পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারীর সাথে বিবাহ দেন। ফলে জগন্নাথ কুশারীও পিরালি থাকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। জগন্নাথের সকল আত্মীয়-স্বজন তাঁকে ত্যাগ করেন। ফলে জগন্নাথ কুশারী শুকদেবের আশ্রয়ে চলে আসেন। তিনি নরেন্দ্রপুর নামক গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে উত্তরপাড়া গ্রামের কাছে বারোপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।

জগন্নাথ কুশারী শুদ্ধ শ্রোত্রিয় বংশের ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং জমিদার হিসেবে ধনবানও ছিলেন। ইতিহাসে মূল পিরালি ব্রাহ্মণ হিসেবে নিগৃহীত রতিদেব ও শুকদেব-এর ইতিহাস হারিয়ে গেছে। সে জাগায় পিরালি-জামাতার বংশ ধরে নতুন বংশের ইতিহাস রচিত হয়েছে।

জগন্নাথ কুশারীর চারটি পুত্র সন্তান জন্মে। এঁদের নাম হলো- প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, হৃষীকেশ ও মনোহর। এঁদের ভিতর পুরুষত্তমের পুত্রের নাম ছিল বলরাম, বলরামের পুত্র হরিহর। হরিহরের পুত্র রামানন্দ। রামানন্দের দুই পুত্রের নাম মহেশ্বর ও শুকদেব। এই সময় এদের আর্থিক অসুবিধা কিম্বা জ্ঞাতিকলহের কারণে, মহেশ্বর তাঁর পুত্র পঞ্চাননকে সাথে নিয়ে, যশোহর ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী গ্রন্থে এই দেশত্যাগের সময় উল্লেখ করেছেনজব চার্নকের কলকাতা-পত্তনের সমসাময়িক অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। [রবিজীবনী, প্রথমখণ্ড। প্রশান্তকুমার পাল ভূর্জপত্র, ১লা বৈশাখ ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা: ৪]

জব চার্নকের কলকাতা পত্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,  এই সময়টা বঙ্গদেশের এই অঞ্চল একটি অস্থির অবস্থার ভিতরে ছিল। ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা মোগল সাম্রাজ্যের অধিনস্থ হুগলী দখলের চেষ্টা করে। এর ফলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজ সৈনিকদের যুদ্ধে হয়। এই যুদ্ধে ইংরেজরা পরাজিত হয়ে হুগলী ত্যাগ করে। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁ, কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জব চার্নককে, কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণে উলুবেড়িতে বাণিজ্যকুঠি নির্মাণের অনুমতিও দেন। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র সুরাট থেকে বোম্বাইতে স্থানন্তরিত করে। বোম্বাই উপকূলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হলে শায়েস্তা খান, জব চার্নককে দেওয়া অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া এই সময় কোম্পানির সৈন্যরা ক্যাপ্টেন হিথ-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল যুদ্ধ জাহাজ সিদি ইয়াকুবের নেতৃত্বে বোম্বাই নগরী অবরোধ করে। প্রায় ১ বৎসর অবরুদ্ধ থাকার পর, কোম্পানির সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ইংরেজরা সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মোগল সম্রাট তাদের ক্ষমা করেন এবং ইংরেজদের পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে সম্রাটকে দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হয়। এই বৎসরে বাংলার শাসনকর্তা ইব্রাহিম খাঁ জব চার্নবকে মাদ্রাজ থেকে ডেকে এনে বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়া দেয়। একই সাথে জব চার্নবকে বাংলার জমিদারি ক্রয় করার অধিকার দেওয়া হয়। চার্নক ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে আগষ্টে সুতানটিতে আসে এবং কলকাতা মহানগরীর পত্তন করেন।

জব চার্নকের এই উদ্যোগের ফলে, কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ ব্যবসায়ীদের আনাগোণায় সুতনটি ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবে পরিচিতি লাভ করে। বিশেষ করে সেকালের বড় বাজারে শেঠ-বসাকদের সুতাবস্ত্রের হাটে বহুলোকের সমাগম হতো। ফলে কাজের খোঁজে, বহুলোক এখানে আসা শুরু করে। এই সূত্রেই আদি কলকাতায় মহেশ্বর ও পঞ্চানন আসে। এঁরা এসে প্রথমে দক্ষিণ গোবিন্দপুরের আদিগঙ্গার তীরে বসবাস করা শুরু করে। সে সময় এই অঞ্চলে বাস করতো মাছ ব্যবসায়ী জেলে, মালো কৈবর্ত প্রবৃতি অ-ব্রাহ্মণ শ্রেণীর মানুষ। সম্ভবত তাঁরা আগ্রহভরে এই ব্রাহ্মণদের থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল।

মহেশ্বর এবং পঞ্চানন শুরুদিকে বিদেশী জাহাজে মালামাল সরবরাহ করতো। কিছুদিন এই কাজ করার পর, এঁরা গোবিন্দপুরে কিছু জায়গা কিনে একটি বসতবাড়ি ও শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার মৃত্যুর পর এই ব্যবসা চালিয়ে যান পঞ্চানন কুশারী। এই সময় নিম্নবর্ণের মানুষরা এঁকে ব্রাহ্মণ হিসেবে ঠাকুরমশাই নামে ডাকতো। এঁদের দেখাদেখি বিদেশীরাও ঠাকুর (
tagoor, Tagore) নামে ডাকতো। কালক্রমে পঞ্চানন কুশারী হয়ে যায় পঞ্চানন ঠাকুর।

পঞ্চাননের দুই পুত্রসন্তানের নাম ছিল জয়রাম ও রামসন্তোষ। এদের সাথে ইংরেজ বণিকদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে এরা কিছুটা ইংরেজে ভাষা রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া ফরাসিদের সাথে বাণিজ্যের সূত্রে, ফরাসি ভাষায় শিখেছিল। এই সময় বাণিজ্যের সুবিধার জন্য ইংরেজরা কিছু কিছু স্থানীয় লোকদের নিয়োগ দিয়েছিল। পঞ্চানন তাঁর জীবদ্দশায়, ইংরেজ কর্মকর্তাকে ধরে তাঁর বড় ছেলে জয়রামকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি পাইয়ে দেন। জয়রাম পে-মাস্টারের অধীনে প্রধান কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন।

১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর ইংরেজদের অধীনে আসার পর, ইংরেজরা এই অঞ্চলে জরীপ চালায়। এই সময় কালেক্টর ছিলেন রালফ্ সেলডন। পঞ্চাননের অনুরোধে সেলডন তাঁর পুত্রদ্বয়কে আমিন হিসেবে নিয়োগ দেন। এই সময় জয়রামের পে-মাস্টারের কাজও বজায় ছিল। ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার দক্ষিণে দশ মাইলের ভিতরে আটত্রিশটি গ্রাম ক্রয় করে। এই সময় এই গ্রামগুলোর জরিপও জয়রাম ও রামসন্তোষ করেন। এই সময় এই অঞ্চল সংলগ্ন গ্রামগুলো ছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের। এই সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্রের সাথে জয়রামের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়। জয়রামের অর্থ এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে, তিনি বসতবাটিতে রাধাকান্ত বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে ৩৩১ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। কথিত আছে ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে মারাঠা খাল খননের সময় জয়রাম তার পরিদর্শক ছিলেন।
এই সময় জয়রাম এবং রামসন্তোষ ধানসায়র (বর্তমানে ধর্মতলা) এলাকায় জমাজমিসহ জাঁজমকপূর্ণ বাড়ি ছিল। এছাড়া বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম এলাকয় তাঁদের একটি বাগান বাড়ি ছিল।

জয়রামের দুই স্ত্রীর নাম ছিল গঙ্গা ও রামধনি। অন্যদিকে রামসন্তোষের একটি স্ত্রী ছিল, নাম ছিল সিদ্ধেশ্বরী। ঠাকুর বাড়ির এই তিনটি বৌ-ই ছিল যশোহর পিরালি বংশের মেয়ে। জয়রামের চারটি পুত্র সন্তানের ভিতরে প্রথম সন্তানের নাম ছিল আনন্দীরাম। পিতার অপ্রিয় কাজের জন্য তিনি পিতৃগৃহ থেকে বিতারিত হন। জয়রামের জীবদ্দশাতেই আনন্দীরাম মারা যান। এই পুত্র ছাড়া তাঁর অপর তিনপুত্র ছিল। এঁদের নাম- নীলমণি, দর্পনারায়ণ এবং গোবিন্দরাম।

১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জয়রামের মৃত্য হয়। এই বৎসরেরই জুন মাসে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে। ১৬ জুন ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করে। দুই দিন যুদ্ধের পর, ১৯শে জুনে ইংরেজ সেনাপতি এবং গভর্নর ড্রেক ইংরেজদের একটি বড় অংশকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ জন সৈন্য দুর্গে থেকে যায়। এই ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে হলওয়েল দুর্গের ভিতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু নবাবের বন্দুকধারী সৈন্যদের আক্রমণের মুখে অধিকাংশ ওলন্দাজ সৈন্য পালিয়ে যায় এবং নবাবের বাহিনীতে যোগদান করে। ২০শে জুন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়। সন্ধ্যায় নবাবের সৈন্যরা দুর্গের দেওয়ালে সরাসরি কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়। এই সময় জনৈক ওলন্দাজ সৈন্য নদী মুখের দুর্গ তোড়ন খুলে দেয়। এই পথে নবাবের সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশ করে। উপায়ন্তর না দেখে হলওয়েল আত্মসমর্পণ করে।

এই যুদ্ধে ঠাকুরদের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা'র পতনের পর,
মীরজাফর নবাব হলে, তিনি কলকাতাবাসীর ক্ষতিপূরণ দেন। এই সময় নীলমণি ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৮ হাজার টাকা পান। কলকাতায় ইংরেজরা দুর্গের সংস্করণ এবং অন্যান্য সুবিধাদির জন্য, ধানসায়র এবং ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা অন্যত্র সরে যায়। এই সময় নীলমণি ডিহি কলকাতা গ্রামে জমি কিনে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি (২০ পৌষ ১১৭১ বঙ্গাব্দ), কালেক্টরির নিজ অধিকারভুক্ত জমি থেকে দুই বিঘা তের কাঠা জমি বার্ষিক ৭৸৶৪ গণ্ডা সিক্কামুদ্রা খাজনায় বসবাসের জন্য পাট্টা নেন। ১১৭১ বঙ্গাব্দের ১৬ই চৈত্র, এই জমির পার্শ্ববর্তী ঘর-বাড়িসহ সাড়ে দশ কাঠা জমি জনৈক রামচন্দ্র কলুর কাছে থেকে ৫২৫ টাকায় ক্রয় করা হয়। এর কিছুদিন পর থেকে এখানে এঁরা সপরিবারে চলে আসেন। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের ২৫ অগ্রহায়ণ (ডিসেম্বর ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) এই জমিসংলগ্ন চুঁচুড়া নিবাসী জগমোহন লাহার কাছ থেকে ঘড়বাড়ি এবং দুই বিঘা সাত কাঠা জমি ৯ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়। উল্লেখ্য এই জমিসমূহের সকল দলিল করা হয় নীলমণির নামে।

এর কাছাকাছি সময়ে নীলমণি কোম্পানির অধীনে চাকরি নেন। নীলমণি উড়িষ্যার কালেক্টরের সেরেস্তা হিসেবে উড়িষ্যায় যান ১১৭২ বঙ্গাব্দে (১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ তাঁর ভাই দর্পনারায়ণকে পাঠাতেন। দর্পনারায়ণ হুইলারের দেওয়ানগিরি করতেন। উভয়ের অর্থ তিনি লবণ ব্যবসা, বিভিন্ন বাজার ইজারা ও অন্যান্য ব্যবসার সূত্রে খাটিয়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন।

১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে (১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দ) জয়রামের কনিষ্ঠ পুত্র গোবিন্দরাম নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে, তাঁর স্ত্রী রামপ্রিয়া ১১৮৯ বঙ্গাব্দে (১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দ) সম্পত্তি ভাগের জন্য সুপ্রীম কোর্টে মামলা করেন। এই মামলার রায়ে রামপ্রিয়া রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটের দুটি বাড়ি লাভ করেন। এরপর দর্পনারায়ণ ও নীলমণি সম্পত্তি ভাগ করে। এই বিভাজনে দর্পনারায়ণ পান পাথুরিয়া ঘাটার বাড়ি এবং রাধাকান্ত জীউর সেবার অধিকার। নীলমণি নেন তাঁর উপার্জিত সমুদয় অর্থ, বিভাজিত নগদ ১ লক্ষ টাকা, লক্ষ্মী জনার্দনের শিলা। নীলমণি পাথুরে ঘাটার বাড়ি ছেড়ে চলে এলে, কলকাতার আদি বাসিন্দা শেঠ-বংশীয় বৈষ্ণবচরণ মেছুয়া বাজারে এক বিঘা জমি নীলমণীকে দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শুদ্রের দান গ্রহণ করবেন না বলে এই দান তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তিনি লক্ষ্মী জনার্দনের নামে এই জমি দান করেন। এই দানের সূত্রে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পত্তন হয়। সম্ভবত ১১৯১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে (জানুয়ারি ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দ) এই বাড়িতে নীলমণি বাস করা শুরু করেন। প্রথমে একটি আটচালা ঘর তৈরি করে এঁরা বাস করা শুরু করেন। পরে এখানে পাকা বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। ১১৯৮ বঙ্গাব্দ (১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ) নীলমণির মৃত্যু হয়।

নীলমণির কয়টি পুত্র ছিল এ নিয়ে মতভেদ আছে। কোনো কোনো মতে তাঁর পুত্র ছিল পাঁচটি। এঁরা হলেন
রামতনু, রামরতন, রামলোচন, রামমণি ও রামবল্লভ। ব্যোমকেশ মুস্তফী তাঁর 'বঙ্গের ইতিহাস' গ্রন্থে তিন পুত্র ও এক কন্যার উল্লেখ করেছেন। এঁরা হলেন

রামলোচনের কন্যার মৃত্যর পর, ১২০৫ বঙ্গাব্দে (১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি রামমণির দ্বিতীয় পুত্র দ্বারকনাথকে দত্তক নেন। ২২ অগ্রহায়ণ ১২১৪ বঙ্গাব্দে (ডিসেম্বর ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি পালকপিতা রামলোচনের নিকট থেকে উইলের মাধ্যমে, বিরাহিমপুর পরগণার জমিদার-সহ বিপুল সম্পত্তি লাভ করেন। এই সময়  রামলোচনের স্ত্রী অলোকা দেবী ও দ্বারকানাথের আপন বড় ভাই রাধানাথ নাবালক দ্বারকানাথের সম্পত্তি দেখাশোনা করেন।
    দেখুন:
দ্বারকানাথ ঠাকুর


সূত্র: