১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের দৃশ্যানুসারে অঙ্কিত ছবি

ফোর্ট উইলিয়াম
ইংরেজি :
Fort William
ভৌগোলিক অবস্থান : ২২
° ৩৩২৭.৫৭ উত্তর দ্রাঘিমাংশ ৮৮°২০১৬.৯৯

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত একটি দূর্গ। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর তৈরিকৃত এই দুর্গটি সংস্কার করে, বর্তমানে
ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইংল্যান্ডের রাজার উইলিয়াম তৃতীয়-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম।

ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, জন গোল্ডসবর্গ (John Goldsborough) -এর তত্ত্বাবধানে এই দূর্গ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। স্যার চার্লস (Sir Charles Eyre) আইয়ার এই নির্মাণ শুরু করেন এই বৎসর থেকে। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে এর নামকরণ করা হয় ফোর্ট উইলিয়াম। ১৭০১ খ্রিষ্টাব্দে জন বিয়ার্ড  (John Beard) উত্তর-পূর্বাংশের দুর্গপ্রাচীর সংযোজন করেন। ১৭০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুর্গের মধ্যভাগে গভর্নমেন্ট হাউস (ফ্যাক্টরি) নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মূল ভবনটি ছিল দোতলা। এবং এর একটি বর্ধিত অংশ ছিল। এর অভ্যন্তরে ছিল একটি প্রহরী কক্ষ। এই কক্ষটি হলো বহুল আলোচিত অন্ধকূপ (Black Hole)।

কোম্পানির নিরাপত্তা বিধানের জন্য দুর্গটি তৈরি হলেও শুরু থেকেই এর কাঠামোটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এই মন্তব্য করেন যে, ভবনসমূহের সুউচ্চ শৃঙ্গের কারণে নদীতীর থেকে দুর্গটিকে জমকাল দেখালেও প্রকৃত অর্থে এটি শক্তিশালী ছিল না। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর রজার ড্রেক তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা সাথে দ্বন্দ্বের জড়িয়ে পড়েন এবং কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলকে তাঁদের অধিকারে রাখার চেষ্টা করেন। নবাব  সিরাজদ্দৌলা প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ইংরেজেদের অধিকৃত কলকাতা নগরীকে উদ্ধার করার জন্য অগ্রসর হন। নবাবের বাহিনী ১৬ জুন ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করে। দুই দিন যুদ্ধের পর, ১৯ জুনে ইংরেজ সেনাপতি এং গভর্নর ড্রেক ইংরেজদের একটি বড় অংশকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ জন সৈন্য দুর্গে থেকে যায়। এই ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে হলওয়েল দুর্গের ভিতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু নবাবের বন্দুকধারী সৈন্যদের আক্রমণের মুখে অধিকাংশ ওলন্দাজ সৈন্য পালিয়ে যায় এবং নবাবের বাহিনীতে যোগদান করে। ২০ জুন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়। সন্ধ্যার নবাবের সৈন্যরা দুর্গের দেওয়ালে সরাসরি কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়। এই সময় জনৈক ওলন্দাজ সৈন্য নদী মুখের দুর্গ তোড়ন খুলে দেয়। এই পথে নবাবের সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশ করে। উপায়ন্তর না দেখে হলওয়েল আত্মসমর্পণ করে। এই সময় এর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় আলিনগর। পরে কিছু ইংরেজ সৈন্যকে নবাবের সৈন্যকে  অন্ধকূপে বন্দী করে রাখা হয়। সকালে এই ঘরে এই সৈন্যদের মৃ্ত্যু হয়। ইতিহাসে একে অন্ধকূপ হত্যা বলা হয়। 

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ও মৃত্যুর পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় তাদের ক্ষমতা সংহত করে এবং ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ এই দুর্গের সংস্কারের উদ্যোগ নেন।

১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানির বাংলা কর্তৃপক্ষ মি. ব্রহিয়েরকে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে বলেন। ব্রহিয়ের এই সময় নতুন দুর্গ নির্মাণে ব্যয় ২১ থেকে ২২ লক্ষ পাউন্ড ধার্য করেছিলেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করলে, নতুন দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যে ব্রহিয়ের জালিয়াতির দায়ে গ্রেফতার হন। কিছুদিন পর ব্রহিয়ে প্যারোলে মুক্তি পান, তবে এই কাজে তাঁকে আর আনা হয় নাই।  ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দের এই দূর্গের অধিকাংশ কাজ শেষ হয়। ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে  নাগাদ দুর্গ নির্মাণ শেষ হয়।

এই সময় উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দূর্গের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটার। আর দুর্গের জন্য ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ছিল ৭০.৯ হেক্টর। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময় দুর্গটি ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে। অবশ্য নতুন নতুন প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আরও অনেক কাজে হাত দিতে হয়।

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই দুর্গের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া হয় এবং তা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি তা অব্যাহত ছিল। আধুনিক

দুর্গ নির্মাণের স্বীকৃত নীতিমালার সংগে সঙ্গতি রেখেই ফোর্ট উইলিয়ম নির্মিত হয়েছিল। মূল দূর্গটি অষ্টভুজাকৃতির। এর পাঁচ দিক স্থলভাগের দিকে এবং তিন দিক হুগলী নদীর দিকে প্রসারিত। পরিখা দুর্গটিকে বেষ্টন করে আছে একটি পরিখা। জল-কপাটের সাহায্যে নদী থেকে জলে তুলে এই পরিখাটি পূর্ণ করা হত। দুর্গে প্রবেশের জন্য সাতটি প্রবেশদ্বার ছিল। গোড়ার দিকে নির্মিত ব্যারাকগুলি ছিল একতলা বিশিষ্ট। সেন্ট পিটারকে উৎসর্গ করা একটি গির্জা ছিল দুর্গের অভ্যন্তরে। শুরুতে সৈন্যরা পর্যাপ্ত পানীয় জল পেতো না। এছাড়া  যথাযথ পয়ঃপ্রণালী ছিল না। ফলে সৈনরা নানা উদরাময়ের শিকার হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে নতুন ব্যারাক নির্মাণের সময় এসব অসুবিধা দূরীকরণের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল।

সামরিক গুরুত্বের বিচারে এই দুর্গটি গুরুত্ব হারিয়েছিল। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের পর আর কখনো এই দুর্গটি আক্রান্ত হয় নি। ব্রিটিশ ভারতে এই দুর্গটি শেষ পর্যন্ত একটি ঐতিহ্য হিসাবেই থেকে গিয়েছিল।

স্বাধীন ভারতে এর ব্যাপক সংস্কার করে, আধুনিক সেনানিবাসে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমানে এই সেনানিবাসে প্রায় ১০ হাজার সৈন্য বসাবাস করার সুবিধা আছে। সৈন্যদের আবাসিক সুবিধা-সহ আধুনিক বিপনী বিতান, সিনেমা হল, খেলাধূলার উপযোগী সকল ব্যবস্থাই এতে আছে।


তথ্যসূত্র:
বাংলাপিডিয়া ষষ্ঠ খণ্ড। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। চৈত্র ১৪০৯/মার্চ ২০০৩।
http://en.wikipedia.org/wiki/Fort_William,_India