বাংলা ধ্রুপদ গানের অন্যতম শিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর পুরো নাম যদুনাথ ভট্টাচার্য।
১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরের ভট্টপাড়া (বর্তমান বৈদিকপাড়া) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মধুসূদন ভট্টাচার্য ওই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুরবাহার ও সেতারবাদক ছিলেন। তিনি রাজা নীলমণি সিংহের সভাগায়ক হয়েছিলেন।
|
দশ-এগারো বৎসর বয়সে তিনি তাঁর পিতার কাছে
সেতার, সুরবাহার এবং পাখোয়াজে তালিম নেন। তিনি
অত্যন্ত সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠ
শুনে বিষ্ণুপুর ঘরানার আদি ধ্রুপদিয়া রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁকে
কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম দেওয়া শুরু করেন। ১৮৫৩
খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গুরু রামশঙ্কর ভট্টাচার্য
মৃত্যুবরণ করলে, তিনি কিছুদিন বিষ্ণুপুরেই
সঙ্গীত চর্চা করতে থাকেন। এরপর সঙ্গীতের
উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে
বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। শোনা
যায়, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এ সময় এক ধনীগৃহে
কিছুদিন পাচকের কাজ করেছেন। ওই বাড়িতেই সে
কালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ধ্রুপদিয়া গঙ্গানারায়ণ
চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হন। যদুভট্টের
কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে স্বগৃহে
(জোড়াসাঁকোর ৫৯ বলরাম দে স্ট্রিট) এনে তালিম
দেওয়া শুরু করেন। তিনি এই গুরু কাছে
খাণ্ডারবাণী রীতির ধ্রুপদ গান শেখেন। এই
বাড়িতেই তিনি প্রায় ষোলো বছর সঙ্গীত শিক্ষা
করেন।
তিনি বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত কুচিয়াকোল নিবাসী
রাজা রাধাবল্লভ সিংহের দরবারে সঙ্গীতগুরু
হিসেবে কাটান। এরপর তিন পঞ্চকোট (কাশীপুর)-এর
রাজা নীলমণি সিংহকে গান শোনাতে যান। রাজা তাঁর
গানে মুগ্ধ হয়ে, রাজদরবারে থেকে যাওয়ার অনুরোধ
করেন। রাজা তাঁকে ‘রঙ্গনাথ’ উপাধিতে ভূষিত
করেছিলেন। এই রাজদরবারে কিছুদিন থাকার পর,
তিনি গোবরডাঙ্গায় চলে আসেন।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি সঙ্গীতে তাঁর
নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এই সূত্রে তিনি
ত্রিপুরার রাজদরবারে মহারাজা বীরচন্দ্র
মাণিক্যের সভাগায়ক নিযুক্ত হন। এই সময়
বিখ্যাত রবাব বাদক কাসেম আলি খাঁ এই দরবারের
ছিলেন। এঁদের কাছ
থেকেই তিনি পরে যথাক্রমে ও ‘তানরাজ’
উপাধি লাভ করেছিলেন। এই সময় তিনি সেতার ও
সুরবাহারের পাশাপাশি মৃদঙ্গবাদনেও দক্ষতা
অর্জন করেন। এই কারণে তাঁর রচিত গানের ভনিতা
তানরাজ বা রঙ্গনাথ পাওয়া যায়। এই দুই
রাজা ছাড়াও বর্ধমানের রাজা মহতাব চন্দ তাঁকে
'সুরসেন' উপাধি দিয়েছিলেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, বঙ্কিমচন্দ্র
‘কয়েক বৎসর ধরিয়া যদুভট্টের নিকট গান
শিখিতেন। একটি হারমোনিয়াম কিনিয়াছিলেন।’
গোপালচন্দ্র রায় জানিয়েছেন, ‘যদুভট্টই প্রথম
বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্ সংগীতে সুর দিয়ে
তাঁকে শুনিয়েছিলেন।’
১২৮২ বঙ্গাব্দ (১৮৭৫-৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) যদুভট্ট 'আদি ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়'-এ তিনি কিছুদিন সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। সঙ্গেও। সাধারণী পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭-৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিকে তিনি চুঁচুড়ায় প্রতিষ্ঠিত একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়ে কিছুদিন পাঠদান করেন।
তিনি
কাঁঠাল পাড়া গ্রামে বিবাহ করেছিলেন। তাঁর একটি
কন্যা সন্তান ছিল।
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ চৈত্র ১২৮৯ [বুধবার ৪
এপ্রিল ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দ] তিনি
মৃত্যুবরণ করেন।