সুন্দর-অসুন্দর
সুন্দর শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো সু-Öউন্দ্ (আর্দ্র হওয়া) +অর্। সুন্দর শব্দের ব্যাখ্যা এই বিশ্লেষণের ভিতরেই পাওয়া যায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে অনুভূতি মনকে দ্রবীভূত বা আর্দ্র করে এবং একই সাথে আনন্দ দান করে তাই সুন্দর। মূলত স্বস্তি-অস্বস্তি'র সূত্রে মানুষের মনের দশার পরিবর্তন ঘটে। এর ভিতরে স্বস্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতির ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় সুখবোধ। সুখানুভূতি চলমান একটি প্রক্রিয়া। যতখন এটি ক্রিয়াশীল থাকে ততক্ষণ মানুষের মন এর দ্বারা আবেশিত দশায় থাকে এবং মনের ভিতর তা ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়া সুখবোধই হলো আনন্দ। আর বহুবিধ আনন্দের সুসমন্বিত বোধই হলো সৌন্দর্য। বলাই বাহুল্য, একটি কার্যক্রম যখন এককভাবে কোনো আনন্দ তৈরি করে, তখন তা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে না। সমন্বিত বহুবিধ আনন্দের ভিতর দিয়ে মানুষের মনে যে আনন্দময় প্রবাহের সৃষ্টি হয়, তার সমন্বিত আনন্দময় অনুভূতিকে বলা হয় সুন্দর। তাই একথাও বলা যায়, যে সকল আনন্দ মনকে দ্রবীভূত বা আর্দ্র করে তা থেকে উদ্ভুত মিশ্র আনন্দই সুন্দর।
যে কোনো সত্তার প্রকাশিত বা বাহ্যিক রূপ দিয়ে সুন্দরের বিচার করা হয়। বিষয়টি মূর্ত বা বিমূর্ত সকল সত্তার জন্যই প্রযোজ্য। একটি ফুলকে সুন্দর বলা হয় এর বাহ্যিকগুণকে বিচার করে। আবার যখন বলা হয় একটি 'সুন্দর মন'। তখন ওই মনের যে অংশটুকু প্রকাশ পায়, তার বিচারে সুন্দর বলা হয়। যে শত্রু আপনার জীবনকে অসুন্দর করে ফেলতে পারে, তার কপট আচরণে আপনি মুগ্ধ হয়ে 'সুন্দর মনের মানুষ' বলতেই পারেন। যে মুহুর্তে তার কুটিল রূপটি আপনার কাছে প্রকাশ পাবে, তখন তাকে আর আপনি 'সুন্দর মনের মানুষ' বলবেন না। 'চক্ চক্ করলেই সোনা হয় না' এই বিচার করা হয় সোনার সার্বিক গুণমানের বিচারে। নকল সোনার সৌন্দর্য আর আসল সোনার সৌন্দর্য যদি একই হয়, তাহলে বাহ্যিক রূপের বিচারে উভয় সুন্দর। ধাতবগুণের বিচারে তা এক না হলেও বাহ্যিক গুণের উভয়ই সুন্দর।
কিন্তু কেন সুন্দর?
সবাই সুন্দর বলে বলেই কি সুন্দর? নাকি আমি সুন্দর বলি বলে সুন্দর? মূলত সুন্দর-অসুন্দর
নির্ধারণের মালিক 'আমি'। 'আমি' যাকে সুন্দর বলবো, তাই সুন্দর। জগৎ সংসারে যত 'আমি'
আছে বা ছিল বা থাকবে, তাদের সবাই যাকে সুন্দর বলবে, সেটা হবে পরম সুন্দর। এর বাইরে
কোনো 'আমি' বা কিছু 'আমি' যাকে সুন্দর বলে তা খণ্ডিত সুন্দর।
অনুভব ও
চেতনা, সত্য, রুচি ইত্যাদি নিয়ে সৌন্দর্যের জগৎ তৈরি হয়, তার ভিতরেই আমাদের বাস। সে
জগতে কখনো 'আমি' স্রষ্টা, কখনো ভোক্তা। এরই ভিতরে রয়েছে 'আমি'র সৌন্দর্যবোধ। বহুবিধ
আনন্দের সংমিশ্রণে যে সৌন্দর্যের সৃষ্টি, তা গ্রহণ করার চেতনাগত বোধই হলো
সৌন্দর্যবোধ। অন্যভাবে বলা যায় সুন্দর করে জীবনকে উপভোগ করার বোধই হলো সৌন্দর্যবোধ।
প্রকৃতির কোনো উপাদানই সুন্দর নয়। সুন্দর বলে 'আমি' যাকে গ্রহণ করে তাই সুন্দর।
প্রতিটি মানুষের ভিতরে আনন্দ পাওয়ার যে সহজাত ক্ষমতা আছে, তার ভিতরেই রয়েছে
সৌন্দর্যবোধের প্রাণভোমরা। তাই আনন্দের এবং আনন্দসমূহের সংমিশ্রণে সৃষ্ট সৌন্দর্যের
সবকিছুই সৌন্দর্যবোধের ভিত্তি গড়ে দেয়। এর কিছু সহজাত, বাকিটা অর্জিত বা চর্চিত।
মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও তার
ক্রমবিকাশ
১. আদি সৌন্দর্যবোধ:
মাতৃগর্ভে মানব শিশুর পার্থিব সৌন্দর্যবোধের ভাণ্ডার থাকে একেবারে শূন্যদশায়। এই দশায় যতটুকু আনন্দটুকু থাকে, তা তার মাতৃজঠর ঘিরে। ভূমিষ্ট হওয়ার পর, মানবশিশু তার ইন্দ্রিয় দ্বারা নানারকম তথ্য দিয়ে উপলব্ধি লাভ করতে থাকে। ভূমিষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া মানবশিশুর দেহ সঙ্কুচিত হয়, এর ফলে তার সারা দেহে তীব্র অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়। একই সাথে মাতৃগর্ভের আরামদায়ক উষ্ণতা থেকে প্রাকৃতিক উষ্ণতায় পৌঁছায় বলে, অন্য একটি অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে তার কান্না করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। জন্মের পর মানব শিশুর কান্নাটাই তার সুস্থ শরীরে জন্মলাভের শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জন্মের পর যে শিশু কাঁদে না, তাকে কাঁদিয়ে স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া চালানো হয়। একটি শিশুর জন্মটা মায়ের কাছে যেমন আনন্দের, তেমনি জন্মের পর শিশুর কান্নাটা আরও বেশি আনন্দদায়ক। শিশুর জন্মমুহূর্তের এই স্মৃতি স্মৃতিভাণ্ডারে হয়তো থাকে, কিন্তু তা আর পরবর্তী সময় সে জাগ্রত করতে পারে না। শুধু সেই মুহূর্ত নয়, অনেকটা বড় হয়ে উঠা পর্যন্ত যত অভিজ্ঞতা লাভ করে, তার বেশিরভাগ অংশ শিশু স্মৃতিভাণ্ডার থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে না।২. পর্যায়ক্রমিক সৌন্দর্যবোধ:
জন্মের পর, একসময় শিশু তার কান্না থামায়। পরমযত্নে পরিচর্যার ভিতর দিয়ে শিশুকে আস্বস্ত করা হয়, সে নিরাপদ। এই স্বস্তিবোধের ভিতর দিয়ে সে নিজেকে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মূলত মানুষের এই প্রচেষ্টা সারাজীবন ধরেই চলে। এই প্রচেষ্টার ভিতরে সৌন্দর্যবোধের যতগুলো অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়, তারই আলোকে মানুষের ভিতরে নতুন সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটে। আর সকল সৌন্দর্যবোধের সমন্বয়ে আবার নতুন সৌন্দর্যবোধের জন্ম নেয়। দেখা যায়, শিশু সুমিষ্ট ধ্বনি শুনলে সে স্বস্তি বোধ করে। এই স্বস্তিবোধের বিষয়টি সে প্রাকৃতিকভাবে সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবেই পায়। কর্কশ ধ্বনি বা তীব্রতর ধ্বনিতে সে চমকে উঠে, ভয় পায়। তাই শিশুর সাথে বলতে হয় কোমল স্বরে। তাতে শিশু স্বস্তিবোধ করে।
মায়ের সুর করে কথা বলা বা গান গাওয়ার ভিতর দিয়ে তার সুরের প্রতি আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। শিশু ক্রমে ক্রমে সুরের ব্যাপারটার সাথে অভ্যস্থ হয়ে উঠে। শিশু যদি সাঙ্গীতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠে, তার ভিতরে সুরের আনন্দলাভের বিষয়টা অনেকটা প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা অর্জনের মতো হয়ে উঠে। একালের শহুরে শিশুদের কাছে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের গান এতটাই প্রিয় যে, শিশুর খাওয়ানোর সময় অনেকেই টেলিভশনের বিজ্ঞাপন চালু করে রাখেন। এই সময় শিশুর স্বরজ্ঞান হয় না, কিন্তু সুরজ্ঞান হয়।
সাধারণভাবে আমরা যাকে সৌন্দর্য বলি, তার সাথে মস্তিষ্কের যান্ত্রিক ফলাফল এবং 'আমি' নামক সত্তার একটি নিবিড় যোগ রয়েছে। নন্দনতত্ত্বে মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় ব্যক্তি বিশেষের মানসিক প্রশান্তির উপর। বলাই বাহুল্য, মানুষের মস্তিষ্ক এবং মন দুইই বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং একই সূত্রে মানুষের সৌন্দর্যবোধও বিবর্তনের ফল। এর ভিতরে দৈবত্ব যদি কিছু থাকে, তা হলো পুরো মানুষ সৃষ্টির কার্যক্রম। মানুষ নিসর্গের, মানুষের কল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গ, আর সেই সূত্রেই সৌন্দর্যবোধ স্বর্গীয়। মানুষ সৌন্দর্য দ্বারা আবেগাপ্লুত হয় তার সহজাত সৌন্দর্যবোধ থেকে, সেখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে না। আবার এই মানুষই যা অনুভব করে, তার গুপ্তরহস্য জানার চেষ্টা করে, ফলে এক সময় না এক সময় সে আবেগের মোহ থেকে বেড়িয়ে এসে সৌন্দর্যের কাটাছেঁড়া করে। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সৌন্দর্যের মৃত্যু ঘটে কিন্তু সৌন্দর্যবোধ ও তার সৃষ্টির পথ খুলে যায়। এসকল ক্ষেত্রে সৌন্দর্য− সৌন্দর্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। প্রকৃতির ক্ষমতা যাই থাক, মূল কথা মানুষের ওই সৌন্দর্য গ্রহণের ক্ষমতা আছে বা অর্জিত হয়েছে। সেই ক্ষমতার গুণে মানুষ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য পছন্দ করে। এই ক্ষমতায় নিজ দেশে যা নাই, তাকেও ভালো লাগে। নায়েগ্রার প্রবল জলপ্রপাত, কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্ণালী রূপ, আফ্রিকার খোলা প্রান্তর, বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ সব কিছুর ভিতরই মানুষ সৌন্দর্য খুঁজে পায়। শুধু তাই নয়, ওই সব বিষয় যখন কোনো শিল্পী সুচারুরূপে ফুটিয়ে তোলেন, তাও ভালো লাগে। প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপের সাথে শিল্পী যখন সুসমন্বয়ে বাড়তি কিছু যুক্ত করেন তখনও অন্যভাবে দেখার আনন্দ দর্শক পান। চিত্রের এই চর্চার বিকাশ ঘটেছে সৌন্দর্য চর্চার বিবর্তনের ধারায়। শাওভে (Chauvet) গুহাগুলি প্রায় বত্রিশ হাজার বছর পুরানো। একই সময়ের তৈরি কিছু নারীমূর্তি ও পশুপাখির আকৃতি পাওয়া গেছে গুহাগুলোতে। আমরা বিভিন্ন দোকানে বা মেলাতে ঝিনুক বা শামুকের অলঙ্কার দেখতে পাই। উল্লেখ করতেই হয় ভারত প্রজাতন্ত্রের মহারাষ্ট্র নামক প্রদেশের আওরঙ্গবাদ জেলায় অবস্থিত ইলোরার গুহামুর্তি এবং মন্দিরের অলঙ্করণের কথা।
আনন্দ ও সৌন্দর্যের
দ্বন্দ্ব:
আনন্দসমূহের
সামঞ্জসের
মধ্য দিয়ে যে মিশ্র আনন্দের জন্ম দেয়, তার উপলব্ধিই সুন্দর। কিন্তু সকল আনন্দই কি
সুন্দর, কিম্বা সকল সুন্দরই কি আনন্দময়? এই দ্বন্দ্ব অনেক সময়ই আমাদের সরল ভাবনাকে
স্থবির করে দেয়। যে মানুষটির কাছে মানুষ হত্যার ভিতর আশৈশব একটি অসুন্দর বিষয়
হিসেবে থাকে, সেই মানুষটিই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শত্রু হত্যার কথা শুনে বা দেখে
আনন্দ লাভ করে। এখানে বিষয়টা আত্মকল্যাণের সাথে জড়িত। এই কল্যাণ কামনা থেকে জন্ম
নেয় ইতিবাচক প্রাপ্তি এবং আত্মতৃপ্তির উপলব্ধি। সেটাই আনন্দ। আবার রাতের অন্ধকারে
অগ্ন্যুৎপাতের ফুলঝুরি দেখে যে, সৌন্দর্য উপভোগের আনন্দ পায়, ঘটনাক্রমে বিষয়টি যদি
তার মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি করে, তা হলে, বিষয়টা তার কাছে আনন্দের থাকবে না। মানুষ
সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে ততক্ষণই আনন্দ পায়, যতক্ষণ তার ভিতরে তার নিজের জন্য
কল্যাণকরী অনুভব থাকে। তাই হিংস্র বাঘের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে মানুষ সৌন্দর্যের মহিমার
সন্ধান করে না। এক্ষেত্রে পালিয়ে বাঁচার ভিতরেই রয়েছে, বেঁচে থাকার আনন্দ। তাই
বাঘের সৌন্দর্য মানুষ অনুভব করে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। এই জাতীয় ভয়ঙ্কর বিষয় দেখে
মুগ্ধ হওয়ার জন্য টেলিভিশনের তথ্যচিত্রই উপযুক্ত।
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে নিজেকে। প্রাথমিকভাবে তাঁর আনন্দ হলো বেঁচে থাকার জন্য। বিপন্ন মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের ভিতরে আনন্দ লাভের কোনো অবকাশ নেই, বরং কষ্ট থাকে। জলোচ্ছ্বাসে ভাসমান মানুষ বাঁচার সংগ্রাম করে, এর ভিতরে তার অন্য কিছু ভাববার সময় থাকে না। যদি সে বেঁচে উঠতে পারে, তাহলেই সে বেঁচের থাকার আনন্দটুকু পায়। এর ভিতরে সৌন্দর্যের বিষয়টা তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয় না। আবার একজন খেলোয়ার যতক্ষণ দলকে জেতানোর জন্য সংগ্রাম করে, ততক্ষণ আনন্দটা উপভোগ করাটা হয় না। আনন্দের উপলব্ধি আসে পরে। যদি খেলার মাঝখানে জয়ের ধারায় থাকে, তাহলে একটি আশঙ্কা মিশ্রিত আংশিক আনন্দ পেতে থাকে। ফুটবলে এক গোলে জয়ী থেকে খেলার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা এই আনন্দ অনুভব করেন বেশি। শেষ পর্যন্ত খেলাতে জয়ী হলে, তাতে খেলা চলাকালীন অনেক ব্যর্থতার ভিতরেও সে আনন্দ পায়। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল অনুকুলে না এলে, হয়তো ভালো খেলার আত্মতৃপ্তি কিছুটা থাকে, কিন্তু সে আনন্দ সে উপভোগ করতে পারে না। খেলা যিনি দেখেন তাৎক্ষণিক ভাবে তিনি সৌন্দর্যটা উপলব্ধি করেন। কারণ দর্শক খেলার পুরো চিত্রটা যেভাবে দেখেন অংশগ্রহণকারী খেলোয়ারদের সবাই তা দেখতে পান না। খেলোয়াড়ের কাছে খেলার আনন্দ বা নিরানন্দ থাকে, দর্শকের কাছে থাকে সৌন্দর্য। নিজের দল হেরে গেলে দর্শক আনন্দ পান না, কিন্তু সৌন্দর্যটা দেখতে পান। সেটা নিজের দলের খেলা দেখেও, প্রতিপক্ষের খেলা দেখেও।
কল্যাণ হলো 'আমি' যাকে শুভ মনে করে। কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা 'আমি' দেহগত বা মনোগত হতে পারে এবং নানা 'আমি'র কাছে একই বিষয় কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হতে পারে। বিষয়টি হতে পারে, একক, দলগত বা রাষ্ট্রীয়। এর সাথে সৌন্দর্য থাকতেও পারে, নাও পারে। সৌন্দর্য 'আমি'র কাছে যতটা কাঙ্ক্ষিত, তার চেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত হলো কল্যাণ। এর ভিতর দিয়ে সে আনন্দ পায়। সৌন্দর্য সৃষ্টির সময় শিল্পীকে কল্যাণকর বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। রাতের অন্ধকারে আলোর শিখা মুগ্ধ করে বটে, কিন্তু সে মুগ্ধতার জন্য অন্যের ঘরে আগুন লাগিয়ে সে তার ছবি আঁকবে, এই সৌন্দর্য উপলব্ধির প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। কোনো শিল্পকর্ম যদি মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে, অকল্যাণের পথে চালিত করে, তা হলে সত্য বা সৌন্দর্যের কারণেই তাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিৎ নয়। কল্যাণবোধ মানুষের সৌন্দর্যভাবনাকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। তাই শুধু কল্যাণ-অকল্যাণ, পছন্দ-অপছন্দের বিচারে সুন্দর বিষয়কেও পরিত্যাগ করা হয়। বিষয়টি মানুষের সার্বিক জীবনবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিষয়টি মনের ইউ, ইগো ও সুপার ইগো-র উপলব্ধির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে অল্পস্বল্প অকল্যাণকে প্রশ্রয় দিয়েও কোনো সৌন্দর্যকে কামনা করি। আবার কখনো কখনো তাকে পুরোপুরি বর্জন করি। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে অনেক সময় এই বর্জনটা ঘৃণাস্তরের হয়। অনেক ছেলেমেয়ের কাছেই প্রথম জীবনের প্রেমিক-প্রেমিকা ঘটনাক্রমে ঘৃণ্য হয় যায়। সেখানে সৌন্দর্যবোধ ওই ঘৃণাবোধকে অতিক্রম করতে পারে না।
সৌন্দর্যের প্রকৃতি
প্রতিটি আমি'র
কাছে যত ধরনের সৌন্দর্য
ধরা দেয়, তার প্রতিটির বিশেষ ধরণ রয়েছে। সাধারণভাবে সৌন্দর্যের প্রকৃতিকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগ তিনটি হলো−
১. স্বাভাবিক সৌন্দর্য: মানুষ জন্মগতভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। এই ক্ষমতার সূত্রে মানুষের মনে স্বাভাবিক বা সহজাত সৌন্দর্যবোধ সক্রিয় থাকে। এই বোধের কারণেই প্রতিটি মানুষের ভিতরে স্বতন্ত্র সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটে। এই বোধের ভিতরে মানুষ খুঁজে পায় নিজের ভালোলাগার বিষয়। এর সাথে যুক্ত থাকে মৌলিক এবং সহায়ক চাহিদা পূরণের আনন্দ। খাদ্যগ্রহণ, সুখপ্রদ তাপমাত্রার অনুভব, ঘুমানো, আশা-পূরণের স্বপ্ন, যৌনাচার ইত্যাদির ভিতরে মানুষ ব্যক্তিগত এবং স্বাভাবিক সৌন্দর্য খুঁজে পায়। সহজাত প্রবৃত্তি থেকে মা, শিশুর ভিতরে যে সৌন্দর্য খুঁজে পান, অন্য মা আবার তা দেখে তাঁর সহজাত সৌন্দর্যবোধের দ্বারা উপভোগ করতে পারেন।
মানুষের সহাজত সৌন্দর্যবোধের বিষয়টি উপলব্ধি করার ক্ষমতা মস্তিষ্কের না থাকলে, মানুষ কোনো সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারত না। জীব হিসেবে মানুষ প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য শরীরের ক্ষয়পূরণ, রোগ-প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। টিকে থাকার সংগ্রামের সফলতায় যে সুখবোধের জন্ম হয়, সেটাও সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে মানুষ ধারণ করে। আর বহুবিধ আনন্দের মধ্য দিয়ে মানুষ সুন্দরের সন্ধান পায়, সে ক্ষমতাও সে ধারণ করে। এই ক্ষমতাই মানুষকে দিয়েছে স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধের ক্ষমতা। খাদ্য সংগ্রহের আনন্দ পেরিয়ে এসে মানুষ যখন প্রকৃতির ভিতরে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে, তখন সে চায় একটি নিরাপদ বাসস্থান, চায় তার চারপাশের অনুকুল পরিবেশ। নদীর ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকে একটি চমৎকার প্রাসাদে বাস করার ভিতরে কেউই বোধ করি আনন্দ খুঁজে পাবে না। সকল ধরনের নিরাপত্তার ভিতরে মানুষের মনের ভিতরে আনন্দের সুবাতাস বয়, আর এসবের সমন্বয়ে জন্ম নেয় সহজাত সৌন্দর্যবোধ।
মানুষ প্রকৃতির ভিতরে যে সৌন্দর্য খুঁজে পায়, তার ভিতরে আছে তার সহজাত স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধ। এই সূত্রে পাহাড়, সাগর, বাঘ, সিংহ এদের সৌন্দর্য স্বাভাবিকভাবে বলতে বাধে না। কিন্তু মানুষের বোধবুদ্ধির ক্রমবিকাশের সূত্রে যে সৌন্দর্যবোধ জন্মেছে, তার কোনটি স্বাভাবিক আর কোনটি আরোপিত, তা নিরূপণে অনেক সময় ভাবতে হয়। যে কোনো বয়সের মানুষের নগ্নরূপ হলো স্বাভাবিক। যে কোনো আবরণ তার স্বাভাবিক রূপকে আড়াল করে। বহুদিনের চর্চিত সংস্কারে বর্তমানে নগ্নতাই অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। মানুষ পোশাক পড়ে, চুল কাটে বা বাঁধে, দাড়ি কামায় ইত্যাদি কৃত্রিমতা। মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্যবোধ চর্চিত সংস্কৃতির আড়ালে অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে।
কিছু স্বাভাবিক আনন্দ মানুষ উপভোগ করে না এমন নয়। জীবনযাত্রায় এর অবস্থান মৌলিক। সবার মূলে রয়েছে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক আনন্দ। এই আনন্দের মধ্য দিয়ে মানুষ খুঁজে পায় জীবনে আদি-সৌন্দর্য। এর সাথে রয়েছে অন্যান্য মৌলিক এবং সহায়ক চাহিদা পূরণের আনন্দ। খাদ্যগ্রহণ, সুখপ্রদ তাপমাত্রার অনুভব, ঘুমানো, আশা-পূরণের স্বপ্ন, যৌনাচার ইত্যাদির ভিতরে মানুষ স্বাভাবিক আনন্দ পায়। সঙ্গীতশিল্পী যখন বলেন. 'মধুর আমার মায়ের হাসি' তখন সে স্বাভাবিক সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করেন। সাগরের দিকে তাকিয়ে কেউ যখন মুগ্ধ হন, তখনও সে তা পায় স্বাভাবিক সৌন্দর্যের কল্যাণেই ।
২. সাধারণ সৌন্দর্য: সাধারণ সৌন্দর্য জীবনঘনিষ্ট। সাধারণ সৌন্দর্যবোধ থেকেই এই সৌন্দর্য গ্রহণের আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। মনুষ্য সমাজের সকলের চর্চিত এবং সমাজ দ্বারা স্বীকৃত জীবনযাত্রার সূত্রে এই সৌন্দর্যবোধ বিকশিত হয়। এটি মূলত সমাজের সকলের সৌন্দর্যবোধের একটি গড় মান। এই গড়মানে স্বাভাবিক সৌন্দর্যের কিছু কিছু বিষয় সামাজিক উপাদানে পরিণত হয়েছে এবং সাধারণবোধের সূত্রের আবার তৈরি হয়েছে সামাজিক মূলবোধ। এই মূল্যবোধের বিচারে আবার সাধারণ সৌন্দর্যবোধ প্রভাবিত হয়। ফলে মানুষের ব্যক্তিগত বোধ অনেক সময়ই সাধারণ সৌন্দর্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধে কেউ জোরে মাইক বাজিয়ে গান শুনতে পারে। কিন্তু সমাজের অন্যাদের কাছে তা কুৎসিত মনে হতে পারে। তাই ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করবে সাধারণ সৌন্দর্যবোধ দ্বারা। অনেক সময় মানুষ ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে, সাধারণ সৌন্দর্যকে প্রশ্রয় দেয়। সাধারণ সৌন্দর্যবোধই একটি সমাজ বা জাতির সৌন্দর্যের ঐতিহ্য গড়ে তোলে। এই বোধেই একটি জাতি তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে।
সাধারণ মানুষের দ্বারা চর্চিত এবং সমাজ দ্বারা স্বীকৃত জীবনযাত্রার সূত্রে এই সৌন্দর্য স্বীকৃতি লাভ করে। কারণ এর বিকাশ ঘটে মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধের উপর ভিত্তি করে। মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় স্বাভাবিক সৌন্দর্যের কিছু কিছু বিষয় সামাজিক উপাদানে পরিণত হয়েছে। এ সকল উপাদানের প্রতি একাত্মতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী সমাজবদ্ধ জীবে পরিণত হয়েছে। আর এই সূত্রেই তৈরি হয়েছে সামাজিক মূলবোধ। এই মূল্যবোধের বিচারে যে সকল সৌন্দর্য সমাজের সবার কাছে আদরণীয়, তাই হলো সাধারণ সৌন্দর্য। প্রতিদিনের খাদ্যগ্রহণের মধ্যে ভালোলাগা, কারো সুন্দর হাসি, মুখশ্রী, পোশাক, একটু বাক্যালাপ ইত্যাদি ব্যক্তি বিশেষের কাছে সাধারণ সৌন্দর্য, কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিচারে এর সবগুলো আবার নৈর্বাচনিক হয়ে যায়। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাধারণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভিতরে তা অনেক ক্ষেত্রে গড়মানে পরিণত হয়।
সাধারণ সৌন্দর্য অনেক সময় স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে অবদমিত করে। যেমন মানুষের নগ্নতায় রয়েছে স্বাভাবিক সৌন্দর্য। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে স্বভাবিক সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে গেছে সমাজের পোশাক পড়ার সাধারণ সৌন্দর্যের আড়ালে। এখনো কোনো কোনো মানবগোষ্ঠীতে পোশাক পড়ার চল নেই, সেখানে নগ্নতা সমাজের সৌন্দর্যকে নষ্ট করে না। এ ক্ষেত্রে সে সকল সমাজে স্বাভাবিক সৌন্দর্য আর সাধারণ সৌন্দর্য একীভূত হয়ে বিরাজ করে।
মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে অসংখ্য সুন্দর বিষয় উপভোগ করে। কিন্তু সকল সৌন্দর্য সবাই গ্রহণ করতে পারে না। কোনো বিশেষে ভালো-লাগা বা আনন্দের অনুভব ক্রমে ক্রমে মানুষের সহজাত অনুভূতির অংশ হয়ে যায়। এই সহজাত অনুভূতি স্থান-কাল-পাত্রের বিচারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে। রূপ-রস-গন্ধ-শ্রবণ-স্পর্শ-আস্বাদনের প্রাথমিক স্তরে এর উৎপত্তি ঘটে। এর যে কোনটির দ্বারা যখন কোনো 'আমি' তীব্র আনন্দ লাভ করে এবং মোহিত হয়, তখনই সে সৌন্দর্য লাভের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। একটি ফুলের সুগন্ধে কেউ যখন আকৃষ্ট হয়ে আনন্দ লাভ করে, তখন সুগন্ধের ঢেউ ঘ্রাণেন্দিয়ে আনন্দের প্রবাহ সৃষ্টি করে। এর ভিতর দিয়ে প্রাপ্তি ঘটে আনন্দের বিচিত্র অনুভূতি। আর এই প্রক্রিয়ার ভিতরে প্রাপ্তি ঘটে সৌন্দর্যের অনুভব। অজস্র আনন্দ বা বেদনার মধ্য দিয়ে যে রূপ ফুটে উঠে, তার ভিতরে সৌন্দর্যের স্থান আনন্দের দিকে। এই অনুভব উপলব্ধি করে 'আমি'। এই অনুভবের ভিতর দিয়ে আনন্দলাভের বোধই হলো 'আমি'র সৌন্দর্যবোধ। সৌন্দর্যবোধ শুধুই সৌন্দর্যকে অনুভব করার বিষয় নয়, অসুন্দরকেও অনুভব করার বিষয়। যদি কোনো গানকে কোনো 'আমি' অসুন্দর বলে, তাহলে সে 'আমি' তার সৌন্দর্যবোধ থেকেই বলে। এই সৌন্দর্যগুলোতে মানুষ অভ্যস্থ হয়েও এগুলোর প্রত্যশা করে এবং প্রাপ্তির ভিতর দিয়ে আনন্দলাভ করে।
সারাদিনের সাধারণ জীবনযাত্রার ভিতরে কিছু কিছু সৌন্দর্য কিছুক্ষণ মনে থাকে। কিছু কিছু সৌন্দর্য অনেকদিন আনন্দ দান করে যায়। সামান্য কিছু সৌন্দর্য আজীবন মনে থাকে। প্রাত্যহিক জীবনের সুন্দর-অসুন্দরের দোলায় যে ছন্দ উঠে, সেটাই মানুষের জীবনে চিরন্তন সৌন্দর্য। দীর্ঘদিনের জীবনযাত্রায় এই সৌন্দর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র, মনোলোভা সুগন্ধী, লোভনীয় খাবার এসব মানুষকে সাময়িকভাবে আপ্লুত করে। কিন্তু মানুষ ফিরে আসে সাধারণ সৌন্দর্যের কাছে। এটি তার ঘর। যেমনটা আমরা পাহাড় সাগর দেখতে ছুটে যাই দূর দেশে। এক সময় হাঁপিয়েও উঠি। তখন ঘরে ফেরার জন্য মন উৎসুক হয়ে উঠে। আমরা ফিরে আসি আমাদের আটপৌরে সাধারণ স্বাভাবিক সৌন্দর্যের আঙিনায়।
৩. সৃজনশীল সৌন্দর্য: এটি মানুষের সৃষ্ট সৌন্দর্য। এর অবস্থান মানুষের মনোজগতের দ্বিতীয় স্তরে। প্রাত্যহিক জীবনে মানুষ যে সাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করে, অনেক সময় সেগুলোকে সে নিজের মতো করে তৈরি করার চেষ্টা করে। এর ভিতর দিয়ে মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। এই সূত্রে সৃষ্ট সৌন্দর্যকে বলা হয় শিল্পকর্ম। শিল্পীর থাকে নিজের রুচিবোধ, সৌন্দর্যের অতৃপ্ততা, থাকে তার নিজের কল্পনার জগৎ। এসবের সংমিশ্রণে সে সৌন্দর্য তৈরিতে উদ্যোগী হয়। এই প্রচেষ্টার দ্বারাই সে শিল্পী হয়ে উঠার সাধনা করে। প্রকৃতিতে প্রতিনয়ত সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতি শিল্পবোধ থেকে তা করে না। তাই সৃজনশীল সৌন্দর্যের আঙিনায় প্রকৃতির স্থান নেই। প্রকৃতি শিল্পীকে উপাদানের যোগানদার মাত্র, শিল্পযজ্ঞে তার স্থান শূদ্রের মতো।
একই সঙ্গীত কারো ভালো লাগে, কারো লাগে না। তার অর্থ ওই সঙ্গীতের সৌন্দর্য হিসেবে কেউ গ্রহণ করতে পারছেন, কেউ পারছেন না। সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা, তার অনুভূতির তীব্রতা যে আনন্দ দান করে, তা মানুষের বিকশিত মননের অংশ। এই বিচারে বলা যায়, সৌন্দর্যবোধ হলো মানুষের মনের অভিযোজিত রূপ। এই রূপটি বিকশিত হয় অনুশীলনের ভিতর দিয়ে। সৌন্দর্যবোধ দান করা যায় না, যদি না সে ওই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। ব্যাপারটা উল্টোও হয়। যে বিষয় আগে ভালো লাগতো না, ওই বিষয়ের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে এক ধরনের ভালো লাগা বোধ জন্মে। এই ভালোলাগা বোধ থেকে আনন্দ পেতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ওই বিষয়ে তাঁর সৌন্দর্যবোধ জন্মে।
শিল্পকলার সৌন্দর্যের অধিকাংশই বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চমানের সঙ্গীত, সাহিত্য, চিত্র ইত্যাদির সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলে, ওই বিষয়ের ভালোলাগার বিষয়গুলোকে আয়ত্ত করতে হয়। এই কারণেই কোনো বিষয় সুন্দর কি অসুন্দর হবে, তা নির্ভর করবে ব্যক্তির বিশেষের সৌন্দর্যবোধের উপর। কোনো ব্যক্তি বিশেষ একটি রাগসঙ্গীত শোনার পর, বিবমিষা ভাব নিয়ে উঠে যেতে পারেন। আবার অন্য একজন ওই রাগটি দ্বিতীয়বার শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতে পারেন।
সৃজনশীল সৌন্দর্যে মাত্রা
ব্যঞ্জনা: সৌন্দর্যের রূপ দেখা-না-দেখায় মেশা। দেখা অংশ আমাদেরকে আনন্দ দেয় প্রত্যক্ষভাবে, না-দেখা অংশ আমাদের আকর্ষণ করে মন্ত্রশক্তি-বলে। এই দুয়ের মিলনে সৌন্দর্যের যে সামগ্রিক রূপ ফুটে ওঠে সেটাই ব্যঞ্জনা। শিল্পকর্মে ব্যঞ্জনা রসগ্রাহীকে কৌতুহলী করে তোলে। বহুল আলোচিত দ্যাভিঞ্চির মোনালিসা ছবিটিকে ব্যঞ্জনার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতীয় রাগসঙ্গীত মূলত ব্যঞ্জনাধর্মী। ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে রহস্যময়তর সৃষ্টি হয়, তাই ব্যঞ্জনাধর্মী শিল্পকর্ম চিরায়ত রূপ পায়। এই রহস্যময়তাই চিরায়ত শিল্পের কাছে মানুষকে টেনে আনে। প্রদর্শনযোগ্য শিল্পকের্মের ভিতরে যে ব্যঞ্জনা, তার আভাষ থাকতে পারে ব্যক্তি আচরণেও। অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের অঙ্গভঙ্গী কিম্বা কথোপকথনেও ব্যঞ্জনার সৌরভ পাওয়া যায়।উগ্রতা ও লাবণ্য: লাবণ্য হলো সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ রূপ। এটি প্রকৃতিতেও পাওয়া যায়। স্নিগ্ধ রূপটি মানুষের মনকে সৌন্দর্যের মধুর রসের সিক্ত করে এবং মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এর বিপরীতে উগ্রতা মনকে বাষ্পীভূত করে এবং মনকে অশান্ত করে দেয়। শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপে রয়েছে এই লাবণ্য। উগ্রতায় অনুভবকে ধাঁধিয়ে দেয়, লাবণ্যে মনকে মোহিত করে। জাঁকজমক নেই বলে, লাবণ্যের রয়েছে নিজস্ব আলো, উগ্রতায় আছে ঔজ্জ্বল্য। মধ্যাহ্নের সূর্যের আলোয় রয়েছে উগ্রতা, ভোরের আলোতে রয়েছে লাবণ্য। রূপের ভিতরে রূপের যে আভাটি পাওয়া যায়, তাতে লাবণ্য যেমন আছে, তেমনি ব্যঞ্জনাও থাকে। শিল্পকর্মে লাবণ্য এবং উগ্রতা উভয়ই স্বাভাবিক নয়, উভয়কেই আনতে হয়। এর ভিতরে লাবণ্যকে তোয়াজ করে আনতে হয়। অনেক সঙ্গীতশিল্পী দাপটে গান করেন। সে দাপটে উগ্র-সৌন্দর্য কণা কণা করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যেটুকু মনের কোণে স্নিগ্ধ নীড় তৈরি করে, সেটু্কই লাবণ্য, বাকিটুকু উগ্রতা। গ্রীষ্মের দাবদাহে গাছপালা রুক্ষ হয়ে যায়, শ্রাবণের ধারায় প্রকৃতি লাবণ্য খুঁজে পায়। শব্দের সাথে শব্দ মিলিয়ে যে ছন্দবদ্ধ কবিতা হয়, তাতে গদ্যের কর্কশতা থাকে না, থাকে শব্দের ও ভাবের লাবণ্য।
মুগ্ধতা: প্রাকৃতিক বা সৃজনশীল সৌন্দর্যবোধের একটি অন্যতম উপাদান হলো মুগ্ধতা। যে সৌন্দর্য মানুষের মনকে মোহিত করে, তার ভিতর দিয়ে মনজগতে যে আবেশিত দশার সৃষ্টি হয়, তাই হলো মুগ্ধতা। মূলত আনন্দের সুসমন্বয়তা, ব্যঞ্জনা ও লাবণ্যের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় মুগ্ধতা। সৌন্দর্যের এই রূপটি চিরন্তন নয়। প্রথমত সকল মানুষের কাছে সকল সৌন্দর্য মুগ্ধতার সৃষ্টি করে না। দ্বিতীয়ত মুগ্ধতা সকল সময় একই রকম থাকে না। 'আমি'র ভিতরে সৌন্দর্যবোধের ক্রমবিবর্তনের ধারায়, মুগ্ধতার পরিবর্তন ঘটে। বার বার ঘুরে ফিরে দেখার মধ্যে মুগ্ধতা থাকে। মুগ্ধ হতে গেলে সৌন্দর্যের যেমন স্নিগ্ধ রূপ থাকতে হয়, তেমনি 'আমি'র তা গ্রহণ করার ক্ষমতাও থাকতে হয়।
সৃজনশীল সৌন্দর্যের মুগ্ধতা 'মাধ্যম' ভেদে নানা রূপে উপস্থাপিত হয়। কবিতা, গল্প, চিত্রকর্ম, সঙ্গীতকে যদি পৃথক পৃথক মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করি, তা হলে দেখা যাবে মুগ্ধতা সৃষ্টির প্রকৃতি সকল মাধ্যমে এক নয়। মুগ্ধতা সৃষ্টির কিছু কিছু উপকরণ একাধিক মাধ্যমে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু সার্বিক মুগ্ধতার বিচারে প্রতিটি মাধ্যম কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। ফলে একই বিষয় দুটি মাধ্যমে উপস্থাপিত হলে, মুগ্ধতা সৃষ্টির উপকরণ এবং উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য ভিন্নরকম হয়। যেমন একটি লিখিত গল্প যে মুগ্ধতা তৈরি করে ভাষার মাধ্যম, ওই গল্পট চলচ্চিত্রে ভিন্নতর মুগ্ধতা তৈরি করবে সচল চিত্রের মাধ্যমে।
মাধ্যমের বিচারে সৌন্দর্যবোধের বিচার করতে গেলে প্রথমে চলে আসে ইন্দ্রিয়জাত সৌন্দর্যবোধের কথা। যেমন−দর্শনজাত, শ্রবণজাত, ঘ্রাণজাত, স্পর্শজাত ও আস্বাদজাত। সৃজনশীল সৌন্দর্যের বিচারে এর সবগুলো সবার জন্য হয়ে উঠে না। প্রথমেই ধরা যাক আস্বাদজাত সৌন্দর্য। উত্তম খাদ্যপানীয় তৈরির কৌশলকে সৃজনশীল বলা যাবে। কিন্তু একটি ভালো রান্না সারা পৃথিবীর সকল মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে আস্বাদিত করার চেষ্টা করা হয় না। আন্তর্জাতিকভাবে সরবরাহের জন্য কিছু খাবার তৈরি করা হলেও সময়ের কারণে এবং প্যাকিং-এর কারণে তার স্বাদের হেরফের হয়। একই ভাবে একটি স্পর্শের সকল অনুভুতি সবাইকে দিতে গেলে বিষয়টা স্পর্শকাতর হয়ে যাবে। মনুষ্যসৃষ্ট আতর বা সেন্টের ঘ্রাণ বোতলে ভরে সারা পৃথিবী ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এটা মূলত ঘ্রাণের সৌন্দর্যবোধের উপাদান হিসেবে কাজ করে।মহত্তম সৌন্দর্য (Sublime): এই জাতীয় সৌন্দর্য প্রকৃতিতে ঘটে কিম্বা মানুষ তৈরি করে। এই সৌন্দর্য উপভোগের আনন্দ বিপুল বিস্ময়ে 'আমি'কে অভিভূত করে। এর সংস্পর্শে এসে কেউ সৌন্দর্যে শ্রদ্ধায় অবনত হয় বা আতঙ্কে অসহায় বোধ করে। এই জাতীয় সৌন্দর্যে থাকে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাত উপলব্ধি। স্মৃতিতে ধৃত অসংখ্য মৌলিক এবং মিশ্র সৌন্দর্য-রূপের সমন্বয়ে যে নবরূপের সৃষ্টি হয়, 'আমি' সে রূপকে ধারণ করতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। এই রূপকে তার চেতনার উচ্চস্তরে স্থান দেয়। এই রূপ এক অপরিসীম ভাবনা-জগতের উন্মুক্ত প্রান্তরে নিয়ে যায়। এই রূপ আমাদের মনে মহত্তম সৌন্দর্যের জন্ম দেয়।
মহত্তম সৌন্দর্যের প্রকৃতি অনুসারে একে নানাভাবে ভাগ করা যায়। যেমন−
ভয়াল সৌন্দর্য: এই জাতীয় সৌন্দর্যের ভিতরে মানুষ কোনো ভয়ঙ্কর রূপকে অনুভব করে। যেমন রাতের আঁধারে অগ্ন্যুৎপাতের দৃশ্য। এর আলোর ফুলঝুড়িতে থাকে দেখার সৌন্দর্য। এর সাথে যুক্ত হয়, স্মৃতিতে থাকা অগ্ন্যুৎপাতের ফলাফল। কিম্বা সুনামির বিশাল ঢেউ, প্রবল ঝড়ে গাছপালার আন্দোলন, আকাশের তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি ইত্যাদিতে থাকে এই ভয়াল সৌন্দর্য। এই জাতীয় বিষয় মানুষও তৈরি করতে পারে, আবার প্রাকৃতিক নিয়মেও সৃষ্টি হতে পারে। ভয়াল সৌন্দর্যে মানুষের বিপন্নতার ভয় থাকে। আর মানুষের মনের বিপন্ন দশার অনুভবে থাকে অসহায়ত্ব। এর সাথে যুক্ত হয় সহজাত বা অভিজ্ঞতালব্ধ সৌন্দর্যবোধ। এই সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় ভয়াল সৌন্দর্য।
মহিমান্বিত সৌন্দর্য: প্রকৃতিতে এমন কিছু সৌন্দর্য আছে, যা আমাদের অভিভূত করে এবং যার বিশালত্বের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়। সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে বিপুল জলরাশির তরঙ্গমালা আমাদেরকে মহিমান্বিত সৌন্দর্য দান করে। এই বিপুল সৌন্দর্যের সবটুকু একবারে দেখা হয় না। একটি সুউচ্চ পাহাড়ে কত ফুল, কত পাখির কলকাকলি। কোথাও বিশাল কোনো গাছের মাথা, ঝাকড়া চুলের বাউলের মতো মাথা দুলিয়ে গাইছে, কোথাও রূপোলি ঝর্নার জল পাহাড়ের চঞ্চলা বালিকার মতো নেচে নচে অচিন দেশে মিলিয়ে যাচ্ছে। এতসব দেখা হয়ে উঠে না। যেন পাহাড়ের এই বিপুল সৌন্দর্যের মেলায়, নিজেকে হারিয়ে ফেলাতেই আনন্দ। সবমিলিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য যেনো অধরাই থেকে যায়। মনে থেকে যায় শুধু এর মহিমা। এরূপ হতে পারে ঘনকালো রাতের আকাশের নক্ষত্রের মেলা, হতে পারে মেরুঅঞ্চলের বরফের টুপি পরানো পাহাড়ের সারি বা মরুভূমির বিপুল বালুকারাশি। মহাবিশ্বের বিশালত্বের কথা বিবেচনা করে একদিকে আমরা বিস্মিত হই, একই সাথে অনুভব করি নিজেদের ক্ষুদ্রত্ব। এসবের ভিতরে পাওয়া যায় মহিমান্বিত সৌন্দর্য।
মহান ও চিরায়ত সৌন্দর্য: বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে বিস্ময়কর সঙ্গীত ধ্বনিত হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ তা উপলব্ধি করে স্রষ্টার প্রতি পরমশ্রদ্ধায় এবং বিস্ময়ে বলেছেন 'তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী'। রবীন্দ্রসৃষ্টির দিকে তাকিয়েও আমাদের ভিতরে তেমনি বিস্ময় জেগে উঠে। আমরা বিস্মিত হই মহাভারতের দিকে তাকিয়ে। এমনি রয়েছে দ্যাভিঞ্চি, মাইকেলাঞ্জেলো, মোজার্ট প্রমুখের সৃষ্টিকর্মে। কবিণাং কবিতম কে, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, কালিদাস, বাল্মিকী না কি রবীন্দ্রনাথ? কেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে ফিরে পাওয়ার জন্য আমাদের হাহাকার। কেন আরও একজন আলী আকবর খানকে পাই না। কারণ একটাই এঁরা আমাদের দিয়েছেন মহত্ত্বম সৌন্দর্যের স্রষ্টা এবং তাঁরা তাঁদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে হয়ে উঠছেন মহান। এঁদের সৃষ্টিই বলে দেন, এঁরা সকল শিল্পরসিকদের কাছে মহত্তম শিল্পী এবং শিল্পীদের মধ্যে শিল্পীশ্রেষ্ঠ। আমরা যখন এঁদের সৃষ্টির বিশালত্ব সংস্পর্শে আসি, তখন সে সৃষ্টির সামান্য অংশই একবারে ধরা পড়ে। সেটুকুতে আকৃষ্ট হয়ে, আবার সেসকল সৃষ্টিকর্মে ফিরে আসি এবং নতুন নতুন রূপের সন্ধান পাই। বহু 'আমি' এসকল সৌন্দর্যকে বহুভাবে দেখে এবং নিজের মতো করে অনুভব করে। এর ভিতর দিয়ে মহান সৌন্দর্য চিরায়ত সৌন্দর্যে রূপ লাভ করে।
চিরায়ত সৌন্দর্য প্রকৃতিতেও আছে। কিন্তু বিষয়টি শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে বলা হয়। যে শিল্পর্কম সৃষ্টির সময় থেকে সৌন্দর্যের দ্যূতি ছড়ানো শুরু করে এবং তা কালকে অতিক্রম করে যায়, তাই চিরায়ত সৌন্দর্য। চিরায়ত সৌন্দর্যের উপলব্ধি একজন 'আমি'র কাছে নানাভাবে ধরা পড়তে পারে। বিশেষ করে বয়স, অভিজ্ঞতা, সৌন্দর্যচর্চা ইত্যাদির সাথে সাথে এই উপলব্ধির পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
সৌন্দর্যের উৎস
সৌন্দর্যের উপলব্ধি মানুষের মনের ভিতরে। কিন্তু এর লক্ষ্য ও উৎস বাইরে।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্য তো বটেই, অতীন্দ্রীয় সৌন্দর্যও বাইরের।
অতীন্দ্রয় সৌন্দর্য কল্পলোকের। কিন্তু তার লক্ষ্য থাকে বাইরে জগতে। কল্পলোকে যে
রাজপ্রাসাদ গড়ে, তা মনের ভিতরে তৈরি হয় কিন্তু ক্ষেত্রটি থাকে বস্তুজগতের কোনো একটি
স্থানে। বাইরের জগৎ উৎস বলেই শিল্পীকে মনোজগৎ ছেড়ে বাইরে আসতে হয়। বাইরে আসতে না
পারলে, শিল্পের সার্থকতা নেই। প্রকৃতির লীলা বাইরে, মনের ভিতরে তার যে ছায়া পড়ে,
তারই আলোকে মনের ভিতরে সৌন্দর্যের জন্ম হয় এবং অবশেষে তাকে স্থান করে নিতে হয়
বাইরে। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে
'আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া'। 'বিশ্বলোকে
সাড়া' পাওয়ার জন্য যে 'আমি' আকুল, তার উৎসও বিশ্বলোক। 'আমি' এবং আমার বিশ্বলোক
একাকার না হলে সৌন্দর্যের জন্ম হয় না। বিশ্বলোকের ভিতরে 'আমি' এবং 'আমি'র ভিতরে
বিশ্বলোকের উপলব্ধি, উভয়ই সৌন্দর্যের উৎস।
মানুষ তার সৃজনশীল কর্মের ভিতর দিয়ে যে সৌন্দর্যের অনুশীলন করে, তার উৎস হিসেবে
সাধারণভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটো হলো− প্রাকৃতিক উৎস এবং কৃত্রিম উৎস।
প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য: প্রকৃতিকে বলা হয়, অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এর সকল রূপ-রস-গন্ধ-শ্রুতি-স্পর্শ-এর মধ্যে প্রবহমান
আনন্দ ধারায় অবিরত সৃষ্টি হয়ে চলেছে সৌন্দর্য। মানুষ প্রকৃতির সন্তান।
সৌন্দর্যবোধ তার জিনকোডে লিখিত।
তাই মানুষ
প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করার উপযোগী হয়ে ওঠতে থাকে শৈশব থেকেই। কিছু বিষয়
মানবশিশুকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে। যে শিশু হামাগুড়ি দেওয়া শিখেছে, তার
সামনে একটি জ্বলন্ত প্রদীপ রাখলে, সে হাত বাড়িয়ে তার শিখা ধরার চেষ্টা
করবে। কারণ সে জানে না এর
পরিণতি কি হতে পারে। বড়রা তাকে থামায়। কিন্তু যদি না থামায়, তাহলে সে হাত
দেবে এবং হাত পুড়িয়ে একটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা লাভ করবে। এভাবে মানুষ অজস্র
বিষয় শেখে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ক্ষতিকারক বলে কোনো বিষয় থেকে নিজেকে
বিরত করে বটে, কিন্তু মানুষ তাকে সৌন্দর্যহীন বলে না। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির
সৌন্দর্য কিম্বা সুনামির বিশাল ঢেউই-এর সৌন্দর্য মানুষকে একই সাথে আকর্ষণ
করে, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য মানুষ এগুলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করে। তার ছোটো উপকরণ
আনন্দ দেয় আর সম্মিলিতভাবে সৌন্দর্যবোধকে উজ্জীবিত করে। এর প্রধান কারণ
বৈচিত্র্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারায়।
বিবর্তনের ধারায় আমাদের চুল, চোখ কিংবা হাতের নখ বর্তমান দশায় পৌঁছেছে। এসব
দেখে আমরা অভ্যস্থ। এই সূত্রে আমাদের ভিতরে এক ধরনের সৌন্দর্য বোধ জন্মেছে।
এর বাইরে কিছু হলে আমরা তাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
সেক্ষেত্রে সৌন্দর্য উপভোগ করার পরিবর্তে আমরা ভীত হয়ে পড়ি।
প্রাকৃতিক কারণে কোনো শিশু চারটি চোখ, নাকের অগ্রভাগে তীক্ষ্ণ দাঁত, একটি কান সাপের মতো হয়। আমরা তাকে নিশ্চয়ই দেখতে সুন্দর বলবো না। কিন্তু
সকল মানবশিশু যদি এমনই হতো এবং আমরা দেখে দেখে অভ্যস্থ হয়ে উঠতাম, তা হলে
বর্তমান মানব শিশুই হয়তো কুৎসিত মনে হতো।
বিবর্তনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যৌন নির্বাচন। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি
আকর্ষণ রয়েছে জীবের জিন-সঙ্কেতে। প্রাকৃতিক এই বিষয়টির সাথে জড়িত রয়েছে
প্রজাতির বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করার জন্য। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ
সৃষ্টি হলো প্রকৃতির এক ধরনের ছলনা। যৌনানন্দের মধ্য দিয়ে জীব জীবনকে উপভোগ
করতে চায়। তার জন্য লিঙ্গের বিচারে জীবদেহে সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে। ময়ুর পেখম
মেলে ময়ুরীকে আকর্ষণের জন্য, গান গাওয়া পাখি গান গায়, তার প্রত্যুত্তর দেয়
সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে কাছে পাওয়ার জন্য। মানবজগতে রূপচর্চার মূলে রয়েছে সুপ্ত
বা উৎকট যৌনাবেদন। মানবজগতে রূপচর্চার অনুশীলনের ভিতর দিয়ে সৌন্দর্যের
অভিজ্ঞতা জন্মলাভ করেছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, মুগ্ধতা বা
আচ্ছন্নতা জাগিয়ে তোলার জন্য মানুষ এই চর্চা করে চলেছে আদিকাল থেকে।
কৃত্রিম সৌন্দর্য: যে সকল সৌন্দর্য মানুষ সৃষ্টি করে। চিত্র, সঙ্গীত, ভাস্কর্য এ সবই কৃত্রিম সৌন্দর্য। শিশুর প্রাথমিক সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চর্চার ভিতর দিয়ে। যে কোনো শিশুকে ছবি আঁকতে দিলে, সে তার চারপাশের প্রকৃতি থেকে ছবির উপাদান সংগ্রহ করে। হতে পারে কম্পিউটার, টেলিভিশন, বৈদ্যুতিক পাখার মতো একটি কৃত্রিম উপাদান। কিন্তু শিশুর কাছে তার সবই প্রাকৃতিক উপাদান। কোনটি মানুষের তৈরি আর কোনটি প্রকৃতির তা জানার চেষ্টা করে না। রঙের বিচারে শিশু তার মনের রঙ মিশায়। আমরা শিশুদের অদ্ভুত রঙ নির্বাচনে কৌতুকবোধ করি। কিন্তু শিশুর মনের রঙের মর্যাদা দিলে, সে কৌতুক মানানসই হয় না।
শিশুর ঘরের ভিতরের খেলনাগুলোকে নিজের মতো করে সাজায়। এই সাজানোর প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তার কৃত্রিম সৌন্দর্যবোধ জেগে উঠে। সবাই বড় হয়ে চিত্রশিল্পী বা সঙ্গীত শিল্পী হয় না। কিন্তু শৈল্পিক বোধ থাকেই। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নানা ধরনের এই শৈল্পিকবোধের জন্ম হয়। মানুষের সৌন্দর্যবোধের প্রকৃতি তৈরি হয় তার চারপাশের জগৎ থেকে। যে পরিবারে সঙ্গীতচর্চার হয়, সেই পরিবারের সন্তান সঙ্গীত শিল্পী হয়ে না উঠলেও সঙ্গীতের বোধ তার ভিতরে থাকে। ভৈরবীর রাগালাপ শুনে একজন দীনমুজুরের ভালো নাও লাগতে পারে। যদি ভালো না লাগে, তাহলে বুঝতে হবে ভৈরবী শুনে আনন্দলাভের মতো সৌন্দর্যবোধ তার তৈরি হয় নি।
সৌন্দর্য বৈচিত্র্যের ছন্দে বাধা
একক আনন্দ ক্ষণিক, তাই তার পতন ঘটে। আনন্দকে জাগিয়ে রাখা হয় বৈচিত্র্যের ভিতর
দিয়ে। পতনশীল আনন্দকে বৈচিত্র্যের ছন্দে বাঁধতে না পারলে, সৌন্দর্যেরও পতন ঘটে।
আনন্দ-নিরানন্দের খেলার ভিতর দিয়ে জেগে উঠে সুন্দর, জেগে থাকে সুন্দর। শুধুই আনন্দ, সেটা
নিরানন্দের সামিল। গানে আছে 'খোলা আকাশ কি এতো ভালো লাগতো যদি কিছু কিছু মেঘ
নাহি থাকতো।' খোলা আকাশ সুন্দর, কিন্তু তাতে এক ঘেয়ে ব্যাপার আছে। এই একঘেয়ে
ব্যাপারটা সৌন্দর্যের জন্য বিপৎজনক। 'কিছু কিছু মেঘ' একঘেয়ে থেকে মুক্তি দেয়।
যা সুন্দর, তার একটি অসুন্দর দশা আছে। দুইয়ের মিলনে সৃষ্টি হয় ছন্দ।
বিপরীতার্থক শব্দের বিচারে অসুন্দর কখনোই সুন্দর নয়। কথাটি এক দিক থেকে ঠিক। ধরা যাক সঙ্গীতে পাঁচটি স্বর এলোমেলো ভাবে ব্যবহার করে এক ধরনের কোলাহল তৈরি করা হলো। সুসমন্বয়ের অভাবের জন্য তা সুন্দর হয়ে উঠবে না। কারণ, ওই পরিবেশনা থেকে আনন্দ লাভ হবে না। কারণ, ওই পরিবেশনায় কোনো স্বস্তি নেই।
যাকে সুন্দর বলা হয়, তার ভিতরে বিষয়ের উপাদানের এমন একটি গুণ থাকে যা মনকে মুগ্ধ বা মোহিত করে। তাই দুঃখের গান সে মুগ্ধ হয়ে শোনে। কর্কশ, বেসুরো বা সুরসমন্বয়হীন সঙ্গীতের প্রতি বিরক্ত হয়ে আসর ছেড়ে চলে যায়, সে আনন্দ পায় না বলেই। আর আনন্দ থাকে না বলেই তা সুন্দর হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে আনন্দ ছন্দ হারিয়ে ফেলে বলেই মানুষ বিরক্ত হয়। কিন্তু অসাধারণ দুঃখের গানের আসর শ্রোতা ত্যাগ করেন না। সেখানকার দুঃখের অনুভবের ভিতরে সমন্বিত এমন একটি রূপ শ্রোতা অনুভব করতে থাকেন, যে রূপের ভিতরে থাকে সমন্বিত আনন্দের উপাদান। আর এর দ্বারা সৃষ্ট সৌন্দর্যের ভিতরে মানুষ জীবনের ছন্দ খুঁজে পায়। এখানে 'আমি' নামক সত্তা জানে, যা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা শিল্পের জন্য। সুতরাং তাকে উপস্থাপিত বিষয়ের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। 'আমি' এর ভিতর দিয়ে দুঃখের সমন্বিত রূপটি দেখার চেষ্টা করবে। যদি তাতে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে 'আমি' বিরক্ত হবে এই ভেবে যে, দুঃখটা ভালো করে প্রকাশ হলো না। আর ভালো হলো না বলেই সে আনন্দলাভে বঞ্চিত হবে। ফলে পুরো বিষয়টি সুন্দর হয়ে উঠবে না। এ ছন্দের দোলায় সুন্দরই অসুন্দর এবং অসুন্দরই সুন্দর হয়ে উঠে। জীবন এমনই। জীবনের সৌন্দর্য হলো বৈচিত্র্যের ছন্দে গ্রথিত সুন্দর-অসুন্দরের মালা। দুইয়ের সমন্বিত রূপের ভিতর দিয়েও সুন্দর আরো সুন্দর হয়ে উঠে। এখানেও মন স্বস্তি চায়। তাই এই সুন্দর-অসুন্দরের খেলাতেই সমন্বয়টাই দরকার।
ধরা যাক, একটি ফুলের চমৎকার রঙ মনের ভিতর আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করছে। কিন্তু ফুলটির দোমাড়ানো হলে, তা আনন্দ দান করে না। উভয় অনুভূতির সমন্বয়ে কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে না। একটি সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের গান আনন্দ দান করছে, কিন্তু সহযোগী যন্ত্রটি হয়তো ঠিক সুরে বাঁধা নেই। এই দুয়ে মিলে সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে না। এমনকি কোনো সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের অধিকারী কোনো শিল্পীর গান পরিবেশনের সময় কোনো একটি জায়গায় বেসুরো বা ভুল স্বর প্রয়োগ করলেও সৌন্দর্য নষ্ট হবে। মূলত শিল্পী চেষ্টা করেন, তাঁর উপস্থাপিত বিষয়ের ভিতরে যে অসংখ্য আনন্দ রয়েছে, সেগুলোর সমন্বিত রূপ মূর্তমান করে তুলতে। বিমূর্ত বা দৈহিক সত্তা রয়েছে এমন সকল অবদানের ভিতরে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তা বিমূর্ত। আর এই বিমূর্ত আনন্দসমূহকে সমন্বিত হয়ে মনের ভিতর যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, বিমূর্ত অবয়ব নিয়ে বিমূর্ত-মূর্তি তৈরি করে। শিল্পীর সাধনা সেই বিমূর্ত-মূর্তির সাধনা।
প্রতিটি একক আনন্দের একটি তরঙ্গ আছে এবং তা একবার চূড়ায় উঠে ধীরে ধীরে তার অগ্রমুখ নিম্নগামী হয়। কিন্তু একই সাথে যদি দুটি আনন্দ 'আমি' উপভোগ করে, তখন 'আমি' দুটি আনন্দই ভাগাভাগি করে ভোগ করবে। ফলে দুটি আনন্দের সূত্রে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। এরূপ একাধিক গতিময় আনন্দের মিশ্রণে সৃষ্ট অনুভূতি 'আমি'র কাছে আনন্দের বা নিরানন্দের মনে হতে পারে। ধরা যাক, একটি বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে একটি সুরের সৃষ্টি করা হলো। এর দ্বারা একজন শ্রোতার মনে আনন্দের সঞ্চার হলো। এবার প্রথম যন্ত্রটি থামিয়ে, অপর একটি যন্ত্রের সাহায্যে আরও একটি সুর বাজানো শুরু হলো। সেটিও শ্রোতার মনে আনন্দ সঞ্চার করলো। এবার দুটো যন্ত্র থেকে দুটি ধ্বনি একসাথে বাজানো শুরু হলো। এই দুটি স্বরের সমন্বয় শ্রোতাকে পৃথক আনন্দ বা নিরানন্দ দান করতে পারে। যখন শ্রোতা মিশ্র স্বর থেকে আনন্দ পায়, তখন দুটি আনন্দ তরঙ্গ একটি মিশ্র আন্তঃআনন্দধারায় আন্দোলিত হতে থাকবে। এই বৈচিত্র্যময় অনুভূতির ফসল হিসেবে পাওয়া যাবে একটি মিশ্র সৌন্দর্য। পক্ষান্তরে মিশ্র সুরের প্রভাবে সৃষ্ট নিরানন্দ শ্রোতাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেবে এবং সৌন্দর্যের অপমৃত্যু হবে। সৌন্দর্যের জন্য সুসমন্বিত আনন্দসমূহের বিন্যাস। চিত্রশিল্পী রেখা এবং রঙের ভিতর দিয়ে মূলত অজস্র আনন্দের সমন্বয় সাধন করে থাকেন।
সৌন্দর্য
প্রতিযোগিতামূলক
যেকোনো
বিষয়ের সৌন্দর্যের একটি আদি মান থেকে। এই মানটি মানুষ পায় প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে।
প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত ওই সৌন্দর্যবোধ মনের ভিতরে একটি বিশেষ স্থানে অবস্থান করে।
যদি কখনো এই জাতীয় সৌন্দর্যের সে মুখোমুখী না হয়, তাহলে, তার ওই বিষয়ের সৌন্দর্যবোধ
ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময়ই তা হয় না। জীবনের চলমান প্রক্রিয়ায়
মানুষ নানা রকম ভাবে একই জাতীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখী হয়। এর ফলে আদি সৌন্দর্য
বিন্দুর সৌন্দর্যমানের হেরফের ঘটতে থাকে। ধরা যাক কোনো একজন প্রথমবার একটি গাঁদা
ফুল দেখে, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো। এরপর আবার অন্য একটি ফুল দেখে আগেরটির চেয়ে আরও
ভালো লাগলো। এক্ষেত্রে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ফুলটি প্রথম স্থানে উঠে আসবে।
এরূপ তৃতীয় আর একটি ফুল দেখলো, তার সৌন্দর্য প্রথম দুটি অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গেলো।
এক্ষেত্রে সৌন্দর্যের অনুভব একটি উচ্চতর অবস্থানের দিকে চলতে থাকবে। এরপর চতুর্থ
ফুলটি দেখে তার মনে কুৎসিৎ বোধের জন্ম নিলো। মূলত মানুষের মনের ভিতরে সৌন্দর্যবোধের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। এই
অভিজ্ঞতাগুলো স্মৃতিতে থেকে যায়। এই সকল অভিজ্ঞতার আলোকে সে তুলনা করে অভিমত দিতে
পারে, ভালো, আরও ভালো, অধিকতর ভালো কুৎসিত ইত্যাদি। এই সকল অভিজ্ঞতা মনের ভিতরে
রেখাচিত্রের তৈরি করে। যাকে কুৎসিত বলা হয়, তার অবস্থান হয় আদি সৌন্দর্যের নিচে।
কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কুৎসিতের ভিতরে কোনো সৌন্দর্য নেই।
যিনি সৌন্দর্য তৈরি করেন তাঁর সৃষ্টির ভিতর দিয়ে, তিনি শিল্পী। শিল্পীর সৃষ্টি যিনি অনুভব করতে পারেন তিনিও শিল্পী। শিল্পীর সৃষ্টি অনুভব করে দর্শক-শ্রোতা তৃপ্ত হন, কিন্তু শিল্পী নিজে তৃপ্ত হন না। কোনো শিল্পী যখন নিজের সৃষ্টিতে পূর্ণতা অনুভব করেন, তখনই তাঁর শৈল্পিক সত্তার মৃত্যু ঘটে। কারণ, শিল্পী মাত্রেই প্রতিনিয়ত নিজের সৃষ্টিতে অপূর্ণতা খুঁজে পান। আর সেই অপূর্ণতা পূরণের তাগিদে শিল্পী আত্মতাড়িত হন। অন্য কারো কাছে শিল্পীর দায়বদ্ধতা নেই। সে সৌন্দর্যের সেবক বা দাস। তাই সৌন্দর্যের জন্যই শিল্পী পরম সৌন্দর্যের সন্ধানে তাড়িত হন। যদি কেউ সেই পরম সৌন্দর্যকে ধারণ করতে পারেন, সেটাই হবে পরম সত্য। আর পরম সত্যই তাঁকে তুলে নেবে পরম স্রষ্টার আসরে। সেখানে সত্য-সুন্দর-সষ্টা একাকার হয়ে যাবে। শিল্পীর প্রতিযোগিতা হবে শিল্পের জন্য এবং নিজের সাথে। নিজেকে অতিক্রম করার মানসিকতার ভিতর রয়েছে শিল্পী হয়ে উঠার সাধনা। অপরকে শ্রদ্ধা করার ভিতর রয়েছে বিনয়। শিল্পী পরিপূর্ণ নয় বলেই বিনয়টা তাঁর জন্য জরুরী।
সৌন্দর্যের তৃপ্তি-অতৃপ্তি
সৌন্দর্যের ভিতরে আছে
মানসিক আকর্ষণ। যে কোনো কিছুর পাওয়ার অনুভূতি থেকে জন্ম নেয় আকাঙ্ক্ষা। সে
আকাঙ্ক্ষা আবার হতে হবে স্বস্তিদায়ক, তার চেয়ে বড় কথা আনন্দদায়ক, তার চেয়েও বড়
সৌন্দর্যময়তা। কোনো কিছুর প্রাপ্তি ঘটলে, মনে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তার স্থিতিশীল
দশা হলো তৃপ্তি। আর 'আমি' যখন সে তৃপ্তিকে গভীরভাবে গ্রহণ করে, তখন তা হয়ে উঠে
আত্মতৃপ্তি। গানা শোনার জন্য কোনো আসরে গিয়ে গান শুনলাম। কিছু শোনা হলো, কিছু
গল্পও হলো। তাহলে শোনাটার ভিতর ফাঁক থেকে গেলো। অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, এটা
অনুষ্ঠানের যেতে পারার তৃপ্তি। গান শোনার তৃপ্তি কোথায়? গান সৌন্দর্যের বিষয়
হয়, তা হলে গানই শুনতে হবে। যদি সে গান মনের ভিতর রসের সঞ্চার করে, আর তা যদি
গান শোনার আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারে, তা হলেই তা হবে তৃপ্তি। আত্মতৃপ্তির
স্থান আরও একটু গভীরে। আমরা অনেক সময়, গানটা ভালোই হয়েছে বলি, এটা সাধারণভাবে
তৃপ্তির কথা। কিন্তু আত্মতৃপ্তির জন্য নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে,
যাকে ভালো বলছি, তা সত্যিই ভালো তো। নিজেকে ফাঁকি না দিয়ে যে
তৃপ্তির জন্ম হয়, তাই হলো আত্মতৃপ্তি।
সামাজিক
সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য অনেক সময়ই আত্মতৃপ্তির কথা সবাইকে বলা যায় না। এই
মানসিকতা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। শ্রোতা-দর্শকদেরর জন্য এই আত্মপ্রবঞ্চনা
গঠনমূলক না হলেও, শান্তির জন্য কেউ সেটা করতেই পারেন। কিন্তু শিল্পীর জন্য সেটা
সুফল বয়ে আনে না। শিল্পী ত্রুটিকে লুকিয়ে যদি আত্মপ্রচারের দ্বারা গুণগুলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে
চান, তাহলে তা আত্মপ্রবঞ্চনাই হবে।
মানুষ সৌন্দর্যের কাছে বারবার ফিরে আসে বা আসতে চায়। এর ভিতরে থাকে
একধরনের অতৃপ্ততা। যখন কবি বলেন, 'মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়'। তখন
সৌন্দর্যের তীব্র আকাঙক্ষার অতৃপ্ত দশা থেকেই বলেন। এই অতৃপ্ততাজনীত কারণে
আকাঙ্ক্ষার মৃত্য হলেও, সৌন্দর্যের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষায় তা পুনরায় জাগ্রত হয়।
ধরা যাক, একটি
গান প্রথমবার শোনার পর, তার সৌন্দর্যে আপনি মুগ্ধ হলেন। বারবার ওই
সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য, আপনি বার বার শুনবেন এবং প্রতিবারই আপনি তৃপ্ত হবেন। একই
গান বহুবার শোনার কারণে, তৃপ্তিবোধের ক্ষেত্রে নানা রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে
পারে। যেমন−
প্রথম প্রতিক্রিয়া: প্রথম বার গান শোনার পর, আপনি মুগ্ধ হবেন এবং বার বার শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন। এক্ষেত্রে প্রথমবারে শোনাটা ছিল একটি সৌন্দর্য উপভোগের অভিজ্ঞতা। ফলে দ্বিতীয় বারের শোনাটা আরও গভীর পর্যবেক্ষণের দ্বারা সমৃদ্ধ হবে। হয়তো দ্বিতীয় বারে আরও কিছু নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম হবে। এইভাবে ওই একই গান ক্রমাগত শোনার ফলে এক সময় মনে একঘেয়েমির জন্ম দেবে। এর ফলে বারবার শোনার ব্যাপারটা মনে অস্বস্তির জন্ম দেবে। তখন ওই গান শোনার প্রতি আপনার আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটবে। আপনি আর তৃপ্তি খুঁজে পাবেন না। মনে হবে সবই পেয়েছি। কিন্তু ওই গানের অনেক আনন্দময় দিকের প্রতি আকর্ষণ মনের গভীরে থেকেই যাবে। এই আকর্ষণের টানে আবার ওই গান আপনি শুনবেন। দীর্ঘ বিরতীর পর, তখন পুরানো আনন্দগুলো জাগ্রত হবে। অনেক সময়ই দ্বিতীয় কালবিরতীতে শোনার সময়, ওই গানের আরও কিছু নতুন করে শোনার মতো উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটা হয়তো শ্রোতাকে গানটির প্রতি ভালোলাগাবোধকে আরও গভীরভাবে উজ্জীবিত করবে। এই প্রক্রিয়ায় একই ব্যক্তির কাছে, চিরায়ত শিল্পকর্মে সৌন্দর্যের নব নব দিক উন্মোচিত হয় এবং প্রতিবার নতুন করে পাওয়ার আনন্দ লাভ হয়। এই কারণে চিরায়ত শিল্পের আবেদন কখনো ফুরায় না।
দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া: কোনো গান প্রথম বার গান শোনার পর, যতটা ভালো লাগে, এরপর থেকে ওই গানের প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে। এক সময় দেখবেন ওই গানটি আপনার প্রিয় গানের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। এর কারণ হলো, যে সৌন্দর্যে আপনি তৃপ্ত হবেন, সে গুণ ওই গানে ছিল না। আপনার কাছে ভালো মনে হয়েছিল, তা ছিল ভালোলাগার চমক। এই চমকটা কেটৈ গেলে, যখন আপনার শিল্পবোধ দিয়ে গানটিকে বিচার করতে বসবেন, তখন আপনার মনে হবে, গানটি ভালো তবে ততটা ভালো নয়।
তৃতীয় প্রতিক্রিয়া: প্রথম বার গানটি শোনার পর, আপনার ততটা ভালো লাগে নি। এই জাতীয় ব্যাপার ঘটে নবীন শিল্পীদের শোনার ক্ষেত্রে। প্রথমবার হয়তো আপনি অনুরোধে ঢেকি গেলার মনোভাব নিয়ে শুনবেন। কিন্তু প্রথমবার শোনার পর আপনার মনে দ্বিতীয় বার শোনার আগ্রহ জন্মাবে। এর কারণ প্রথম শোনাতে আপনার সৌন্দর্যবোধকে উজ্জীবিত করেছে। আপনি তৃপ্ত কিন্তু ওই তৃপ্তি লাভের অভিজ্ঞতাটা বার বার হোক সেটা আপনি অনুভব করতে চাইবেন। অনেক উপন্যাস, গল্প, কবিতা ইত্যাদি হয়তো প্রথমবার ভালো লাগে নি, কিন্তু পরে আপনার ভিতরে মুগ্ধতার জন্ম দিয়েছে। এর অর্থ হলো, আপনার সৌন্দর্যবোধের সাথে শিল্পীর সৃষ্ট সৌন্দর্যের সমন্বয় হয় নি। এই জাতীয় ঘটনা ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে শুধু ঘটে না। অনেক সময় বহু মানুষের কাছেই বিষয়টা এইভাবেই ধরা পরে। কোনো শিল্পী আজ যা সৃষ্টি করলেন, সমসাময়িক মানুষ তা গ্রহণ করতে পারেন নি। হয়তো সৌন্দর্য চর্চায় তিনি সমসাময়িককালের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অনেক পরে, তিনই হয়তো সবাইকে অতিক্রম করে উপরে উঠ আসবেন।
সৌন্দর্যের রূপ
সৌন্দর্যের
রূপ বিকশিত হয় আনন্দের আনন্দযজ্ঞে।
সৌন্দর্য
যেহেতু সমন্বিত বহু আনন্দের দ্বারা সৃষ্ট মিশ্র আনন্দ। তাই আনন্দের ছোটো ছোটো
রূপের ভিতরেই রয়েছে সৌন্দর্যের রূপ। রূপ থাকলেই সৌন্দর্যের কথা আসে। রূপ না
থাকলে সৌন্দর্যের বসবার ঠাঁই নাই। অনেক সময় সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে রূপের জন্ম হয়
বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে তা হয় না। সৌন্দর্য হলো একাধিক আনন্দের সমন্বিত অবয়ব।
সৌন্দর্য মাত্রেই রূপের আশ্রয়ী। ধরা যাক কেউ একজন অচেনা কোনো সুর বাজাচ্ছেন। সে
সুরের প্রতিটি স্বর আনন্দ দান করছে। সময়ের সাথে সাথে আগের বাজানো স্বর অতীত হয়ে
যায়। কিন্তু স্মৃতিতে তা জাগ্রত থাকে। প্রতি মুহূর্তের স্বরপরিবর্তনের সাথে
সাথে, অতীতের আনন্দবিন্দুগুলো একত্রিত হয়ে একটি অয়য়ব পায়।
কান শোনে তাৎক্ষণিক শব্দ , কিন্তু 'আমি'
শোনে অতীত-বর্তমানের সমন্বয়ে সৃষ্টি একটি সুরের ধারা। তাই আমির কাছে সুরের সৌন্দর্য
ধরা পরে একটি বড় রূপের ক্যানভাসে।
সৌন্দর্যের আনন্দযজ্ঞের সকল অনুভব সকল 'আমি' নিতে পারে না।
আবার সৌন্দর্যের সকল দিক সবার কাছে একইভাবে প্রকাশিতও হয় না। সৌন্দর্যের রূপে
থাকতে পারে−
উগ্রতা, স্নিগ্ধতা, রহস্যময়তা ইত্যাদি। সৃষ্টি করতে পারে মুগ্ধতা বা বিমুখতা।
এসবই আমি' যেভাবে নেয়, তাই।
অনেক সময় একটি বিশেষরূপ যে সৌন্দর্য দান করে, একাধিক রূপের সমন্বয়ে তা আরও সুন্দর হয়ে উঠে। সুন্দর খাবার− সুন্দর পরিবেশে আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠে। মানুষের যৌন-সৌন্দর্যে দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণের আবেদন অপরিসীম। শিশুর কাছে মায়ের স্পর্শ, মুখমণ্ডল, গায়ের গন্ধ এর সবই পরম রমণীয়। বাঙালি মেয়েরা টিপ পড়ে। টিপের একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। তা কপালে থাক আর, আয়নায় বসানো থাক। দুই ভ্রূর মাঝখানে বসে টিপ ভ্রূদ্বয়ের সুসমন্বিত একটি রেখার জন্ম দেয়। উপরের প্রশস্ত কপাল নিচের নাক, ঠোঁট এবং থুতনির বরাবর একটি উলম্ব রেখার যোগসূত্র তৈরি করে। সবমিলিয়ে টিপ একধরনের জ্যামিতিক সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। এর সাথে যুক্ত হয় টিপের রঙ আকার। নারীমুখের কপাল, ভ্রূ, নাক, ঠোঁট, কপোল এসবের যে ছোটো ছোটো সৌন্দর্য রয়েছে, টিপ তার একটি অংশ হয়ে ভিন্নতর সৌন্দর্যের রূপকে প্রকাশ করে।
মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি যে রূপের জন্ম দেয়, তার সাথে অনেকক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক অবয়বের যোগসূত্র থাকে। কিন্তু মানুষের মনের ভিতর এমন কিছু রূপের জন্ম হয়, যা সম্পূর্ণই অনুভবের। রবীন্দ্রনাথের গানে পাই 'আমি রূপে তোমায় ভোলাব না/ভালোবাসায় ভোলাব'। এ গানের রূপ হলো সৌন্দর্য। এ রূপ দেখার, আর ভালোবাসার রূপ অদেখার। যে রূপ দেখার, তা দেখার চেয়ে বেশি কিছু দান করে না। এ রূপ হলো ব্যঞ্জনা। যে রূপ মোহিত করে, তা অনুভবের, তা সৌন্দর্যময়। সে রূপ যদি ভালোবাসার হয়, অহঙ্কারের সাথে বলাই যায়, ভালোবাসায় ভোলাব। স্পর্শের রূপ আছে। দেহ দিয়ে স্পর্শ করলে দেখা যায়, তার রূপ একপ্রকার। মন দিয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়াটা ভিন্নতর রূপ। ভালবাসার রূপ তৈরি হয় দেখা ও না-দেখার যুগপৎ অনুভবে, ছোঁওয়া না-ছোঁওয়ার রোমাঞ্চে। যিনি ভালোবাসেন তিনি অরূপ রূপের সন্ধান পান।
অনেক সময় আমরা
কুরূপ বা সুরূপ বলি। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, রূপের কু বা সু বলে কিছু নেই। 'আমি' রূপকে কিভাবে
গ্রহণ করে, তার উপর নির্ভর করে সু বা কু। একজনের কাছে কোনো বিশেষ রাগ সু বা কু হতে
পারে। একই দৃশ্য দেখে সবাই সমানভাবে মোহিত নাও হতে পারে। কারও কাছে রজনীগন্ধার চেয়ে
গোলাপের গন্ধ বেশি ভালো লাগে। মিষ্টির চেয়ে কেউ ঝালকে বেশি পছন্দ করতে পারে।
সাধারণভাবে যা ভাল লাগে তা এক ধরনের স্বস্তি। আর তীব্রতর স্বস্তি-বোধ থেকে জন্ম নেয়
আনন্দ। প্রবহমান আনন্দের ধারায় অনুভূতি যে রূপ পায়, তার সামগ্রিক আনন্দের ধারায়
জন্ম নেয় সৌন্দর্য।
এমনি মানুষের মনের ভিতর যে রাগ, হিংসা, স্নেহ, মমতা ইত্যাদি রয়েছে, আমরা তার বহির্প্রকাশ দেখি মাত্র। তার রূপটা ধরা পুরোপুরি ধরা পরে না। রাগের বশে যে অন্যের মাথায় বাড়ি দেয়, সেটাও তার রাগের অংশ মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে, বাংলাদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ যেভাবে ঘৃণা করে, তার প্রকাশ কি যথাযথভাবে পাওয়া যায়। আমাদের অনেক ভাবনাই আমাদের বোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই তার সবটুকু যথাযথভাবে প্রকাশিত হয় না।
মানুষের মনের ভিতরে অন্য জগতের সৃষ্টি হতে পারে। কল্পজগতের লীলাভূমিতে আনন্দ-বেদনার জোয়ার-ভাটা যদি চলে, তাহলে সেখানে সৌন্দর্য তৈরি হবে নিজের তৈরি কল্পসত্যে। অনেকে আছেন নিজের তৈরি এই কল্পসত্যে বুঁদ হয়ে থাকেন। কোনো কোনো গুণীজন সে কল্পসত্যকে গল্পে, গানে, ছবিতে তুলে আনেন। তখন তাঁর কল্পসত্যের সৌন্দর্যে অন্য মানুষ মোহিত হয়।
ইন্দ্রিয়বাহিত বা দেহাভ্যন্তরীণ অনুভূতির সূত্রে যে সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা হয়, তা ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতির কারণে পার্থক্য গড়ে তোলে। দেখা, শোনা, স্বাদ গ্রহণ করা, স্পর্শ লাভ করা, ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের উপস্থাপনকে ভিন্নভাবে গ্রহণ করে। ছবির সৌন্দর্য কখনোই সঙ্গীতের মতো নয়। আবার একাধিক ইন্দ্রিয়গ্রাহী অনুভূতি মিশ্র সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ সঙ্গীতসহযোগে নৃত্য পরিবেশনা। কিম্বা একটি সুগন্ধী বৈঠকখানা। এই মিশ্র সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় রসভঙ্গ হয়। প্রায়ই আমরা নৃত্যানুষ্ঠানে সঙ্গীতের তারিফ করি কিন্তু নাচের করি না। বা নাচের অংশটিকে ভালো বলি, গানের অংশকে ভালো বলি না। প্রকৃতির কোনো নান্দনিক রূপ দেখে যখন বিমুগ্ধ, তখন পচাগলা কোনো গন্ধ তার রসভঙ্গ করে। অতি প্রিয়গান প্রিয়জনের মৃত্যুতে বেদনার সৃষ্টি করতে পারে। সৌন্দর্য থাকাটাই সৌন্দর্য উপভোগের একমাত্র তার শর্ত নয়। এর সাথে দরকার উপযুক্ত পরিবেশও। এই পরিবেশ শুধু পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নয়। মনের অবস্থাও মনের পরিবেশকে বলা হয় মেজাজ। কারণ মনের মেজাজ যে দশায় থাকে, তা কোনো পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
কোনো উপস্থাপিত বিষয় থেকে যেমন সৌন্দর্য সৃষ্টি হতে পারে, তেমনি সৌন্দর্যও পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্যকলায় এর অভিজ্ঞতা পাই। একটি করুণ সুর মানুষের মনকে আর্দ্র করে। নাটকের বেদনার দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে। প্রকৃতিতে এমনটা রয়েছে। কুৎসিত এবং সুন্দরের সহাবস্থান। জঙ্গলে পচাগলা প্রাণীদেহের পাশে একটি অপূর্ব ফুল ফুটে আছে। উভয়ের সহাবস্থান মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু তারপরেও ফুল সুন্দর বলেও ভিন্ন পরিবেশেও সুন্দর। শুধু পরিবেশগত কারণে আরও সুন্দর হয়ে উঠে নি। কিন্তু এমন তো হ্য়ই, হঠাৎ কোনো গান শুনে হঠাৎ মনটা ভালো হয়ে যায়।
যেভাবেই হোক, যত ভাবেই হোক, সৌন্দর্যের একটি শাশ্বত রূপ আছে। সে রূপ আছে বলেই মানুষ বিচিত্ররূপের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে। এই রূপ গ্রহণ বা ধারণ করার ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ সুন্দরকে উপলব্ধি করতে পারে। সে কারণে বলা হয়ে থাকে, 'আমি' কোনো রূপকে সুন্দর বলে বলেই সুন্দর, 'আমি' তুলনা করতে পারে বলেই পরম সুন্দরের সন্ধান করে। আর পরম সুন্দরের অনুসন্ধানই হলো নন্দনতত্ত্বের লক্ষ্য।
সৌন্দর্য ও রুচি
আমাদের চারপাশের অসংখ্য সুন্দর
বিষয় রয়েছে। কিন্তু সব সুন্দর সবার কাছে সুন্দর নয়। আবার একজন মানুষের বিচারে যা
কিছু সুন্দর, তা একই সময়ে একই স্থানে নাও থাকতে পারে। একটি সুন্দর পাহাড়, একটি সাগর
সৈকত, একটি দিগন্ত প্রসারিত সবুজ মাঠ এক সাথে হয়তো দেখা হয়ে উঠে না। জীবনের সকল
সুন্দর মুহূর্ত একই মুহূর্তে আসে না। এমনকি ধারাবাহিকভাবে সকল সুন্দর আসতেই থাকে
এমনটাও হয় না। বাস্তব জীবনে প্রতিটি মানুষ তার ব্যক্তিগত মানসিকতার বিচারে
সুন্দর-অসুন্দর ভিতরে বসবাস করে। অসুন্দর আছে বলেই সুন্দর আরও সুন্দর হয়ে উঠে।
আমাদের জীবনটাকে যদি সুন্দর বলি, তাহলে তা সুন্দর-অসুন্দরের গড় মানেই বলি। এই
গড়মানের সুন্দর জীবন ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, একটি উচ্চতর মানে জীবনকে সাজানোর
আকাঙ্ক্ষার ভিতরে গড়ে উঠে সুন্দরতর জীবনের অঙ্গীকার। জীবনকে সুন্দরতর কারা এই
প্রক্রিয়ায় থাকে ছোটো ছোটো অনেক উপাদান। জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর অর্থ হলো- এর
সকল উপাদানের সমন্বয়। আর এই সাজানোর প্রক্রিয়ার ভিতরেই
পাওয়া যায়
রুচি-র পরিচয়।
ধরা যাক, পাঁচ জন ব্যক্তিকে তাদের মনের
মতো করে পাঁচটি ঘর সাজাতে বলা গেল। দেখা গেলো সবার সাজানো এক রকম হচ্ছে না। তার
অর্থ হলো, পাঁচজনের সৌন্দর্যবোধ একরকম নয়। পাঁচটি সজ্জার ভিতরে অনেকগুলো সৌন্দর্যের
উপাদান মিলে যেতে পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে একরকম হয়ে উঠে নি। অর্থাৎ সবার সৌন্দর্যের
সামগ্রিক রূপটা এক নয়। তার অর্থ হলো, সবার সমন্বয় করার দৃষ্টিভঙ্গী একরকমের নয়।
স্বস্তি-অস্বস্তির তীব্র অনুভূতিতে যে আনন্দ-বেদনার সৃষ্টি হয়, তারই সমন্বয়ে সৃষ্টি
হয় সুন্দর-অসুন্দর। আর এর ভিতরের অনেকগুলো সৌন্দর্য সমন্বিত হয়ে যখন একটি সামগ্রিক
সৌন্দর্য তৈরি করে, তখন তার বোধটা নানারূপে মনের মধ্যে বাসা বাধে।
এই বোধ এবং তার প্রকাশটাই
হলো রুচি। স্পষ্ট করে বললে, বলা যায় প্রতিটি মানুষের সামগ্রিক সৌন্দর্য বোধ এবং তার
প্রকাশটাই হলো রুচি।
যখন কেউ কোনো কিছু তৈরি করতে চায় বা অন্যের করা কিছু উপভোগ করতে চায়, তখন তার নিজের
ভিতরের রুচি থেকেই বিবেচনা করতে বসে। কোনো একজন ঘর সাজানোর জন্য পেশাগত কোনো লোকে
নিয়োগ করলো। পেশাদার লোক তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে যে যেভাবে ঘর সাজাবে, তা হবে অনেকটাই
যান্ত্রিক। পরিপাটি করে বিয়ের কনে চুল বাঁধে সেটা আনুষ্ঠানিক এবং কৃত্রিম। সংসারে
কাজ শেষে দিন শেষে গৃহবধূ যেভাবে চুলটা বাধে তাই স্বাভাবিক। আড়ম্বরপূর্ণ সজ্জায়
থাকে চোখ ধাধানো ঔজ্জ্বল্য, সহজাত সজ্জার ভিতরে আছে লাবণ্য। কনের সাজে সজ্জিত মেয়ের
সৌন্দর্য, মেয়েটির রুচি নয়। মেয়েটির রুচির পরিচয় পাওয়া যাবে তার সংসারের সাধারণ
জীবনযাপনের ভিতরে লালন করা সৌন্দর্য। প্রতিটি মানুষ যে সৌন্দর্যবোধ লালন করে,
প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ভিতরে তার প্রকাশটা সেই বোধ থেকে। অকৃত্রিমাভাবে সেই বোধের
প্রকাশটাই হলো তার রুচি।
রুচির ক্রমবিকাশ এবং
পরিণতি
মানুষের বোধ-জগতে থাকে নানা ধরনের
সৌন্দর্যের রূপ। শৈশব থেকে পরিণত বয়সের মৃত্যু পর্যন্ত সৌন্দর্যের রূপ পাল্টায়।
সৌন্দর্য উপলব্ধির সহজাত ক্ষমতা থাকে তার জিন সঙ্কেতে। এই ভিত্তিকে আশ্রয় করে
মানুষের সৌন্দর্যবোধ ডালপালা মেলে বড় হয়ে উঠে। আর এই প্রক্রিয়ার ভিতরে গড়ে উঠে তার
রুচি বোধ। শিশু তার খেলনা সাজায় তার প্রিয় খেলনা দিয়ে। অপছন্দের খেলনাকে সে দূরে
ঠেলে দেয়। এই পছন্দ-অপছন্দের পিছনে থাকে সুন্দর-অসুন্দরের নির্বাচন। এই নির্বাচনের
ভিতরে থাকে রুচির প্রাথমিক উপকরণ তথা প্রাথমিক সুন্দর-অসুন্দরের নির্বাচন। তার
নির্বাচিত খেলনা দিয়ে যখন সে তার চারপাশকে সাজায়, তখন তার ভিতরের সৌন্দর্যবোধ তাড়িত
করে। এর ভিতর দিয়ে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে, সেটা শিশুর রুচি। এই রুচি হতে পারে
ত্রিমাত্রিক উপকরণ, হতে পারে খাদ্যের স্বাদ, চারপাশের সৌরভ, প্রিয়জনের স্পর্শ
ইত্যাদি। শিশুরা ছবি আঁকার সময় যেভাবে রঙ ব্যবহার করে, বড়দের কাছে তা হাস্যকর মনে
হতে পারে। কিন্তু শিশুর কাছে সেটাই সত্য, সেটাই সুন্দর। সেটাই তার রুচি।
স্বাভাবিকভাবে শিশুরা বড় হয়ে উঠে একটি পারিবারিক পরিবেশে। সে তার নিজের জগতের বাইরে চোখ তুলে দেখে তাঁর বাবা-মা এবং তার চারপাশের আরও কিছু মানুষ। এর ভিতরে রয়েছে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বিদ্যালয়ের সহপাঠী, গৃহশিক্ষক বা স্কুলের শিক্ষক ইত্যাদি। এদের সংস্পর্শে সে যা কিছু পায়, তার কিছু তার ভালো লাগে, কিছু তাকে ভালো হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এরই ভিতর দিয়ে শিশুরা একটি মিশ্র অভিজ্ঞতা লাভ করে। শিশুর বোধে ঠাঁই করে নেয় সৌন্দর্যের নানা রূপ। আর নানা সৌন্দর্যের সমন্বয়ের সূত্রে গড়ে ওঠে তার রুচিবোধ। যে শিশু প্রতিনিয়ত পরিবারের বাবা-মায়ের ঝগড়া শুনে বড় হয়, তার কাছে অন্য কোনো দম্পতির প্রকাশ্যে ঝগড়াটা কুরুচির মনে হবে না। বস্তি এলাকার শিশুরা ক্রমাগত যৌনগন্ধী গালি ব্যবহার করে। এই রুচিটা পায় তার পরিবেশ থেকে। স্কুলকলেজের একজন শিক্ষকের কাছে তা কুরুচির হতে পারে, বস্তিবাসীর কাছে কচি-মুখের গালিগালাজ শ্রুতিমধুর মনে হতে পারে।
প্রতিটি মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে কাজ করে অনুকরণ। শিশুরা নিজের মতো করে যা ভাবে, তার পিছনে অনেকটাই থাকে অনুকরণে প্রবৃ্ত্তি। এই প্রবৃত্তি থেকে মানুষ ভাষা শেখে। এই প্রবৃত্তি থেকেই আচরণও শেখে। এর সাথে থাকে তার চারপাশের মানুষের আচরণ দেখার বা শুনার অভিজ্ঞতা। কি করতে হয় বা হবে সেটা যেমন শেখে, একই সাথে কি করা যাবে না, কি করা উচিৎ নয়, সেটা শেখে। অনুকরণ এবং অনুসরণের ভিতর দিয়ে মানুষ একটি পরিবারে এবং সমাজের অংশ হয়ে উঠে। আর উভয়ের সংমিশ্রণে বেড়ে উঠা শিশুদের ভিতরে একটি সাধারণ সৌন্দর্যবোধের জন্ম নেয়। এইভাবে সে একটি পরিবার বা একটি সমাজের উপযোগী হয়ে উঠে। এই ভাবে একটি বেড়ে উঠা মানুষের ভিতরে জন্ম নেয় সাধারণ সৌন্দর্যবোধ। আর এই বোধ জন্ম দেয় রুচি। এই রুচিবোধ একই সাথে তার নিজের, পরিবার বা সমাজের রুচিবোধকে ধারণ করে।
রুচির কোনো নির্দিষ্ট কু বা সু নেই। বিষয়টা নির্ভর করে 'আমি'র অবস্থানের উপর। প্রতিটি 'আমি'র ভিতরে যে রুচিবোধের মানদণ্ড রয়েছে, বা ধীরে ধীরে তৈরি হ্য়, তার বিচারে 'আমি' নির্ধারণ করে কু বা সু। তাই কোনো 'আমি'র রুচিবোধ পাল্টাতে গেল, তার রুচির মানদণ্ড-কে পাল্টাতে হবে। এটাকে সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় 'মগজ ধোলাই' বলা যেতে পারে। গ্রামের সাধারণ একটি মেয়ের সাজপোশাক বা আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করে, শহরের কোনো আধুনিকা বলতেই পারে 'খ্যাত্'। একইভাবে গ্রামের মেয়ে আধুনিকাকে 'বেহায়া' বলতেই পারে। বাস্তবতা হলো উভয়ের এই ভাবনা প্রকাশ পাবে নিজস্ব রুচি বোধের উপর। বেড়ে উঠার ধারায় উভয়ের ভিতরে যে সৌন্দর্যবোধের যে পার্থক্য গড়ে উঠেছে, তার বিচারে কার রুচি কতটা উন্নত তা নিরূপণ করা যায় না।
সাধারণত দেখা যায়, একটি পরিবারের সকল মানুষের রুচি সমান হয় না। কিন্তু কিছু সাধারণ রুচি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মেলে। ফলে পরিবারের সকল সদস্যের সম্মিলনে যে পারিবারিক শক্তি বা পারিবারিক আত্মার সৃষ্টি হয়, তাতে থাকে এই পারিবারিক রুচির সমন্বিত রূপ। সেখানে পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি স্নেহ-মমতা যেমন কাজ করে, তেমনি রুচি বোধটাও কাজ করে। পরস্পরের রুচিগত পার্থক্য থাকলেও, যদি তা অকল্যাণকর না হয়, তাহলে সে রুচিকে পরিবারের লোকেরা মর্যাদা দেয়। পরিবারের কোনো মেয়ের নীল রঙ পছন্দ। বাবা-মা ওই মেয়েটির পোশাক কেনার সময় নীলরঙ পছন্দের বিষয়টা মাথায় রাখে। এই জাতীয় ছোটোখাট রুচির প্রতি সম্মান বা মর্যাদা দেওয়ার ভিতরে পরিবারের ঐক্য দৃঢ়তর হয়। আবার একটি সাধারণ বাঙালি পরিবারের একটি মেয়ে, হঠাৎ করে যদি বিকিন পড়ে ঘুরে বেড়ানো শুরু করে, সেটা তার ব্যক্তিগত রুচি। যদি তার এই ব্যক্তিগত রুচি পরিবারের সবাই অনুসরণ করে বা প্রশ্রয় দেয়, তাহলে তা ধীরে ধীরে এক সময় পারিবারিক রুচিতে পরিণত হবে। কিন্তু ওই পরিবারে অন্যান্য সদস্যরা যদি এর তীব্রভাবে বিরোধিতা করে, তা হলে, তা পারিবারিক অংশ না হয়ে, ব্যক্তিগত রুচির পর্যায়েই থেকে যাবে। পরিবারগুলোর এই জাতীয় রুচির সমন্বয় বা সংঘর্ষ নিতান্তই ব্যক্তিগত বা পারিবারের নিজস্ব রুচি হতে পারে। যদি বড় পরিসরের কোনো একস্থানে স্থানে একটি পরিবারই থাকে, তাহলে পরিবারের সদস্যদের মতামতই যথেষ্ট। কিন্তু পরিবারটি যদি আরও অন্যান্য পরিবারের সাথে কাছাকাছি থেকে একটি পাড়া বা সমাজ গঠন করে, তাহলে রুচির এই ব্যাপ্তি প্রসারিত হবে। সেক্ষেত্রে সামাজিক রুচির বিষয়টাও বিবেচনায় আসে। এক্ষেত্রে পারিবারিক রুচি হবে এমন একটি সৌন্দর্য এবং মূল্যবোধের সমন্বিত সজ্জা− যা ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের জন্য পৃথক রুচির সৃষ্টি করবে। এক্ষেত্রে পারিবারিক রুচির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, অন্যান্য পরিবারের রুচি-বৈশিষ্ট্যের বিচারে একটু পৃথক হবে। একটি পরিবারের একটি নীল রঙ পছন্দ করে, কিন্তু অন্য পরিবারের নীল রঙ অপছন্দ করে। এর দ্বারা পারিবারিক রুচির সামান্য অংশকে তুলে ধরে মাত্রা। কিন্তু সামাজিক রুচিতে এর তেমন প্রভাব নেই। কিন্তু সমাজের সাধারণ রুচির সাথে যা সাংঘর্ষিক তা সামাজিক রুচিতে পরিণত হবে না। একটি পরিবারের মদ্যপান পারিবারিক রুচির অংশ হতে পারে। কিন্তু সমাজের বিচারে যদি তা নিন্দারযোগ্য হয়, তাহলে ওই রুচি সামাজিক রীতির মধ্যে ফেলা যাবে না।
প্রতিটি সমাজের এমন কিছু পারিবারিক রুচি আছে, যা ওই সমাজের সাধারণ রুচিতে পরিণত হতে পারে। যেমন একটি সমাজের সবাই বাড়িতে ফুলের বাগান করে। এই সাধারণ রুচি একটি সমাজের রুচিতে পরিণত হয়। সমাজের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সাধারণ রুচি একসময় ঐতিহ্যে পরিণত হয়। যেমন দীর্ঘদিন ধরে কোনো সমাজ যদি বিশেষ দিনে বাড়ির আঙিনায় আল্পনা আঁকে, তাহলে এই রীতি দীর্ঘদিনের চর্চার সূত্রে ঐতিহ্যে পরিণত হয়। মূলত একটি সমাজের সাধারণ সৌন্দর্যবোধই সামাজিক নান্দনিক ঐতিহ্যে পরিণত করে। এইভাবেই সৃষ্টি হয় জাতিগত রুচি। লোকসঙ্গীতে থাকে আঞ্চলিক সাঙ্গীতিক সৌন্দর্যের বিকাশ। এই সঙ্গীত চর্চার ভিতরে রয়েছে একটি অঞ্চলের সৌন্দর্যচর্চা। অনেক সময়ই এই জাতীয় সৌন্দর্যবোধ বা রুচি ব্যক্তি থেকে জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়। ধরা যাক একটি অঞ্চলের একটি পরিবারের কেউ কখনো গানের চর্চা করে নি। যদি ওই পরিবারের কোনো একজন সঙ্গীত চর্চা শুরু করে। তাহলে তা পারিবারিক ঐতিহ্যের বাইরের বিষয় হবে। যদি ওই পরিবার সঙ্গীতচর্চাকে গর্হিত কাজ মনে করে বাধা দেয়, তাহলে তা হবে ওই পারিবারের জন্য কুরুচির। কিন্তু জাতিগত রুচির বিচারে তা হবে সুরুচির। এক্ষেত্রে অবশ্য বিবেচনায় রাখতে হবে যে, ওই সমাজের কতজন সঙ্গীতচর্চাকে সুরুচির মনে করে। যদি কোনো সমাজের বেশিরভাগ মানুষ সঙ্গীতচর্চাকে কুরুচি মনে করে, তাহলে তা সমাজের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়াতে সামাজিক রুচির অংশ হয়ে উঠবে না। তাই বালা যায়− একটি জাতির সঙ্গীত, ঐতিহ্যগত খাবার, গৃহসজ্জা, পোশাক, লোকচিত্রকর্ম, নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির ভিতরে রয়েছে জাতীয় রুচির পরিচয়।
রুচির একটি বিশেষ অর্থ হলো শোভা। আর শোভা হলো সৌন্দর্যের সমন্বিত স্নিগ্ধতা এবং ঔজ্জ্বল্যের প্রকাশ। সমাজের রুচি মূলত সামাজিক প্রথা, ঐতিহ্য এবং প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার স্বাভাবিক শোভাকে ধারণ করে। এর ভিতর দিয়ে সমাজের মানুষ নান্দনিক প্রশান্তি লাভ করে। কোনো গ্রামের গৃহস্থরা যদি নবজাতকের উদ্দেশ্যে গীতবাদ্যের আয়োজন করে, তাহলে তার ভিতর দিয়ে সঙ্গীতের নান্দনিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। এর ভিতর দিয়ে পরিবারের বা সমাজের মানুষের বিশেষ রুচির প্রকাশ ঘটে। অনুষ্ঠান শেষে আনন্দ থেমে যায়, সাঙ্গীতিক সৌন্দর্যেরও অবসান ঘটে। কিন্তু প্রশান্তি রয়ে যায়। রুচি এই প্রশান্তিকে বহন করে নিয়ে যায় দিনের পর দিন। একটি তৃপ্তিদায়ক প্রশান্তি আদর্শ হয়ে রয়ে যায় মানুষের মনে। এই আদর্শের সূত্রে অন্যান্য আনন্দানুষ্ঠানের মান মানুষ নির্ধারণ করে। ফেলে আসা দিনের প্রশান্তির ভিতর দিয়ে মানুষ বলে, তেমনটি আর হলো না। এই তেমনটির বিচারে মানুষ যখন কোনো অনুষ্ঠানকে বিশ্রী বলে, তখন তার ভিতরের রুচি থেকেই বলে।
ভাবের জগতে সৌন্দর্যবোধের স্বরূপ
ভাব জগতের সৌন্দর্যবোধের রয়েছে নিজস্ব রূপ।
ছোটো ছোটো মৌলিক রূপের সমন্বয়ে সৌন্দর্যবোধ পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু সকল
সৌন্দর্য সবার ভিতরে
সমান উদ্দীপনা জাগায় না। তাই সৌন্দর্যবোধের কোনো সর্বজনীন আদর্শ রূপ নেই। তবে ব্যক্তি বিশেষের
কাছে কোনো আদর্শ সৌন্দর্যবোধ গড়ে উঠতেই পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু একজনের
সৌন্দর্যবোধ অনেকের সাথে
প্রায় এক হতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি এক হয় না। এর ফলে সমমনা মানুষের কাছে
সৌন্দর্যবোধের একটি গড় মান তৈরি হয়। এই গড় মানের বিচারে সমমনা মানুষগুলো সমস্বরে
বলতে পারে ওই গানটি করুণ। একই নাটক দেখে কেউ কাঁদে কেউ ততটা বেদনার্ত হয়ে ওঠে না।
শিল্পকর্মের সৌন্দর্যবোধের আস্বাদনে কতকগুলো বিধি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এই সকল বিধি গড়ে ওঠে কিছু অবস্থার উপর, যা সৌন্দর্যগ্রাহীর মনের উপর প্রভাব ফেলে। এই সকল বিধিই মানুষকে সৌন্দর্যবোধের গভীরে জগতে টেনে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে মনোজগতের ভাব কিছু বিষয়কে অনুসরণ করে। যেমন-
১. সংবেদনশীলতা: সংবেদনশীলতা হলো সাড়া দেওয়ার গুণ। অর্থাৎ দুঃখের গল্প শুনে দুঃখ অনুভব করা, হাসির গল্প শুনে হাসা। বিষয়টির সাথে ব্যক্তি বিশেষের মানসিকতার সম্পর্ক নিবিড় রয়েছে। কিন্তু কিছু সৌন্দর্যবোধ রয়েছে, যা সহজজাত। এই বিচারেও রসাস্বদেনের প্রকৃতি দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১.১. সহজাত সংবেদনশীলতা: কাম, ভয়ের মতো কিছু সহজাত অনুভূতি গ্রহণের ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। এই অনুভূতি যখন কোনো শিল্পকর্মের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়, তখন মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা আনন্দ বেদনা লাভ করে।
১.২. অভিজ্ঞতা সঞ্চাত সংবেদনশীলতা: কথায় বলে, রসিক জনের কাছে রসিকতা করলে, হাসতে হাসতে তার মৃত্যু হতে পারে। বে-রসিকের কাছে রসিকতা করলে, তার হাতে রস পরিবেশকেরই মৃত্য ঘটতে পারে। দুটি বিষয়ই ঘটবে সৌন্দর্যবোধের হেরফেরের জন্য। একটি নাটক দেখে কেউ চোখের জলে ভাসে, কেউ বা চোখ পাকিয়ে বলে যত সব আদিখ্যেতা। রাগ-সঙ্গীত শুনে যার মনে রসের পরিবর্তে রাগের জন্ম হয়, তার কাছে রাগ করেও রাগসঙ্গীতের কথা বলাটা বিপজ্জনক হবে।
সৌন্দর্যবোধের সূত্রে শিল্পের সৃষ্টি এবং গ্রহণ, উভয় ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটা প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতা গড়ে উঠবে বিশেষ ধরনের মাধ্যমের দ্বারা সৃষ্ট সৌন্দর্যের প্রকৃতি অনুসারে। যেমন রাগসঙ্গীত একটি মাধ্যম। রাগের মাধ্যমে সৌন্দর্য সৃষ্টির অভিজ্ঞতা যেমন শিল্পীর থাকা দরকার তেমনি শ্রোতারও থাকা দরকার। মূলত সৌন্দর্য গ্রহণের গুণ এবং অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় সৌন্দর্য-পিপাসু মন। এই মনের অধিকর্তা 'আমি'। তাই 'আমি'-ই হলো মূল রসিক। আমি'র ভাণ্ডারে থাকে নানা ধরনের আনন্দের অনুভূতি। আবার নানা ধরনের আনন্দের দ্বারা সৃষ্ট নানা ধরনে সৌন্দর্যের স্মৃতিও আমি স্মরণ করতে পারে। মনের দ্বিতীয় স্তরে শিল্পের সোন্দর্যবোধের অবস্থান। মনের গভীরে তার রূপ ঘুমিয়ে থাকে। যখনই 'আমি' কোনো সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়ায়, মনের ভিতরের সেই বোধ জাগ্রত হয়। মনের গভীরে ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো নতুন সৌন্দর্যের সংস্পর্শে সে জেগে ওঠে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়কের সাথে দ্রুত ভাব বিনিময় হয়।১.২. নিবিড় নৈকট্য: সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং গ্রহণের জন্য শিল্পী এবং ভোক্তা, উভয়েরই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকাটা জরুরি। শিল্পী যদি নিজে সৌন্দর্যকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন এবং ওই অনুভব অনুসারে যথাযথ সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে তাঁর নিবিড় নৈকট্য ঘটে নি। যাচ্ছে-তাইভাবে সৌন্দর্য উপস্থাপন করাটা শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক। একইভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে শিল্পকে গ্রহণ করাটা উচিত নয়। বরং এটা অনেক সময় অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়। সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যায়, সঙ্গীতানুষ্ঠান চলাকালে নিজেদের ভিতর অন্য বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এটি শিল্পীকে অপমান করার পর্যায়ের অপরাধ। এই জাতীয় শ্রোতারা সারাজীবনে অসংখ্য আসরে বসেও সঙ্গীতের সৌন্দর্য গ্রহণ করতে পারেন না। এঁরা মূলত নিজেকে সঙ্গীতবোদ্ধা বা সঙ্গীতরসিক হিসেবে জাহির করার জন্য আসরে আসেন। এটা তাদের একটি অহঙ্কারের বিষয় হয়ে ওঠে এই ভাবে 'আমিও ওই আসরে ছিলাম।'
১.৩. কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসন: অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো বিষয়ের সাথে বাস্তব কোনো বিষয়ের নিকট সম্পর্ক থাকে। শিল্পের প্রয়োজনে শিল্পী বাস্তবতাকে অনেক সময় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কাহিনি ফুটিয়ে তুলবার জন্য নাট্যকার নানারকম সংলাপ ব্যবহার করেন। বাস্তবে ঐতিহাসিক চরিত্রটি হয়তো ওইভাবে কথা বলতেন না। এক্ষেত্রে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংলাপ রচিত হয়েছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। ঐতিহাসিক নাটকের পোশাক, আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে সততটা থাকা দরকার, কিন্তু সংলাপ, সঙ্গীত অঙ্গভঙ্গী ইত্যাদির ভিতরে বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়াটা সৌন্দর্য আস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। এক্ষেত্রে বাস্তবে সত্য আর শিল্পের সত্য একটি বিন্দুতে মিলিত হয় বটে, কিন্তু কোথাও কোথাও বাস্তব সত্যকে শিল্পের সত্য অতিক্রম করে যায়। আর এই অতিক্রমের দ্বারাই মনের দ্বিতীয় স্তরে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। এই সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য নাট্য পরিচালক আলো, শব্দ ব্যাবহার করেন নানা ভাবে। মঞ্চকেও ব্যবহার করেন নান্দনিক অনুভূতি থেকে। নাটকের সৌন্দর্যকে দর্শকের মাঝে ফুটিয়ে তোলার জন্য এগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সংলাপের দ্বারা যে সৃষ্টি হয় সৃষ্টি হবে, একটি বাঁশি বা বেহালার সুর তাকে আরও তীব্রতর করে থাকে। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি মঞ্চে দেখানো হয়। বাস্তবতা অনুসরণ করে, মঞ্চে গিয়ে বৃষ্টির ফোটা খোঁজাটা বোকামি। বাস্তবের অনুভূতি প্রদানের ভিতরই রয়েছে শিল্পের সৌন্দর্য সৃষ্টির সার্থকতা। আবার শিল্পের নামে যথেচ্ছাচারও চলে না। যার জন্য যতটুকু, তাতে ততটুকু সৌন্দর্যই মেশাতে হয়। কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজন পরিমিতি বোধ। এই সংমিশ্রণে থামতে জানতে হয়। গল্পের গরু গাছে ওঠে রূপকথায়। সেখানে মানায়, কিন্তু শরৎচন্দ্রের মহেষ নামক গল্পের গরুকে গাছে চড়ালে, নাট্যকার নিজেই নাট্যগুরু না হয়ে নাট্যগরু হয়ে যাবেন।
১.৪. সামঞ্জস্য: সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য শিল্পের ছোটো আনন্দকে সুসমন্বিত করা প্রয়োজন। কোনো কোনো অভিব্যক্তি একাধিক সৌন্দর্যরূপকে জাগ্রত করে থাকে। চোখের জল কান্নার প্রতীক আবার তীব্র আনন্দেরও প্রতীক। শুধু চোখের জল ফেললেই হয় না, সাথে মুখভঙ্গী, সামঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গী না থাকলে, অভিনয়টাই নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ রয়েছে পাগলের হাসি আর রসিকের হাসি, বেদনার আহ্ আর শীৎকারের আহ্, গোগ্রাসে খাওয়া আর শান্ত হয়ে খাওয়া ইত্যদির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকা শিল্প সৃষ্টির জন্য জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, কণ্ঠসঙ্গীতের সাথে উৎকট সঙ্গীতযন্ত্রের ব্যবহার। বাদ্যযন্ত্রের যথাযথ ব্যবহারে সঙ্গীতের সৌন্দর্যকে উজ্জীবিত করে, নইলে যন্ত্রের যন্ত্রণা বাড়ে। শিল্পী একই সাথে স্রষ্টা এবং ভোক্তা। তাই তাকে শুধু সৃষ্টির কথা ভাবলে হয় না, ভোগের কথাও ভাবতে হয়। নইলে সৃষ্টিতে ভেজাল ঢুকে পড়ে।