অগ্নি-বীণা
কাজীনজরুল ইসলাম

মোহরম
নীল সিয়া আশমান, লালে লাল দুনিয়া –
‘আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।’
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁশু আনে সিমারেরও ছোরাতে!
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্‌কে –
‘জয়নালে পরাল এ খুনিয়ারা বেশ কে?’
‘হায় হায় হোসেনা’, ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের ও পঞ্জায়!
উন্মাদ দুলদুল ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়!
মা ফাতেমা আশমানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস!
রণে যায় কাসিম ওই দু-ঘড়ির নওশা;
মেহেদির রংটুকু মুছে গেল সহসা!
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পুরবি ও দখিনা
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেলো সকিনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান খান খুন হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর!
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি, মা!’
নিয়ে তৃষা সাহারার দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তব শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশমনও ‘সাব্বাস’।
দ্রিম দ্রিম বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’।
কলিজা কাবাব-সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জুর।
মা-র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়পায়!
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়টায়?
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু –‘পানি দাও, মরে জাদু আসগর !
পেল না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, – ‘পানি দেব ফিরে আয় বাছা শুন্!’

পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে!
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
‘দাদা! তেরি ঘর কিয়া বরবাদ পয়মাল ।’
হাইদরি হাঁক হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার
শমশের চমকায় দুশমনে ত্রাসবার !
খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার।
নিঃশেষ দুশমন; ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতে নীরে নেমে মোছে আঁখি-প্রান্ত?
কোথা বাবা আসগর! শোকে বুক ঝাঁঝরা,
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে মল আহা, তবু পানি এক কাৎরা
দেয়নি রে বাছাদের মুখে কমজাতরা !
অঞ্জলি হতে পানি পড়ে গেল ঝরঝর,
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জর!
হলকুমে হানে তেগ ও কে বসে ছাতিতে? –
আফতাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে।
আশমান ভরে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে!
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহাণ-হাতে, আহ্
আরশের পায়া ধরে কাঁদে মাতা ফাতেমা,
‘এ্যয় খোদা, বদলাতে বেটাদের রক্তের
মার্জনা কর গোনা পাপী কম্‌বখতের !’
কত মোহর্‌রম এল, গেল চলে বহু কাল –
ভুলিনি গো আজও সেই শহিদের লোহু লাল!
মুসলিম! তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদিন’,
‘ওয়া হোসেনা – ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহর্‌রম মাহিনা –
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া -ক্রন্দন চাহি না।
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ আরবির,
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির; –
তবে শোনো ওই শোনো বাজে কোথা দামামা,
শমশের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য,
‘হুঁশিয়ার ইসলাম, ডুবে তব সূর্য!
জাগো, ওঠো মুসলিম, হাঁকো হায়দরি হাঁক,
শহিদের দিনে সব লালে-লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তিন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন!’
হাসানের মতো পিব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের ;
আসগর সম দিব বাচ্চারে কোরবান,
জালিমের দাদ নেব, দেব আজ গোর জান!
সকিনার শ্বেতবাস দেব মাতা-কন্যায়,
কাসিমের মতো দেব জান্ রুধি অন্যায়!
মোহর্‌রম! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’
দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!
দুনিয়াতে দুর্মদ খুনিয়ারা ইসলাম!
লোহু লাও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম!  

রচনা ও প্রকাশকাল:
মোসলেম ভারত পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৭ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ধূমকেতু প্রথমবর্ষ।  সপ্তম সংখ্যায় [১২ ভাদ্র  ১৩২৯, মঙ্গলবার ২৯ আগষ্ট ১৯২২] কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।