আনন্দময়ীর আগমনে

আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ ভারত আজ কসাইখানা,_আসবি কখন সর্বনাশী?
দেব-সেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,
রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে?

বিষ্ণু নিজে বন্দি আজি ছয়-বছরি ফন্দি-কারায়,
চক্র তাহার চরকা বুঝি ভণ্ড-হাতে শক্তি হারায় !
মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে,
অরবিন্দ চিত্ত তাহার ফুটবে কখন কে সে জানে!

সদ্য অসুর-গ্রাসচ্যূত ব্রহ্মা-চিত্তরঞ্জনে, হায়,
কমগুলুর শান্তি-বারি সিঞ্চি যেন চাদ নদীয়ায়।
শান্তি শুনে তিক্ত এমন কাঁদছে আরো ক্ষিপ্ত রবে,
মরার দেশের মড়া-শান্তি সে তো আছেই, কাজ কি তবে?
শান্তি কোথায়? শান্তি কোথায় কেউ জানি না
মাগো তোর এ দনুজ-দলন সংহারিণী মূর্তি বিনা!

দেব্তারা আর জ্যোতিহারা, ধ্রুব তাঁদের যায় না জানা,
কেউ বা দেব-অন্ধ মাগো, কেউ বা ভয়ে দিনে কানা।
সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেন দানব-রাজার অত্যাচারে,
দত্ত তাঁহার দম্ভোলি ভীম বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজারে।
রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে,
সে কর শুধু পশল না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।
গগন-পথে রবি-রথের সাত সারথি হাকায় ঘোড়া,
মর্তে দানব মানব-পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া।

বারি-ইন্দ্র বরুণ আজি করুণ সুরে বংশী বাজায়,
বুড়িগঙ্গার পুলিন বুকে বাঁধছে-ঘাঁটি দস্যু-রাজায়।
পুরুষগুলোর ঝুঁটি ধরে বুরুশ করায় দানব-জুতো,
মুখে ভজে আল্লা হরি, পূজে কিন্তু ডাণ্ডা-গুঁতো।
দাড়ি নাড়ে, ফতোয়া ঝাড়ে, মসজিদে যায় নামাজ পড়ে,
নাইকো খেয়াল গোলামগুলোর হারাম এ-সব বন্দি-গড়ে।

'লানত' গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলুমবাজে,
ধর্ম-ধবজা উড়ায় দাড়ি, 'গলিজ' মুখে কোরান ভাঁজে।
তাজ-হারা যার নাঙ্গা শিরে গরমাগরম পড়ছে জুতি,
ধর্ম-কথা বলছে তারাই, পড়ছে তারাই কেতাব-পুথি।
উৎপীড়কে প্রণাম করে শেষে ভগবানে নমি,
হিজড়ে ভীরুর ধর্ম-কথার ভণ্ডামিতে আসছে বমি।
টিকটিকির ঐ লেজুড় সম দিগ্বিদিকে উড়ছে টিকি,
দেব্তার আগে পূজে দানব, তাদের কাছে সত্য শিখি !
পুরুষ ছেলে দেশের নামে চুগলি খেলে ভরায় উদর,
টিকটিকি হয়, বিষ্ঠা কি নাই- ছি ছি এদের খাদ্য ক্ষুধার।
আজ দানবের রঙমহলে তেত্রিশ কোটি খোজা গোলাম
লাথি খায় আর চ্যাঁচায় শুধু, 'দোহাই হুজুর, মলাম মলাম।'

মাদিগুলোর আদি দোষ এ অহিংসা-বোল নাকি-নাকি,
খাঁড়ায় কেটে কর্‌ মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি !
হান্‌ তরবার, আন্‌ মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদিগুলোয় কর্ মা পুরুষ, রক্ত দে মা, রক্ত দেখা!
লক্ষ্মী-সরস্বতীকে তোর আয় মা রেখে কমল-বনে,
বুদ্ধিবুড়ো সিদ্ধাদাতা গণেশ-টনেশ চাই না রণে।
ঘোমটা-পরা কলা বৌ-এর গলা ধরে দাও করে দূর,
ঐ বুঝি দেব-সেনাপতি, ময়ুর-চড়া জামাই ঠাকুর?
দূর করে দে, দূর করে দে এ সব বালাই সর্বনাশী,
চাই নাকো ঐ ভাং-খাওয়া শিব, নেক দিয়ে তায় গঙ্গামাসি !
তুই একা আয় পাগ্‌লি বেটি তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে,
রক্ত তৃষায় 'ম্যয় ভূখা হু-র কাদন-কেতন কণ্ঠে ধরে।
ম্যয় ভূখা হুঁ'র  রক্তক্ষেপী ছিন্নমস্তা আয় মা কালী,
গুরুর বাগে শিব-সেনা তোর হুস্কারে ঐ 'জয় আকালী!'

এখনো তোর মাটির গড়া মূন্ময়ী ঐ মূর্তি হেরি
দু'চোখ পুরে জল আসে মা. আর কতকাল করবি দেরি?
মহিষাসুর বধ করে তুই ভেবেছিলি রইবি সুখে,
পারিসনি তা, ত্রেতা যুগর টল্‌ল আসন রামের দুখে।

আর এলিনে রুদ্রাণী তুই, জানিনে কেউ ডাকল কি না,
রাজপুতনায় বাজল হঠাৎ 'ম্যয় ভূখা হুঁ'-র রক্তবীণা।
বৃথাই গেল সিরাজ, টিপু, মীর কাসিমের প্রাণ-বলিদান,
চণ্ডি! নিলি যোগমায়া-রূপ, বলল সবাই বিধির বিধান।

হঠাৎ কখন উঠল খেপে বিদ্রোহিণী ঝান্সি-রানি,
খ্যাপা মেয়ের অভিমানেও এলি নে তুই মা ভবানী।
এমনি করে ফাকি দিয়ে আর কতকাল নিবি পূজা?
পাষাণ বাপের পাষাণ মেয়ে, আয় মা এবার দশভূজা।

বছর বছর এ-অভিনয় অপমান তোর, পূজা নয় এ,
কি দিস্‌ আশিস কোটি ছেলের প্রণাম চুরির বিনিময়ে।
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস্‌, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা;
আয় পাষাণী, এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা!
দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল্‌ মা, ছেলের রক্ত মাগে মা দশভুজা।
সেইদিন হবে জননী তোর সত্যিকারের আগমনী,
বাজবে বোধন-বাজনা, সেদিন গাইব নব জাগরণী।
'ম্যয় ভূখা হুঁ-মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী,
কৈলাস হতে গিরি-রানির মা-দুলালি কন্যা অয়ি!
                আয় উমা আনন্দময়ী !