অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী


    ভিক্ষা দাও

ভিক্ষা দাও! পুরবাসী, ভিক্ষা দাও! তোমাদের একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও!
    আমাদের এমন একটি ছেলে দাও, যে বলবে আমি ঘরের নই, আমি পরের। আমি আমার নই, আমি দেশের।
    ওগো তোমরা চেয়ে দেখো সর্বনাশা আমাদের বুকের উপর চেপে বসে আছে। কোটি কোটি লোক দুমুঠো ভাতের জন্য হা হা করে ছুটছে। ওগো এ দেখো কোটি কোটি ভাই আধপেটা খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের বুকে হাত দিয়ে দেখো সেখানে আর প্রাণ নাই, তোমাদের হৃদয়ে অনুভব করে দেখো সেখানে আর বল নাই। ওগো বলি চাই। বলি চাই। তোমাদের একটি ছেলে বলি চাই।
    ওগো সংসারী! কোথা যাও। তৃমি কি সুখ পেয়েছ? পদে পদে অভাব আর অধীনতায় আহত হয়ে তুমি এক মুহূর্তের জন্যেও শাস্তি পেয়েছ? ওগো! তৃমি তো শান্তি পাবে না। তুমি তো যুদ্ধে তোমার ছেলে দাও নাই। ওগো, ভিক্ষা দাও, একটি (সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও।
   ওগো পুজারী, কোথায় অর্ঘ্য দিতে চলেছ? বুকে বুকে দেবতার তপ্ত শ্বাস হু হু করে বয়ে যায়- তুমি কার কাছে ডালি নিয়ে যাও। ও কি নিয়ে যাচ্ছ তুমি! ফুল আর পাতায় তোমরা দেবতা কি তুষ্ট হবেন? বুকে তার তীব্র জ্বালা, চোখে তার হিংস্র বহি। ওগো, সে তো ফুল পাতা চায় না, সে চায় কাঁচাতাজা প্রাণ। ওগো, বলি দাও- বলিদাণ্ডা রে
    ওরে তরুণের দল। একবার ফিরে দাঁড়াও।
    কোথা যাও তোমরা অন্ধের মতো, কোথায় চলেছ তোমরা? ঐ যেন চাষীর শত শত রক্ত প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে তাদের দলিত করে কোনো উন্নতির দিকে ছুটে চলেছ? তোমার বুকের ভিতর যে দেবতা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠছে তার কণ্ঠরোধ করে কোনো মায়াবীপুরের দিকে চলৈছ? কান পেতে শোনো কাদের কান্নার ধ্বনি আকাশে পাতালে ধ্বনিত হচ্ছে। তোমরা কি তোমাদেরে অলস বাঁশি দূর করে দেবে না? চোখ মেলে দেখো, সব গেল। সব গেল। তিল তিল করে সব যে শেষ হয়ে গেল। ওগো তরুণের দল, তোমাদের ভিতর কি এমন লক্ষ্মীছাড়া কেউ নেই- যে বলে, আমি তিল তিল করে করে বাঁচব না। আমি ঘরের মায়ায় ভুলব না, ঘর আমার স্থান নয়, ঐ কাঁটাবন আমার ঘর, দুঃখ-দারিদ্র্য আমার সম্পত্তি, মৃ্ত্যু আমার পুরস্কার। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে এই ভীষণ আঁধারে নিজের বুকের আগুন জেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়? তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে বলতে পারে, আমি আছি, সব মরে গেলেও আমি বেঁচে আছি; যতক্ষণ আমার প্রাণে ক্ষীণ রক্তধারা বয়ে যাবে ততক্ষণ পর্যস্ত আমি তা দেশের জন্য পাত করব। ওগো তরুণ, ভিক্ষা দাও, তোমার কাঁচা প্রাণ ভিক্ষা দাও।
    ওরে তরুণের দল! একবার বুকে হাত দিয়ে বল্‌ দেখি একবারও কি এ নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়নি? একবারও কি এই জগদ্দল পাথর ঠেলে ফেলতে ইচ্ছা হয়নি? ওরে ওঠ, ওরে তোরা ওঠ, দূর করে দে জড়তা, ছিঁড়ে ফেলে দে বন্ধন। হৃদয় থেকে কোমলতা দূর করে দে। শয়তানের হিংসা নিয়ে শত্রুর পানে একবার ছুটে চল্‌। বিশ্বের গরল প্রাণে ঢেলে দে। তোরা বিশ্বময় বিষ ছড়িয়ে দে, সুখের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে যাক! অত্যাচার! অত্যাচার ঐ দেখো অত্যাচার তার ভীষণ মূর্তি ধরে রসেছে। ধনী তার ধন নিয়ে, বলবান তার লাঠি নিয়ে, কাজী আর পণ্ডিত তার শাস্ত্র দিয়ে মানুষকে হত্যা করবার কী ভীষণ চেষ্টা করছে। ঐ শোন্‌ তাদের তাণ্ডব চিৎকার। এ দেখ্‌ কি বিকট মূর্তি।
    কে আছ বীর, তার টুটি ধরে মারতে পারো। কে আছ, দুঃসাহসী, তার সহস্র ফণা নিয়ে খেলতে পারো। কে আছ নাস্তিক, কে আছ হিংসুক, কে আছ বিদ্রোহী, এসো! কে আছ তরুণ, কে আছ পাগল ভিক্ষা দাও, তোমার মাতাল প্রাণটি ভিক্ষা দাও।