অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
নজরুল ইসলাম, কাজী


       তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা

ভারতবর্ষ পত্রিকার ৭ম বর্ষ ১ম খণ্ডের ৩য়্ সংখ্যায় (ভাদ্র ১৩২৬), 'সঞ্চয়' বিভাগে হেমেন্দ্রকুমার রায় 'তুর্ক-মহিলার ঘোমটা-খোলা' নামক একটি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল [পৃষ্ঠা: ৪০৬-৪০৭]। এই রচনায় লেখক তৎকালীন আমেরিকান সংবাদপত্র  'New York Herald'-এ  লিখিত জনৈক লেখকের রচনা অনুসরণে তুর্কি-মহিলাদের সম্বন্ধে লেখেন- 'তুর্ক-রমণীরা মোটেই সুন্দরী নয়!' এই রচনার প্রতিবাদে নজরুল 'তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা' নামক এই প্রবন্ধটি রচনা করেন এবং তা সওগাত পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। সওগাত পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬ (অক্টোবর-নভেম্বর ১৯১৯) সংখ্যায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই ছিল পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের প্রথম প্রবন্ধ। 

 

            তুরক-মহিলার ঘোমটা-খোলা
গত ভাদ্র সংখ্যা "ভারতবর্ষে' সুলেখক হেমেন্দ্রবাবুর 'সঞ্চয়ে' 'তুর্ক মহিলার ঘোমটা. খোলা'
শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে বোধ হয় অনেকেই ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। ততোধিক মর্মাহত হয়েছেন
বোধ হয় আমাদের নতুন কবিভায়ারা। লেখাটা যে তাঁদের নাকের ডগায় মূর্তিমান
রসভঙ্গের মতো আবির্ভূত হয়ে তাণ্ডব নৃত্য করে গেছে! সেই 'মান্ধাতার আমলের -
পুরানো' এক মহাকবি-প্রসিদ্ধিতে এমন একটা প্রচণ্ড লাঠ্যাঘাত, কী সাংঘাতিক কথা!-
    তবে ও সম্বন্ধে এ গরিবের যৎকিঞ্চিৎ বক্তব্য আছে।

    প্রথম 'New York Herald' নামক আমেরিকান সংবাদপত্রের অচিন লেখকের তুর্কদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ভয়ানক একটা খটকা বেধে গেছে। আজকাল অনেক লেখক ঘরে বসেই দুনিয়ার যে-কোনো স্থানের ভ্রমণ-কাহিনী 'অসংকোচে লিখে থাকেন; এ একটি নিষ্করুণ সত্যি কথা। তাঁরা হয় বিখ্যাত ভ্রমণকারীর কাছ থেকে শুনে
নতুবা কোনো ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ে এবং তাতে কিছু ঘরের তেল-মসলা সংযোগ-করে আমাদের সামনে এনে হাজির করেন এবং আমরাও 'কৃতার্থ' হয়ে যাই। আমিও ঐ লেখা পড়েছি, তাতে তিনি যে তর্কদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ, তা কিছুতেই বোঝা যায় না। হতে পারে তিনি কিছুদিন বা খুব বেশিদিন সেখানে ছিলেন, কিন্তু তিনি- আমার যতদূর সম্ভব সাদা চোখে কিছুই দেখেন নি। 'সাহেব', তুর্কদের সম্বন্ধে অন্যান্য যে-সব বাজে বকেছেন, সেসম্বন্ধে কিছু না-বলে আমি কেবল তুর্ক মহিলার সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চারটি কথা বলে এই নীরস গদ্যের অবসান করব।

    পাশ্চাত্য প্রদেশে যে পৌরাণিক প্রবাদের মতো তুর্ক তরুণীর বিশ্ব-বিমোহিনী সৌন্দর্যের হয়ে আসছে, আর পাশ্চাত্য প্রদেশ কেন জগতের সমস্ত দেশের নৃতন-পুরাতন সকল কবি ও লেখকই যে পঞ্চমুখে তুর্ক রমণীর ভুবনে-অতুল সুষমার বর্ণা করে যাচ্ছেন, সব কি তাহলে বিলকুল মিথ্যা? তবে কি তারা কোনো কিছু না দেখে-শুনেই চক্ষু বুঁজে, শুধু কল্পনার নেশায় মনের চোখে বেচারি তুর্ক-তরুণীদের মূর্তি এঁকে তাদিগকে একেবারে হুরপরির সঙ্গে সমান আসন দিয়েছেন? এমন অনেক জগদ্বিখ্যাত কবি ও লেখক তুর্ক মহিলার রূপ বর্ণনা করতে করতে তন্ময় হয়ে গিয়েছেন, যাঁরা দস্তরমতো তৃর্ক দেশে ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁরা যে নেহাৎ কবিত্বপূ্র্ণ মোলায়েম ধরনে চক্ষু বুজে বেড়িয়ে বেড়াননি, এ বোধ হয় বিশ্বাস করা যেতে পারে। তাছাড়া তুর্কদের দেশ পাশ্চাত্য দেশেরই অন্তর্গত, আর তা নেহায়েত দূরও নয়, অথচ বাবা আদমের কাল হতে আজ পর্যন্ত তুর্ক রমণীদের মুখচন্দ্র কেউ দেখেননি?  এবং খামাখা ঘরের খেয়ে বেচারিদের রূপ বর্ণনায় মুখে ফেনা উঠিয়েছেন? আর ঐর আমেরিকান সারা দুনিয়ার চোখের উপরকার একটা মস্ত পর্দা ফাক করে ধরলেন? লেখকের কেরদানি'কে বাহাদুরি দিতে হয় কিন্তু। আর হেমেন্দ্রবাবুও সানাইয়ের পোঁ ধরার মতো তাঁর দগ্ধ অদৃষ্টকে ধিকার দিয়েছেন যে হুরপরি দেখা আর তাঁর ভাগ্যে ঘটল না। তাই দুধের সাধ ঘোলে মিটানোর মাতো গানে-গল্পে, কবিতায় প্রসিদ্ধ! হুরপরি নামে আখ্যাতা তুর্ক রমণীর রূপ-মাধূর্য শুনেই কোনো রকমে নিজের 'আকুল পিয়াসা' দমন করে রেখেছিলেন,_এমন্‌ সময় 'দিলেন পিতা পদাঘাত এক পৃষ্ঠের' মতো সশরীরে আমেরিকান লেখক মসায় মৃত্তিকা ভেদ করে উঠে একেবারে 'চিচিং ফাক" করে দিলেন বা মাঝ মাঠে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। আসল তুর্ক রমণীরা (দো-আঁশলা নয় অবশ্য।) বাস্তবিকই হুরপরির চেয়েও সুন্দরী। ও বিষয়ে আমার মতো অধমাধমের অদৃষ্ট দগ্ধ না হয়ে খুব স্নিগ্ধ বলতে হবে; কারণ আমি আমার এই চর্মচক্ষে বাস্তব জগতে যে.কয়জন তুর্ক রমণীকে দেখবার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তাযর অন্তত-একজন এবং-সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্টকে বাংলার স্টেজে হাজির করতে.পারলে অনেকেরই মূর্চ্ছা ও পতন' হতো এবং মাথা খারাপ হয়ে যেত, এ আমি 'হলফ করে বলতে পারি। দুনিয়ার সকল জাতির রমণী (বিশেষত যাঁরা সৌন্দর্যের জন্য বিশ্ব-বিশ্রুত, উদাহরণস্বরূপ - পার্শি, ইরানি, ইহুদি, আরবি প্রভৃতি) দু-দশজন করে আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে দেখবার সুযোগ পেয়েছি এবং তা স্বপ্রে নয়, দিবালোকে, কল্পনায় নয় বহাল খোশ-তবিয়তে, আর প্রাণপণে চক্ষু বিস্ফারিত করে। কিন্তু কই তুর্ক মহিলার মতো এমন ভুবন-ভুলানো রূপ, সৌন্দর্য তো আর পোড়া চোখে পড়ল না। তবে হতে পারে, হয়তো ঐ তরুণীদের রূপাগ্নি আমার চোখ ঝলসে দিয়েছে, আই আর দুনিয়ার কোথাও সুন্দরী দেখতে পাই না।

    হেমেন্দ্রবাবু পরের মুখে ঝাল খেয়ে একেবারে লম্ফঝম্প দিয়ে বলে ফেলেছেন, 'তুর্ক রমণীরা মোটেই সুন্দরী নায়।' কেননা একজন সাহেব বলে ফেলেছেন যখন, তখন তা বেদবাক্য। একটু রসিকতার লোভে তাঁর মতো লোকের পক্ষে একজন খামখেয়ালি লেখকের ছেঁদো কথায় সায় দেওয়া উচিত ছিল না। সাহেবের সুরারাগরঞ্জিত নয়নে ওঁদেরই স্বজাতির মতো 'ওল ছিলা' চেহারা হলেই বোধ হয় বেশ সুন্দরীটি হতো। তবে এর সর্বশেষ প্রমাণ পেতে হলে আমাদের দুইজনকেই আবার 'আস্তানা, পর্যন্ত ছুটতে হয়, সেও তো এক সাংঘাতিক ব্যাপার। হেমেন্দ্রবাবু ইচ্ছা করলে অন্তত সিরাজী সাহেবের কাছেও এ সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ জানতে পারতেন।

    পিকিং হতে আমদানি বেঢপ মুখ, হাবশির দেশ হতে রপ্তানি বিটকেল কুচকুচে মুখ, সিভ্যন্টিয়ান বা 'স্ক্যান্ডিনেভিয়ান' দেশের চ্যাপ্টা বেখাপ্পা মুখ ইত্যাদি যেসব পাঁচমিশেলি মুখ সাহেব-পুঙ্গব তুর্কিদের মাঝে দেখেছেন, তাই নিয়ে যদি তুর্ক তরুণীর সুষমা সম্বন্ধে ঐরকম বীভৎস মত পোষণ করেন, তাহলে আমাদের বলবার কিছুই নাই। তাহলে সাহেবেরই জয়! তাছাড়া লেখক জানেন এবং স্বীকারও করেছেন, “তুর্কিরা নানা দেশ হতে নানা জাতের বন্দিনী জোগাড় করে আনত, আর তাদেরই সঙ্গে অবাধ রক্ত-মিশ্রণের ফলে এই অসংখ্য ও বিচিত্র মুখাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব সকলেই পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে শুধু এই গজঘণ্ট, রঙ-বেরঙের মুখ আদৌ তুর্কির নয়, ওসব হচ্ছে বাঁদিদের মিশ্র মুখ। ঐসব পাঁচমিশেলি মুখই বোধ হয় ঘোমটা খুলে বাইরে বেরিয়ে সাহেবের মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে।

    তুর্কিরা আধুনিক পাশ্চাত্য কায়দা-কানুনে 'কেতাদুরস্ত হলেও এখনও তাদের মেয়েরা পথে ঘোমটা খুলে বেরোয়নি, আর বেরুলেও এমন সাধারণ জায়গায় বেরোয়নি, যাতে তাদের, স্বর্গীয় সুষমা-মাধুরী সাহেবের বিড়াল-নয়ন সার্থক্‌ করে দিয়েছিল। সম্ভ্রান্ত আসল তৃর্কি মহিলারা হাজার শিক্ষিতা হলেও এখনও রীতিমতো বোরকা দিয়ে পথে বের হন। কাজেই অন্যান্য দেশের মতো 'ঘো্মটার আড়ালে খেমটারনাচ” দেখা লেখকের আর পোড়া কপালে জোটেনি।

    এইসব খামখেয়ালি লেখকের কাণ্ড দেখে আমি নির্ভয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে. পারি যে, সেই সাহেব যদি বাংলায় আসেন, তাহলে দেশে ফিরে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার নমুনা স্বরূপ আমাদের কুললক্ষ্মীদের রূপ বর্ণনা নিম্নলিখিতরূপে করবেন-_
    “বাঙালি মেয়েগুলো বিশ্রী কালো, তদুপরি তৈলচি্ক্বণ হওয়ায় বোধহয় যেন আবলুস কাঠে ফ্রেঞ্চ পালিশ বুলানো হয়েছে। এই জাতীয় স্ত্রীলোক পাড়াগাঁয়ে থাকে। (বাগদিদের মেয়ে দেখে সাহেব আমাদের বনফুলের মতো সুন্দরী কুলবধূদের সম্বন্ধে এই রকম সাংঘাতিক ধারণায় উপনীত হবেন।) তারপর শহুরে তাবৎ স্ত্রীলোকই খুব বেশি রকমের স্থূলাঙ্গিনী, দেহের অনুপাতে উদর ঢক্‌কা-সম ভীষণ প্রশস্ত, পরিধানে কম-সে কম দুই তিন থান কাপড়, অঙ্গে খুব ভারি ভারি অলঙ্কার, মুখটি চন্দ্রের মতো নয়ই- তবে অনেকটা মালসার মতো । মাড়োয়ারি মেয়েদের দেখে একথাই লিখবে সাহেব, কারণ তারাই বেশির ভাগ বাইরে বেরিয়ে রাস্তার ধুলো উড়োতে উড়োতে কাঁইয়ো মাইয়ো করে যায়। সাহেবের এ বর্ণনা ডাহা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া চলবে না, আর তাই পড়ে আমাদের সুন্দরী তরুণীরা হাত-পা কামড়িয়ে মরবেন।
    উপসংহারে আমার বক্তব্য এই যে, যদি কখনও আমার নসিবে হুরপরি দেখা থাকে তবে তারা কখনও তুর্কি যুবতীর চেয়ে সুন্দরী হবেন না, এ-বিষয়ে আমি স্থির সিদ্ধান্ত হয়ে বসে আছি। এমন ডাঁশা আঙুর-আর পাকা ডালিমের মতো মিশানো লাবণ্য, আর আয়নার মতো স্বচ্ছ তরল সৌন্দর্য বোধ হয় বেহেম্তেও দুশ্রাপ্য। রমণী বিশ্বে সৌন্দর্যের সার যে কত বেশি সুন্দরী হতে পারে, তা তুর্কি তরুণী না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। আমি যদি কবি হতুম, তাহলে আমিও আমার সোনার বীণার তারে ঘা দিযে আকুল কণ্ঠে গেয়ে উঠতাম
        আগার ফেরদৌস বর রুয়ে জামিন আস্ত।
        হামিনাত্ত-ও হামিনাস্ত-ও হামিনাস্ত॥