বিষের বাঁশী
কাজী নজরুল ইসলাম

জাগৃহি
[তোটক ছন্দ]

‘হর         হর হর শংকর হর হর ব্যোম’ –
একি        ঘন রণ-রোল ছায়া চরাচর ব্যোম!
হানে        ক্ষিপ্ত মহেশ্বর রুদ্র পিনাক,
ঘন          প্রণব-নিনাদ হাঁকে ভৈরব-হাঁক
ধু ধু         দাউ দাউ জ্বলে কোটি নর-মেধ-যাগ,
হানে        কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ!
আজ        ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য-পাগল,
           ভাঙল আগল ওরে ভাঙল আগল!
বোলে       অম্বুদ-ডম্বুর কম্বু বিষাণ,
নাচে         থই-তাতা থই-তাতা পাগলা ঈশান!
দোলে       হিন্দোলে ভীম-তালে সৃষ্টি ধাতার,
বুকে         বিশ্বপাতার বহে রক্ত-পাথার!
ঘোর         নির্ঘোষে ‘মার মার’ দৈত্য, অসুর,
প্রেত,        রক্ত-পিশাচ, রণ-দুর্মদ সুর।
করে         ক্রন্দসী-ক্রন্দন অম্বর রোধ –
ত্রাহি         ত্রাহি মহেশ হে সম্বরো ক্রোধ!
সুত          মৃত্যু-কাতর, হাহা অট্টহাসি
হাসে         চণ্ডী চামুণ্ডা মা সর্বনাশী।
কাল-        বৈশাখী ঝঞ্ঝারে সঙ্গে করি –
রণ-          উন্মাদিনী নাচে রঙ্গে মরি!
উর-          হার দোলে নরমুণ্ড-মালা,
করে         খড়্গ ভয়াল, আঁখে বহ্নি-জ্বালা!
নিয়া         রক্তপানের কী অগস্ত্য-তৃষা নাচে
ছিন্ন          সে মস্তা মা, নাইকো দিশা!
‘দে          রে রক্ত দে রক্ত দে’ রণে ক্রন্দন,
বুঝি         থেমে যায় সৃষ্টির হৃৎ-স্পন্দন!
জ্বলে        বৈশ্বানরের ধু ধু লক্ষ শিখা,
আজ        বিষ্ণু-ভালে লাল রক্ত-টিকা!
শুধু          অগ্নি-শিখা ধু ধু অগ্নি-শিখা,
শোভে      করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা!
রণ-         শ্রান্ত অসুর-সুর-যোদ্ধৃ-সেনা,
শুধু          রক্ত-পাথার, শুধু রক্ত-ফেনা!
একি        বিশ্ব-বিধ্বংস নৃশংস খেলা,
কিছু         নাই কিছু নাই প্রেত-পিশাচে মেলা।
আজ        ঘরে ঘরে জ্বলে ধু ধু শ্মশান মশান –
হোক       রোষ অবসান, ত্রাহি ত্রাহি ভগবান!
আজি       বন্ধ সবার পূতি-গন্ধে নিশাস,
বিষে        বিশ্ব-নিসাড়, বহে জোর নাভিশ্বাস!
দেহ         ক্ষান্ত রণে, ফেলো রঙ্গিণী বেশ,
খোলো     রক্তাম্বর মাতা সম্বরো কেশ!
এ তো      নয় মাতা রক্তোন্মত্তা ভীমা!
আজ        জাগৃহি মা, আজ জাগৃহি মা।
তব         চরণাবলুণ্ঠিত মহিষ-অসুর,
হলো       ধ্বংস অসুর, লীন শক্তি পশুর।
তবে        সম্বরো রণ, হোক ক্ষান্ত রোদন–
হোক       সত্য-বোধন আজ মুক্তি-বোধন!
এসো       শুদ্ধা মাতা এই কাল-শ্মশানে
আজ        প্রলয়-শেষে এই রণাবসানে!
জাগো      জাগো মানব-মাতা দেবী নারী!
আনো      হৈম ঝারি, আনো শান্তি-বারি!
এসো       কৈলাস হতে মা গো মানস-সরে,
নীল         উৎপল-দলে রাঙা আঁচল-ভরে।
এসো       কন্যা উমা, এসো গৌরী রূপে,–
বাজো      শঙ্খ শুভ, জ্বালো গন্ধ ধূপে!
আজ        মুক্ত-বেণি মেয়ে একাকী চলে,
ওই         শেফালি-তলে হেরো শেফালি-তলে।
ওড়ে        এলোমেলো অঞ্চল আশ্বিন-বায়,
হানে        চঞ্চল নীল চাওয়া আকাশের গায়!
ঘোষে       হিমালয় তার মহা হর্ষ-বাণী, –
এল         হৈমবতী, এল গৌরী রানি।
বাজো      মঙ্গল শাঁখ, হোক শুভ-আরতি,
এল         লক্ষ্মী-কমলা, এল বাণী-ভারতী।
এল         সুন্দর সৈনিক সুর কার্তিক,
এল         সিদ্ধি-দাতা, হেরো হাসে চারিদিক!
ভরা        ফুল-খুকি ফুল-হাসি শিউলির তল,
আজ        চোখে আসে জল, শুধু চোখে আসে জল!
নিয়া         মাতৃ-হিয়া নিয়া কল্যাণী-রূপ
এল         শক্তি স্বাহা, বাজো শাঁখ, জ্বালো ধূপ!
ভাঁজো     মোহিনী সানাই, বাজো আগমনি-সুর,
বড়ো       কেঁদে ওঠে আজ হিয়া মাতৃ-বিধুর।
ওঠে        কণ্ঠ ছাপি বাণী সত্য পরম –
বন্-         দে মাতরম্। বন্‌দে মাতরম্!


রচনা ও প্রকাশকাল:
ধূমকেতু  পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা (৩০ শ্রাবণ ১৩২৯, মঙ্গলবার ১৫ আগষ্ট ১৯২২) প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল- 'জাগরণী'। বিষের বাঁশী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল 'জাগৃহি' শিরোনামে।