ভাঙার গান
কাজীনজরুল ইসলাম

                                পূর্ণ-অভিনন্দন
                                         [গান]

এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ!
ভেদ করি পুন বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ!
এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম!
এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
ছয়বার জয় করি কারা-ব্যুহ, রাজ-রাহু-গ্রাস-মুক্ত চাঁদ!
আসিলে চরণে দুলায়ে সাগর নয়-বছরের মুক্ত-বাঁধ!
নবগ্রহ ছিঁড়ি ফণি-মনসার মুকুটে তোমার গাঁথিলে হার,
উদিলে দশম মহাজ্যোতিষ্ক ভেদিয়া গভীর অন্ধকার!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
স্বাগত শুদ্ধ রুদ্ধ-প্রতাপ, প্রবুদ্ধ নব মহাবলী!
দনুজ-দমন দধীচি-অস্থি, বহ্নিগর্ভ দম্ভোলি!
স্বাগত সিংহ-বাহিনী-কুমার! স্বাগত হে দেব-সেনাপতি!
অনাগত রণ-কুরুক্ষেত্রে সারথি-পার্থ-মহারথী!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
নৃশংস রাজ-কংস-বংশে হানিতে তোমরা ধ্বংস-মার
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র, ভাঙিয়া পাষাণ-দৈত্যাগার!
এস অশান্তি-অগ্নিকাণ্ডে শান্তিসেনার কাণ্ডারি!
নারায়ণী-সেনা-সেনাধিপ, এস প্রতাপের হারা- তরবারি!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!
না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।
জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
স্বর্গ হইতে জননী তোমার পেতেছেন নামি মাটিতে কোল,
শ্যামল শস্যে হরিৎ ধান্যে বিছানো তাঁহারই শ্যাম আঁচল।
তাঁহারি স্নেহের করুণ গন্ধ নবান্নে ভরি উঠিছে ঐ,
নদীস্রোত-স্বরে কাঁদিছেন মাতা, 'কই রে আমার দুলাল কই?'
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
মোছো আঁখি-জল, এস বীর! আজ খুঁজে নিতে হবে আপন মায়,
হারানো মায়ের স্মৃতি-ছাই আছে এই মাটিতেই মিশিয়া,হায়!
তেত্রিশ কোটি ছেলের রক্তে মিশেছে মায়ের ভস্ম-শেষ,
ইহাদেরি মাঝে কাঁদিছেন মাতা, তাই আমাদের মা স্বদেশ।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর!
 
এস বীর! এস যুগ-সেনাপতি! সেনাদল তব চায় হুকুম,
হাঁকিছে প্রলয়, কাঁপিছে ধরণী, উদ্‌গারে গিরি অগ্নি-ধূম।
পরাধীন এই তেত্রিশ কোটি বন্দির আঁখি-জলে হে বীর,
বন্দিনী মাতা যাচিছে শক্তি তোমার অভয় তরবারির।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!  
 
গল-শৃঙ্খল টুটেনি আজিও, করিতে পারি না প্রণাম পা'য়,
রুদ্ধ কণ্ঠে ফরিয়াদ শুধু গুমরিয়া মরে গুরু ব্যথায়।
জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম,
শত্রু-খড়্‌গ-ছিন্ন-মুণ্ড দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!

* মাদারীপুর শান্তি-সেনা-বাহিনীর প্রধান শ্রীযুক্ত  পূর্ণচন্দ্র মহাশয়ের কারামুক্তি উপলক্ষে রচিত।


রচনা ও প্রকাশকাল:
গানটির নিচে লেখা আছে- 'মাদারীপুর শান্তি-সেনা বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাশ-এর কারামুক্তি উপলক্ষে রচিত'। উল্লেখ্য,  ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে (মতান্তরে নভেম্বর) বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস কারামুক্ত হন। এই সময় নজরুল বহরমপুরে জেলে ছিলেন পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তির পর জেলে বসে নজরুল এই গানটি রচনা করেছিলেন। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে (আগষ্ট ১৯২৪) 'ভাঙার গান' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।