ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
 

কথা ও কাহিনী
 


       শেষ শিক্ষা
একদিন শিখগুরু গোবিন্দ নির্জনে
একাকী ভাবিতেছিলা আপনার মনে
আপন জীবনকথা ; সে সংকল্পলেখা
অখণ্ড সম্পূর্ণরূপে দিয়েছিল দেখা
যৌবনের স্বর্ণপটে, যে আশা একদা
ভারত গ্রাসিয়াছিল, সে আজি শতধা,
সে আজি সংকীর্ণ শীর্ণ সংশয়সংকুল,
সে আজি সংকটমগ্ন । তবে একি ভুল !
তবে কি জীবন ব্যর্থ ! দারুণ দ্বিধায়
শ্রান্তদেহে ক্ষুব্ধচিত্তে আঁধার সন্ধ্যায়
গোবিন্দ ভাবিতেছিল ; হেনকালে এসে
পাঠান কহিল তাঁরে, ‘ যাব চলি দেশে,
ঘোড়া - যে কিনেছ তুমি দাও তার দাম ।'
কহিল গোবিন্দ গুরু, ‘ শেখজি, সেলাম,
মূল্য কালি পাবে, আজি ফিরে যাও ভাই ।'
পাঠান কহিল রোষে, ‘ মূল্য আজই চাই ।'
এত বলি জোর করি ধরি তাঁর হাত —
চোর বলি দিল গালি । শুনি অকস্মাৎ
গোবিন্দ বিজুলি - বেগে খুলি নিল অসি,
পলকে সে পাঠানের মুণ্ড গেল খসি ;
রক্তে ভেসে গেল ভূমি । হেরি নিজকাজ
মাথা নাড়ি কহে গুরু, ‘ বুঝিলাম আজ
আমার সময় গেছে । পাপ তরবার
লঙ্ঘন করিল আজি লক্ষ্য আপনার
নিরর্থক রক্তপাতে । এ বাহুর'পরে
বিশ্বাস ঘুচিয়া গেল চিরকালতরে ।
ধুয়ে মুছে যেতে হবে এ পাপ, এ লাজ —
আজ হতে জীবনের এই শেষ কাজ ।'
 

পুত্র ছিল পাঠানের বয়স নবীন,
গোবিন্দ লইল তারে ডাকি । রাত্রিদিন
পালিতে লাগিল তারে সন্তানের মতো
চোখে চোখে । শাস্ত্র আর শস্ত্রবিদ্যা যত
আপনি শিখালো তারে । ছেলেটির সাথে
বৃদ্ধ সেই বীরগুরু সন্ধ্যায় প্রভাতে
খেলিত ছেলের মতো । ভক্তগণ দেখি
গুরুরে কহিল আসি, ‘ একি প্রভু, একি !
আমাদের শঙ্কা লাগে । ব্যাঘ্রশাবকেরে
যত যত্ন কর, তার স্বভাব কি ফেরে ?
যখন সে বড়ো হবে তখন নখর,
গুরুদেব, মনে রেখো হবে সে প্রখর ।'
গুরু কহে, ‘ তাই চাই, বাঘের বাচ্ছারে
বাঘ না করিনু যদি কী শিখানু তারে ? '

বালক যুবক হল গোবিন্দের হাতে
দেখিতে দেখিতে । ছায়া - হেন ফিরে সাথে,
পুত্র-হেন করে তাঁর সেবা । ভালোবাসে
প্রাণের মতন — সদা জেগে থাকে পাশে
ডান হস্ত যেন । যুদ্ধে হয়ে গেছে গত
শিখগুরু গোবিন্দের পুত্র ছিল যত —
আজি তাঁর প্রৌঢ়কালে পাঠানতনয়
জুড়িয়া বসিল আসি শূন্য সে হৃদয়
গুরুজির । বাজে - পোড়া বটের কোটরে
বাহির হইতে বীজ পড়ি বায়ুভরে
বৃক্ষ হয়ে বেড়ে বেড়ে কবে ওঠে ঠেলি,
বৃদ্ধ বটে ঢেকে ফেলে ডালপালা মেলি ।

একদা পাঠান কহে নমি গুরু-পায়,
‘ শিক্ষা মোর সারা হল চরণকৃপায়,
এখন আদেশ পেলে নিজভুজবলে
উপার্জন করি গিয়া রাজসৈন্যদলে ।'
গোবিন্দ কহিলা তার পিঠে হাত রাখি,
‘ আছে তব পৌরুষের এক শিক্ষা বাকি ।'

পরদিন বেলা গেলে গোবিন্দ একাকী
বাহিরিলা ; পাঠানেরে কহিলেন ডাকি,
‘ অস্ত্র হাতে এসো মোর সাথে । ' ভক্তদল
‘ সঙ্গে যাব' ‘ সঙ্গে যাব' করে কোলাহল —
গুরু কন, ‘ যাও সবে ফিরে ।'

                        দুই জনে
কথা নাই ধীরগতি চলিলেন বনে
নদীতীরে । পাথর - ছড়ানো উপকূলে
বরষার জলধারা সহস্র আঙুলে
কেটে গেছে রক্তবর্ণ মাটি । সারি সারি
উঠেছে বিশাল শাল, তলায় তাহারি
ঠেলাঠেলি ভিড় করে শিশু তরুদল
আকাশের অংশ পেতে । নদী হাঁটুজল
ফটিকের মতো স্বচ্ছ, চলে এক ধারে
গেরুয়া বালির কিনারায় । নদীপারে
ইশারা করিল গুরু ; পাঠান দাঁড়ালো ।
নিবে-আসা দিবসের দগ্ধ রাঙা আলো
বাদুড়ের পাখা-সম দীর্ঘ ছায়া জুড়ি
পশ্চিমপ্রান্তর - পারে চলেছিল উড়ি
নিঃশব্দ আকাশে । গুরু কহিলা পাঠানে,
‘ মামুদ, হেথায় এসো, খোঁড়ো এইখানে ।'
উঠিল সে বালু খুঁড়ি একখণ্ড শিলা
অঙ্কিত লোহিত রাগে । গোবিন্দ কহিলা,
‘ পাষাণে এই যে রাঙা দাগ, এ তোমার
আপন বাপের রক্ত । এইখানে তার
মুণ্ড ফেলেছিনু কেটে, না শুধিয়া ঋণ,
না দিয়া সময় । আজি আসিয়াছে দিন,
রে পাঠান, পিতার সুপুত্র হও যদি
খোলো তরবার — পিতৃঘাতকেরে বধি
উষ্ণ রক্ত-উপহারে করিবে তর্পণ
তৃষাতুর প্রেতাত্মার । ' বাঘের মতন
হুংকারিয়া লম্ফ দিয়া রক্তনেত্রে বীর
পড়িল গুরুর'পরে ; গুরু রহে স্থির
কাঠের মূর্তির মতো । ফেলি অস্ত্রখান
তখনি চরণে তাঁর পড়িল পাঠান ।
কহিল, ‘ হে গুরুদেব, লয়ে শয়তানে
কোরো না এমনতরো খেলা । ধর্ম জানে
ভুলেছিনু পিতৃরক্তপাত ; একাধারে
পিতা গুরু বন্ধু বলে জেনেছি তোমারে
এতদিন । ছেয়ে থাক্‌ মনে সেই স্নেহ,
ঢাকা পড়ে হিংসা যাক মরে । প্রভু, দেহো
পদধূলি । ' এত বলি বনের বাহিরে
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল, না চাহিল ফিরে,
না থামিল একবার । দুটি বিন্দু জল
ভিজাইল গোবিন্দের নয়নযুগল ।

পাঠান সেদিন হতে থাকে দূরে দূরে ।
নিরালা শয়নঘরে জাগাতে গুরুরে
দেখা নাহি দেয় ভোরবেলা । গৃহদ্বারে
অস্ত্র হাতে নাহি থাকে রাতে । নদীপারে
গুরু-সাথে মৃগয়ায় নাহি যায় একা ।
নির্জনে ডাকিলে গুরু দেয় না সে দেখা ।
 

একদিন আরম্ভিল শতরঞ্জ খেলা
গোবিন্দ পাঠান-সাথে । শেষ হল বেলা
না জানিতে কেহ । হার মানি বারে বারে
মাতিছে মামুদ । সন্ধ্যা হয়, রাত্রি বাড়ে ।
সঙ্গীরা যে যার ঘরে চলে গেল ফিরে ।
ঝাঁ ঝাঁ করে রাতি । একমনে হেঁটশিরে
পাঠান ভাবিছে খেলা । কখন হঠাৎ
চতুরঙ্গ বল ছুঁড়ি করিল আঘাত
মামুদের শিরে গুরু ; কহে অট্টহাসি,
‘ পিতৃঘাতকের সাথে খেলা করে আসি
এমন যে কাপুরুষ, জয় হবে তার ! '
তখনি বিদ্যুৎ-হেন ছুরি খরধার
খাপ হতে খুলি লয়ে গোবিন্দের বুকে
পাঠান বিঁধিয়া দিল । গুরু হাসিমুখে
কহিলেন, ‘ এতদিনে হল তোর বোধ
কী করিয়া অন্যায়ের লয় প্রতিশোধ ।
শেষ শিক্ষা দিয়ে গেনু — আজি শেষবার
আশীর্বাদ করি তোরে হে পুত্র আমার ।'

 

কার্তিক ১৩০৬