কুকি
উত্তর-পূর্ব ভারত, উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এরা মোঙ্গোলীয় মহাজাতির একটি শাখা।

ধারণা করা হয়, চীনের ইয়ালোঙ (
Yalung ) নদীর তীরবর্তী শিনলুঙ বা ছিনকুঙসেন অঞ্চলে ভারতীয় মোঙ্গোলীয়দের আদিপুরুষেরা বসবাস করতো। চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরততা এবং সেই সূত্রে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে, খ্রিষ্টপূর্ব ২১০ অব্দের এই অঞ্চল থেকে বহু মানুষ মিয়ানমার ও তিব্বতের দিকে চলে আসে। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে এদের একটি দল চীন-মায়ানমার সীমান্তের শান অঞ্চলে (বর্তমানে শান মিয়ানমারের একটি প্রদেশ) এসে বসতি স্থাপন করেছিল। শান অঞ্চলের আদিবাসীরা এই নবাগতদের খুব ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের কারণে এদেরকে উৎখাতও করতে পারে নি। শান অঞ্চলে এরা প্রায় ৩০০ বৎসর বসবাস করে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে পরে এদের একটি শাখা ভারতের মণিপুর এবং মিয়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী কাবাও উপত্যাকায় চলে আসে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। এই সময় মিয়ানমারের আদি নৃগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত বার্মিজদের সাথে সম্প্রীতি গড়ে উঠে এবং উভয় জাতির ভাষা এবং সংস্কৃতি উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

এরপর এদের একটি শাখা মিয়ানমারের স্যাগায়িং প্রদেশের খ্যাম্পাট অঞ্চলে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টীয় ১৪শ শতকের মধ্যভাগে এরা মিয়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের ভারত সীমান্ত বরাবর বসতিস্থাপন করে।  খ্রিষ্টীয় ১৬শ শতকের দিকে বর্তমান
ভারত প্রজাতন্ত্রের মিয়ানমারের সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধাপে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে প্রথম যে মিজোরা প্রথম প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে কুকি বলা হয়। ভারতে প্রবেশকারী এই জাতি গোষ্ঠীর দ্বিতীয় দলকে নব্য কুকি নামে অভিহিত করা হয়। আর এই জাতি সত্তার সর্বশেষ যে দলটি ভারতে প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে অভিহিত করা হয় লুসাই নামে। মূলত কুকি, নব্য কুকি এবং লুসাইদের সম্মিলিত নাম হলো মিজো।

ব্রিটিশশাসনামলে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার পাহাড়ী এলাকায় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করে নি। কিন্তু ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কুকিরা স্থানীয় সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করে। উল্লেখ্য, এর পরবর্তী সকল আক্রমণ সবসময় যে কুকিদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তা নয়। কিন্তু শুরুটা কুকিদের দ্বারা হয়েছিল বলে, ব্রিটিশ ভারতের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আক্রমণকে কুকিদের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।

১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তৎকালীন তিপ্পেরা
(Tipperah) জেলার বৃটিশ প্রজাদের উপর আক্রমণ করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। কুকিদের এই আক্রমণের ১৮৬ জন ব্রিটিশ প্রজা খুন হয় এবং ১০০ জনকে তারা বন্দী করা হয়। এছাড়া এরা অন্যান্য ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর উপরও অত্যাচার করে। প্রশাসনিকভাবে এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়।

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কুকিদের শায়েস্তা করার জন্য বরকলে একটি সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়। সেসময় লুসাই চীফ রতনপুয়া গ্রামটি বরকলের উত্তর-পূর্বে ১৮মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ২৭শে জানুয়ারি ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) র‌্যাবনের নেতৃত্বে হালকা অস্ত্রশস্ত্রসহ ২৩০ জন নির্বাচিত সিপাই ও ৪৫০ জন খাদ্য দ্রব্যাদি বহনকারী কুলির দল নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্য বরকল থেকে রতনপুয়ার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেকালে ঐ গ্রামে প্রবেশের পথ ছিল অত্যন্ত দুর্গম। প্রায় ছয় দিন হেঁটে অসংখ্য পাহাড় নদী ও কাঁটাময় ঝোপ জঙ্গল অতিক্রম করে, ১লা ফেব্রুয়ারি তারিখে ঐ গ্রামে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশ সৈন্যদের মোকাবেলা করা সম্ভব নয় অনুমান করে, কুকিরা তাদের সমস্ত মূল্যবান সম্পদ সরিয়ে নিয়ে, গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। সৈন্যরা তল্লাসি করে অপরাধের শাস্তিস্বরূপ মাত্র ১৫০০ মন চাউল আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে নিরাপদেই বরকলে ফেরত আসতে হয়। কুকিরা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণ না করার জন্য এরা ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া কুকিরা ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ায়,
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। এই সূত্রে পরবর্তী ২ বছর অর্থাৎ ১৮৬২ ও ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত পার্বত্য এলাকায় শান্তি বিরাজ করে।

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ও ১৯ জানুয়ারিতে কুকিদের সেন্দু নামক একটি দল ২টি গ্রাম আক্রমণ করে ৫ জনকে হত্যা করে এবং মহিলা ও শিশুসহ ২৩ জনকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যায়। একই বছরে এপ্রিল মাসে একই জাতির লোকেরা ২৬ জনের একটি বাঙালী কাঠুরিয়া দলকে আক্রমণ করে ৫ জনকে গুলি করে এবং ৯ জনকে আটক করে। এরপর এরা খিয়াংথা গ্রামে আক্রমণ করে এবং ৫৬ জন অধিবাসীর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করে ও ৩০ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৫-৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সেন্দুরা পার্বত্য অঞ্চলে আরো ২টি হামলা করে। প্রথমবারে এরা ৬ জনকে এবং দ্বিতীয়বারের ২০ জনেরও অধিক ব্যক্তিকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুলাই লুসাই এর হলং জাতি বনযোগী উপজাতিদের ৩টি গ্রামের ক্ষতি হয়। তাদেরকে পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে উপত্যকায় বোমাং কুকী বলা হতো। তাদেরই একটি বিচ্ছিন্ন দল বৃটিশ রাজ্যের কর্ণফুলী নদীর শাখা কাপ্তাই খালে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে একটি গ্রাম ধ্বংস করে। তারা ৮০ জনকেবন্দী হিসেবে নিয়ে যায় এবং ৪ জনকে হত্যা করে।

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে হলং-রা পুনরায় বোমাং অঞ্চলের কিয়াংথা (মগ) গ্রামে হানা দিয়ে ১১ জনকে হত্যা ও ৩৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কোন হামলা হয় নি। কিন্তু ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে সাঙ্গু নদীর উপর চিমা পুলিশ ফাঁড়িতে এরা একটি হামলা চালায়। এতে ১০ জনের গার্ডের ৭জনই মারা যায়। আক্রমণকারীরা ফাঁড়িটি ধ্বংস ধ্বংস করে গার্ডের মহিলা ও শিশুদের বন্দী হিসেবে নিয়ে যায়। পরের মাসেই পুলিশ ফাঁড়িটি পুনরায় স্থাপন করা হয়। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে জুলাই ভোরে ৪০/৫০ জনের একটি দল পুনরায় আক্রমণ করে এবং ৪ ব্যক্তি ও ৬ শিশুকে আটক করে নিয়ে যায়। আবার চিমা ও পিন্দুর মাঝামাঝি স্থানে সাঙ্গু নদীর পাড়ে একটি গ্রামে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে আরো একটি আক্রমণ সংঘটিত হয়। এতে ২ জন নিহত এবং ১জন বন্দী হয়। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে কোন হামলা হয় নি। কিন্তু ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে একটি সেন্দু দল পিন্দু সীমান্ত পুলিশ ফাঁড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়। এ অসম সাহসিক কর্মটি সংঘটিত হয়েছিল সুসংহত ভাবেই।

১৮৭০-৭১ খ্রিষ্টাব্দের লুসাই এর হলং উপজাতিরা কেচার
(Cacher)-এর প্রতিবেশী বৃটিশ জেলায় বেশ কয়েক বার অস্বাভাবিক উত্যক্ত হওয়ার মতো আক্রমণ সংঘটিত করে, যাতে কয়েক জন ইউরোপীয়কে জীবন বিসর্জন দিতে হয়। এছাড়া একজন শস্য রোপণকারীর কন্যাসহ স্থানীয় কয়েকজন বৃটিশ প্রজাকে আক্রমণকারীরা বন্দী করে নিয়ে যায়। এ সকল নির্যাতন অত্যাচারের ঘটনা তৎকালীন সরকারকে কার্যকর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে এবং লুসাই অঞ্চলে একই সাথে ২টি প্রতি আক্রমণ পরিচালিত হয়। একটি কেচার হতে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে জেনালের ব্রাউনলো, সি.বি. এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ যুদ্ধাভিযান পাঁচ মাসব্যাপী চলে এবং সম্পূর্ণরূপে সফল হয়। বেআইনী ও অকারণে আক্রমণের জন্য আক্রমণকারীদের যথেষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর  ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্ষা শুরু হওয়ার সামান্য পূর্বে সেন্দুরা একটি আক্রমণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়, কিন্তু আক্রান্ত গ্রামের মানুষ আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। ফলে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এরপর ছোটো খাটো কিছু আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ি সকল আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত সেনা অভিযান পরিচালিত হয়। এরপর থেকে ব্রিটিশ ভারতে পার্বত্য এলাকায় শান্তি ফিরে আসে।

ি সংস্কৃতি:
কুকিরা বিশ্বাস করে যে, পাথিয়ান বলে তাদের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তাঁর আদেশেই বিশ্ব-ভূমণ্ডল, গাছ-বৃক্ষ, জীব-জন্তু সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আকাশে অবস্থান করেন। গোত্রভেদে আবার এই পাথিয়ানের নাম ভিন্নতর দেখা যায়। যেমন কোহেন ও অনলগোত্রভুক্ত লোকেরা এঁকে বলে পথেল এবং কোমদের কাছে তিনি পথেং নামে পরিচিত।
জুলাই মাসে পাথিয়ানপূজা অনুষ্ঠিত হয়। নির্দিষ্ট দিনে পাথিয়ানের উদ্দেশ্যে একটি শূকর উৎসর্গ করা হয় এবং প্রত্যক বাড়িতেই একটি করে মোরগ জবাই করা হয়। এই পূজা ‘চাপুই চোল্লাই’ নামে পরিচিত। এ দিনটি তাদের কাছে খুব পবিত্র। নৃত্যগীত এই পূজার প্রধান আকর্ষণ। কুকিরা পরজন্মে বিশ্বাস করে না। তবে মৃত্যুর সময় কোনো অলৌকিক শক্তি কর্তৃক মৃতব্যক্তির আত্মা নিয়ে যায়, এমটা বিশ্বাস করে। মৃতব্যক্তিদের সমস্ত আত্মা ‘মিথুখু’ নামে একটি গহীন অরণ্যে অবস্থিত একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় অবস্থান করে।

কুকিদের আদিমানব-মানবীর লোককাহিনীতে উল্লেখ আছে যে, তারা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল বৃক্ষচূড়ায়। এজন্যে কুকিদের অনেককে বৃক্ষের উপরে ঘর বেঁধে বাস করতে দেখা যায়। এখনো তাদের অনেকে বৃক্ষশাখায় ঘর তৈরি করে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

স্বাভাবিক অবস্থায় নরহত্যাকে তারা পাপ মনে করে। তবে শত্রুপক্ষের কাউকে হত্যা করলে তা পাপ বলে গণ্য হয় না। এক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের নারীহত্যাকে বেশি গৌরবের বলে মানা হয়। এছাড়া গর্ভবর্তী নারীহত্যা দ্বিগুণ সাহসের কাজ বলে গণ্য করা হয়। তারা মনে করে নারীর জন্যেই পৃথিবীতে মনুষ্যজাতির আবির্ভাব। সুতরাং নারী হত্যা করেল, শত্রুর জনসংখ্যা কমে যাবে। দ্বিতীয়ত তারা মনে করে, নারী জাতির অনুপ্রেরণায়ই পুরুষ যুদ্ধে জয়লাভ করে। তৃতীয়ত নারীরাই সংসারে যাবতীয় কর্মে অগ্রণী বলে পুরুষজাতি সকল কর্মে সহায়তা লাভের সুযোগ পায়। কাজেই নারীজাতিকে নির্মূল করতে পারলে পুরুষ পঙ্গু হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে তাদের শত্রুসংখ্যা বিলুপ্ত হবে বলে তাদের বিশ্বাস।