বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ
(প্রাকৃতজন গোষ্ঠীর আদিকাল থেকে ১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত)

৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলা সাহিত্যে বিকাশের সময়কালকে প্রাচীনযুগ বা চর্যাগীতি র কাল বলা যায়। এরপরবর্তী ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে অন্ধকারযুগ বলা হয়। কারণ এই সময়ে বাংলা সাহিত্যের কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। ভাষাতাত্ত্বিকরা বাংলা ভাষার নমুনা না পাওয়ার কারণ হিসেব দেখিয়েছেন তৎকালীন বঙ্গদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এই সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধবিগ্রহ তথা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, তা এই সময়ের বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। এই সময়টাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্ধযুগ। এর সূচনা হয়েছিল ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে। এরপর বাংলার অধিকার নিয়ে দেড়শত বৎসর টানা হ্যাঁচড়া চলে। এরই ভিতর দিয়ে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব শুরু করেন। আর ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বাংলাদেশের সিলেট থেকে উত্তরে বারাণসী এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গ সকল অঞ্চল জুড়ে তিনি তাঁর অধিকারে আনেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এই সময় বাঙালি কবি চণ্ডিদাস জীবিত ছিলেন। এই সময় বাংলা সাহিত্যের চর্চা পুনরায় শুরু হয়। এই বিচারে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে মোটা দাগে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হলেও বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল পশ্চিমা মুসলমানদের ব্যবহৃত নানা ধরনের শব্দের দ্বারা। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারে ছিল, সংস্কৃত, অর্ধতৎসম, তদ্ভব ও দেশী শব্দের সমাহার। ১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এর সাথে মিশলো আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি শব্দ। প্রথমদিকে রাজদরবারে বিদেশী মুসলমানরা নিজেদের ভাষায় কথা বলতো। কিন্তু তারা যখন প্রশাসনিক কাজে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতো, তখন বাংলাতে কথা বলার চেষ্ট করতো। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টায়, তাদের ভিতরে একটি মিশ্র-বাংলার তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা নামাজ, রোজা, আজান ইত্যাদি শব্দের বাইরে কিছু আরবি, ফার্সি শব্দ ব্যবহার করলেও তা বাংলা প্রধান ছিল। অভিজাত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রথম প্রথম মুসলমানদের এড়িয়ে চলতো বটে, কিন্তু রাজশক্তিকে অগ্রাহ্য করে বেশি দিন থাকা যায় না। এই সময় অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা রাজ দরবারে কাজও করতো। ধীরে ধীরে এরা প্রশাসনের কর্মী হিসেবে বিদেশী শব্দ ব্যবহার করা শুরু করেছিল। গোড়ার দিকে বাংলা ভাষা সনাতন ধারা এবং মুসলমানী ধারায় হয়তো ভাগ করা যেতো দেড়শত বৎসর পরে বাংলা ভাষার ব্যবধান যে ঘুঁচে গিয়েছিল, তা লক্ষ্য করা যায়  সেকালের কবিদের আরবি, ফার্সি ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের পরিমাণ দেখে। কালক্রমে হিন্দু-মুসলমানের চেয়ে বড় পরিচয় দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাঙালির পরিচয় দাঁড়িয়েছিল বাঙালি মুসলমান কিম্বা বাঙালি হিন্দু।

১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।


সূত্র :
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপা। বৈশাখ ১৩৯৬।
ভাষার ইতিবৃ্ত্ত।
সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশারস্ প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত
। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
বাংলা সাহিত্যের কথা
। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স।
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা
। ডঃ রামেশ্বর শ।
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://en.wikipedia.org/wiki/Magadhi_Prakrit