প্রাগৈতিহাসিক ভাষা
ইংরেজি :
prehistoric language

 

সুদূর অতীতের যে সকল ভাষাকে ঐতিহাসিকরা তথ্য-প্রমাণাদি দ্বারা নথিভুক্ত করতে পারেন নাই, সে সকল ভাষাকে বলা হবে প্রাগৈতিহাসিক ভাষা পক্ষান্তরে যে সকল ভাষার প্রাচীন নমুনা উদ্ধার সাপেক্ষে ভাষার অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, সে সকল ভাষাকে বলা হয়- ঐতিহাসিক ভাষা

মানুষের এই আদি ভাষাটি যথার্থই বাণী-প্রধান ছিল না কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। বিজ্ঞানীরা মানুষের মাথার খুলি পরীক্ষা করে দেখেছেন মস্তিষ্কের যে অংশটি মানুষকে কথা বলার ক্ষমতা প্রদান করে, ১০ লক্ষ বৎসর আগে হোমো এরেক্টাস (Homo erectus) প্রজাতির উপ-প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত জাভা মানব এবং পিকিং মানবদের ভিতরে খুলির বিকাশ ঘটেছিল হোমো এরেক্টাস
-দের সূত্রে প্রাগৈতিহাসিক ভাষার যে পরিবর্তন সূচনা ঘটেছিল, সেখান থেকে পরবর্তী খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ পযর্ন্ত ভাষার যে পরিবর্তন ঘটেছিল তার সামগ্রিক রূপকে বলা হয়ে থাকে প্রাগ-ভাষা (Proto-language) ভাষাবিজ্ঞানী ডেরেক বিকের্টন (Derek Bickerton) মতে ভাষা দুটি প্রধান দুটি ধাপ অনুসরণ করে বিকশিত হয় প্রথম ধাপে  মানুষের মস্তিষ্কে বস্তুগত ধারণা এবং তা প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতীকী ধ্বনি প্রকাশের ক্ষমতা সৃষ্টি হয় এবং দ্বিতীয় স্তরে বাক্য গঠনের ক্ষমতা অর্জিত হয়। এই বিচারে বলা যায় প্রাগ-ভাষা প্রকাশের উপযোগী মস্তিষ্কের বিকাশের সাথে সাথেই Homo erectus -রা টুপটাপ করে কথা বলা শুরু করেছিল, এমনটা ভাবার কারণ নেই প্রাগৈতিহাসিক ভাষার বিকাশ ঘটেছিল কিছু প্রতীকী শব্দের মধ্য দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক ভাষার বিকাশের উৎস বিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষাবিদ বিভিন্ন ধরনেরর সূত্র দিয়েছেন, কিন্তু কোনো সূত্রই ভাষা-উৎসের সঠিক কারণ নির্দেশ করতে সক্ষম হয় নাই এই জাতীয় সূত্রগুলো হলো


ডিং
-ডং তত্ত্ব  (Ding-Dong theory) :
এই সূত্র অনুসারে মানুষ প্রাকৃতিক শব্দ অনুসরণে শব্দ সৃষ্টি করতে শিখেছিল যেমন- বজ্রপাতের শব্দ অনুসরণে শিখেছিল বুম্, পাখির শব্দ অনুসরণে শিখেছিল টুইট 


বো-বো তত্ত্ব   (
Bow-Bow theory) :
এই সূত্র অনুসারে মানুষ আদ্য শব্দ গ্রহণ করেছিল প্রাণীর শব্দ অনুসারে যেমন- কুকুরের ডাক ভৌ, বিড়ালের ডাক মিউ ইত্যাদি


পুহ-পুহ তত্ত্ব   (
Pooh-Pooh theory) :
এই সূত্র অনুসারে মানুষ ব্যথা, আনন্দ, আবেগ ইত্যাদির কারণে সহজাত ধ্বনি তৈরি করতে পারতো মানুষের ভাষার আদি উৎস ছিল এই সকল ধ্বনি যেমন- উহ, আহ, ওহ ইত্যাদি


ইয়ো-হে-হো
তত্ত্ব   (Yo-he-ho theory) :
এই সূত্র অনুসারে মানুষ একসাথে কাজ করার সময় ছন্দবদ্ধভাবে ধ্বনি উৎপন্ন করতো যেমন- হেইও, ও-ও-হো ইত্যাদি


উহ-ওহ তত্ত্ব   (
Uh-oh theory) :
এই সূত্র অনুসারে আদিমানবগোষ্ঠী কোন বিষয়ে সতর্ক করার করার জন্য বা প্রস্তুতি গ্রহণের সাঙ্কেতিক ধ্বনি তৈরি করতো এই সকল ধ্বনি থেকে মানুষের ভাষার সূত্রপাত হয়েছিল


লা-লা তত্ত্ব   (
La-La theory) :
এই সূত্র অনুসারে  রোমান্টিক পরিস্থিতে মানুষ যে ধরণের শীৎকার ধ্বনি উৎপন্ন করে, ভাষার আদি উৎস ছিল সে সকল শব্দই এই ধ্বনিগুলো মানুষ করে থাকে- যৌনানন্দে, বিজয়ানন্দে বা বড় ধরনের গভীর আনন্দে উচ্চারণ করতো 
 

ভাষার আদ্যধ্বনি কোনগুলো ছিল, সে বিষয়ে যে তত্ত্বগুলোর উল্লেখ করা হলো, মূলত তার কোনটিকেই একমাত্র আদি শব্দ-উৎস হিসাবে বিবেচনা করা যায় না তবে যদি সবগুলো সূত্রকে একটি সূত্র হিসাবে বিবেচনা করা যায়, তা হলে এই বিষয়টির কাছাকাছি একটা ধারণা করা যায় স্টেভেন পিংকার (Steven Pinker), নোয়াম চমস্কি (Noam Chomsky),  ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) প্রমুখ ভাষাবিদরা মনে করেন যে মানুষ মনের ভাব ভাষায় প্রকাশ করার এবং অন্যের ভাষা বিশ্লেষণ করে ভাবার্থ গ্রহণের উপযোগী একটি বিশেষ ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্কের আছে চমস্কির ভাষায় মস্তিষ্কের এই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী অংশটি হলো ল্যাড (LAD =Language Acquisition Device) আদি মানুষের ল্যাড হয়তো ততটা সুগঠিত ছিল না অবশ্য মানুষের কাছাকাছি প্রাণীদের ল্যাড রয়েছে, তবে মানুষের মতো অতটা বিকশিত নয় যা হোক, কাল-পরিক্রমায় যখন মানুষের দেহ এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ একটি পরিপূর্ণতার দিকে উন্নীত হলো, তখন ল্যাডেরও বিকাশ ঘটেছিল।  

প্রাথমিক স্তরে মানুষ প্রাণী হিসাবে সহজাত কিছু ধ্বনি উৎপন্ন করতে পারতো এসবের ভিতরে ছিল ভয়, রাগ, বেদনা, শীৎকার ইত্যাদি ভাষার কিছু না বুঝেই কোলের শিশুরা যখন তা তা, বা বা জাতীয় ধ্বনি ক্রমাগত করতে থাকে, তখন আপতঃ পর্যবেক্ষণে সেসকল ধ্বনি অর্থহীনই মনে হতে পারে কিন্তু শিশুর কাছে তা তার মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ আদি মানুষ বিচিত্রভাবে স্বরযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল, কণ্ঠধ্বনির উচ্চতা-সামান্যতা নির্ধারণের জন্য পরে ধীরে ধীরে শিখেছিল কণ্ঠ-নিঃসৃত ধ্বনিকে জিহ্বা, তালু, দন্তমূল, ওষ্ঠাধর ইত্যাদির সাহায্যে বিভিন্ন শব্দ-বৈচিত্র্যে প্রকাশ করার কৌশল গোড়ার দিকের শব্দগুলো ছিল প্রকৃতিজাত ধ্বনি বা প্রাণীর ডাকের অনুকরণীয় শব্দ পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা যেমন ধ্বনি সৃষ্টি করতো, তেমনি অপরের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য উচ্চারণ করতো ধ্বনি এ সব মিলেই ভাষার আদি-উপকরণের সংগ্রহের ভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল পরবর্তী সময়ে অনেকদিন ধরে চলেছিল শব্দের পরে শব্দ বসিয়ে বাক্য নির্মাণের প্রচেষ্টা আর এই প্রচেষ্টার ভিতর দিয়েই ভাষা নির্মাণ চলেছিল মুখে মুখে এবং এখন অব্দি তা অব্যহত রয়েছে

জীবিত ভাষা মাত্রেই বহতা নদীর মতো সহজাত প্রকাশ  রুদ্ধ না হলে তা পরিবর্তিত হয় সহজাতভাবেই প্রকাশ রুদ্ধ হলে ভাষা মৃত ভাষায় পরিণত হয় কখনো বড় ভাষার সংস্পর্শ এসে ছোট ভাষাগুলো হারিয়ে যায় বা নূতনভাবে প্রকাশ পায়

 

প্রাগ্-ভাষার বিবর্তন ও প্রাগ্-ভাষা পরিবার

মানুষের বাক্য নির্মাণের কৌশল আয়ত্ব করতে করতে ভাষা স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছিল গোড়ার দিকে মানুষ বাক্য নির্মাণে ক্রিয়াপদ ও এর ক্রিয়ার কাল অনুসারে বাক্যের ভাব পরিবর্তন করতে পারতো তবে একই শব্দের একাধিক সমার্থ বাচক শব্দের ভাণ্ডার ততটা গড়ে উঠেনি দিনের পর দিন গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম বাণী-প্রধান হয়ে উঠেছিল ধারণা করা হয়, ভাষা বাণী-প্রধান হয়ে উঠেছিল খ্রিস্ট-পূর্ব ৮০০০ অব্দের দিকে।  আফ্রিকার আদি মানুষেরা এশিয়া হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।  প্রাগ্-ভাষার মানুষের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে, আদি ভাষা আঞ্চলিক ভাষায় রূপ লাভ করে। এই রূপান্তর ঘটেছিল দীর্ঘ সময় ধরে। এই সকল আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহৃত আদি ভাষার প্রচলিত শব্দের উচ্চারণে পার্থক্য সূচিত হয়েছিল, একই সাথে নতুন পরিবেশে নতুন জীবনযাত্রায় নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছিল। এইভাবে খ্রিস্ট-পূর্ব ৭০০০ অব্দের ভিতরে, নানা ধরনের আঞ্চলিক ভাষা নিজস্ব রূপ পেয়েছিল। ভাষা বিজ্ঞানীরা এই সকল ভাষার সমষ্টিগত রূপের নাম দিয়েছেন প্রাগ্-ভাষা পরিবার ( Prehistoric Language Family)। এখন পর্যন্ত ভাষাবিজ্ঞানীরা ১৬টি প্রাগ্-ভাষা পরিবারের নামকরণ করতে পেরেছেন। নিচে এর তালিকা দেওয়া হলো।

১. প্রাগ্ অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার ( Proto Austro-Asiatic Language Family)
২. প্রাক অস্ট্রোনেশীয় ভাষা পরিবার (Proto Austronesian  Language Family)
৩. প্রাগ্ আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার (Proto Afro-Asiatic Language Family)
৪. প্রাক আল্টাইক ভাষা পরিবার (Proto Altaic Asiatic Language Family)
৫. প্রাগ্ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার (
Proto Indo-European Language Family)
৬. প্রাক উরালিক ভাষা পরিবার (Proto Uralic Language Family)
৭. প্রাক এস্কিমো-আলেউট ভাষা পরিবার (Proto Eskimo-Aleut Language Family)
৮. প্রাক ককেশীয় ভাষা পরিবার (Proto Caucasian  Language Family)
৯. প্রাক খোইশীয় ভাষা পরিবার (Proto Khoisan Language Family)
১০. প্রাক তাই-কাডাই ভাষা পরিবার (Proto Sino-Tibetan Language Family)
১১. প্রাগ্ সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার (Proto Sino-Tibetan Language Family)
১২. প্রাক দ্রাবিড়ীয় ভাষা পরিবার (Proto Dravidian  Language Family)
১৩. প্রাক নাইজার-কঙ্গো ভাষা পরিবার (Proto Niger-Congo Language Family)
১৪. প্রাক নাইলো-সাহারা ভাষা পরিবার (Proto Nilo-Saharan Language Family)
১৫. প্রাক না-দেনে ভাষা পরিবার (Proto Na-Dené Language Family)
১৬. প্রাক পামা-নাইয়ানগান ভাষা পরিবার (Proto Pama-Nyungan Language Family)

উল্লিখিত শ্রেণী বিভাজনের সূত্রে আমরা প্রাক-ভাষার যে তালিকা পেয়েছি, তার সবগুলো পৃথিবীর একই জায়গায় বা একই সময় বিকশিত হয়েছিল তা নয় এই সব প্রাকভাষা পরিবারগুলো থেকেই পরবর্তী সকল জীবিত ও মৃত ভাষাসমূহের সৃষ্টি হয়েছিল  


সূত্র :
http://en.wikipedia.org/wiki/Proto-language