বিস্তারিত: অম্ল-মধুর রসবিশিষ্ট স্বনামখ্যাত উপাদেয় ফল বা এই ফলের গাছের সাধারণ নাম।
এই
গাছের আদি উৎপন্ন অঞ্চল হলো- দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে।
কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে প্রবেশের পূর্বেই স্থানীয় রেড ইণ্ডিয়ানদের দ্বারা এই গাছটি
দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মধ্য আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইণ্ডিজের দ্বীপাঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে
পড়েছিল। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলম্বাস প্রথম এই ফলটির দেখা পান গুয়াডালোপ
(Guadaloupe)
দ্বীপে। ফেরার সময় তিনি এই ফল এবং এর গাছ স্পেনে নিয়ে আসেন।
১৬ শতকের দিকে স্প্যানিশরা এই গাছ ফিলিপাইনে নিয়ে আসে। পরে এখান থেকে হাইতি দ্বীপে
এর চাষ শুরু হয়। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই গাছ ইংল্যাণ্ডে পৌঁছে। ইংল্যাণ্ডে
ছোট ছোট গ্রিন হাউজে ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আনারসের চাষ হতো। ১৫৫০
খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতবর্ষে এই ফলটি প্রবেশ করে পর্তুগীজ বণিকদের দ্বারা।
এটি একবীজপত্রী
Bromeliales
বর্গের
Bromeliaceae
গোত্রের বহুবর্ষজীবী বীরুৎ জাতীয় গাছ। অঙ্গজ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই গাছ
প্রায় ৫০ বৎসর জীবিত থাকতে পারে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা এর কাছাকাছি অঞ্চলে ভালো জন্মে।
এর উচ্চতা ১৩০-১৫০ সেন্টিমিটার। এর পাতাগুলো দীর্ঘ ও অগ্রভাগ দুচালো। পাতাগুলো
২০ থেকে ৭২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতার উভয় প্রান্তে কাঁটা থাকে। অবশ্য
কিছু প্রজাতির আনারসের পাতা কাঁটাবিহীন হয়ে থাকে। পাতাগুলো পত্রবৃন্তহীন এবং
কাণ্ডের সাথে দৃঢ়ভাবে আটকানো থাকে। পাতার উপরিভাগ রঙ ঘন সবুজ বা লালচে। এর তলার
দিকের রং ধূসর।
এই গাছের ফুলগুচ্ছাকরে ধরে গাছের শীর্ষদেশে। এই পুষ্পমঞ্জরীতে ফুলের সংখ্যা থাকে
শতাধিক। ফুলগুলো সর্পিলাকারে সাজানো থাকে। পুরো মঞ্জরীদণ্ডের ফুলগুলো ধীরে ধীরে
ফোটা শুরু করে এবং ১০-২০ দিনের মধ্যে সবগুলো ফুল ফুটে যায়। ফুলগুলোর রং হয়ে থাকে
লাল বা পার্পেল। ফুলগুলো উভয় লিঙ্গধর্মী এবং মঞ্জরী পত্র দ্বারা আবদ্ধ থাকে।
দক্ষিণ আমেরিকায় এর পরাগায়ণ ঘটিয়ে থাকে হামিং বার্ড। অন্যান্য অঞ্চলে পরাগায়ণ ঘটায়
ছোট ছোট পাখি বা পতঙ্গ। এই ফুল থেকে ফল হওয়ার পর, তা বড় হওয়া থেকে পাকার
সময় লাগে প্রায় ৫-৬ মাস। ফলের শীর্ষে থাকে একগুচ্ছ পাতার মুকুট। উল্লেখ্য এই পাতার
মুকুট দ্বারা অঙ্গজ প্রজনন ঘটে থাকে। তাই ফলের বীজ থেকে এই গাছের চাষ করা হয় না।
আনারস মূলত একটি যৌগিক ফল। একাধিক ফলের সমন্বয়ে তৈরি এই যৌগিক ফলটির প্রতিটি
বিভাজেনের সাথে একটি করে চোখ থাকে। প্রজাতি ভেদে পাকা অবস্থায় রঙ হতে পারে
সবুজ, হলুদ, কমলা-হলুদ, লালচে বর্ণের। পাকা অবস্থায় আনারস অত্যন্ত রসালো ও
আঁশযুক্ত হয়ে থাকে। এর স্বাদ অম্ল-মধুর এবং সুগন্ধী। এটি সর্বোচ্চ ১২ ইঞ্জি
পর্যন্ত লম্বা এবং ওজনে ১ থেকে ১০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আনারস রৌদ্রজ্জ্বল ও উষ্ণস্থানে জন্মে। তুষারপাত ও ঘন কুয়াশা এই গাছের জন্য
অত্যন্ত ক্ষতিকারক। চাষের জন্য pH 4.5-6.5
সমৃদ্ধ দোঁ-আঁশ মাটি উত্তম। তবে জলাবদ্ধ জমিতে এর চাষ করা যায় না। ভাল চাষের জন্য
তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় ১০-৩২ ডিগ্রী ফারেনহাইট। একই সাথে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়
৬৩৫-২৫০০ মিলিমিটার। ফলের আকৃতি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয় নাইট্রোজেন ঘটিত সার। এই
গাছের প্রধান শত্রু হলো পিঁপড়া, বিটল বা এই জাতীয় ছোট ছোট পোকা।
বাণিজ্যিকভাবে আনারসের কয়েকটি প্রজাতিকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন-
হিলো
(Hilo)
: হাওয়াই অঞ্চলে এগুলো জন্মে। এর ২-৩ পাউণ্ড হয়ে থাকে। এর আকৃতি
সিলিণ্ডারের মতো হয়ে থাকে।
কোনা সুগারলফ
(Kona Sugarloaf)
: মাংসাল শরীর কিন্তু মধ্যভাগ কাঠের মতো শক্ত নয়। এর ওজন হয়ে থাকে প্রায় ৫-৬
পাউন্ড। এর আকৃতি সিলিন্ডারের মতো। এইগুলো প্রচুর মিষ্টি হয়ে থাকে। টক প্রায়
নাই বললেই চলে। অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু।
নাটাল কুইন
(Natal
Queen) :
মৃদু সুগন্ধী এই আনারসগুলোর রঙ উজ্জ্বল হলুদ। কিছুটা অম্লধর্মী তবে মিষ্ট। ওজন
হয়ে থাকে ২-৩ পাউন্ড।
পারনামবুকো
(Pernambuco)
: এই আনারসগুলো
হলদেটে-সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। এর সুগন্ধ অত্যন্ত চমৎকার। অত্যন্ত মিষ্ট হলেও
সামান্য টকধর্মী। এই কারণে কোনা সুগারলফের চেয়ে অনেকে এই প্রজাতিটি বেশি পছন্দ
করে থাকেন। এর ওজন হয়ে থাকে প্রায় ২-৪ পাউন্ড।
রেড স্প্যানিশ
(Red Spanish)
: মৃদু হলুদ বর্ণের এই আনারসগুলো অত্যন্ত চমৎকার সুগন্ধী হয়ে থাকে। এইগুলো
মৃদু অম্লযুক্ত মিষ্ট ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। এগুলোর ওজন হয়ে থাকে প্রায় ২-৪
পাউন্ড।
স্মুথ কেয়াননে
(Smooth Cayenne)
:
হাল্কা হলুদ
রঙের এই আনারসগুলো উচ্চ চিনিযুক্ত এবং অম্লযুক্ত হয়ে থাকে। এর আকৃতি হয়ে থাকে
সিলিন্ডার মতো থাকে। এর ওজন ৫-৬ পাউন্ড হয়ে থাকে।
পাকা আনারস সাধারণত অন্যান্য ফলের মতো না সিদ্ধ করেই খাওয়া হয়। এছাড়া কোনো
কোনো ক্ষেত্রে তরকারীর সাথে ব্যবহার করা হয়। এর রস বাজারজাত করা হয়। এর পাতার
রস কৃমি রোগ ছাড়া বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। অপক্ব আনারসকে
গর্ভপাতে ব্যবহার করা হয়। ফিলিপাইন ও তাইওয়ানে আনারসের পাতা থেকে সূক্ষ্ণসুতা
তৈরি করা হয়। এই সুতা থেকে প্রস্তুতকৃত কাপড়কে বলা হয় পিনা
(Pina) ।