আদি মানব গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক
জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়- হোমো গণের উন্নততম প্রজাতি হিসেবে আধুনিক মানুষ তথা
হোমো স্যাপিয়েন্স-এর
আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকা মহাদেশে, প্রায় ৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এর সর্বপ্রাচীন প্রমাণ মিলেছে
মরক্কোর
জেবেল ইরহুদ অঞ্চলে।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত এই জীবাশ্মগুলোর বয়স নির্ধারিত হয়েছে আনুমানিক ৩১৫,০০০ ± ৩৪,০০০ বছর।
অর্থাৎ, উচ্চ সীমা বিবেচনায়- মানুষের অস্তিত্ব শুরু হতে পারে প্রায় ৩৫০,০০০ বছর আগে।
এই প্রাচীনতম জীবাশ্মের ভিত্তিতে বলা যায় আফ্রিকার উত্তরাংশে (মরক্কো) মানুষের উপস্থিতি সবচেয়ে আগে প্রমাণিত।
ধারণা করা হয়,
জেবেল ইরহুদ মানুষ ৩,১৫,০০০-১,৯৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে আফ্রকার
বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদেরই পূর্বমুখী অভিযাত্রীর দল পূর্ব আফ্রিকার দিকে
অগ্রসর হয়ে প্রাথমিকভাবে বসতি স্থাপন করেছিল, ইথিওপিয়ার ওমো নদীর তীরে।
ইথিওপিয়ার
ওমো কিবিশ অঞ্চলে
প্রাপ্ত জীবাশ্মের বয়স ধরা হয়েছে ২৩৩,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাদ।
এদেরই একটি দল ধীরে ধীরে পূর্ব আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হয়- কেনিয়া অঞ্চলে
বসতি স্থাপন করেছিল। পূর্ব আফ্রিকা থেকেই- প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে। মানুষ আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, যা
-আউট অফ আফ্রিকা- মডেল নামে পরিচিত।
অতএব, মানুষের আবির্ভাব আফ্রিকা জুড়ে ঘটলেও- সর্বপ্রথম জীবাশ্ম-প্রমাণ মরক্কোতে।
এবং এই আদি মানুষের বংশধরই কেনিয়া, ইথিওপিয়া হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।
নৃবিজ্ঞানী
এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে—
প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা
Homo sapiens
(হোমো স্যাপিয়েন্স)
নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল
আফ্রিকার
ইথিওপিয়া অঞ্চলে।
সেই আদি মানবগোষ্ঠীর সুসংগঠিত ভাষা বা সঙ্গীত ছিল না। তারা কৃষি কাজ জানতো না, জীবিকার জন্য নির্ভার করতো বনের ফলমূল আর বন্যপ্রাণী। প্রকৃতপক্ষেই তারা ছিল প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল প্রকৃতির সন্তান।
এরা ছিল খর্বাকার এবং এদের গায়ের রঙ ছিল কালো। মাথার চুল ছিল
কোঁকড়ানো। এদের মাথার গড়ন ছিল লম্বাটে এবং নাক ছিল চ্যাপ্টা।
![]() |
|
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর মানুষ |
ক্রমে ক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আফ্রিকা থেকে মানুষ অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। অন্য দলটি ইরিত্রিয়ার ভিতর দিয়ে লোহিত সাগর পার হয়ে আফ্রিকা সংলগ্ন এশিয়ায় ইয়েমেন অঞ্চলে প্রবেশ করে। এদের অগ্রগামী দল এই সময়ের ভিতর আরব উপদ্বীপ ও পারশ্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার থাকে ১ লক্ষ বৎসরের ভিতরে। এরপর এদের কিছু মানুষ মঙ্গোলিয়া ঘুরে চীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবেশ করেছিল। অপর দলটি পারশ্য হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে এরা প্রবেশ করে প্রায় প্রায় ৭৫-৬০ হাজার বৎসর আগে।
![]() |
|
মুর্শিদাবাদ থেকে প্রাপ্ত ২০,০০০ বৎসরের পুরানো নমুনাগুলো। সূত্র : the Telegraph, March, 2008 |
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার
বৎসরের মধ্যে এরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত
হয়েছিল ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। এই যুগে নেগ্রিটোরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
করতো অমসৃণ পাথর। এদের নিদর্শন পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যাকায়, দক্ষিণ
ভারতের মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে।
দেখুন :
বাংলাদেশের ইতিহাস
।
এরা কৃষিকাজ জানতো না। ধারণা করা যায়,
প্রাচীন প্রস্তরযুগে এরা আগুনের ব্যবহার
হয়তো
জানতো। এরা গুহাবাসী ছিল বা বড় বড় গাছের নিচে দলবদ্ধভাবে বাস করতো। এদের
প্রধান খাদ্য ছিল বন্য পশুপাখি। এছাড়া খাওয়ার উপযোগী ফলমূল ও লতা আহার করতো।
এদের হাতেই পত্তন ঘটেছিল ভারতের মধ্য প্রস্তরযুগ। খ্রিষ্টপূর্ব ১০-৬ হাজার বৎসরের ভিতরে এই মধ্য এই মধ্য প্রস্তরযুগের ব্যাপ্তীকাল ধরা হয়। এই সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় দক্ষণ ভারতের তিনেভেলি, গুজরাটের সবরমতি, বোম্বাই-এর উপকূলে, গোদাবরী ও নর্মদা নদীর উপত্যাকায়, মহীশূরের ব্রহ্মগিরি অঞ্চলে। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম বাংলার দুর্গাপুরে কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এসব নমুনাকে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০০ বৎসরের পুরানো হিসেবে দাবি করেছিলেন। অনেকের মতে এই নমুনা খ্রিষ্টপূর্ব ৮ থেকে ১২ হাজার বৎসরের পুরানো। মধ্য প্রস্তরযুগের নেগ্রিটোরা পাথরের ফলা তৈরি করে তীরের মাথায় ব্যবহার করতে শিখেছিল। মাটির তৈরি পাত্র তৈরির কৌশল তারা শিখেছিল বটে। কিন্তু কুমোরের চাকা তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। এযুগের নেগ্রিটোদের প্রধান খাবার ছিল বন্য পশু-পাখি। তবে তারা কিছু প্রাণীকে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছিল। এই সময় কৃষিকাজের চেষ্টা তারা করেছিল, কিন্তু পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে নি।
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা ভারতবর্ষে কোন সময় থেকে আসা শুরু করেছিল, তা
সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না।
ধারণা করা এরা ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের
ফলে আদি
নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে
পড়ে। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে বিলীন হয়ে
গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য
হারিয়েছিল।
এদের কয়েকটি দল সাগর পাড়ি দিয়ে
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপে পৌঁছেছিল। ফলে ভারতে আগত অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে
নিজেদেরকে পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উড়িষ্যার মালকানগিরি জেলার অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ি
প্রত্যন্ত অঞ্চলে এদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বসবাস করে। এদেরকে
স্থানীয়ভাবে
বোণ্ডা বলা হয়।
তথ্য সূত্র :
World History- The Human Experience.
Mounir Farah, Andrea Berens Karls. MGraw-Hill, 1985
http://en.wikipedia.org/wiki/Negrito
ভারত বিচিত্রা। নভেম্বর-ডিসেম্বর। ২০১৭।