প্রতিভা বসু
(
১৫-২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ)
সঙ্গীত শিল্পী, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও প্রাবন্ধিক।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ ঢাকার বিক্রমপুরে হাসড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আশুতোষ সোম ও মায়ের নাম সরযূবালা সোম। তাঁর ডাক নাম ছিল রাণু। পিতার পদবী অনুসারে তাঁর নাম ছিল রাণু সোম। তাঁর অপর নাম প্রতিভা। বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহের পর তাঁর নাম হয়- প্রতিভা বসু।

চাকরি সুবাদে আশুতোষ মাদারীপুরে সপরিবারে থাকা শুরু করেন। সেই কারণে তাঁর শৈশভ কেটেছিল মাদারীপুরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ নিয়েছিলেন মাদারীপুরের স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর পিতার সাথে কর্মস্থল হুগলি জেলার চুঁচুড়া শহরে পিসিমার বাড়িতে। এখানে পিসিমার ইচ্ছায় তাঁর গানের তালিম শুরু হয় স্থানীয় সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে।

কিছুদিন পর আশুতোষ ঢাকায় বদলি হন। মধ্যবর্তী কিছুদিনের জন্য তিনি পরিবারের অন্যান্যদের সাথে নীলফামারীতে কাটান। এঁরপর ঢাকায় চলে আসেন। এই সময়ের ভিতরে তিনি
চারুদত্ত, মেহেদি হোসেন, ভোলানাথ মহারাজ, প্রফেসর গুল মহম্মদ খাঁ প্রমুখের কাছে গান শিখেছিলেন।

এই সময় ঘরোয়া গান গেয়ে প্রতিভা বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এই সূত্রে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে হিজ মাস্টার ভয়েসের রেকর্ড করার দল ঢাকায় এসে প্রথম তাঁর গানের রেকর্ড করেন। প্রতিভা বসু তাঁর জীবনের জলছবি গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন-

'... প্রথম হিজ মাস্টার্স ভয়েসে আমি গান রেকর্ড করি। রেকর্ড করতে তখন আমাকে কলকাতা আসতে হয়নি। কর্মকর্তারা ঢাকায় গিয়েই মেশিন ফিট করেছিলেন। টিকাটুলিতে সুশুংয়ের রাজার একটি বাড়ি ছিলো। সেই বাড়িতেই যন্ত্র ফিট করা হয়েছিল, সেখানেই গিয়েই গান গেয়েছিলাম আমি। তখন মাইক ছিলো না, ধুতুরা ফুলের মতো দেখতে মস্তবড়ো এক চুঙির ভিতর মুখ দিয়ে গান গাইতে হতো। বোধহয় তিনখানা না চারখানা রেকর্ড করা হয়েছিল। তার মধ্যে অতুলপ্রসাদ সেনের 'বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখি পাতে' গানটি ছিল।'

এরপর তিনি দিলীপ কুমার রায় এবং কাজী নজরুল ইসলামের কাছে গান শেখেন। নজরুল ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ঢাকায় এসে নিজে যেচে প্রতিভার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে নজরুল তাঁকে গান শেখানো শুরু করেন। এই সময় প্রতিভা তাঁর পিতামাতার সাথে ঢাকার বনগ্রামে থাকতেন।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন (বৃহস্পতিবার ৭ আষাঢ় ১৩৩৫) নজরুল বনগ্রামে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা) যান রাণু সোমের (প্রতিভা বসু) সাথে দেখা করতে যান। উল্লেখ্য, এর আগে দিলী্পকুমার রায় ঢাকা এসে রাণুকে বেশ কিছু নজরুলের গজল আঙ্গিকের গান শিখেয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে নজরুলের কাছে এই সুকণ্ঠী শিল্পীর প্রশংসা করেন। তাই এবারের ঢাকায় আসার পরের দিনই পরম আগ্রহ নিয়ে নজরুল রাণু সোমের (প্রতিভা বসু) সাথে পরিচিত হতে, তাঁদের বাসায় যান। নজরুলও তাঁর সঙ্গীত-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হন। মুগ্ধ কবি রাণুকে একটি উৎসরগ্ করেন।

নজরুল যতদিন ঢাকায় ছিলেন প্রায় ততদিনই  তিনি গান শেখানোর জন্য তিনি বনগ্রামে যেতেন। এ বিষয়ে চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়, প্রতিভা বসুর রচিত 'জীবনের জলছবি‌' গ্রন্থে। এই গ্রন্থে পাওয়া যায় নজরুলের রচিত একটি নতুন গানের কথা জানা।
'...রাত জেগে নতুন গান লিখেছেন তিনি, না শিখিয়ে থাকতে পারছেন না। ‌'এসো এসো শিগ্গির এসো, হারমোনিয়াম নিয়ে বসো।' আমরা সবে চা খাচ্ছি, আমার চেহারায় তখনো ঘুম ঘুম ভাব। বসে গেলেন সঙ্গে। ...রাত্তিরে একটা গান লিখেছি সুরটা তুলে নাও তাড়াতাড়ি, আবার ভুল হয়ে যাবে।‌'
    সকালটা ঝক্ ঝক্ করতে লাগলো। আবার হারমোনিয়াম আবার পানের বাটা আবার ঘনঘন চা। গানটা হলো 'আমার কোনকূলে আজ ভিড়লো তরী, এ কোন সোনার গাঁয়/ভাঁটির টানে আবার কেন উজান যেতে চায়।' দেখা গেল তখনো তার বয়ান সঠিক নায়, সুরেরও হেরফের হচ্ছে। ঠিক করছেন গাইত গাইতে, শেখাতে শেখাতে।‌'
উল্লেখ্য, গানটি পরে চোখের চাতক-এ অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
ঢাকাতে নজরুলের প্রধান কাজই ছিল রাণুর গান শেখানো। এই সূত্রে নজরুল এক রাত্রিতে রাণুদের প্রতিবেশী এক পরিবারের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। এই দুই পরিবারের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল বেশ আগে, দিলীপকুমার রায়ের গান শেখানো নিয়ে। প্রতিভা বসু তাঁর 'জীবনের জলছবি‌' গ্রন্থের এই বিবাদের বিষয়ে লিখেছেন-
'যখন দিলীপদা এসেছিলেন তখন ওঁরা একদিন দিলীপদাকে নিজেদের মেয়েদের গান শোনাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, দিলীপদা সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপর থেকে ও বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী বয়স্ক সুন্দরী আত্মীয়টি আর আমাদের সাথে কথা বলতেন না।  কর্তা ও কন্যাদেরও বলতে দিতেন না।...'
এই ঘটনার পর নজরুল যখন রাণুদের বাসায় আসা-যাওয়া শুরু করলেন এবং সেই সাথে রাণুকে গান শেখানো শুরু করলেন, তখন এদের সকল রাগ এসে পড়েছিল নজরুলের উপর। তাই ২৫শে জুলাই (বুধবার ৯ শ্রাবণ ১৩৩৫) রাত দশটার দিকে, রাণুদের বাসায় গান আর আবৃত্তির আসর শেষে নজরুল যখন বের হন, তখন প্রতিবেশীদের লেলিয়ে দেওয়া দশ-বারো জন যুবক লাটি নিয়ে নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুল এদের একাই প্রতিহত করে আহত হন। এই অবস্থায় রাণুর পিতা এগিয়ে গিয়ে আহত নজরুলকে নিজের বাসায় এনে সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন।

নজরুলের ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর, ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে প্রতিভা কলকাতায় আসেন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির আহ্বানে এবং ১২টি গান রেকর্ড প্রকাশের চুক্তি হয়েছিল।  এইচএমভি থেকে প্রথম নজরুল-সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল- ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। রেকর্ড নম্বর-  পি ১১৬৭৩। এই রেকর্ডে তাঁর গাওয়া দুটি গান ছিল-

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে দার্জিলিং যান। এই সময় প্রতিভা দর্জিলিং গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ দিলীপকুমার রায়ের কাছে জেনেছিলেন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিভার কথা। রবীন্দ্রনাথ গান শোনার জন্য পত্রমারফত প্রতিভাকে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর গান শেখেন। পরে তিনি রেকর্ডে বেশকিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন।

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বুদ্ধদেব বসুর সাথে প্রতিভর বিয়ে হয়। এই সময় তাঁর নাম প্রতিভা সোম থেকে প্রতিভা বসু হয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁর রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে প্রতিভা বসু শিরোনামে। বিবাহের সময় বুদ্ধদেবের তেমন ভালো রোজগার না থাকায়, বিবাহের কয়েক বৎসর তাদের আর্থিক অনটনে কেটেছে। প্রথম দিকে অল্প দামে ভালো বাসা যোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। পরে বালগঞ্জের ২০২ রাসবিহারী এভিনিউয়ে একটি বাসায় উঠেছিলেন। এই বাসাতে এঁরা প্রায় ২৯ বৎসর কাটিয়েছিলেন। এখানে জন্মেছি তাঁর  দুই কন্যা মীনাক্ষীও দময়ন্তী এবং পুত্র শুদ্ধশীল বসু। 

বিবাহের পর প্রতিভা গানের জগৎ ত্যাগ করে সাহিত্য-জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম ছোটো গল্প 'মাধবীর জন্য' প্রকাশিত হয়েছিল। এই সূত্রে তিনি তৎকালীন সাহিত্য জগতে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। 

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বুদ্ধদেব বসু মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।

২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

প্রতিভা বসুর রচনাসমূহ