এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি
সমার্থক শব্দাবলি: এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার'স ভয়েস (His Master's Voice)

একটি ব্রিটিশ পণ্য-বিক্রয় প্রতিষ্ঠান। গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশনা এবং রেকর্ড বিপণনযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমিল বার্লিনার (Emile Berliner) নামক একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী প্রথম সঙ্গীতের রেকর্ড বিপণন শুরু করে। এই রেকর্ডের ব্যাস ছিল ৫ ইঞ্চি। এই রেকর্ডগুলো ইউরোপে বাজারজাত করার জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা হতো।

প্রথমদিকে বার্লিনার খেলনাযন্ত্রের সাথে রেকর্ড বাজানোর জন্য রেকরড তৈরি করেছিলেন।
গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথমদিককার রেকর্ড
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে রেকর্ড বিপণনের জন্য একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল
United States Gramophone Company। এই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রথম রেকর্ড বাজারজাত হয় ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই রেকর্ডগুলোর ব্যাস ছিল ৭ ইঞ্চি। তখন এই রেকর্ডের উপর লেবেল লাগানো হতো Berliner Gramophone হিসেবে।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম ব্যারি ওয়েন (
William Barry Owen, এমিল বার্লিনারের ব্যবসার সাথে যুক্ত হন এবং UK Gramophone Company প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম ওয়েন
Lambert Typewriter Company তৈরির অধিকার লাভ করেন। এই সূত্রে এই কোম্পানির নাম হয় Gramophone & Typewriter Ltd. । অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাখার অবনতি হলে, কলাম্বিয়া রেকর্ডস এবং জোনোফোন এই শাখাকে কিনে নেয়। এর ভিতর গ্রামোফোন টকিং মেশিন তৈরিকারক এল্ড্রি আর জনসন (Eldridge R. Johnson) নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নামকরণ করা হয় Victor Talking Machine Company প্রথম দিকে কলাম্বিয়া রেকর্ড-এর সাথে সত্তাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে এই দ্বন্দ্ব মিটে গেলে, এরা ফ্ল্যাট রেকর্ড তৈরি করা শুরু করে।

এডিনের সমতলীয় রেকর্ড

উল্লেখ্য ভিক্টোরিয়া টকিং ম্যাশিন কোম্পানি কখনোই গ্রামোফোন কোম্পানির শাখা বা অর্থানুকুল্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল না। এরা মূলত বার্লিনার কোম্পানির জন্য টকিং ম্যাশিন তৈরি করতো। কলাম্বিয়া এবং ভিক্টোরিয়া ফ্ল্যাট রেকর্ড তৈরি শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর সাথে অবশ্য ইংল্যান্ডের গ্রামোফোন কোম্পানি এবং আমেরিকার বাইরের কিছু রেকর্ড তৈরির প্রতিষ্ঠানও যুক্ত ছিল। এরাই প্রথম সমতলীয় রেকর্ড প্রচলন করেছিলেন এমিল বার্লেনিয়ার। এরপর এডিশন পরে সমতলীয় রেকর্ড তৈরি করা শুরু করেন। এর নাম ছিল ডায়ামন্ড ডিস্ক।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানির নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আলফ্রেড ক্লার্ক প্যারিস অপেরার জন্য ২৪টি সমতলীয় রেকর্ড তৈরি করে। এই রেকর্ডগুলো লোহা এবং সীসার তৈরি বাক্সে ভরে সংরক্ষণ করা হয় অপেরা হাউসের নিচের কক্ষে।

গ্রামোফোন এ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেড কলকাতায় শাখা অফিসের প্রথম ম্যানেজার ছিলেন জন ওয়াটসন হাওড। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে নতুন রেকর্ড কোম্পানি নিকোল রেকর্ড কোম্পানির পরিচালকের পদ গ্রহণ করেন।

গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় বন্ধ হয়ে যায়- কিছু রেকর্ড কোম্পানি। এর ভিতরে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ডোয়ার্কিন এন্ড সন' রেকর্ড, কোম্পানি  বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে 'মুখার্জি এ্যান্ড মুখার্জি' রেকর্ড কোম্পানি ' রয়্যাল রেকর্ড-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধ হয়ে যায় বীণাপাণি রেকর্ড। ফলে ১৯০৮-১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতে রেকর্ড ব্যবসার সিংহভাগ চলে যায় গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির হাতে। এই প্রতিযোগিতায় নিকোলে রেকরড বিশেষ সুবিধা করতে পারলেও ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এদের রেকর্ড প্রকাশের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিক রইলো না। ১৯০৮ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বেশকিছু ইউরোপীয় রেকর্ড কোম্পানি, ভারতের রেকর্ডের বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। এদের মাধ্যমে ভারতীয় রেকর্ডের বাজারে আত্মপ্রকাশ করে বেকা রেকর্ড, ওডেন রেকর্ড, রাম-এ-ফোন ডিস্ক রেকর্ড, জেমস ডিস্ক রেকর্ড, সিঙ্গার রেকর্ড এবং সান ডিস্ক রেকর্ড। এর ভিতরে স্বল্প দামে সান ডিস্ক রেকর্ড বাজারে এলে, এদের রেকর্ড প্রচুর বিক্রয় হয়। এই সময় এদের উভপার্শ্বিক রেকর্ড বিক্রয় হতো ২ টাকায়। সে সময় এই মানের অন্যান্য কোম্পানির রেকর্ড বিক্রয় হতো ৩ টাকা বা তার বেশি দামে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য গ্রামোফোন কোম্পানি জেনোফোন লেবেলে তাদের রেকরড বিক্রয় শুরু করেছিল ২ টাকায়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে মূল্য কমের বিচারে জোনোফোন রেকরড শীর্ষে চলে গিয়েছিল। এদের এন-১ সিরিজের রেকর্ডগুলো ছিল ১০ ইঞ্চি এবং ভি-১ সিরিজের রেকর্ড ছিল ১২ ইঞ্চি মাপের।

এর ভিতরে কিন্তু নতুন নতুন দেশীয় কোম্পানির জন্ম হয়, আবার বিদেশী অনেক ব্যবসার জন্য ভারতে আসে। দেশীয় রেকর্ড কোম্পানিগুলোর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো ছিল- শাহানশাহ্ রেকর্ড, মেগাফোন রেকর্ড, পাইওনিয়ার রেকর্ড, সেনোলা রেকর্ড, হিন্দুস্থান রেকর্ড। আর বিদেশী কোম্পানির ভিতরে ছিল কলাম্বিয়া রেকর্ড, নিকোল, বেকা, ওডিয়ন উল্লেখযোগ্য।
 
এডিশন-বেল-এর চোঙাকৃতির রেকর্ডের জন্য আঁকা মূল ছবি
হিজ মাস্টার'সর-এর লোগো
এদের রেকর্ডে শ্রবণরত একটি কুকুর-এর ছবি রয়েছে। এই ছবি আর এইচএমভি নাম সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

ছবির এই কুকুরটি ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম হয়েছিল। এর মালিক ছিল প্রিন্স'স থিয়েটারের দৃশ্য নকশাকারী মার্ক হেনরি বারাউড
(Mark Henry Barraud) । ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে হেনরি বারবাউড মৃত্যুর পর, কুকুরটির মালিক হয় তাঁর দুই ভাই ফিলিপ ও ফ্রান্সিস। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে কুকুরটি মারা যায়। কুকুরটির কবর দেওয়া হয় ক্লারেন্স সরণীর কিংস্টোন আপঅন থামিস গোরস্থানে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সিস এডিশন-বেল-এর চোঙাকৃতির রেকর্ডের জন্য একটি ছবি আঁকেন। এই ছবিতে এই কুকুরটির ছবি ব্যবহার করা হয়। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি ছবিটির স্বত্‌বাধিকার পাওয়ার জন্য ফ্রান্সিস একটি আবেদন করে। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল Dog Looking At and Listening to a Phonograph । এই ছবিটি নিয়ে এডিশন-বেল কোম্পানির কাছে বিক্রয়ের জন্য গেলে, কোম্পানির কর্মকর্তা James E. Hough ছবিটি গ্রহণ করার পরবর্তে মন্তব্য করেন "কুকুরা ফোনোগ্রাফ শোনে না (Dogs don't listen to phonographs) । এরপর ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ফ্রান্সিস ছবিটি নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানির মেডিয়ান লেনের অফিসে যান। ছবিটি ভিক্টর টকিং এবং গ্রামোফোন কোম্পানি ছবিটি ক্রয় করেন এবং তাঁদের রেকর্ডের জন্য এই ছবিটির কিছু পরিবর্তন করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশে এই ছবিটি নানারূপে নানা দেশের রেকর্ডের সাথে ব্যবহার করা হয়। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে এল্ডরিজ জনসন ভিক্টর টকিং ম্যাশিন কোম্পানির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিক অধিকার পায়। সেই সূত্রে এরা এই ছবিটি তাঁদের রেকর্ডে ব্যবহার করা শুরু করে।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাখার অবনতি হলে, কলাম্বিয়া রেকর্ডস এবং জোনোফোন এই শাখাকে কিনে নেয়। এর ভিতর গ্রামোফোন টকিং মেশিন তৈরিকারক এল্ড্রি আর জনসন (
Eldridge R. Johnson নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নামকরণ করা হয় Victor Talking Machine Company। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানি তাদের হিজ মাস্টার্'স ভয়েসের লোগো যুক্ত করে। এই লোগোটি গ্রামোফোন কোম্পানির তৈরিকৃত রেকর্ডের বাণিজ্যিক প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই লোগোতে ব্যবহৃত কুকরটির নাম ছিল নিপ্পার (Nipper)

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এইচএমভি ইলেক্ট্রিক্যাল রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থার উদ্বোধন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উল্লেখ্য এই রেকর্ডিং ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে কিনা, তা পরীক্ষা করার জন্য প্রথম রেকর্ড করেছিল ধীরেন দাস ও হীরেন বসু।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বিয়া কোম্পানির এবং গ্রামোফোন কোম্পানি একত্রিত হয়। মিলিত দুই কোম্পানির নাম হয়
Electric and Musical Industries Ltd (EMI) । কিন্তু The Gramophone Company, Ltd. নামটি অনেকদিন চালু ছিল।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগষ্ট ভারতে
The Gramophone Co. (India) Limited । নামক একটি কোম্পানি চালু হয়। কিছুদিন পর এই নামটি পরিবর্তন করে রাখা হয় The Gramophone Co. of India Limited । ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১লা এপ্রিল এর সাথে Private । শব্দটি যুক্ত হয়। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ অক্টোবর পুনরায় এর নাম হয় “The Gramophone Company of India Limited”

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে
EMI। নামে কোম্পানি হিসেবে বৈধতা পায়। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের RPG Group। এই কোম্পানির অধিকার ইএমআই-এর কাছ থেকে ক্রয় করে। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর এই কোম্পানির নামকরণ করা হয় 'সারেগামা'। [দেখুন: ভারতবর্ষে রেকরড]

সূত্র: