নন্দনতত্ত্বের ক্রমবিকাশ
প্রাগ্-আধুনিক মানব অধ্যায়

জীবজগতের প্রজাতি মাত্রেই টিকে থাকার সংগ্রামের ভিতরে অনুভব করে স্বস্তি ও অস্বস্তি। যাপিত জীবনের স্বস্তিবোধের ক্রমোত্তরণের সুখময় দশার মধ্য দিয়ে মনোজগতে জাগে আনন্দের অনুভব। আর বহুবিধ আনন্দের সমন্বিত দশায় সৃষ্ট সামগ্রিক অনুভব হলো সুন্দর। জীবের সৌন্দর্য-বোধ লুকিয়েছিল জীবসত্তার গভীরেতার উদ্ভব হয়েছিল জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার স্বস্তিবোধের মধ্য দিয়ে। এর ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বেঁচে থাকার আনন্দ। আর যাপিত জীবনের বহুবিধ আনন্দের সমন্বয়ে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে জীবন হয়ে  উঠেছিল সুন্দর।

আদিম
জীবকণিকার ভিতরে অস্বস্তি থেকে স্বস্তি দশায় পৌঁছার প্রক্রিয়া সচল ছিল সহজাত টিকে থাকার প্রেরণায়। বেঁচে থাকার সংগ্রামে জীবকণিকার দৈহিক পরিবর্তন ঘটেছিল একটি সুদীর্ঘ সময় ধরে। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় আবির্ভাব ঘটেছিল হোমো গণের প্রজাতিসমূহ। জীবের এই ক্রমবিবর্তনের ধারায়, কোনো কোনো প্রজাতি বেঁচে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি এমন কিছু আচরণে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল। এরা প্রয়োজন মেটানোর মৌলিক শর্তে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল যে, প্রয়োজনের চেয়ে প্রয়োজন মেটানোর আনন্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিল। একালের মনুষ্য সমাজে তা অনেক বেশি সক্রিয়। যেমন দেহের ক্ষয়পূরণ বা বৃদ্ধির জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য গ্রহণের এই প্রয়োজনটা মানুষের কাছে যতটা প্রাধান্য পায়, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় সুস্বাদু খাবার খাওয়ার আনন্দ।

জীবজগতের প্রাথমিক আনন্দ লাভের সুযোগ ঘটেছিল খাদ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কারণ এর ভিতর দিয়ে জীব ক্ষুধার অস্বস্তি থেকে স্বস্তি বা আনন্দ লাভ করেছিল। কথায় বলে খেতে পেলে শুতে চায়। এই শোয়াটা হলো বিশ্রাম। এর সাথে রয়েছে অনুকুল পরিবেশে ক্ষুধাতৃপ্ত দেহের আশ্রয়। এই দুটি অধ্যায়ের পর, জীবের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছিল প্রজাতিগতভাবে প্রকৃতিতে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল
যৌনানন্দ।

জীবদেহে যৌনানন্দের বিকাশ ঘটেছিল প্রকৃতির কৌশলী উপকরণ হিসেবে। প্রজাতির বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন শিশুর জন্ম দান। শিশুর জন্মদানের প্রাথমিক স্তর হিসেবে আননন্দময় যৌন-ক্রিয়ার ব্যবস্থা লেখা হয়েছিল জিন সঙ্কেতে। যতদিন আদিম জীবকণিকাগুলো বিভাজিত হয়ে বা নিজের অন্যের সাহায্য ছাড়াই নিজ দেহে শিশু উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতো, ততদিন যৌনানন্দ ছিল স্বনির্ভর। কালপ্রবাহে এক সময় একই প্রজাতি স্ত্রী-পুরুষে বিভাজিত হয়ে গেল। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল যৌনানন্দের পরনির্ভশীলতা। এর ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণজনতি ব্যাকুলতা। পরস্পরের সান্নিধ্যলাভ এবং মিলন হয়ে উঠেছিল আনন্দ লাভের একটি বিশেষ উপকরণ।

জীবের ক্রমবিবর্তনের প্রাথমিক স্তরে অপত্যস্নেহ বলে কিছু ছিল না। কারণ কোনো প্রজাতি থেকে উৎপন্ন শিশু যথেষ্ঠ স্বাবলম্বী হয়ে জন্মাতো। কিন্তু উন্নতর জীবের ক্ষেত্রে দেখা গেলো, এদের শিশুরা প্রকৃতির সাথে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ঠ ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে না। একটি সুনির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর শিশু পূর্ণতা লাভ করতো, যাকে আমরা বলে থাকি প্রাপ্তবয়স্ক দশা। শিশুর প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত শিশু পিতা-মাতার কাছ থেকে অপত্যস্নেহ লাভ করতো। এর ভিতর দিয়ে সৃষ্টি সন্তানের প্রতি ভালোবাসার আনন্দ। জীবের ক্রমবিকাশের ধারায়, ভালো খাদ্যগ্রহণ, উত্তম পরিবেশে থাকা, যৌনমিলন, অপত্যস্নেহ- এ সবই সহজাত অনুভবের সূত্রে বাধা ছিল।

জীবজগতের সকল প্রজাতির আনন্দিত জীবনের অঙ্গন থেকে বেরিয়ে এসে যদি শুধু মনুষ্য সমাজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক আনন্দের কথাই ভাবি, তাহলে প্রশ্ন জাগে এ কোন্ মানুষ? প্রাচীন দার্শনিকরা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন- শুধু হোমো গণের জ্ঞানী প্রজাতি তথা হোমো স্যাপিয়েন্সদের ভিতরে। নিশ্চয়ই হোমো স্যাপিয়েন্সরা সার্বিক বুদ্ধিমত্তা এবং সৌন্দর্যপিপাসার বিচারে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু যখন হোমো গণের পূর্ব-প্রজাতিদের মধ্যে এই দুটি বিষয়ের কমবেশি উপস্থিতি আবিষ্কৃত হলো, তখন অনিবার্যভাবে ভাবতেই হলো- সুন্দরের সাধনার অধিকার শুধু হোমো স্যাপিয়েন্সরা অর্জন করেছিল, নাকি হোমো গণের পূর্ব-প্রজাতিদের কাছ থেকে প্রাধমিক শিক্ষা লাভ করেছিল? যদি ধরেই নেওয়া যায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের নান্দনিক বোধের বিকাশ ঘটেছিল হোমো গণের পূর্ব-প্রজাতিদের হাত ধরে, তাহলে এদের আগের অস্ট্রালোপিথেকাসদের মধ্যেও তো এর কিছু নমুনা পাওয়া যায়। এই ভাবে আমরা যদি ধীরে ধীরে অতীতের দিকে যেতে থাকি, তাহলে আমাদেরকে পৌঁছুতে হবে আদিম জীবকণিকার কাছে। এটাই সত্য, কারণ আজকের মানুষ ক্রমবিবর্তনের ধারায় শুধু দেহটা পায় নি। পেয়েছে সকল সকল বুদ্ধিমত্তা এবং নান্দনিক বোধ বহুদিন ধরে একটু একটু করে।

প্রশ্ন হলো- তাহলে নন্দনতত্ত্বের ক্রমবিকাশের ধারায় যুগসন্ধিকাল হিসেবে কোন সময়কে বিবেচনা করবো এবং কিসের বিচারে তা নির্ণিত হবে? আমরা যদি জীবের ক্রমবিবর্তনে ধারাকে অনুসরণ করি, তাহলে দেখবো জীবের ভিতরে এক সময় সৃজনশীল ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছিল। আদিম এক কোষী প্রজাতিগুলো ছিল, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য কিছু সহজাত ক্ষমতার মধ্যে। কালক্রমে উন্নতর প্রজাতির উদ্ভব হতে থাকলে, এদের কিছু প্রজাতির ভিতর সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটেছিল। যেমন ধরা যাক, আমাদের চেনাজানা বাবুই পাখির কথা। এর ঘর বানাতে পারে। এবং দেখতেও সুন্দর। নিঃসন্দেহে এটি একটি সৃজনশীল কাজ। কিন্তু এদের বড় অক্ষমতা হলো- নিজদের সহজাত ক্ষমতার দ্বারা ঘর বানায় বটে, কিন্তু এর বাইরে সে অন্য কিছু বানাতে পারে না বা অন্য নকশার মজবুত ঘর তৈরি করতে পারে না। এই সূত্রে মানবেতর প্রজাতিসমূহের এই সৃজনশীল ক্ষমতাটাই বেশি করে চোখে পড়ে। স্বাধীন ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে মানবেতর প্রজাতিসমূহের সৃজনশীল ক্ষমতা সহজাত প্রবৃত্তির অধীন। মূলত যথার্থ সৃজনশীল ক্ষমতা হলো- নিজের মতো করে কিছু উদ্ভাবন করা।

স্বাধীনভাবে সৃজনশীল কাজের ভিতর দিয়ে নতুন কিছুর সৃষ্টি এবং তার উন্নয়নের ঘটনা ঘটেছিল মূলত হোম গণের প্রজাতিদের ভিতরে।
সৃজনশীল কাজের বিচারে আদিম নমুনা হিসেবে পাই নিম্ন-প্রস্তর যুগের এদের তৈরি কিছু পাথুরে যন্ত্রপাতি। সে সব তৈরি হয়েছিল হোমো হ্যাবিলিস ও হোম ইরেক্টাসদের মতো মানুষদের হাতে। সে সব যন্ত্রপাতিকে তারা ডিম্বাকার, লম্বাটে করে মসৃণ করেছিল, ব্যবহারের সুবিধার জন্য। আদিম সৃজনশীল স্তর পেরিয়ে মানুষ সুকুমার কলার (সঙ্গীত, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যদি) চর্চা শুরু করেছিল, তা সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ দিয়ে চিহ্নিত করার উপায় নেই। তবে প্রত্নতাত্তিকদের অন্বেষণের সূত্রে আমরা যে চিত্র নমুনাগুলো পাই, তা মানব সভ্যতার ক্রমবিরতিত ধারাকে তুলে ধরে। যা নিঃসন্দেহে সৌন্দর্যবোধের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাষায় প্রস্তরযুগের সকল সুকুমার কলাই 'প্রাগৈতিহাসিক সুকুমারকলা'। এই সময় অরণ্যচারী মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পর্বতগুহায় বসবাস করা শুরু করেছিল। একই সাথে তারা পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতি তৈরি করতে শিখেছিল। এরা আগুন তৈরি করতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল। মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের এই ধারা সূচিত হয়েছিল আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যপিয়েনস্‌দের আগে থেকে। 

হোমো হলো
প্রাণিজগতের হোমিনিডি গোত্রের একটি গণ বিশেষ। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে লিনিয়াস
(Linnaeus) এর নামকরণ করেছিলেন। আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভাষায় এটি শুধুই গণ নয়। সামগ্রিকভাবে হোমো হলো মানুষের সমার্থক শব্দ। এর ভিতরে আধুনিক মানুষ হলো- Homo sapiens হোমো স্যাপিয়েন্স। এর বাইরে অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে বলা যায় প্রাচীন মানুষ।

হোমো গণের প্রজাতিসমূহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- পরিবেশ অনুসারে বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। এর ভিতরে প্রকাশ পেয়েছিল বুদ্ধিমত্তার। এই ক্ষমতার বিশেষ প্রকাশ ঘটেছিল হোমিনিডি আদিম প্রজাতিগুলোর ভিতরে। এই বুদ্ধিমত্তার বিশেষ প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, মানুষ এবং মানুষের নিকটবর্তী প্রজাতিগুলোর ভিতরে। বিশেষ করে শিম্পাঞ্জী, গোরিলা এবং বানরকুলের ভিতরে। কিন্তু সৃজনশীল ক্ষমতার বিচারে এরা হোমো গণের সমকক্ষ উঠতে পারে নি। তাই প্রাথমিক নির্বাচনে এদেরকে বাইরেই রাখা যেতে পারে।

জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের ধারায় অনেক পথ পেরিয়ে এসে প্রাইমেট বর্গের উদ্ভব হয়েছিল ১ কোটি ৭০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বর্গ থেকে উদ্ভব হয়েছিল হমো গণের। এক সময় মনে করা হতো- হোমো গণের প্রজাতি বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছিল সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে। এরাই সার্থকভাবে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপকরণ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে শিখেছিল এবং উপাদানসমূহ থেকে নানাবিধ উপকরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া নিজেদের অভিজ্ঞতাকে তার স্বজাতির কাছে প্রকাশ করার কৌশল আয়ত্ব করতে পেরেছিল। ফলে এরা বহুজনের জ্ঞানকে একীভূত করে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যখন ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে কেনিয়ার তুরকানা কাউন্টির লোমেক্উইযখন কেনিয়ান্থ্রোপাস গণের Kenyanthropus platyops প্রজাতির ব্যবহৃত পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হলো, তখন দেখা গেল সৃজনশীল ক্ষমতার গুণ শুধু হোমো গণের প্রজাতির ভিতর বিকাশিত হয়েছিল, এমনটা নয়। ৪৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে আফ্রিকাতে আবির্ভুত অস্ট্রালোপিথেকাসের ভিতরে এই বিশেষ ক্ষমতার স্ফূরণ দেখা গিয়েছিল। তবে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ করতে পারে নি। এর পরে হোমিননি গোষ্ঠীর Kenyanthropus platyops প্রজাতিটির ভিতর সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটেছিল। তূলনমূলকভাবে এরা বুদ্ধিমত্তা দিক থেকে কেনিয়ান্থ্রোপাসরা অস্ট্রালোপিথেকাদের চেয়ে অগ্রসর ছিল।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোনিয়া হার্মার্ড এবং জেসন লুইস কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের কাছে কিছু পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতির সন্ধান পান। গবেষকরা এই ক্ষেত্রের নামকরণ করেন Lomekwi3 । এই নতুন ক্ষেত্রটিতে পাওয়া যায় এমন কিছু যন্ত্র, যেগুলো পাথর ঘষে তৈরি করা হয়েছিল। এরূপ নানা ধরনের ১৩০টি নমুনা পাওয়ার পর সোনিয়া হার্মার দাবি করেন যে, এগুলো হোমোনিনি গোষ্ঠীর কোনো প্রজাতির সৃষ্টি। ইথিওপিয়ার গনার নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত পাথরের যন্ত্রের চেয়ে এগুলো ছিল বেশ ভারি। এখানে প্রাপ্ত যন্ত্রের ভিতরে পাওয়া গিয়েছে একটি ধাতুর তৈরি তাওয়া। এর ওজন প্রায় ১২ কেজি।

এর আগের প্রজাতিগুলো, জন্মগ্তসূত্রে প্রাপ্ত সহজাত ক্ষমতায় যা করতে পারতো, তার বাইরে কিছু ভাবাটা প্রয়োজন মনে করে নি। কেনিয়ান্থ্রোপাস গণের এই প্রজাতিটি, এর বাইরে বেরিয়ে এসে পাথরকে ঘষে ঘষে যন্ত্র তৈরি করেছিল। মটি খনন, হিংস্র জন্তু থেকে আক্রমণ প্রতিহতকরণ, মাংস কর্তন বা থেঁতলানোর জন্য এরা এই পাথুরে যন্ত্র ব্যবহার করতো। এরা গাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করতো। সেকালের পরিবেশে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য এই টুকু ক্ষমতাই হয়তো পর্যাপ্ত ছিল না। তাই ৩২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis)
হোমো গণের উদ্ভব হয়েছিল ২৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।  এই গণের আদিম প্রজাতিগুলো গোড়াতেই সুগঠিত ভাষার ব্যবহার শিখে উঠতে পারে নি বটে, কিন্তু এরা অঙ্গসঞ্চালন এবং কিছু ধ্বনি ব্যবহার করে, যোগাযোগ এবং ভাব বিনিময় করতে শিখেছিল। এই ধারায় হোমো গণের আদিম কোন প্রজাতির আবির্ভাব হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে হোমো গণের প্রজাতিসমূহের সর্বপ্রাচীন জীবাশ্ম হিসেবে  হোমো হ্যাবিলিসদের আদি প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদের আবির্ভাব ঘটেছিল শীতল পরিবেশে। কারণ এই সময়
পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে গিয়ে বরফ যুগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ২৬  লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এই বরফযুগের প্রভাবে উত্তর গোলার্ধের মেরু সংলগ্ন এলাকার জলস্থল বরফ ঢেকে গিয়েছিল। এই সময় আফ্রিকার জলবায়ু মেরু সংলগ্নের মতো না হলে- অনেকটাই শীতল পরিবেশে চলে গিয়েছিল।  এরই ভিতরে ্রায় লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকায়

হোমো হ্যাবিলিসদের উচ্চতা ছিল মাত্র ১-১.৫ মিটার এবং ওজন ছিল ৩০-৩২ কেজি। আধুনিক মানুষের চেয়ে এদের হাত ছিল অপেক্ষাকৃত বড়। এরা হাতের সাহায্যে হাতিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই কারণে এদের নামকরণ করা হয়েছে হাতুরে মানব (habillis=handy man)।  এদের আবিষ্কৃত জীবাশ্মের কাছে কিছু পাথুরে অস্ত্র পাওয়া যায়। এদের মুখ ছোট হলেও, নাক ততটা নিচু ছিল না এবং  চোয়ালের গড়নও ছিল এপদের চেয়ে পাতলা। এদের মাথার খুলির মাপ ছিল ৫০০-৬৫০ সিসি।

ওল্ডোয়ান পাথুরে কুঠার

এরা আত্মরক্ষা এবং শিকারের জন্য অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছিল। এদের প্রধান শত্রু ছিল- সেকালের শিকারী হায়না (Chasmaporthetes nitidula) , লেপার্ড, সাবার-টুথ, কুমির। এদের দ্বারা সৃষ্ট সভ্যতার প্রথম নমুনা পাওয়া যায় পূর্ব-আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার ওল্ডুভাই জর্জ (Olduvai Gorge) অঞ্চলে। এরাই প্রথম পাথুরে কুঠার ব্যবহার করা শিখেছিল। এই কুঠারে কোনো হাতল ছিল না। এই কুঠার মুঠোবন্দি করে, সজোরে আঘাত হানা হতো। এই কুঠার এরা গাছের ছালবাকল বা কন্দ থেঁৎলানো, শিকারকে আঘাত করা এবং বন্য প্রাণীর আক্রমণ প্রতিহত করা, কাঠ চেরা, নরম জিনিস কাটা ইত্যাদির জন্য ব্যবহার করতো। এই কুঠারের আঘাতকারক অংশ ছিল সুঁচালো। হোমো হ্যাবিলিসদের এই কুঠার উন্নতর হয়েছিল পরবর্তী পরবর্তী ১৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ক্রমবিবর্তনের ধারায়। এই ধারায় হোমো হ্যাবিলিসরা কুঠারকে দীর্ঘ করেছিল এবং প্রান্তভাগ অধিকতর সুঁচালো করতে সক্ষম হয়েছিল।

হোমো ইরেক্টাস
এরপর উন্নতর প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল হোমো ইরেক্টাস২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকাতে এই প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল।  হোমো গণের এই প্রজাতি প্রথম দুই পায়ে ভর করে মাটির উপর সটান দাঁড়াতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানীরা তাই এর নাম দিয়েছেন ইরেক্টাস।

এরা
সৃজনশীল ক্ষমতার দ্বারা নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপকরণ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে পারতো এবং এ সকল উপাদনসমূহ দিয়ে নানাবিধ উপকরণ তৈরি করতে পারতো তবে সৃজনশীল ক্ষমতার বিচারে এরা আধুনিক মানুষের সমকক্ষ ছিল না। সটান মাটির উপর দাঁড়াতে বা চলাফেরা করার বিশেষ গুণের কারণে এরা চলাফেরায় স্বচ্ছন্দ গতি পেয়েছিল। এই বিশেষ গুণের কারণেই এরা হাতে এবং মাথায় ভারি বস্তু বহন করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া মস্তিষ্কের ও দেহের কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক দিয়ে এরা অনেকটাই আধুনিক মানুষের মতো হয়ে উঠেছিল। এদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৮ মিটার। এদের গড় ওজন ছিল ৬০ কেজি। খুলির গড়ন ছিল আধুনিক মানুষের মতো। খুলির পরিমাপ ছিল ৯০০-১১০০ সিসি। এরা আধুনিক মানুষের মতো দুই পায়ে সোজা হয়ে হাঁটতো এবং হাত ও পায়ের আনুপাতিক দৈর্ঘ্য ছিল আধুনিক মানুষের মতো।

সম্ভবত এরা আফ্রিকা মহাদেশের তান্জানিয়ার ওল্ডুভাই জর্জ (Olduvai Gorge) অঞ্চলে হোমো হ্যাবিলিস মতো আবির্ভূত হয়েছিল। হোমো হ্যাবিলিস মতোও নিম্নপ্রস্তর-যুগ বিকাশে এরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। প্রায় ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতিটিই আফ্রিকার বিভিন্ন  অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি শাখা ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে। পরে এই শাখাটি বিভাজিত হয়ে একটি শাখা ইউরোপের ককেশাশ অঞ্চলে থেকে যায়। অবশিষ্ট অংশের একটি দল প্রথমে চীনে প্রবেশ করে। পরে এর একটি দল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপাঞ্চলে চলে যায়। বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই প্রজাতিটি ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বিভিন্ন স্থানে এই প্রজাতিটির বিবর্তিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। এসকল প্রজাতির জীবাশ্মগুলোকে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে এবং নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- জাভা মানব, সোলো মানব, পিকিং মানব ইত্যাদি।

হোমো এর্গাস্টার
প্রায় ১৯ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবিরর্ভূত হয়েছিল হোমো এর্গাস্টার নামক অপর একটি প্রজাতি। আর ১৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূরব্দের দিকে এই প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

এরা মাটির উপর দুই পায়ে সটান দাঁড়াতে পারতো। তাই প্রথম দিকে কোনো কোনো বিজ্ঞানী একে হোমো ইরেক্টাস-এর উপ-প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। বর্তমানে একে একটি পৃথক প্রজাতি হিসাবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হোমো গণের আগের প্রজাতিগুলো অপেক্ষা এদের বুদ্ধি ছিল বেশি। এদের মাথার খুলির মাপ ছিল ৭০০-৮৫০ সিসি। ধারণা করা হয় এদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৯ মিটার। এদের নিতম্বের হাড়ের গড়ন দেখে মনে হয়- এরা দীর্ঘপথ হাঁটতে বা দৌড়াতে পারতো। এদের হাতের ও পায়ের গড়ন ছিল আধুনিক মানুষের মতো।

ফ্রান্সে প্রাপ্ত আশুলিয়ান কুঠারের নমুনা

আত্মরক্ষা এবং শিকারের জন্য এরা পাথুরে কুঠার ব্যবহার করতো। তবে এই কুঠারের আকার ছিল অনেকটা নাশপাতির মতো। এই বিশেষ ধরনের যন্ত্রকে বলা হয় আশুলিয়ান যন্ত্রপাতি

১৯ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবিরর্ভূত হয়েছিল হোমো গণের আরও দুটি প্রজাতি। সম্ভবত এরা আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। এই কারণে,অনেকে এদেরকে সরাসরি মানুষের পূর্ব-পুরুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকেন। মূলত এদের সাথে হোমো ইরেক্টাসের অনেক মিল থাকলেও- ধারণা করা এরা পূর্ববর্তী কোনো অজ্ঞাত প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

হোমো ইরেক্টাসের উত্তরসূরী হিসেব আত্মপ্রকাশ করেছিল আরও কিছু প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল। জীবাশ্ম বিচার করে এদের আবির্ভাবকাল অনুমান করা হয়েছে। এদের অনেক প্রজাতিরই সৃষ্ট সভ্যতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এদের ভিতরে ছিল-

হোমো জর্জিকাস:
সম্ভবত এদেরও আবির্ভাবকাল লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। অবশ্য এর যে খুলিটি পাওয়া গেছে, তা ৭.৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পুরানো।  এদের মাথার খুলির মাপ ৬০০ ঘন-সেন্টিমিটার


হোমো এন্টেসেসর:
প্রায় ১২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকা স্পেন ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিল। লক্ষ বৎসর আগে এরা ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপে যে কয়েকটি মনুষ্য- প্রজাতি বসবাস করতো- হোমো এন্টেসেসর ছিল তার মধ্যে একটি। ধারণা করা হয় এরা ছিল হোমো এর্গাস্টার এবং হোমো হাইডেলবার্গেনসিস -এর মধ্যবর্তী একটি প্রজাতি। কিন্তু Richard Klein-সহ আরও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন হোমো এর্গাস্টার থেকে বিবর্তিত হয়ে এই প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছিল। বৈশিষ্ট্যে বিচারে এরা হোমো হাইডেলবার্গেনসিস-এর কাছাকাছি ছিল। আবার অনেকে মনে করেন হোমো এন্টেসেসর আর হোমো হাইডেলবার্গেনসিস একই প্রজাতি

হোমো আটল্যান্‌থ্রোপাস
ধারণা করা হয়, ১২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল আফ্রিকার মৌরতানিয়া অঞ্চলে । এদের উচ্চতা ছিল ১.৭-১.৮ মিটার এবং ওজন ছিল ৬০ কেজি। এদের মস্তিস্কের পরিমাণ ছিল ১০০০-১১০০ ঘন-সেন্টিমিটার।

হোমো সেপ্রানেনসিস
প্রথম দিকে ধারণা করা হয়েছিল এই প্রজাতিটি ৯-৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে জীবিত ছিল। এই সময় এর সাথে হোমো ইরেক্টাস-এর খুলির অনেক মিল লক্ষ্য করে, অনেকে ভেবেছিলেন হয়তো এই খুলিও হোমো ইরেক্টাস-এর। পরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে অনুমান করেছেন, হয়তো এরা ৫ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসর আগে পৃথক প্রজাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।


সৃজনশীল প্রাচীন গোষ্ঠীর বিচারে বড় ধরনের পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস নামক প্রজাতি। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এরাই হয়ে উঠেছিল আধুনিক মানুষের নিকটতম জ্ঞাতি।

হোমো হাইডেলবার্গেনসিস
এদের জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি এবং দেহগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরনে বিতর্ক আছে। এদেরকে সরাসরি হোমো ইরেক্টাসদের সদস্য হিসেবে অনেকে দাবি করেছেন। আবার অনেকে হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। নানা ধরনের গবেষণার পর, একে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে সকলে স্বীকার করে নিয়েছে।

সম্ভবত হোমো গণের ভিতর এই প্রজাতিই প্রথম তাদের মরদেহ কবর দ
েওয়া শুরু করেছিল। এদের ভিতরে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা জন্মেছিল। অবশ্য এদের আগেই হোমো এর্গাস্টারদের ভিতর কথা বলার উপযোগী স্বরতন্ত্র এবং বাগ্-প্রত্যঙ্গের বিকাশ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এরা শিকারের জন্য নিক্ষেপণযোগ্য বর্শা ব্যবহার করতে পারতো। বিভিন্ন জীবাশ্ম পর্যালোচনার পর, বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন এদের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৪০ সেন্টিমিটার। তুলনামূলকভাবে এদের পা দেহের উপরের অংশের চেয়ে বড় ছিল। এদের উজ্জ্বল ও মোটা অস্থি দেখে ধারণা করা যায় যে, দৈহিকভাবে এরা বেশ সবল ছিল।

এদের মস্তিষ্কের গড় মাপ ছিল ১২৫০ সিসি। মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে ছিল ছোটো চক্ষু-গহ্বর। এই গহ্বরের উপরে ছিল বাঁকানো ভ্রূ-রেখা। মুখের চোয়াল ততটা প্রশস্ত ছিল না। এর ফলে এরা আগের প্রজাতিগুলোর মতো বড় হা করতে পারতো না। নিচের চোয়াল বেশ মজবুত ছিল। আগের প্রজাতিদের চেয়ে এদের দাঁত ছোটো ছিল। তবে
আকারে আধুনিক মানুষদের চেয়ে বড় ছিল।

এরা ছিল মূলত শিকারী। শিকারের জন্য এরা পাথরের তৈরি নানা আকারের অস্ত্র ব্যবহার করতো। এছাড়া মাটি খনন, মাংস কাটা বা থ্যাঁৎলানোর জন্য পাথরের কুঠার ব্যবহার করতো। এদের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ছিল হোমো এর্গাস্টারদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাত
ির মতো। এর বাইরে এরা এন্টলার হরিণের অস্থি এবং কাঠ দিয়ে অস্ত্র তৈরি করা শিখেছিল। এসকল উপকরণ দিয়ে এরা হাতুরি, বর্শা ইত্যাদি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এরা বেশ ভালোভাবেই আগুন জ্বালানো এবং আগুন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবহার করা শিখেছিল

আয়োনিয়ান আমলে (৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং সমগ্র সাইবেরিয়া অঞ্চলে ব্যাপক শৈত প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। ইউরোপের হিমশীতল পরিবেশে এদের টিকে থাকার জন্য আগুনের ব্যবহারটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। সম্ভবত এই সময় এরা শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোটা পশুর চামড়া ব্যবহার করা শিখেছিল। এরূপ হিমশীতল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মাংস, হাড়, চামড়া সংগ্রহের জন্য বড় বড় পশু শিকার করতো দলবদ্ধভাবে। তখন এদের শিকারের তালিকায় ছিল- গণ্ডার, জলহস্তি, ভল্লুক, ঘোড়া, নানা ধরনের হরিণ।


নৃবিজ্ঞানীদের মতে প্রায় ৪-৩ লক্ষ বছর পূর্বে হোমো হাইডেলবার্গেনসিস একটি দল আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে। এই দলটি পরে দুটি স্বতন্ত্র দলে পরিণত হয়। এই দল দুটি হলো- নিয়ানডার্থাল ও ডেনিসোভান। এদের ভিতরে নিয়ানডার্থাল মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পাড়ি দেয়। এরা জর্মান, ইতালি, স্পেন, গ্রিস প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি শাখা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা যায়। উত্তর ভারতের নর্মদা নদীর তীরে এদের একটি অংশ বসতি স্থাপন করেছিল।  এদের একটি দল সাইবেরিয়ার দিকে চলে যায়। এই দলেরই জীবাশ্ম নমুনা পাওয়া গেছে আল্টাই পর্বতের ডেনিসোভা গুহায়। ডেনিসোভানদের অপর দলটি চলে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার দিকে। এদেরকেই অন্যদিকে ডেনিসোভান মানব বলা হয়
 
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস
হোমো গণ থেকে প্রায় ৫ লক্ষ ৫০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এদের আবির্ভাব হয়েছিল। এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র ছিল ইউরেশিয়াএদের গড় উচ্চতা ছিল ১৬৪ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ৫ ইঞ্চি)। গড় উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১ ইঞ্চি (১৫৫ সেন্টিমিটার)। এদের মাথার খুলির মাপ ছিল ১২০০-১৭০০ সিসি। এদের নাক ছিল বেশ বড়।  আধুনিক মানুষের খুলির গড় মান হলো ১৪০০ সিসি। এই বিচারে নিয়ানডার্থালদের মস্তিষ্ক বড় ছিল।
 

নিয়ানডার্থাল-মানব মধ্য প্রস্তরযুগের সূচনা করেছিল এবং এদের বিকাশ উচ্চ প্রস্তরযুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরা পাথুরে অস্ত্র ব্যবহার করতো। এই সূত্রে এরা শিকারে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে তারা কুঠার, বর্শা ব্যবহার করতো। বর্শাফলকের সাথে তারা কাঠের দণ্ড ব্যবহার করতো। এদের অস্ত্রের গঠন দেখে ধারণা করা হয়েছে যে, এরা ম্যামথ (বিলুপ্ত হাতীজাতীয় প্রাণী) বড় বড় প্রাণী হত্যা করতে পারতো।

এই প্রজাতিকে আধুনিক মানুষের ঠিক পূর্ববর্তী প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন এরা ছিল আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) সমান্তরাল প্রজাতি। মূলত এদের সাথে আধুনিক মানুষের ডিএনএর মিল ছিল প্রায় ৯৯.৭%। সেই কারণে এরা মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
 

ধারণা করা হয়, হোমো গণ থেকে প্রায় ৫ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসর আগে আফ্রিকায় এই প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল। এরা এই সময়ে আফ্রিকার মরক্কোতে বসতি গড়ে তুলেছিল।  এই সময়ে প্রাপ্ত এক মাত্র হস্তশিল্পের নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, 'টান-টানের ভেনাস'। নিয়ানডার্থালদের মাধ্যমে ধরিত্রীদেবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। কালক্রমে এই মাতৃত্ব, প্রেম, যৌনতা, সন্তান, ফসল, উর্বর্তার স্থান দখল করেছিল, পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পৌরাণিক কথকথতায়।

'টান-টানের ভেনাস'
(Venus of Tan-Tan)
ধারণা করা হয়, স্ফটিক পাথরের নির্মিত এই মূর্তিটির তৈরি হয়েছিল প্রায় ৫ থেকে ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে।  এই মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ৬ ইঞ্চি, প্রস্থ প্রায় ২.৬ ইঞ্চি। ওজন প্রায় ১০ গ্রাম।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মূর্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন জার্মানির প্রত্নতত্ত্ববিদ লুৎজ ফিয়েডলার
(Lutz Fiedler) । মরক্কোর টান-টান নগর থেকে কিছু দূরে ড্রা নদীর তীরে এই মূর্তিটি তিনি পেয়েছিলেন। পরে টান-টান নগরের নামানুসারে এর নামকরণ করেছিলেন
টান-টানের ভেনাস

অনেকে মনে করেন এই মূর্তিটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল। পরে সংস্কার করে মনুষ্য মূর্তিতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর গায়ে লালচে রঙ করার জন্য পরে লৌহ এবং ম্যাঙ্গানিজ মিশ্রিত রঙ ব্যবহার করেছিল।

প্রায় ৪ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর পর্যন্ত হয়তো এরা আফ্রিকাতে ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে খাদ্যাভাবের কারণে এরা এশিয়া এবং ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।
প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসর আগে আদি নিয়ানডার্থালরা ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।  ইউরেশিয়া আগত নিয়ানডার্থালদের একটি দল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের পারব্ত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এখানে এদের দ্বারা এখানে পত্তন হয়েছিল মস্টারিন সভ্যতার।  এই সময় এরা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। সম্ভবত এরা শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতো। হিংস্র পশু এবং প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্বত গুহায় বসবাস করতো। নিজেদের ভিতরে তথ্য আদান প্রদানের মতো নিম্নস্তরের ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। এদের খাদ্য তালিকায় ছিল পশুর মাংস এবং নানা ধরনের ফলমূল। এদের ভিতরে মৃতদেহ কবরস্থ করার রীতি গড়ে উঠেছিল।

ফেরাস্সিয়ে গুহাচিত্র
এরা গুহার পাথুরে দেওয়ালে পেয়ালার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এগুলো এরা তৈরি করেছিল গুহাগুলোকে শৈল্পিকভাবে সাজানোর তাগিদে। এর অন্যতম নমুনা স্থান হিসেবে উল্লেখ করা যায়- ফ্রান্দের লা ফেরাসসিয়ের গুহাকে। ধারণা করা হয়, এই দেওয়াল সজ্জার নমুনা'র বয়স ধরা হয়েছে ৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই দেওয়াল সজ্জার নাম দেওয়া হয়েছে '
La Ferrassie Cave Cupules' টান-টানের ভেনাস-এর মতো এখানে কোনো নারী মূর্তি পাওয়া যায় নি বটে, তবে দেওয়াল খোদিত করে নারী যোনী'র চিত্র অঙ্কন করেছিল। সম্ভবত এটিও ছিল আদি দেবীর প্রতীক। এই সময় যোনীকে ভূমিক্ষেত্র এবং উর্বরতার প্রতীক হিসেবে মান্য করা হতো। সম্ভবত ভারতীয় শৈবপন্থীদের শিবলিঙ্গ পূজার মতো সে সময়ে মাতৃযোনীর পূজা হতো।

ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি
এদের ভিতরে সঙ্গীতের চর্চা ছিল।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্লোভেনিয়ার ডিভ্‌জে বাবে প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের একটি অনুভূমিক গুহা থেকে এদের তৈরি একটি বাঁশির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বাঁশি ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি নামেই প্রচলিত। উল্লেখ্য, প্রায় ৪১,৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল।  প্রাপ্ত বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল গুহাভল্লুকের উরুর অস্থি থেকে।

প্রাগ্‌-আধুনিক মানুষের সাংস্কৃতিক ক্রমবির্তনের ধারা :

নমুনা প্রাপ্তির বিচারের প্রাগ্-আধুনিক মানুষের সংস্কৃতিক ক্রমবিবর্তনের আদিম প্রজাতি হলো হোমো হ্যাবিলিস এবং সর্বশেষ প্রজাতি হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস। যথেষ্ঠ নমুনা না পাওয়ার কারণে এর বাইরে রাখা হয়েছে হোমো নালেডি,
হোমো রোডেসিয়েনসিস, ইত্যাদি।

 প্রাগ্-আধুনিক মানুষের জীবনযাপনের ধারায় প্রধান যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায়, তাহলো-

এসব প্রাগৈতিহাসক শিল্প-নমুনা দেখে মনে হয়, হোমো গণের আদিম প্রজাতিসমূহের ভিতরে সুকুমার কলার বিকাশ ঘটেছিল সৃষ্টি তাড়না থেকে। এদের ভিতরে ছিল নিজের মতো করে সুন্দরকে উপস্থাপনার বিমল আনন্দ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এর শুরু হয়েছিল বহু আগেই মানবেতর প্রাণীদের ভিতরে। মানবেতর প্রজাতির ভিতরে দেখা যায়  এমন কিছু আচরণ যা তারা করে আনন্দ পাওয়ার জন্যই। যেমন বানর জাতীয় প্রাণীর গাছে গাছে দোলা খাওয়া, পরস্পরের সাথে খুনসুটি করা। এই আচরণ তীব্রভাবে দেখা গিয়েছিল হোমো গণের বিভিন্ন প্রজাতি সমূহের ভিতরে। প্রাগ্‌আধুনিক মানুষ হয়তো সেই আনন্দের প্রাপ্তিত তাড়নায় গুহায় ছবি এঁকেছিল, পশুর হাড় থেকে বাঁশি তৈরি করেছিল, পশুর রগ দিয়ে তৈরি করেছিল ততযন্ত্র।

আদিম মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিতে আনন্দ পেতো। বহুবিধ আনন্দের সমহারে মানুষের সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটেছিল আরও পরে। কারণ অল্পতেই আনন্দ পাওয়া যায়, কিন্তু সৌন্দর্যের জন্য লাগে একটু বড় পরিসর। যেখানে বহুবিধ আনন্দের সুসমন্বয় ঘটার সুযোগ থাকে। আদিম মানুষ সুবিশাল পাহাড়ে বনরাজিতে দেখাছিল আরণ্যক সৌন্দর্য, আকাশের সুবিশাল পটে সৌন্দর্য অনুভব করেছিল মেঘরাশির রূপবৈচিত্র্যের ভিতরে, কিম্বা জ্যোৎস্না-প্লাবিত উদার আকাশে, কিম্বা অন্ধকার রাত্রিতে নক্ষত্রের দীপাবলি সন্দর্শনে। এরই ভিতর দিয়ে একসময় মানুষের ভিতরে জেগে উঠেছিল সৃষ্টির নেশা। তার চিরচেনা জগতের যে উপকরণগুলো তাকে মুগ্ধ করেছিল, সেগুলোই তারা নিজের মতো করে উপস্থান করার চেষ্টা করেছিল। এই সূত্রে কণ্ঠে উঠে এসেছিল সুর, আর পর্বতগুহার দেয়ালে ফুটে উঠেছিল চিত্রাবলি। দূর-অতীতের পোশাক-সৌন্দর্য, রন্ধন সৌন্দর্য, গন্ধসৌন্দর্য, আচরণগত সৌন্দর্য, বাক্য-সৌন্দর্য ইত্যাদি কিভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল, তার আদিম নমুনা অনুসরণ করার উপায় আমাদের নেই। কিন্তু ভাস্কর্য বা বাদ্যযন্ত্রে নমুনা থেকে আদিম মানুষের নান্দনিক অনুভবকে কিছুটা হলেও স্পর্শ করা যায়।

আধুনিক মানুষের আবির্ভাব
ধারণা করা হয় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud) -তে। উল্লেখ্য আগে মনে করা হতো, দুই লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আদি মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল ইথিওপিয়া অঞ্চলে। সম্ভবত আদিম মানুষ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে মরোক্কো থেকে ইথিওপিয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবরতী অধ্যায়ে আমরা দেখার চেষ্টা করবো আধুনিক মানুষের প্রগৈতিহাসিক অধ্যায়ের সৌন্দর্য ভাবনার স্তরগুলো।


 
http://www.visual-arts-cork.com/site/prehistoric.htm