সত্তার সত্য
নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে যা স্বতন্ত্র পরিচয় ধারণ করে, তাই হলো
সত্তা।
একটি সত্তা যে সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তাই ওই সত্তার বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম।
ব্যাকরণের সূত্রে ধর্ম হলো-
√ধৃ
(ধারণ
করা+
ম (মন্)।
প্রত্যক্ষ
অনুভবের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, সত্তার গুণ
(Quality)।
এই সূত্রেই আমরা বলে থাকি আগুনের
ধর্ম, পানির ধর্ম বাতাসের ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু বস্তুকে অনুভব করা হয়, শুধু এর
নিজস্ব গুণ দিয়ে নয়। অন্য কোনো সত্তার কাছে তা কিভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, তার
দ্বারা। এই বিচারে প্রত্যক্ষ সংবেদন হয়ে উঠে কোনো বিশেষ সত্তার দ্বারা অন্য সত্তার
দ্বারা অনুভবের বিষয়। এই অনুভবের বিষয়টি নানা ভাবে সংঘটিত হতে পারে।
প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য বস্তু থেকে পৃথক
করে। এই পার্থক্য সৃষ্টি হয় অন্য সত্তার শনাক্ত করার ক্ষমতার দ্বারা।
সত্তার
ধর্মের প্রকাশ ঘটে সত্তা এবং সত্তা পর্যবেক্ষকের পারস্পরিক তথ্য-যোগাযোগের সূত্রে।
একটি সত্তা যত ধরনের গুণাবলি ধারণ করে, তার সবটুকু
পর্যবেক্ষকের কাছে যদি ধরা না পড়ে, তাহলে পর্যবেক্ষক ওই সত্তার ধর্ম সম্পর্কে আংশিক
ধারণা করতে পারে মাত্র। সেই কারণে একাধিক ব্যক্তি একই সত্তা একই রকমভাবে অনুভব করতে
পারে না। ধরা যাক একটি আলোকিত ঘর। এই ঘরের একটি গুণ হলো আলোকিত দশা। একজন অন্ধলোকের
কাছে এই ঘরটির আলোকিত গুণটি ধরা পড়বে না।
অন্ধ লোকের বিচারে সবই অন্ধকার। তার
অর্থ এই নয়, আলোকিত ঘর হতে পারে না। কোন বর্ণান্ধ মানুষ হয়তো লাল রঙ ধরতে পারে না।
সুতরাং একজনের জন্য লাল ফুল, বর্ণান্ধের জন্য তা অন্য রঙের ফুল। সর্দি হলে, আমরা
অনেক সময় অনেক গন্ধ পাই না। তার অর্থ এই নয় যে, ওই বস্তুটি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য
হারিয়ে ফেলেছে। তাই কোনো সত্তার প্রকৃত গুণ কি, সেটা কোনো সুনির্দিষ্ট মান প্রদান
করে না। এই
বিচারে মানুষ বা মানবেতর প্রাণী বাস্তবে অন্যকোনো সত্তার ধর্ম সম্পূর্ণ জানতে পারে
না তার তথ্যগ্রহণের অক্ষমতার কারণে।
কোনো সত্তার ধর্ম যখন কারো কাছে প্রকাশিত হয়, তখন
সত্তার কিছু গুণ বা উপলব্ধি-কৃত গুণের
মানের বিচার চলে আসে। একই সাথে ইন্দ্রিয়ভিত্তিক বিচারের বিষয়টি চলে আসে। সাধারণভাবে
এই জাতীয় বিষয়গুলো যে ভাবে বিচার করা হয়, তাই হবে সত্তার গুণমানের বিচার। যেমন-
সত্তার গুণ-তীব্রতা: কেউ যখন কোনো সত্তার গুণকে নিজের মতো করে অনুভব করে, তখন সে এর গুণের তীব্রতা (Intensity) বিচারও করে। ধরা যাক কেউ একটি বিশেষ বস্তুকে 'বল' বলছে। এখানে দর্শক বলটি আকারের একটি বিশেষ গুণকে বিশেষ মূল্য দিচ্ছে। একই সাথে সে আকারের গুণমানকেও তুলনা করবে, বলটি ছোটো না বড়। আকার, গন্ধ, স্পর্শকাতরতা ইত্যাদি সংবেদনের বিচারে গুণ তীব্রতার বিচার করা হয়। এই বিচারে গুণের তীব্রতার তুলনা করার বিষয়টি নির্ধারিত হয় দুটি প্রক্রিয়া সূত্রে। এর একটি ইন্দ্রিয়গত অপরটি ভাবগত।
ইন্দ্রিয়গত: ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সকল অনুভব মানুষের মনে উৎপন্ন হয়, তার তীব্রতা নিরূপিত হয়, ইন্দ্রিয়ের সংবেদন মানের বিচারে। তাই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বিচারে গুণ-তীব্রতা নিরূপিত হবে। যেমন―
দর্শনগত বিচার: কোনো সত্তাকে যেভাবে দেখা যায়, তার বিচারে গুণসত্তার তীব্রতা নিরূপিত হয়। ত্রিমাত্রিক জগতের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এর মূল মাপকাঠি। এর দ্বারা অবয়গত লম্বা, খাটো, মোটা চিকন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা করা হয়। এর সাথে থাকতে পারে আলো এবং দর্শনেন্দ্রিয়ের সংবেদন গুণ। উভয়ের সমন্বয়ে সৃষ্ট হবে আলোর ও রঙের তীব্রতা। বস্তুর অবস্থানের বিচারে সৃষ্টি হবে ছোটো বা বড়র আকার। বস্তুর অন্য গুণমানের তীব্রতাও সৃষ্টি হয়। স্পর্শ না করেই যেমন অনুভব করা যায় তরল, কঠিন, স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ ইত্যাদি।
শ্রবণগত বিচার: সাধারণভাবে শ্রাব্য ধ্বনিসমূহের প্রাথমিক বিচার করা হয়, শব্দের তীব্রতা, উচ্চতা, শব্দ-উৎসের দূরত্ব। এরপরে একে একে বিচারে আসে, কর্কশ, সুরেলা, বিরক্তিকর, সুখকর ইত্যাদি বিষয়। এছাড়া কোন বস্তুর কম্পনে শব্দ তৈরি হয়, তাও বিবেচনায় আসে। যেমন― শব্দটির বস্তুগত রূপ হতে পারে ধাতব, জলজ, চামড়াজাত ইত্যাদি। আধুনিককালে শব্দ ভৌধধর্মী না যান্ত্রিক সেটাও বিবেচনা করা হয়।
স্পর্শগত বিচার: স্পর্শের দ্বারা বস্তুর কার্কশ্য, মসৃণতা, তাপ, তারল্য, কাঠিন্য ইত্যদি অনুভব করা যায়। এর কোনটি কমবেশি তার বিচার হয় তীব্রতার দ্বারা। এর দ্বারা আমরা অনুভব করি কম গরম, বেশি গরম, কম মসৃণ, বেশি মসৃণ ইত্যাদি। এর বাইরে স্নেহের স্পর্শ, প্রণয়ের স্পর্শ, আঘাতের স্পর্শের তীব্রতা অনুসারে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি।
আস্বাদনগত বিচার:
মিষ্টি, টক, লোনা, তিতা এই চারটি মৌলিক আস্বাদনের অনুভবের তীব্রতা
বিচার অহরহ করে থাকি। আস্বাদনে বেদনার দ্বারা সৃষ্টি হয় ঝাল। এছাড়া
একাধিক আস্বাদনের মৌলক উপাদানের মাধ্যমে তৈরি হয় নানারূপ মিশ্র অনুভব।
আর অনুভব সৃষ্টি হলেই চলে আসে তীব্রতার প্রশ্ন। তুলনামূলক বিচারে কম
মিষ্টি, বেশি মিষ্টির মতো বিষয় এই বিচার থাকেই।
ঘ্রাণগত বিচার: বস্তু
থেকে আগত উদ্বায়ী অংশ যখন আমাদের নাকে এসে পৌঁছায়, তখন নানারকম গন্ধ
অনুভূত হয়। একই সাথে মনোজগতে এর বিচার গন্ধটা কম না বেশি।
ভাবগত বিচার: ইন্দ্রিয় দ্বারা বস্তুর গুণ অনুভব করে যে ধরনের তীব্রতা অনুভব করা যায়, ভাবগত অনুভবের তীব্রতা সেরূপ। একটি গান শুনে ভালো না খারাপ লাগছে, তার সাথে ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক থাকলেও, এর ভিতরে অতীন্দ্রিয় রূপ আছে। গানের ধ্বনিরূপ সুরেলা কি সুরেলা নয়, শব্দমান মৃদু কি উচ্চ সেটা ইন্দ্রিয়গত। কিন্তু গানের ভাবগত রূপ যা ভিন্নতর অনুভবের সৃষ্টি করে। এই অনুভবের তীব্রতা আমাদেরকে বিমোহিত করে কিম্বা বিরক্তির সৃষ্টি করে, তার সাথে অবশ্যই ভাবের তীব্রতার সম্পর্ক থেকেই যায়।
ধর্ম ও
বিশ্বাস
যে কোনো সত্তা তার নিজস্ব ধর্ম নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিরাজ করে। অন্য সত্তার কাছে তার
রূপের অংশবিশেষ ধরা পড়ে,
অনুভবের ভিতর দিয়ে। একটি সত্তার যতটুকু
রূপ অন্য সত্তার কাছে ধরা পড়ে, তার সমন্বিত রূপ থেকে জন্ম নেয় ভাবমূর্তি। আর
ভাবমূর্তির অনুভবকে গ্রহণ বা অগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে উৎপন্ন হয় সত্যাসত্যের
ভাবমূর্তি। আর সেই ভাবমূর্তি থেকে জন্ম নেয় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়
প্রতিটি সত্তার স্বতন্ত্র পরিচয়। এই বিশ্বাস থেকেই গাছপালা, নদী, গ্রহ, নক্ষত্র,
ভাবনা চিন্তা, কল্পনা ইত্যাদি সবই এক একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবেই আমাদের কাছে
মূর্তমান হয়ে উঠে। এর ভিতরে যে সকল সত্তার ওজন আছে এবং জায়গা দখল করে, সেগুলোকে
মূর্ত সত্তা (ত্রিমাত্রিক জগতের বিচারে দৈহিক সত্তা)। এর বাইরের সব বিমূর্ত সত্তা।
উভয় সত্তার স্বরূপ জানার চেষ্টার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় বিজ্ঞানমনস্কতা। এর ভিতর
দিয়ে মানুষ যে ধারণা লাভ করে এবং ওই ধারণার ভিত্তিতে সে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। আর
দৃঢ়তর সিদ্ধান্তই জন্ম দেয় বিশ্বাসের।
মানুষের বিশ্বাস
সত্যাশ্রয়ী। অর্থাৎ মানুষের কাছে যখন কোনো বিষয় সিদ্ধান্তের বিচারে সত্য বলে
প্রতীয়মান হয়, তখনই সে তা বিশ্বাস করা শুরু করে। যতদিন না নতুন কোনো সত্য আগের
সত্যকে প্রতিস্থাপিত করে, ততদিন আগের বিশ্বাসেই সে থেকে যায়। মানুষ নানারকম সত্য
ধারণ করে। নানারকম ছোটো ছোটোসত্যের সমন্বয়ে এক একটি মিশ্র সত্যের সৃষ্টি হয়।
প্রতিটি মিশ্র সত্যই একাধিক ক্ষুদ্র বিশ্বাসকে ধারণ করে। যেমন পানি তরল পদার্থ, এটি
একটি সত্য। পানির আরেকটি বাষ্পীয় রূপ আছে এটি একটি সত্য। পানিকে উত্তপ্ত করলে পানি
বাষ্পীভূত হয় এটিই আরও একটি সত্য। এই তিনটি সত্যই মানুষের কাছে পানির একটি সমন্বিত
বা মিশ্র সত্যের প্রকাশ ঘটাবে। এবার অন্যদিক থেকে পানিকে দেখলে দেখা যাবে—
চিনি পানিতে গলে যায়, কিন্তু লোহা গলে না। পানির গলন-ধর্মের এই বৈপরীত্য নিয়েও একটি
সত্য উৎপন্ন হবে। এইভাবে প্রতিটি বস্তুর ক্ষেত্রে যে সকল ধর্ম, মানুষের কাছে সত্য
বলে স্বীকৃত হবে, তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে বিশ্বাস। মানুষের যে কোনো বিশ্বাস
অর্জনের প্রক্রিয়া চারটি ধারায় সম্পন্ন হতে পারে। এই ধারা চারটি হলো—
১. প্রত্যক্ষ বিশ্বাস: মানুষ তার ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে যে বিশ্বাস করে, তাই হলো প্রত্যক্ষ বিশ্বাস। যেমন আগুন গরম, এর নানারকম দ্রব্যকে দগ্ধ করার গুণ রয়েছে, এর দ্বারা পানিকে বাষ্পীভূত করা যায়, লোহাকে গলিয়ে ফেলা যায় ইত্যাদির ভিতর দিয়ে মানুষ আগুনের ধর্ম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে মানুষের ভিতরে আগুন সম্পর্কে একটি বিশ্বাসও জন্মেছে। আগুনে হাত পুড়ে যাবে, এই বিশ্বাস থেকে মানুষ আগুনে হাত দেবে না, কিন্তু লোহা গলানোর জন্য আগুন ব্যবহার করবে, পানি গরম করা বা বাষ্পীভূত করার জন্য আগুন ব্যবহার করবে। এরূপ বস্তুজগতের বিভিন্ন বস্তুর ধর্মকে প্রত্যক্ষভাবে জেনে মানুষ নানা ধরনের বিশ্বাসকে ধারণ করে এবং বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে। আদিমানবের প্রত্যক্ষ বিশ্বাসের জ্ঞান যা ছিল, তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার সংগ্রামের ভিতর দিয়ে নানা ধরনের বিষয় আবিষ্কার করেছে। এর ফলে সে অজর্ন করেছে নানাধরনের বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এই জ্ঞান থেকে লাভ করেছে অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রত্যক্ষ বিশ্বাস।
২. পরোক্ষ বিশ্বাস: মানুষ তার নিজের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেমন প্রত্যক্ষ বিশ্বাস অর্জন করে, তেমনি অপরের বিশ্বাসকেও ধারণ করে থাকে। এই পিছনে থাকে একটি সত্যের আশ্বাস। পৃথিবী যে সূর্যের একটি গ্রহ এবং সূর্যের দিক থেকে এর অবস্থান তৃতীয়, তা নিজে পরীক্ষা করে দেখেছে ক'জন। কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সূত্রে সাধারণ মানুষ এই সত্যটাকে গ্রহণ করেছে। এখানে দুটি বিশ্বাস কাজ করে। একটি হলো প্রত্যক্ষ বিশ্বাসীর উপর বিশ্বাস, অপরটি হলো প্রত্যক্ষ বিশ্বাসীর বিশ্বাসকে বিশ্বাস। যে সকল জ্যোতির্বজ্ঞানী সূর্য এবং পৃথিবীর সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁদের সম্পর্কে এই বিশ্বাস থাকতে হবে যে, তাঁরা মিথ্যা বলছেন না। আর তাঁরা মিথ্য বলছেন না, তাই তাঁদের কথাও বিশ্বাস করা যায়। যেহেতু বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তাহলে তার বিবৃত্তিরও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। মানুষের বাস্তব জীবন চলে এই দুটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।
৩. উপপ্রেয়মূলক (hypothetical) বিশ্বাস: এই জাতীয় বিশ্বাসে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশ্বাস কাজ করে না। কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে এক ধরণের কল্প বিশ্বাস তৈরি করা হয়। বিজ্ঞানীরা কোনো সত্য আবিষ্কার করার আগে এই রকম কিছু বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হন। অনেক সময় এই জাতীয় বিশ্বাস সুদূর-প্রসারী কোনো ফলাফল আনে না, কিন্তু গবেষাণার ধারাকে সচল রাখে। বাস্তব জীবনে এই জাতীয় উপপ্রেয়মূলক ভাবনা কখনো কখনো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে। এর দ্বারা কখনো মানুষ সফল হয়, কখনো বিফল হয়। ধরা যাক, প্রতিবৎসর বর্ষায় পদ্মা নদীর একটি স্থানে সস্তায় ইলিশ মাছ বিক্রয় হয়। কোনো ব্যক্তির কাছে এই বিশ্বাসটি কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশ্বাস থেকে আসতে পারে। কোনো এক বর্ষা মৌসুমে একজন মানুষ এই বিশ্বাস নিয়ে পদ্মা নদীর ওই স্থানে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। ওই বছরের অবস্থা না জেনেই তিনি যে অনুমান নির্ভর বিশ্বাসের উপর ভর করে ওই স্থানে যাওয়ার যে উদ্যোগ নিলেন, সেটাকে বলা যাবে বিশ্বাসের বিশ্বাস। বাস্তব জীবনের এই জাতীয় বিশ্বাসকে ঠিক উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাস বলা যায় না। একে বলা যেতে পারে ধারণামূলক বিশ্বাস। উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসের বিষয়টি দেখা যায়, গবেষণার ক্ষেত্রে। এমন একটি বিষয়, ঘটে চলেছে, কিন্তু এর প্রকৃত কারণটা অজানা। এই অজানা রহস্যকে উন্মোচন করার জন্য কিছু কাল্পনিক সত্যকে উপস্থাপন করা হয়, যুক্তিতর্ক দিয়ে। তবে এই কল্প-বিশ্বাস এতটাই সত্যের কাছাকাছি থাকে যে অনেক সময়, সমকালীন বিজ্ঞানীরা তার ত্রুটিই ধরতে পারেন না, বা পারলেও বিপরীত কোনো যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করতে পারেন না। যেমন ১৮০৩-০৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ইংরেজ পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানী জন ডাল্টন (John Dalton) পরমাণু সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রকাশ উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। তাঁর প্রদত্ত স্বীকার্য পাঁচটি সূত্রে গ্রথিত। একালের বিজ্ঞানীরা এই তত্তের নানাবিধ সমালোচনা করেন বটে। কিন্তু ১৮শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ডাল্টনের স্বীকার্যকেই বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তখন পর্যন্ত এই স্বীকার্য অস্বীকার করার মতো যথেষ্ঠ প্রমাণাদি উপস্থাপন করা যায় নি। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে জে জে থমসন (J. J. Thomson,) ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করেন। এর ফলে ডাল্টনের তৃতীয় স্বীকার্যের অংশবিশেষ (পরমাণু বিভাজিত হতে পারে না) ভুল প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞানীদের প্রায় সব তাত্ত্বিক আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় এই জাতীয় উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসের সূত্রে। তার চূড়ান্ত ধারণাটা আমরা জানতে পারি বটে, বিজ্ঞানীরা যে প্রাথমিক বিশ্বাসকে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না, তা অজানা থেকে যায়।
সাধারণভাবে আমরা যাদেরকে সাধারণ মানুষ বলি, এদের ভিতরেও এরূপ উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসের জন্ম হতে পারে। তবে নিষ্ঠার সাথে তারা সে সকল বিশ্বাসের সত্যাসত্য যাচাই করেন না। ফলে তাদের উপপ্রেয়মূলক বিশ্বাসগুলো অমোঘ সত্যে পরিণত হয় না বা চূড়ান্ত ফলাফল বয়ে আনে না।৩. অলৌকিক বিশ্বাস: পার্থিব জগতের যা কিছু ঘটে তার একটি প্রকৃতি-নির্ভর সূত্র আছে। সেটা মানুষের শূন্যে ভেসে থাকা হোক, আর জলের উপরে আলোর নাচন হোক। মানুষ যখন প্রাকৃতিক বিধি অনুসারে এর ব্যাখ্য দিতে পারে, তখন তা হয়েছে যায় প্রাকৃতিক। আর লোক (মানুষ) যার সম্পর্কে আগে থাকেই জানে, তা হলো লৌকিক। এর বাইরে যা ঘটে, তা হলো অতিপ্রাকৃতিক বা অলৌকিক হিসেবে মানুষ চিহ্নিত করে। এর পিছনে একটি বিষয় মূখ্য ভূমিকা রাখে তা হলো সত্য। মানুষ যখন কোনো ঘটনাকে প্রাকৃতিক বিধি অনুসরণ করে ব্যাখ্য দিতে পারে না বা কোনো প্রাকৃতিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, তখন তাকে অলৌকিক বলে। যখনই কোনো প্রাকৃতিক বিধি অনুসরণ করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন তা আর অলৌকিক থাকে না। বাংলাদেশের অনেক বদ্ধ জলাশয়ের উপরে রাতের বেলায় আলোর নাচানাচি দেখা যায়। কেন এটা ঘটে, মানুষ তার ব্যাখ্যা যতদিন দিতে পারে নি, ততদিন এটা ছিল আলেয়া নামক ভুতের আলো। এটা ছিল সম্পূর্ণ অলৌকিক বিশ্বাস। এখন আলেয়াকে কেউ অলৌকিক আলো বলে না।
মানুষের
ধর্ম
প্রজাতিগতভাবে
Homo sapiens
(হোমো স্যাপিয়েন্স) যে
গুণাবলি ধারণ করে, তাই মানুষের ধর্ম। যেহেতু মনুষ্যজাতির সকল সদস্য একই রকম নয়, তাই
একে চূড়ান্ত ধর্ম না বলে সেট তত্ত্বের সূত্রে বলা সাধারণ ধর্ম।
প্রাথমিকভাবে চোখে পড়ার
মতো মানুষের ৩টি ধর্ম প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়। এই ধর্ম ৩টি হলো−
বস্তুধর্ম: মানুষের দেহের বিচারে তার ওজন আছে, জায়গা দখল করে। জড়ধর্মের
গুণে মানুষ আগুনে দগ্ধ হয়, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কঠিন হয়ে যায়, দেহকে কেটে ফেলা যায়।
একটি বহিরাগত আকার আছে। যে আকারকে মানুষের আকার বলা হয়। এই আকার দেখে অন্যান্য
দৃশ্যমান বস্তু থেকে মানুষকে আলাদা করা যায়। সব মিলিয়ে মানুষের জড়ধর্মের প্রকাশ
ঘটে।
জীব ধর্ম: জীবজগতে
মানুষ একটি বিশেষ প্রজাতি (হোমো স্যাফিয়েন্স)।
জীব হিসেবে প্রতিটি মানুষের জন্মগ্রহণ করে
এবং বেঁচে থাকার একটি গড় সময়ও আছে। জীবদ্দাশায় দেহের ক্ষয়পূরণ হয় এবং
ক্ষয়পূর্ণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করে, প্রজনন ক্ষমতা আছে। এরূপ নানাবিধ
বিশেষ্ট্যের বিচারে মানুষের জীবজগতের প্রজাতি।
বিশ্বাসের ধর্ম: মানুষের চেতনার ভিতর দিয়ে বোধের জন্ম হয়। দেহগত ও মনোগত বোধের সংমিশ্রণে মানুষের মনে বিশ্বাসের জন্ম হয়। অর্থাৎ মানুষ তার বোধ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ভিতর দিয়ে কিছু বিশ্বাসকে ধারণ করে।
জড়ধর্ম, জীবধর্ম এবং বিশ্বাসের ধর্মের সমন্বিত রূপই হলো মানুষের ধর্ম। এর ভিতরে বিশ্বাস মানুষকে অন্যন্য মানবেতর প্রাণী থেকে পৃথক একটি সত্তায় উন্নীত করেছে। জীবজগতে অন্যান্য সকল জীবেরই জড়ধর্ম ও জীবধর্ম আছে। প্রতিটি জীবেরই এই দুটি ধর্মের বাইরে একটি ধর্ম জীবের থাকে। সেটি হলো অনুভব করার ক্ষমতা। এই অনুভবকে সে ধারণ করে। এই অনুভবকে দিয়ে সে কি করবে বা তার কি করার ক্ষমতা আছে, তা জীবের জিনকোড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে জীব থেকে জীবের অনুভব ক্ষমতা যেমন পৃথক হয়, তেমনি অনুভব থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ব্যবহারও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়।
মানুষের জিনকোড এবং মস্তিষ্কের গঠনের
বিচারে, মানুষের অনুভব, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ইত্যাদি অন্যান্য প্রজাতির
চেয়ে ভিন্নতর হয়। এরই ভিতর দিয়ে মানুষের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়ে
গেছে। সকল মানুষের সমান বিচারবুদ্ধি একই রকমের হয় না। কিন্তু গড় মানে মানুষের
বিচারবুদ্ধির যে নমুনা পাওয়া যায়, তা মানুষের বুদ্ধি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু মানুষ হতে গেলে, তাকে অবশ্যই জড়ধর্ম এবং জীবধর্মের অধীনেই থাকতে হবে।
একটি রোবোটের বুদ্ধি মানুষের মতো হলেও তাকে মানুষ বলা যাবে না, কারণ, রোবোট
জড়ধর্ম এবং জৈবধর্মের বিচারে মানুষের মতো নয়।
আদিকালের মানুষ জীবন নিয়ে কী ভেবেছে, কী ভেবেছে জগৎ সৃষ্টি নিয়ে, কী ভেবেছে এই সৃষ্টির সাথে জীবনের সম্পর্ক নিয়ে। এই ভাবনা থেকে পৃথিবীর নানা অংশে এক সময় তৈরি হয়েছিল অসংখ্য পৌরাণিক উপাখ্যান। খুঁজলে এ সকল কাহিনির ভিতর অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। ভৌগোলিক পরিবেশ অনুসারে নানা রকমের পৌরাণিক চরিত্র পাওয়া গেলেও, মূল বিষয়গুলো একই ধরনের হয়। সে ধরন হলো– মানুষের অসহায়ত্বকে অলৌকিক কোনো শক্তির কাছে সমর্পণ করা। একই সাথে বিশ্বচরাচরে তার নিজের অবস্থানটা কোথায় তার উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা। ভাষাভেদে সে সকল শক্তির নামে পার্থক্য যতটা পাওয়া যায়, ততটা দৈবশক্তির কল্পনায় পাওয়া যায় না। এই সূত্রে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছিল নানা ধরনের ধর্মবিশ্বাস।
আদিম মানুষের প্রথম ভাবনা ছিল নিজেকে
টিকিয়ে রাখা। তার জেনেছিল এককভাবে মানুষ তার অস্তিত্বকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে
পারে না। তাই তারা দলবদ্ধ হয়েছিল। ফলে বহু মানুষের একক আত্মা সম্মিলিতভাবে দলীয়
আত্মায় পরিণত হয়েছিল। সেকালের মানুষের দলগত বোধবুদ্ধির দিয়ে, নানা ধরনের টিকে
থাকার চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার ভিতর দিয়ে মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, কিছু
সমস্যার সমাধান করা যায় না। যেমন মৃত্যু। কোনো না কোনোভাবে মানুষ মৃত্যুকে রোধ
করতে চেয়েছে, পারে নি। এখনো পারে না। আদিম মানুষ এটুকু বুঝতে পেরেছিল, বেঁচে
থাকার অর্থ হলো একটি শক্তির অধীনে থাকা। এই শক্তি হলো আত্মা। আত্মা দেহ ছেড়ে
গেলে মৃত্যু হয়। তা যদি হয়, তাহলে দেহ-ত্যাগী আত্মা কোথায় যায়? এই প্রশ্নের
উত্তর পায় নি। তারা স্বপ্নে মৃত মানুষকে দেখেছে, তাদের সাথে কথা বলেছে।
স্বপ্নের ভিতরে কিছু নির্দেশও পেয়েছে কখনো কখনো। সব মিলিয়ে মানুষের কাছে এই
ভাবনা প্রবলতর হয়েছে যে, জীবিত মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু আত্মার মরণ নেই। এরই
সূত্রে মানুষ খোঁজার চেষ্টা করেছে অমর-আত্মার শেষ গতি কোথায়। পৃথিবীতে
ভালো-মন্দ কাজের জন্য আত্মার কি কোনো শাস্তি বা পুরস্কার নেই? লৌকিক বিশ্বাস
দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর মেলে নি। ফলে কল্পলোকে সে তৈরি করেছে ঈশ্বর। এই বিশ্বাস
মানুষের জন্ম-মৃত্যুর একটি সমাধান দিয়েছিল। কিন্তু সংশয়ও ছিল। কালক্রমে এই সংশয়
থেকে দৃঢ়ভাবে তৈরি হয়েছিল ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস।
প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে, সংঘবদ্ধ হতে হবে। সহজাত এই প্রবৃত্তির ভিতর দিয়ে আদিম মানুষ অনুভব করেছিল একটি অমোঘ সূত্র- 'মানুষ এককভাবে দুর্বল কিন্তু সমষ্টিগতভাবে প্রবল'। তাই মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের কাঠামোটা তৈরি হয়েছিল সংঘবদ্ধ ভাবনার ভিতর দিয়ে। সংঘবদ্ধ আদি মানবগোষ্ঠীর ভাবনায় তিনটি মৌলিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। এই বিষয় তিনটি হলো- ১. নিজেদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ, ২. অন্যের খাদ্য না হওয়া এবং ৩. প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
১. নিজেদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ:
আদিম মানুষ খাদ্য সংগ্রহের তালিকায় ছিল বনজ উপাদান আর অন্য প্রাণী। বনজ উপাদান হিসেবে ছিল ফল ও মূল। ক্ষুধা-নিবৃত্তি উপকরণের পাশাপাশি তারা রোগ-নিরাময়ক উদ্ভিদের সন্ধান পেয়েছিল ধীরে ধীরে। অন্য প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণের প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছিল নানাভাবে। কারণ মানুষ একমাত্র প্রাণী, যারা সহজাত ক্ষমতার বাইরে অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহার করে শিকার করা শিখেছিল। বাঘ-সিংহের মতো মানুষ অনাদিকাল থেকে একই প্রক্রিয়ায় নিজের শরীরীক ক্ষমতা দিয়ে শিকার করে না। মানুষ নিজের শরীরের বাইরের উপকরণ হিসেবে হাতিয়ার ব্যবহার করা শিখেছিল। এর পাশাপাশি খাদ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়াও মানুষ আয়ত্ত করেছিল।২. অন্যের খাদ্য না হওয়া
মানুষের দেহ অন্যান্য প্রাণীদের মতো, অতটা সুরক্ষিত নয়। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য শরীরের আকার ও ক্ষমতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন কোনো উপযুক্ত শারীরীক হাতিয়ার মানুষের নেই। অন্যপ্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঘ-সিংহের মতো মানুষের দাঁত নখ নেই, হাতির মতো শারীরিক শক্তি নেই, ঘোড়া বা জেব্রার মতো জোড়ে দৌড়ানোর সামর্থ্য নেই, এমন কি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হুল ফুটানোর ক্ষমতাও নেই। আছে তার মগজাস্ত্র। এই অস্ত্রের দ্বারাই মানুষ তার দেহের বাইরের প্রাকৃতিক উপকরণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করেছিল। এরই সূত্রে পাথর, বাঁশ বা কাঠকে অস্ত্রে পরিণত করেছিল।৩. প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
প্রতিটি প্রাণীরই রয়েছে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা। এই ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে তাপমাত্রার হেরফের, জীবনধারণের অনুপযুক্ত বাতাস বা জলীয় উপাদানের প্রভাবে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। জীবনযুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য, মানুষ বাসস্থান বা পোশাকের মতো উপাদান খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল আদি কাল থেকেই।
আদিকালের মানুষের টিকে থাকার বা বেঁচে থাকার
সমস্যা স্থান এবং তার পরিবেশ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করেছিল। ফলে ঈশ্বরভাবনায়
প্রকারভেদ চলে এসেছিল। আদিকালের মানুষ প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া বহু বিষয়ের ব্যাখ্যা
লৌকিক জগতের বিচারে খুঁজে পায় নি। ফলে আশ্রয় নিতে হয়েছে অলৌকিক ভাবনার কাছে।
চিরচেনা পাহাড়ের মুখ উপচে কেন আগুনে লাভা ছড়িয়ে পড়ে, কেনো রোগ মহামারী হয়, কেমন করে
দিন-রাত্রির সংঘটন হয়, এরকম আরও কত কি। ফলে যথার্থ ব্যাখ্যাহীন কৌতুহল ভিন্নঘাতে
প্রবাহিত হয়েছে। প্রাকৃতিক যে সকল কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে পারে নি, সেকল বিষয়ের
পিছনে একটি অলৌকিক শক্তির কথা ভেবেছে। ফলে বিষয়ানুসারে অলৌকিক শক্তির বিশ্বাসে
বহুত্ব যুক্ত হয়েছে।
এরই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল অলৌকিক নানা উপখ্যান। এসকল উপাখ্যানে যুক্ত হয়েছিল নানা
রকম উপাদান, কিন্তু তার ভিত্তি ছিল ভৌগোলিক পরিবেশ। আদিমানবগোষ্ঠী নানাভাগে পৃথিবীর
নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিটি অঞ্চলেই এমন কিছু প্রাকৃতিক বিষয় থাকে যা
মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। মানুষ যখন এর প্রতিকার করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর কারণ
প্রাকৃতিক বিধি অনুসরণে ব্যাখ্য দিতে পারে নি, তখনই তার উপর অলৌকিক বিশ্বাস স্থাপন
করেছে। এই সূত্রে মানুষ সৃষ্টি করেছিল দেবতাকূলের। বহু দ্বীপের গ্রিক উপকূলীয়
অঞ্চলে সমুদ্র দেবতা পসেইডন যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভারতবর্ষের বিশাল স্থলভাগে জলের
দেবতা বরুণ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বঙ্গদেশের স্থলচর মানুষের জন্য সমুদ্র দেবতার
দরকার পড়ে নি। মধ্যপ্রাচ্যের পৌরাণিক কাহিনিতে বরফের দেবতা নেই। কিন্তু
শীতপ্রধান স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নর্স পৌরাণিক কাহিনিতে আছে
বরফের দেবী স্কাদি (Skadi)।
বাংলাদেশে কোনো বরফের দেবতা নেই। কারণ, এখানে প্রচণ্ড শীতেও বরফ পড়ে না। জলাজঙ্গলার
বাংলাদেশে সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য মনসা দেবী পূজিতা হন, কিন্তু উত্তর
ভারতের মনসা অবহেলিতা। এরূপ ভৌগোলিক পরিবেশের বাইরেই রয়েছে কিছু সাধারণ চাহিদা বা
বিষয়। তাই সম্পদ ও খাদ্যের দেবদেবী নানাভাবে রয়েছে নানা পৌরাণিক উপাখ্যানে। রয়েছে
যুদ্ধদেবতা বা যুদ্ধংদেহী বীরযোদ্ধার উপাখ্যান।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মানুষ পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পেতো কিন্তু এর প্রতিকারে কোনো পথ
জানা ছিল না। তাই তারা ভেবেছিল 'অলৌকিক শক্তি'র অধিকারী কেউ আছে, যে এই বিপর্যয়
ঘটে। এই অলৌকিক শক্তির ভাবনা একসময় বিশ্বাসের সূত্রে দেবতা হয়ে গেছে। রাগান্বিত
মানুষকে প্রশস্তি এবং উপহার দিয়ে শান্ত করা যায়, এই বোধ থেকে আদিম মানুষ দেবতাকে
সন্তুষ্ট করার জন্য, শ্লোক রচনা করেছে আবার উপহার দিয়ে পূজা করেছে। এর সাথে কিছু
সুযোগ সন্ধানী মানুষ পুরোহিতের ভূমিকায় নেমে, বিধি তৈরি করেছে। সে সময় সাধারণ মানুষ
দেবতার জন্য যে, ভোগ নিবেদন করতো, মূলত তা ভোগ করতো দেবতার নামে পুরোহিতরা।
কালক্রমে এর মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে পুরাণ-কথা।
এই অলৌকিক বিশ্বাস কালক্রমে বহুদেবতা নির্ভর ধর্মমতে পরিণত হয়েছিল। পৌরাণিক ধর্মের
দেবতাদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য পুরোহিতরা তৈরি করেছিলেন পৌরাণিক কাহিনি। কিন্তু
প্রতিটি কাহিনি গড়ে উঠেছিল স্থানীয় জীবনযাত্রার সাথে সমন্বয় করে। আরও পরে আরও বহু
ঈশ্বরের একীভূত দশাকে সমন্বিত করে একটি অখণ্ড সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রকাশ
ঘটেছিল একেশ্বরবাদী দর্শন। একালে মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসের যে রূপ পাওয়া যায়। তার
শ্রেণি বিভাজনটা নিচের মতো হতে পারে।
ধর্মবিশ্বাস
নাস্তিকবাদ
(Atheism):
প্রকৃতির নিয়মে জীবের
সৃষ্টি এবং লয়। স্রষ্টার অস্তিত্ব নাই। এই মতবাদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে
জড়বাদ।
জড়বাদ সৃষ্টির বিবর্তনবাদের শুরুতে জড়পদার্থের প্রাধান্য ছিল, কিন্তু তাতে
প্রাণ, আত্মা এসবেরও ধারণা সমান্তরালভাবে ছিল। খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ এবং
ঊনবিংশ শতাব্দীতে জড়বাদ (Materialism)
বিপুলভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এই তত্ত্বে
জগতের সকল
বস্তুকে আদি
সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আধুনিককালে জড়বাদের এই ধারণা বিজ্ঞানীদের
ভাবনার ভিতর দিয়ে রূপ লাভ করেছে স্বভাববাদ বা নিসর্গবাদ
(Naturalism)।
এই মতে জগতে জড় পদার্থ নিমিত্তমাত্র, শক্তি ও গতিই আসল। প্রাকৃতিক বিধিতে
জড় জগতের যে পরিবর্তন ঘটে, তা শক্তির কারণে। শক্তি অবিনশ্বর এবং শক্তিরই
রূপান্তরিত দশা হলো বস্তু। এই মতে জড়, প্রাণ, মন এর ভিতরে কোনো পার্থক্য
নেই। শক্তির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নতুন পদার্থের উন্মেষ ঘটে। একে বলা হয়
উন্মেষগুণ (Emergent
quality)।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে যে আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তারই
সূত্রে হেগেলের ভাবশিষ্য কার্ল মার্ক্স-এর হাতে তৈরি হয় দ্বান্দ্বিক
বস্তুবাদ (Dialectical
Materialism)।
এই মতে জগতের সকল পরিবর্তনের গুণ বস্তুর ভিতরেই আছে। চলমান বা গতিশীল
প্রক্রিয়ার অবিরত পরিবর্তন ঘটে। এঙ্গেলস তাঁর
Dialectics of
Nature গ্রন্থে
দ্বান্দ্বিক
বস্তুবাদের তিনটি মৌলিক সূত্র উল্লেখ করেছেন। এই সূত্র তিনটি হলো―
১. পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত রূপান্তর নীতি: কোনো বস্তুর গুণগত
উপকরণের পরিমাণের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে, বস্তুর রূপান্তর ঘটে। ধরা যাক পানি।
একটি বিশেষ তাপমাত্রা-সীমায় তরল থাকে। এর তাপ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম
করলে বরফ হয়ে যায়। এখানে তাপের পরিমাণ পানির রূপান্তর ঘটায়। একই ভাবে
সমাজের নানা ধরণের উপকরণের হ্রাসবৃদ্ধিতে সমাজের পরিবর্তন ঘটে। এই
পরিবর্তনের শুরুতে ছোটছোট দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা বিপ্লবে
পরিণত হয়। মূলত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কারণেই শ্রেণিসংগ্রামের সৃষ্টি হয়।
২. বিরোধ ব্যাখ্যা নীতি: জগতের কোনো বস্তুই স্থির থাকে না। বস্তুর
এই গতিময়তা জগতকে পরিবর্তিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। সামাজিক জীবনে এই গতি
প্রতিনিয়ত কাজ করে। এর ফলে সমাজ পুরাতনকে ছেড়ে নতুনের পথে অগ্রসর হয়। এর
অগ্রগমনে ঘটে নতুনের সাথে পুরাতনের সংঘাত। সমাজের এই সংঘাত বা দ্বন্দ্ব
সদাবিদ্যমান। ছোটো খাটো দ্বন্দ্ব অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু
পরিবর্তন থামানো যায় না। এই পরিবর্তন যখন বড় আকারে সংঘটিত হয়, তখন
দ্বন্দ্বের প্রকৃতি পাল্টে গিয়ে সংঘাতে পরিণত হয়।
৩. নঞ্র্থক নীতি: উন্মেষগুণে ব্স্তুর যখন রূপান্তর ঘটে, তখন মূল
বস্তুর সকলগুণ নঞ্র্থক হয়ে যায়। নতুন বস্তু পুরানো বস্তুকে অপসারিত করে
নিজের স্থান করে নেয়। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদীরা লাভের লোভে অধিক পরিমাণ শ্রমিক
নিয়োগ করে। তাতে সাময়িকভাবে লাভটা বাড়ে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী যখন সংগঠিত
হয়, তখন প্রথম আঘাত হানে পুঁজিবাদীকেই। সমাজবাদী দশায় সকল সম্পদ শ্রেণিহীন
সমাজের সকলের সম্পদে হয়ে যায়। এরফলে পুঁজিবাদী এবং শ্রমিক উভয়ই বিলুপ্ত হয়ে
যায়।
আস্তিকতাবাদ বা ঈশ্বরবাদ (Theism): প্রকৃতি কোনো বিশেষ শক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁর দ্বারা জগৎসংসার নিয়ন্ত্রিত হয়।
একত্ববাদ বা অদ্বৈতবাদ (Monism): সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা একজন এবং তিনিই তা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই মতবাদের সূত্রে সৃষ্টি হয়েছে একেশ্বরবাদ (Monotheism) স্রষ্টার স্বরূপ ব্যাখ্যার সূত্রে দুটি মতবাদের সূত্রে উদ্ভব হয়েছে বিমূর্ত অদ্বৈতবাদ ও মূর্ত অদ্বৈতবাদ।
বিমূর্ত অদ্বৈতবাদ
(Abstract
Monism):
এই মতবাদে বলা
হয়, ঈশ্বরের কোনো বস্তুগত আকার নেই। এই মতবাদের সূত্রপাত হয়েছিল
কখন, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে মিশর, মধ্যপ্রাচ্য,
ভারতবর্ষে বিকশিত একেশ্বরবাদী ধর্মমতে এর উদাহরণ মেলে। আধুনিককালে
এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন দার্শনিক স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭
খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর মতে, পরমাত্মা, নিরাকার, এক এবং অদ্বিতীয়
সত্তা। তাঁর ইচ্ছাতে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় দর্শনে বলা হয়েছে
জগতের পরিবর্তনের ধারা হলো প্রপঞ্চ। পরিবর্তনশীল জগৎ প্রপঞ্চময়
(মায়াময়)। একমাত্র পরমাত্মাই সত্য আর সব কিছু তাঁর ইচ্ছায় সৃষ্ট।
পরমাত্মা পরমগুণের অধিকারী। মানুষের পক্ষে তাঁর স্বরূপ ব্যাখ্যা
করা সম্ভব নয়।
মূর্ত
অদ্বৈতবাদ
(Concrete
Monism):
এই
মতে পরমস্রষ্টা এক এবং অদ্বিতীয়। তবে এই পরমাত্মা নিরাকার নয়।
জগতের সবকিছুর ভিতরে তিনি মূর্তমান। স্রষ্টার পরমগুণের প্রকাশ ঘটে
জগতের প্রকাশের ভিতরে। জার্মান দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১
খ্রিষ্টাব্দ) মূর্ত অদ্বৈতবাদকে একটি মতবাদে পরিণত করেন। এরপর
ইউরোপ ও ভারতবর্ষের দার্শনিকরা এই মতবাদকে বিশেষভাবে সমর্থন করেন।
মূলত মূরত্ ও অমূর্ত মতবাদের সূত্রে একালের অদ্বৈতবাদ পূর্ণাঙ্গতা
লাভ করেছে। স্রষ্টা গুণের বিচারে নিরাকার
কিন্তু জগতের ভিতর দিয়ে
মূর্তমান। সার্বিক বিচারে প্রকৃত একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে পাওয়া
যায়―
ইহুদী, ইসলাম এবং ব্রাহ্ম।
দ্বৈতবাদ
(Dualism):
এই মতবাদে বলা হয়, জগৎ
জড়পদার্থ ও মন দুটি পৃথক সত্তা। এবং এই দুটি সত্তাই জগতের আদি
উপাদান। যদিও প্রাচীন গ্রিস এবং তাঁর পরবর্তী অনেক দার্শনিকই
প্রচ্ছন্নভাবে এই দুটি সত্তাকে স্বীকার করেছেন। ভারতীয় সাংখ্য
দর্শনে এই দুটি সত্তাকে পুরুষ ও প্রকৃতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তারপরে মতবাদের বিচারে দ্বৈতবাদে পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে নি। যথার্থ
দ্বৈতবাদের উদ্ভব হয়, দেকার্তের দর্শন থেকে। তাঁর মতে, জড়ের ধর্ম
নিজের বিস্তার আর মনের ধর্ম চৈতন্য। জড়ের চেতনা নাই আবার মনের
কোনো বিস্তৃতি নেই। তাই গুণাবলির বিচারে এ দুটি পৃথক সত্তা। জড়
পদার্থ যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অধীনে থাকে, মন অযান্ত্রিক এবং মন চলে
উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য।
ঈশ্বরভাবনায় দ্বৈতসত্তার উপস্থিত লক্ষ্য করা যায়, ইহুদীদের ধর্মে।
সেখানে শুভশক্তি সদাপ্রভু (ঈশ্বর) আর অশুভ শক্তি শয়তান। তবে ইহুদী
ধর্মমতে শয়তানকেও সৃষ্টি করেছিলেন সদাপ্রভু। পরে এই ভাবনা
খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করেছে। এই ধর্মগুলোতে শুভশক্তির
সাথে অশুভ শক্তির দ্বন্দ্ব আছে। পারস্যের অগ্নি-উপাসকর শুভশক্তির
অধিকারীর নাম 'আহুর মাজদা' আর অশুভের প্রতীক 'অহির্মন'।
শুভ-অশুভের বিচারে দুটি ক্ষমতাবান সত্তা রয়েছে, এই মত থেকে তৈরি
হয়েছে দ্বীশ্বরবাদ
(Ditheism)।
মূলত মানুষের ঈশ্বর-ভক্তির
মান নির্ণয়ের জন্য ঈশ্বরই
শয়তান তৈরি করেছে। শয়তান মানুষকে বিপথে চালিত করবে আর ঈশ্বর
কল্যাণের আধার হিসেবে শয়তানের পথ পরিত্যাগ করবে। দ্বীশ্ববাদে
বিশ্বাস করা হয়, জগতের সকল কর্মকাণ্ড এগিয়ে চলেছে এই দ্বীশ্বরের
সংঘাতের ভিতর দিয়ে।
কৃষ্ণযাদু:
ঈশ্বর আছে কি
নেই, এই প্রশ্নের মীমাংশা করা যায় আস্তিকতা ও নাস্তিকতার সংজ্ঞা
দিয়ে। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েও একদল লোক
ঈশ্বরের বিরুদ্ধে
সাধনার দ্বারা সিদ্ধ হতে চায়। এক্ষেত্রে সাধনা করে, শয়তান নামক
ঈশ্বর-বিদ্বেষী শক্তিকে। এরা মনে করে শয়তানের উপাসনা করে অলৌকিক
ক্ষমতা অর্জন করা যায়। এই ক্ষমতাকে বলা হয় শয়তানি ক্ষমতা
(Black
Magic)
যে ক্ষমতার দ্বারা, মানুষের জন্য ঈশ্বর যা কিছু কল্যাণকর বলে
নির্ধারণ করেছেন, তাকে ধ্বংস করে শয়তানি শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা
যায়। শয়তান নাম সত্তার অস্ত্বিত্ব ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম
ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে। এই শয়তান যিশুখ্রিষ্টকে সংপ্রশ্নের
মুখে ফেলেছিল, হযরত মুহম্মদকেও নানাভাবে উত্যক্ত করেছে, তাঁর
জীবদ্দশায়। ইয়াজিদি ধর্মাবলম্বীদেরকে
(Yazidism)
মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা শয়তানের উপাসক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই
ধর্মমতে ঈশ্বর বিশ্বচরাচর আদমের আগে মেলেক তাউস (Melek
Taus)
সৃষ্টি করেছিলেন। ঈশ্বরে আদেশ অমান্য করার অপরাধে, তাঁকে শাস্তি
দেওয়া হয়। এরপর এই মালিক তাউশ দীর্ঘ ৭০০০ বছর কান্নাকাটি
করে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেন। খ্রিষ্টান এবং মুসলমানরা মনে করেন,
আজাজিল নামক পতিত ফেরেস্তা শয়তানে পরিণত হয়েছিল। এই ফেরেস্তারই
অন্য নাম মেলেক তাউস। ইয়াজিদি ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে,
মেলেক তাউস স্বয়ং শেখ আদী ইবনে মুসাফির
নামক ব্যক্তি নামে পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়েছিলেন। এই কারণে এঁরা
শেখ আদী ইবনে মুসাফির-কে তাঁদের প্রত্যক্ষ ধর্মপ্রবর্তক বা
নবী হিসেবে মান্য করেন।
বহুত্ববাদ
(Pluraliism):
জগত বৈচিত্র্যময়। বহুবিধ উপকরণের সমাবেশে জগতের সকল
কিছু ঘটছে। এর প্রতিটি উপকরণ বা কার্যকারণের পিছনে রয়েছে স্বতন্ত্র
শক্তি। এই সকল শক্তির সমন্বয়ে জগত অনাদিকাল থেকে চলছে। তাই এই সকল
শক্তির আরাধনার ভিতরে রয়েছে জগতের কল্যাণ। এই সূত্রে তৈরি হয়েছে
বহু-ঈশ্বরবাদ (Polytheism)।
এই সূত্রে তৈরি হয়েছে বহু দেবতার ধারণা। এই ধর্মবিশ্বাসের
অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের হিন্দু, আফ্রিকার কিছু
জাতিগোষ্ঠী, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কিছু মানুষ দেবদেবীতে বিশ্বাসী।
মিশ্রবাদী: একই সাথে
একেশ্বর এবং বহু-ঈশ্বরের রূপ পাওয়া যায়। ক্যাথলিকদের মতে পিতা-পুত্র
পবিত্র আত্মার সমন্বিত রূপ হলো মূল ঈশ্বর। কিন্তু প্রার্থনা করা হয়
যিশুর নামে। গির্জায় যিশু এবং তাঁর মা মেরি কে সাকার করে রাখা হয়।
একেশ্বরের সাথে পৌত্তালিকতার সংমিশ্রণ বিশেষভাবে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান
ধর্মে যতটা দেখা যায়, ততটা প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে দেখা যায় না।
অনির্দেশিত: সরাসরি একেশ্বর
বা বহু ঈশ্বরের কথা বলা হয় না। কিন্তু শেষ পরিণতি হয় একটি মহামাধ্যমে।
বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণ লাভ হলে যে স্থান লাভ হয়, সেটা একটি মহাস্থান বটে।
একেশ্বরবাদীরা একে বলেন, স্রষ্টার নৈকট্যে পৌঁছানো। এছাড়া বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বীরা বুদ্ধের মূর্তিস্থাপন করে যে নিবেদন করে, পৌত্তালিকদের
মতো।
সংশয়বাদী: যাঁরা কখনো ঈশ্বর
মানেন কখনো মানেন না। এদের ভাবনার প্রধান ধারায় আস্তিকতা বা নাস্তিকতা
যাই থাক, উভয় শ্রেণির মানুষই সংশয়ের দোলায় দুলতে থাকেন। ধর্ম বিশ্বাসের
দ্বান্দ্বিক প্রকাশ ঘটে এদের ভাবনার ভিতর দিয়ে।
অজ্ঞেয়বাদ (Agnosticism): এই মতবাদটি কোনো প্রথাগত ধর্মত উপস্থাপন করে না। তবে নিতান্তই দার্শনিক মতবাদ হিসেবে অনেক সময়ই ঈশ্বর-বিশ্বাস বিষয়ক ভাবকে প্রকাশ করে। এই মতাদর্শে বলা হয়, ঈশ্বরসম্পর্কীয় জ্ঞান অসীম। তাই ঈশ্বর সম্পর্কে কখনো পূর্ণভাবে জানা সম্ভব নয়। এই মতবাদে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়, কিন্তু তাঁর অসীমত্বের কারণে অগ্রাহ্য করাই শ্রেয় বলে বনে করা হয়। উল্লেখ্য, অজ্ঞেয়বাদের সূত্রপাত ঘটেছিল, জার্মান বিজ্ঞানী ইমানুয়েল কান্টের অবভাসিক ভাববাদ (Phenomenalistic Idealism) থেকে।
জগতের সৃষ্টির সাথে সাথে স্বয়ম্ভূ আত্মার উদ্ভব হয়েছে, তাকে আল্লাহ বা ব্রহ্মা যাই বলা যাক না কেন, বিশ্বাসের বিচারে এক, কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার বিচারে পৃথক। ইসলামের সুফিবাদীরা জগৎ-আত্মার সাথে জগতের সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন ধ্যানের ভিতর দিয়ে। এঁরা ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে ধ্যানের ভিতর দিয়ে জগৎ-আত্মার সন্ধান করেছেন। ব্রাহ্মধর্মও আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত। সকল ধর্মে জগৎ-আত্মা শুভ। এর বিপরীতে রয়েছে অশুভ শক্তি। ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম ধর্মে এই অশুভ শক্তি হলো শয়তান। অশুভ শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় সকল সনাতন ধর্মেও। বৌদ্ধধর্মেও অশুভ শক্তি 'মার'। জগতের সবই যদি জগৎ-আত্মার অংশ হয়, তাহলে− শয়তান, মার তথা সকল অশুভ শক্তিও তো জগৎ-আত্মার অংশ। এই দ্বন্দ্বটা রয়েছে মূলত শুভ-অশুভ ভাবনার ভিতরে।
যা বিতর্কের জন্ম দেয়, যা বিভাজিত করে, তা কোনো সত্তার বিচারে পরম ধর্ম নয়। জীবধর্ম ও জড়ধর্মের বিচারে পৃথিবীর সকল মানুষ একই ধর্মের। কিন্তু বিশ্বাসের ধর্মের বিচারে মানুষ বিভাজিত। 'যত মত তত পথ' তার অর্থ বহু বিশ্বাসনির্ভর পথ। সকল মানুষের বিশ্বাস এবং জড় ও জীব ধর্ম নিয়ে যদি কোনো অখণ্ড সত্তা হিসেবে মানুষকে বিবেচনা করা যায়, তাহলে সেটাই হবে মানুষের ধর্ম। ধর্মমতগুলো মানুক আর না মানুক, প্রতিটি ধর্মমতই মানুষের ধর্মের অংশ মাত্র। 'আমার ধর্মমতই শ্রেষ্ট' এর চেয়ে কোনো বড় অহঙ্কার নেই। ধর্ম বিশ্বাস থেকেই বলি, আপনার মতই যদি শ্রেষ্ঠ তবে, ঈশ্বর আপনার ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন কেন? এর উত্তর আপনি জানেন না, বলেই আপনার মতই শ্রেষ্ঠ মত বলে বিবেচনা করেন।
এসব তর্ক
বাদ দিলে, বিশ্বাসের বিচারে তাহলে মানুষের ধর্ম ভিত্তি কি। মূলত ধর্মে ভিত্তি হলো
কল্যাণ। এর ভিতরেই নিহিত আছে পবিত্র-অপবিত্র, শুভ-অশুভ ইত্যাদি নানা বিষয়।
মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার বিচারে, জগতের
সবকিছু কল্যাণকর নয়।
মূলত যা দেহ ও মনের জন্য কল্যাণকর তাই পবিত্র, তাই শুভ।
একই অর্থে অকল্যাণকর যা কিছু,
তার সবই অশুভ। মানুষের বিচারে জগৎ-আত্মার ক্ষতিকারক অংশই হলো শয়তান। প্রতিটি সত্তা
তার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়। তাই শুভ শক্তির বিচারে যা কিছু অকল্যাণকর তা
এমন তাই অশুভ শক্তি। আবার অন্য দিক থেকে বলা যায়, অশুভশক্তিও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে
রাখতে চায়। এই টিকে থাকার স্বপক্ষে যা কিছু আছে, তা অশুভ শক্তির জন্য কল্যাণকর।
সেখানে মানুষ যাকে শুভ বলে, শয়তানের জগতে সেটাই অশুভ বা অকল্যাণকর। ধরা যাক,
শয়তানের শক্তি প্রতিষ্ঠা পেলো। তখন শয়তানের নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যে যা
কিছু করবে তার সবই ওই রাজ্যের জন্য কল্যাণকর হবে। সেটা না পেলে শয়তানের রাজ্য
ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই টিকে থাকার জন্য যার যার ক্ষেত্রে শুভ ইচ্ছাটারই জয় হতেই হবে,
এরই তাগিদে জন্ম নেয় নিজস্ব বোধ।
মানবিক বোধ শব্দটা প্রায়ই শুনতে
হয়। মানুষের চৈতন্যে দ্বারা যে ভাবের সৃষ্টি হয়, তার উপলব্ধি হলো মানবিক বোধ। এর
কোনো আদর্শ মাপকাঠি নেই। মানুষে মানুষে চৈতন্যের পার্থক্য যদি থাকে, তাহলে মানিবক
বোধেরও পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। মূলত মানবিক বোধ হলো মানুষের বোধের একটি গড়
মান। মানবিক বোধ-এর এই আক্ষরিক অঙ্গন ছেড়ে বাইরের দিকে তাকালে মানবিকবোধের ব্যাপ্তী
ঘটে। এই ব্যাপ্তীর মূলে থাকে কল্যাণ। এই কল্যাণের লক্ষ্য হতে পারে মানুষ, পশু,
প্রকৃতি ইত্যাদি । সব মিলিয়ে মানবিক বোধের গড়মান গড়ে উঠে একটি সমাজের সমমনা
চৈতন্যবোধের ভিত্তিতে। এর বাইরের বিপরীত অবস্থানে যা থাকে, তার গড় মান অমানবিক বোধ।
বিষয়টা স্থান-কাল-পাত্রের সামগ্রিক বোধের বিচারে নিরূপিত হয়। একটি সমাজের সবাই মনে
করে, শিশু হত্যাটা অমানবিক। ওই সমাজে শিশুরা রক্ষা পাবে ওই সমাজের মানিবিক বোধ
থেকে। ইসলাম-পূর্বযুগে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ওই সময় ওই সমাজে ওই
রীতিটাই ছিল মানবিকবোধের অংশ। একালের বিচারে তা অমানবিক। স্থান ও কালের বিচারে
মানবিক বোধ পাল্টায়। আবার একই সময়ে একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মানবিক বোধ কাজ করতে
পারে। অনেক সময় এই ভিন্নতা এতটাই প্রকট থাকে যে, একটির বিচারে অন্যটি অমানবিক হয়ে
যায়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময়, পাকিস্তানীরা যতটা
পাকিস্তান ও ইসলামের মূল্যবোধ নিয়ে ভেবেছে, তার চেয়ে বেশি ভেবেছে কিভাবে বাঙালি
জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করা যায়। পাকিস্তানিদের কাছে বাঙালি হত্যাটা ছিল
তাদের তথাকথিত মানবিকবোধের অংশ। বাঙালিদের কাছে ছিল তা ছিল অমানবিকতার প্রকাশ। অনেক
মানবিক বোধ সমগ্র মানবসত্তার বিচারে আদর্শ মানদণ্ডে দাঁড়ায়। এরূপ যুদ্ধের নিরস্ত্র
সাধারণ মানুষকে হত্যা করাটা অপরাধ। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই এই বোধটা ধারণ করে।
কিন্তু ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে যখন হত্যা করে, তখন এটা যে মানবিক মূলবোধের
কাতারে পড়ে না, সেটা ধর্মান্ধদের মনে হয় না। তবে এই জাতীয় কাজটা ভালো তা কিন্তু এরা
প্রকাশ করে না। যেমন ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যখন বিচার শুরু হলো, তখন অপরাধীরা
তাদের কর্মকাণ্ড প্রথমেই অস্বীকার করেছে। তার অর্থ হলো যুদ্ধাপরাধকে তারা তাদের
মানবিক বোধ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি।
মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তার চর্চাই হলো মানুষের ধর্ম চর্চা। এই ধর্মে রয়েছে
নিজের, পরিবারের, সমাজের, জগতের ইত্যাদির কল্যাণ। প্রতিটি কল্যাণ আবার স্তর থেকে
স্তরে ভিন্ন রূপ লাভ করে। এই কল্যাণমূলক ধাপগুলোর পারস্পরিক সমন্বয়ের বিচারে তৈরি
হয় মানুষের ধর্ম। বড় মাপে এই ধাপগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন—
প্রথম
স্তর: প্রথম ধাপে
প্রতিটি মানুষ তাঁর নিজের কল্যাণের জন্যই করবে। এক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে
বিচ্ছিন্ন একক একটি সত্তা হিসেবে ভাববে। শুধু এই ভাবনা মানুষকে স্বার্থপরতা
শেখাবে বা অনুপ্রাণিত করবে। 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম' এই ভাবনা বুঝা যায় মানুষ
সঙ্কটে পড়লে। যেমন জনহীন কোনো জঙ্গলে দুজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ সেখানে
কোনো বাঘ এসে হাজির। এক্ষেত্রে দুজন প্রস্তুত হতে পারে বাঘের সাথে যুদ্ধের
জন্য। কিম্বা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যার যার মতো করে পালাতে চেষ্টা করবে।
টিকে থাকার জীবধর্মে বিচারে, মানবিক আচরণের কোনোটিই অধর্ম হবে না। কিম্বা প্রিয়
বন্ধুর প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে রোগকে বন্ধু হিসেবে আলিঙ্গন করা যায় না। এর ভিতরে
ধর্ম নেই। ধর্ম হবে, আগে নিজেকে রোগাক্রান্ত না হওয়ার জন্য সুরক্ষিত করা, তারপর
বন্ধুর সেবা করা।
দ্বিতীয় স্তর:
মানুষ সামাজিক জীব। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আদিম মানুষ দলবদ্ধ হয়েছিল।
কালক্রমে দলগত বড় ঐক্য ভেঙে ছোটো ছোটো পরিবারে বিভক্ত হয়। কিন্তু বহু পরিবার
মিলে তৈরি হয়েছিল সমাজের। পরিবারের প্রতিটি সদস্য নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণকে
অগ্রাধিকার দেবে, একই সাথে পরিবারের অন্যান্যের কল্যাণের কথাও ভাববে। সমাজের
ছোটো একক হিসেবে পরিবার থেকে এই ধর্মের চর্চা শুরু হয়। ধরা যাক রাত দুপুরে,
পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লো। রাতে ঘুমানোটা শরীরের জন্য ভালো, এই কথা না ভেবে
অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই হবে মানুষের ধর্মের অংশ। একজন সুস্থ মানুষ এক
রাত জাগলে শরীরের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অসুস্থ লোকটির পাশে
দাঁড়ালে বা তার রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করলে, লোকটি বেঁচে যেতে পারে। পরিবারের
সবাই সবার কাছে কমবেশি ঋণী থাকে। পরিবারের অন্য সদস্যের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে
আছে ঋণশোধের মানবিক বোধ। আরও রয়েছে সহজাত মমতাবোধ।
সন্তান যতই খারাপ হোক, পিতামাতার চায় তবুও সন্তান বেঁচে থাকা, সুস্থ থাক। কখনো
কখনো থাকে স্বার্থপরতা। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে গৃহবধু অত্যাচারী স্বামীর মৃত্যু
কামনা করে না। এর ভিতরে রয়েছে অপরের কল্যাণের চেষ্টার ভিতর দিয়ে নিজের
কল্যাণের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু পারিবারিক কিছু সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে
মানুষ এত কিছু ভাবে না। মনের আবেগপ্রবণ অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়ে অন্যের সেবা
করে। এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সন্তানের জন্য পিতামাতার সেবার ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয় স্তরে কিছু কল্যাণকর কাজ মানুষ করে করুণা থেকে। পরিবারে বৃদ্ধ চাকরকে
যখন বলা হয়, তুমি অত ভারি কাজ করো না। সেটা বলা হয় চাকরের প্রতি ব্যক্তিবিশেষের
মানবিক বোধ থেকে। কিন্তু এর পিছনে থাকে চাকরটির প্রতি করুণা। অবশ্য কোনো
ব্যক্তি এটুকু নাও করতে পারে। কিন্তু বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি যখন এই কথা বলা
হয়, তার ভিতরে থাকে করুণা, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ইত্যাদির একটি
সংমিশ্রিত রূপ।
তৃতীয় স্তর: মানুষ
নিজের পরিবারের গণ্ডি পেড়িয়ে, নিজের ব্যাপ্তীকে বাড়াবে। এই পর্যায়ের প্রথমে
থাকবে একটি ছোটো সমাজ। সেটা হতে পারে একটি গ্রাম বা মহল্লা।
মানুষকে ভাবতে হবে সমাজের সকলের কল্যাণের কথা। ব্যক্তি হিসেবে আমি জোরে জোরে
মাইক বাজিয়ে গান শুনতে পারি। এর দ্বারা আমার মনে সুখের জন্ম দেবে। এই সুখের
জন্য যদি কোনো অসুস্থ প্রতিবেশী আরও অসুস্থ হয়ে পরে, তাই হবে অমানবিক।
শহরাঞ্চলে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই রাতে উচ্চকিত গানের আসর বসায়। এটি যে
অমানবিক আচরণ, সেটা যে নিজে যেমন জানে না, তার পরিবারের লোকরাও জানে না। বা
জানলেও অগ্রাহ্য করে। বরং অভিভাবকরা অনেক সময় 'ছেলে-ছোকরা'-দের কাজ বলে
তুচ্ছার্থে উড়িয়ে দেন। এর ফলে সমাজের অন্যদের চোখে যে তাঁরা নিজেরাই তুচ্ছ হয়ে
যান, যেটা ভাবেন না। বাসাবাড়িতে জোরে গান বাজানোটাও এই পর্যায়ে পড়ে। সমাজে এই
পর্যায়ের অমানবিক আচরণ দেখা যায়, ইংরেজি নববর্ষের প্রচণ্ড শব্দের বাজি পোড়ানোর
ভিতরে, সারারাত ধরে ওয়াজমাহফিল বা জিকির করার ক্ষেত্রে। ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে
এটাকে অনেকে অমানবিক মনে করেন না। কিন্তু এটা ভাববার বিষয় যে, ধর্মাচরণ নিজের
জন্য না অন্যকে জানান দেওয়ার জন্য। ধ্যানের ভিতর দিয়ে জগৎ-আত্মার সাথে নিবিড়
নৈকট্য গড়ে তোলাটা, ওয়াজমাহফিল বা জিকিরের মধ্য দিয়ে হয় কিনা তা ধর্মান্ধরা
ভাবেন না। ধর্ম শিক্ষার জন্য যদি ওয়াজ-মাহফিল হয়, তাহলেও উৎসবের মতো না করে,
ছোটো ছোটো শিক্ষা-কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে করা যাতে পারে। যেমনটা স্কুল-কলেজ,
মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত হয়। যেখানে আড়ম্বর যত বেশি, সেখানে উৎসবের
আমেজ পাওয়া যায় যতটা, শিক্ষা ততটা হয় না। রবীন্দ্রনাথের গানে পাই 'তোমার পূজার
ছলে তোমায় ভুলেই থাকি'। সেটাই ঈশ্বরের পাওয়ার ক্ষেত্রেই হোক বা কোনো লক্ষ্য
অর্জনের ক্ষেত্রেই হোক, পূজাটা হয় কিন্তু যথাযথভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না।
জ্ঞানচর্চার জন্য গুরুর দরকার আছে। এই বিচারে যে কোনো বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানই
গুরুমুখী। গুরুতর আয়োজন করে গুরুমুখী জ্ঞান অনেক সময় গুরুত্ব হারায়। গুরুমুখী
বিদ্যায় গুরু-শিষ্যের পারস্পরিক কথোপকথনে মহত্তম কর্মে উত্তীর্ণ হয়। সেখানে
গুরু ও শিষ্যের উভয়েরই ভাবনার জগৎ সম্প্রসারিত হয়। 'বিরাট জনসভার' বিপুল
দেহভারে গুরুর গুরুতর বাণী শোনা যায় বটে, কিন্তু নিজের অনেক প্রশ্নের উত্তর
পাওয়া যায় না বা উত্তর পাওয়ার সুযোগ থাকে না।
চতুর্থ
স্তর: মানুষ শুধু মানুষকে নিয়ে ভাববে না, জগতের অন্যান্য সকল উপকরণের
কল্যাণের কথা ভাববে। এর সাথে যুক্ত থাকবে মনুষ্য জাতির কল্যাণ। দেশে পর্যাপ্ত
বনাঞ্চল গড়ে তোলার জন্য যে আবেদন আজকাল সোচ্চার হয়ে উঠেছে, তার ভিতরে
প্রত্যক্ষভাবে নিজের কল্যাণ তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু সমগ্র পৃথিবীর
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় এর প্রভাবটা এতে আছে, এবং এই পরিবেশের সাথে প্রতিটি
মানুষের কল্যাণ নিহিত আছে। তাই এই জাতীয় কাজও মানুষের ধর্মের ভিতরে পড়ে। একই
অর্থে বিপন্ন প্রজাতির পশুপাখি রক্ষাও মানবিক ধর্মের ভিতরে পড়ে।
মানুষের কল্যাণবোধ এবং জগতের কল্যাণবোধের বিচারে কিছু কিছু 'বাণী' প্রচলিত আছে।
যার ভুল ব্যাখ্যার কারণে অনেক সময় অনেকেই বিভ্রান্তের মধ্যে কাটায়। যেমন- আমার
শুনে থাকি বা বলেই থাকি, জীবহত্যা মহাপাপ। আক্ষরিক
অর্থে এই বাক্যটি কোনো সত্যকে প্রকাশ করে না, বরং মানবিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত
করে। জীবজগতে মানুষ টিকে থাকার জন্য প্রতিমুহূর্তে অন্য জীবকে হত্যা করে।
প্রতিবার শরীরের ভিতরে বাতাস গ্রহণের সময়, অক্সিজেনের পাশাপাশি অসংখ্য জীবাণুও
ঢুকে পড়ে। মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে।
যেগুলোকে হত্যা করতে পারে না, সেগুলো শরীরের রোগের সৃষ্টি করে। পরে সেগুলোকে
মেরে ফেলার জন্য আমরা ঔষধ ব্যাবহার করি। মানুষ যদি ভাত খায়, তাহলে প্রতি বেলায়
অসংখ্য ধাননামক গাছের বীজকে হত্যা করে। মানুষর দৈহিক চাহিদা মেটানোর জন্য যে
সকল উপকরণ দরকার তা পাওয়ার জন্য জীব বা উদ্ভিদের
জীবননাশ করতে হয়। এমন কি পানির মতো অহিংস উপকরণকে ফুটিয়ে ক্ষতিকারক জীবাণু
হত্যা করে, প্রথমেই হিংসার প্রকাশ ঘটানো হয়।
মানুষ তাঁর নিজের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য যখন জীবহত্যা
করে, তখন পাপ নয়। পাপ হলো শুধু ব্যক্তিগতভাবে আনন্দ পাওয়ার জন্য অন্য জীবকে
হত্যা করা। একটি নরখাদক বাঘকে হত্যা করাটা পাপ নয়। কিন্তু শিকারের আনন্দের
জন্য, বা বিলাসিতায় বাঘ মেরে তার চামড়া সংগ্রহের ভিতরে আছে, পরিবেশগত ভারসাম্যে
ব্যাঘাতের পাপ। এটা অমানবিক।
পঞ্চম স্তর: সত্যকে ধারণ করাই হবে মানুষের ধর্ম। ব্স্তু ধর্ম এবং জৈবিক ধর্মকে আশ্রয় করেই মানুষের চৈতন্যের জগৎ। বস্তু এবং জৈবিক ধর্মে মানুষ একটি প্রজাতি। কিন্তু বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত চৈতন্যের ধর্ম নানারূপ। চৈতন্যের ধর্মের পার্থক্য গড়ে উঠে ভৌগোলিক এবং আর্থ-সামাজিক পরিবেশের কারণে। ফলে দেশে দেশে, কালে কালে এবং জনে জনে চৈতন্যের ধর্ম পৃথক হয়ে গেছে। তাই একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এবং একজন মৌলবাদী ধার্মিক পরস্পরকে অবজ্ঞা করেন, তখন তা তার চেতনা থেকেই করেন। এর ভিতরে কোনো সাধারণ মানব ধর্মের সংজ্ঞা পাওয়াটা মুশকিল। তবে চৈতন্যের কাছে মানুষ তার কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি করতে হয়ে। চৈতন্যের এই অংশকে আমরা বিবেক বলি। এই বিবেক আবার স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানারকম হয়। চৈতন্যের বিচারে প্রাপ্তমনস্ক মানুষও অকারণে অমানবিক কাজ করেন। চলতে ফিরতে কেউ একটা গাছের পাতা ছিঁড়লো। সেটা বড় কোনো ক্ষতিজনক বা লাভজনক ভেবে করে না। শিশু বা কিশোররাও প্রাপ্ত মনস্ক হয়ে উঠার আগে যা কিছু করে আনন্দ বা অন্য কিছু পাওয়ার আগ্রহে কিছু অমানবিক কাজ করে থাকে। যত সে প্রাপ্তমনস্ক হয়ে উঠে, ততই সে একটি আদর্শ চৈতন্যের দিকে অগ্রসর হয়। এই আদর্শ চৈতন্য সে গড়ে তোলে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। এর সাথে যুক্ত হয় তার ভাবনা। এই দুয়ের সংমিশ্রণে গড়ে উঠে তার আদর্শ চৈতন্য। এই নিজস্ব ভাবনাই তাকে অন্যান্য মানুষ থেকে পৃথক করে দেয়। অনেক অনেক মত অনেকের সাথে মেলে, কিন্তু এর ভিতরে তার নিজস্ব কিছু ভাবনা থাকে। যে ভাবনা থেকে সে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আর এই সিন্ধান্তের অনড়তার ভিতর দিয়ে যে চৈতন্য তৈরি হয়, সেটা তার নিজস্ব আদর্শ চৈতন্যদশা। মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে এই আদর্শ চৈতন্যদশার সাথে তুলনা করে ভালো মন্দের বিচার করে। কিন্তু আদর্শ চৈতন্য দশা নানা কারণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। ফলে একটি সময়ের জন্য একটি আদর্শ চৈতন্য থাকলেই বয়স বা সময়ের অতিক্রান্ত রেখায় তা পাল্টায়। এটা যদি না পাল্টাতো, তাহলে মানুষ বয়সের বিচারে এগিয়ে গেলেও চৈতন্যের বিচারে স্থবির হয়ে যেতো। এই স্থবিরত্ব থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পথই হলো বিজ্ঞানের পথ। কোনো বিশেষ বিষয় জানাটা জ্ঞানের অংশ, কিন্তু বিশেষভাবে জানার ইচ্ছাটা হলো বিজ্ঞান। যে বৈদ্যুতিক পাখা আপনার মাথার উপর ঘুরছে। এরকম পাখা কারখানা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। এটা বিজ্ঞান নয়। এটি বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা সৃষ্ট একটি পণ্য তৈরি করার প্রক্রিয়া মাত্র। কিন্তু বিদ্যুৎ শক্তিকে ব্যবহার করে, কিভাবে বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি করা যায়, তা জানার ইচ্ছাট ছিল বিজ্ঞান। আর শেষ পর্যন্ত প্রথম যে পাখাটা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল বিজ্ঞানের ফসল। চৈতন্যের জগতের যে কোনো ক্ষেত্রে যখন জানার ইচ্ছাটা মরে যায়, তখন বিজ্ঞানের মৃত্যু হয়। কিম্বা ইচ্ছাকে বুঝ দেওয়ার জন্য গোঁজামিল দেওয়া হয়, তখন অপবিজ্ঞানে পরিণত হয়। আর এই অপবিজ্ঞান যখন বিশ্বাসে পরিণত করা হয়, তখন তৈরি হয় কুসংস্কার। মানুষ হবে সত্যাশ্রয়ী। মানুষ হবে সুন্দরের জন্য এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য। মানুষ জীবন ধারণের সত্য ধারণ করবে টিকে থাকার জন্য, কল্যাণ ও সত্য-সুন্দরকে ধারণ করবে জীবন যাপনের জন্য।
মনুষ্য
সত্তার ধর্ম
মনুষ্য সত্তা হলো এমন একটি শাশ্বত ধর্ম, যা তার জড় ধর্ম, জৈবিক ধর্ম এবং বিশ্বাসের
ধর্মের সমন্বয়ে সৃষ্ট। জড় কাঠামো আছে বলে, মানুষ একটি বিশেষ অবয়ব পেয়েছে। সেই অবয়ব
সজীব, কারণ তার জৈবিক ধর্ম আছে। আর জৈবিক ধর্মকে ভিত্তিক করে বিশ্বাসের ধর্মকে ধারণ করে।
মনুষ্য সত্তা জীব হিসেবে প্রথম সে নিজেকে রক্ষা করবে। এই বাসনা তার ধর্মের অংশ।
প্রতিটি মানুষের নিজেকে রক্ষা করার বাসনা পূরণের জন্য খাদ্য গ্রহণ-সহ যাবতীয়
কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হবে। এর ভিতরে রয়েছে জগতের সকল প্রজাতির সাধারণ ধর্ম। এক্ষেত্রে
আণুবীক্ষিক জীব থেকে মানুষ তেমন কোনো উন্নতর প্রজাতি নয়। জীবজগতের এই প্রবণতায়
প্রতিটি জীবই স্বার্থপর। মানুষের মানসিকতার বিচারে প্রতিটি মানুষের ভিত্তি হলো
তার প্রবৃত্তির জৈবস্তর। সেখানে সে একটি প্রজাতি ছাড়া আর কিছু নয়।
জীবজগতের বিশেষ করে প্রাণিজগতের প্রজাতিসমূহ প্রথম স্বার্থপরতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল,
যখন তাদের ভিতরে অপত্যস্নেহের বিকাশ ঘটেছিল। দেখা গেল নিজের কল্যাণকে বিসর্জন
সন্তানকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা সন্তানকে
রক্ষা করার চেষ্টা করা শুরু হলো। তারপরেও দেখা গেল এসব প্রজাতিরা তাদের সন্তানদের
শৈশব দশা পেরিয়ে গেলে, সন্তানদেরকে প্রকৃতি কাছে ছেড়ে দিচ্ছে। এরপর আবার সে
স্বার্থপর হয়ে উঠেছে।
প্রাণীজগতের কিছু কিছু প্রজাতি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করা শুরু করেছিল। এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক নির্ভরতার জন্ম হয়েছিল। এ সকল প্রজাতিগুলো দলবদ্ধ হয়ে শিকার করা বা আত্মরক্ষা করা শিখেছিল। ফলে দলের অন্যের প্রতি বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল। জীবের ক্রমবিবর্তনের ধারায় যখন হোমো গণের প্রজাতিসমূহের আবির্ভাব হয়েছিল, তখন দলগত বন্ধন আরও দৃঢ়তর হয়েছিল। এদের ভিতরে অপত্যস্নেহটা আমৃত্যু রয়ে গেল। দলগত প্রীতি প্রবলতর হয়ে, শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। হোমো গণের সর্বশেষ প্রজাতি হিসেবে যখন মানুষের যখন আবির্ভাব হলো, তখন তাদের ভিতরে স্নেহ-মমতার বিকাশ ঘটেছিল বটে। এরা নিজ দলের জন্য যতটা স্বার্থ ত্যাগ করার মনোভাব অর্জন করলেও, অপর দলের প্রতি তা রইলো না। আদিম মানুষের এই স্বার্থপরতার কারণে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এরা নির্বিবাদে জঙ্গল ধ্বংস করছিল। দুর্বল বা সবল অন্য সকল প্রজাতির প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। আবার কুকুর, হাতি, ঘোড়া, উট প্রভৃতিকে দাসে পরিণত করেছিল। পশু নির্যতনের অধ্যায় তাদের মনে তখনও স্থান পায় নি।
আদিম মানুষ ক্রমে ক্রমে আদিম দশা থেকে মধ্যযুগীয় দশায় পৌঁছিছিল। এরই ভিতর দিয়ে চলতে চলতে একসময় নিজের কল্যাণের বাইরে এসে মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল অন্যের কথা। কেউ কেউ প্রবলভাবে অনুভব করেছিল- 'অন্ধজনে দেহ আলো- মৃতজনে দেহো প্রাণ'। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল- 'প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'। এখন মানুষ ভাবে, আমি নিজে বাঁচবো, অন্যকে বাঁচাবো। এই ভাবনায় রয়েছে 'অন্য' শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর সকল প্রজাতি এবং আমি পৃথিবীর পরিবেশ। এ সবই সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। এসব নিয়েই মানুষের ধর্ম। এ এমন একটি ধর্ম, যা মানুষকে সাম্প্রদায়িক করবে না, পক্ষপাতদুষ্ট করবে না। আমাদের প্রথাগত বিশ্বাসের ধর্মগুলো মানুষের এই ধর্ম থেকে বিচ্যুত করেছে। এসকল ধর্মে মনুষ্যধরমের অংশ বিশেষ কিছু কল্যাণকরী দর্শনকে ধারণ করে বটে, কিন্তু সমগ্র মনুষ্য ধর্মকে গ্রহণ করতে পারে না। তাই এ সকল ধর্ম হলো- মনুষ্য ধর্মের উপধর্ম।