শ্রবণ নমুনা
খায়রুল আনাম শাকিল [শ্রবণ নমুনা]

                              ১৪০০
          
রাগ: অরুণ ভৈরব। তাল: ঝাঁপতাল।

জাগো অরুণ-ভৈরব জাগো হে শিব-ধ্যানী।
শোনাও তিমির-ভীত-বিশ্বে নব দিনের বাণী
          তোমার তপঃ-তেজে, শিব
          দগ্ধ বুঝি হয় ত্রিদিব,
শরণাগত চরণে তব
হের নিখিল প্রাণী
ধ্যান হোক ভঙ্গ তব শক্তি ল'য়ে সঙ্গে,
সৃষ্টির আনন্দে, হর, লীলা কর রঙ্গে।
          ললাটের বহ্নি ঢাকো
          শশী-লেখার তিলক আঁকো,
ফণি হোক মণিহার, হে পিনাক-পাণি                                      

ভাবার্থ:
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে
ভৈরব হলেন শিব বা মহাদেবের অপর নাম। শিবের স্ত্রী সতীর (মহামায়া, দুর্গা ) দেহত্যাগের পর, তাঁর বিরহজনীত কাতরতা এই গানে ফুটে উঠেছে।

কালিকা পুরাণ মতে– দক্ষ মহামায়াকে [দুর্গা] কন্যারূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেন দক্ষের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া দক্ষকে বলেন, তিনি অবিলম্বে তাঁর (দক্ষের) পত্নীর গর্ভে তাঁর কন্যারূপ জন্মগ্রহণ করবেন এবং এই কন্যা মহাদেব-এর স্ত্রী হবেন। বে তাঁকে (দুর্গাকে) যথাযথ সমাদর না করলে তিনি দেহত্যাগ করবেন এরপর দক্ষ  অসিক্লী -কে বিবাহ করেন। মহমায়ার জন্মের পর দক্ষ এঁর নাম রাখেন সতী [১-৪৪। অষ্টমোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]

সতী যৌবনে পদার্পণ করলে, মহাদেব-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়কিন্তু মহাদেব দক্ষকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন না করায় ইনি ক্রমে ক্রমে মহাদেব-এর প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেনবিবাহের এক বৎসর পর, দক্ষ এক মহাযজ্ঞের য়োজন করেন এই যজ্ঞে দক্ষ মহাদেব ও সতীকে নিমন্ত্রণ করলেন নাসতী নারদের মুখে এই যজ্ঞের কথা জানতে পেরে অযাচিতভাবে যজ্ঞে যাবার উদ্যোগ নেন। তিনি শিব (মহাদেব)-এর অনুমতি লাভের আশায়, যোগিনীদের সাথে নিয়ে ধ্যানমগ্ন শিবকে  জাগানোর জন্য উপস্থিত হন। শিবের ধ্যনভঙ্গের প্রাথমিক পর্যায়ে সতী এই গানটির মাধ্যমে শিবের বন্দনা করছেন।

শিব সূর্যের মত তেজস্বী, এই অর্থে শিবকে অরুণ-ভৈরব নামে অভিহিত করা হয়েছে। আবার নজরুল তাঁর সৃষ্ট রাগ 'অরুণ-ভৈরব' শব্দটি এখানে কৌশলে ব্যবহার করেছেন। এই বিচারে শব্দটি দ্ব্যর্থভাব প্রকাশ করে। স্থায়ীর পংক্তিতে 'তিমির-ভীত' শব্দের দ্বারা তামস রূপে ভীত বিশ্বের দশাকে বিশেষিত করা হয়েছে। এই পংক্তিতে পাপ-পঙ্কিলে নিমজ্জিত শঙ্কিত বিশ্বে কল্যাণের বাণী শোনানোর জন্য ধ্যানমগ্ন শিবকে জেগে উঠার জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে।

শিব-শক্তির তীব্র তপঃতেজ দগ্ধ হয় ত্রিদিব (স্বর্গলোক)। সেই তেজি শিবের কাছে যোগিনীসহ দুর্গা শরণাগত। সঞ্চারীতে সেই শিবকে সৃষ্টির লীলায়িত রঙ্গে তাঁর সকল শক্তি নিয়ে জেগে উঠার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। একই সাথে এই প্রার্থনা করা হয়েছে, যেনো শিবের সে তেজে ধ্বংসের তীব্রতা না থাকে। তাই শিবের কাছে পার্থিনীদের আবেদন, যেনো শিব তাঁর ত্রিনয়নের অগ্নিকে আবরিত রাখেন। এর পরিবর্তে কপালের স্নিগ্ধ চন্দ্রচিহ্ন তিলকরূপে অলঙ্কার হিসেবে শোভা পায়। আর শিবের কণ্ঠের সর্প যেনো বিষাক্ত ফণা না তুলে কণ্ঠের মণিহার
রূপে বিরাজ করে।

১. প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:  

. রেকর্ড সূত্র: নাই

৩. রচনাকাল: ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে, কাজী নজরুল ইসলাম উদাসী ভৈরব  নামনাটিকাটি বেতারে অভিনয় আকারে পরিবেশনের পরিকল্পনা নেন । এই বিচারে বলা যায়, গানটি রচিত হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম ৪০ বৎসর বয়সের দিকে।
 

৪. প্রাসঙ্গিক পাঠ: গানটি কাজী নজরুল ইসলাম, জগৎ ঘটক রচিত উদাসী ভৈরব নামক
নাটকের জন্য লিখেছিলেন। মূলত এই নাটিকাটির গান এবং অধিকাংশ সংলাপ নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন।  নাটিকাটি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই নভেম্বর তারিখে বেতারে প্রচারিত হয়। এটি ছিল উক্ত নাটকের প্রথম গান। গানটি পরিবেশন করেছিলেন নিতাই ঘটক, গীতা মিত্র ও ইলা ঘোষ-এর কণ্ঠে গীত হয়েছিল।

এই গানটি নজরুল-সৃষ্ট 'অরুণ-ভৈরব' রাগে নিব্দ্ধ। এই বিষয়ে জগৎ ঘটক তাঁর স্বরলিপি গ্রন্থ 'নবরাগ' -এ লিখেছেন

'বহুকাল পূর্বের কথাউদাসী ভৈরব  নামে একখানি নাটিকা বেতারে অভিনীত হবার জন্যে কবি আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন এবং এর ছয়খানি গান তিনি রচনা ও তাতে সুরারোপ করেন। সুরগুলি রাগ-ধর্মী ও তাঁর সৃষ্ট নবরাগ। বাসন্তী বিদ্যাবীথির প্রয়োজনীয় নাটিকাটি বেতারে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল। ... গানগুলি অরুণ-ভৈরব, আশা-ভৈরব, শিবানী-ভৈরবী, রুদ্র-ভৈরব, যোগিনী ও উদাসী ভৈরব।' 

৫. সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম

. স্বরলিপিকার: জগৎ ঘটক।

. সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী:
অরুণ ভৈরব-সাদ্রা। নবরাগ  (নজরুল  সঙ্গীত স্বরলিপি) [নজরুল ইন্সটিটিউট, সেপ্টেম্বর ২০০৫] ১০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২৩-২৫।
তাল: ঝাঁপতাল
অঙ্গ:
সাদ্রাঙ্গ।
পর্যায়: নাট্যগীতি

গ্রহস্বর: দা।