চন্দ্রদ্বীপ
প্রাচীন বাংলার জনপদ বিশেষ।

বর্তমান বরিশাল জেলা ছিল চন্দ্রদ্বীপের মূলভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। আবুল ফজল-এর মতে
বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ছিল সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদী সপ্তশাখায় বিভক্ত ছিল। এর একটি ছিল পাবণী পূর্বগামী শাখা। পূর্বগামী ত্রিধারার মিলিত স্থানকে সুগন্ধা বলা হতো। এই সুগন্ধা নদীর বুকে গঙ্গার পলিমাটি অসংখ্য দ্বীপ সৃষ্টি করে। এসবের মধ্যে ইন্দ্রদ্বীপ, সংখকোট, স্ত্রীর, জম্বু দ্বীপ প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে দ্বীপগুলোর সম্মিলিত নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। দ্বীপগুলোর আকৃতি চাঁদের ন্যায় ছিল বলে এরূপ নামকরণ করা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, চন্দ্রভদ্র জনগোষ্ঠির নামানুসারে চন্দ্রদ্বীপের নাম হয়েছে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায় না। খ্রিষ্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতকে এই অঞ্চল মৌর্য ও গুপ্ত শাসনাধীন ছিল। ৪র্থ শতকে পুষ্করণ (বাঁকুড়া) মহারাজা চন্দ্রবর্মা কোটালীপাড়া দখল করে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় কোটালীপাড়াকে কেন্দ্র করে চন্দ্রদ্বীপের সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। উল্লেখ্য গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাখরগঞ্জ, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাটসহ সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল তখন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এই সময় বর্তমান মাদারিপুরের পূর্বাংশ ইদিলপুর এবং পশ্চিম অংশ কোটালীপাড়া নামে পরিচিত ছিল। ইদিলপুর চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের একটি উন্নত জনপদ ছিল। একসময় এ অঞ্চলের প্রশাসনিক নাম ছিল নাব্যমন্ডল। কোটালীপাড়া ছিল বাংলার সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র।

গঙ্গারিডি রাজ্যের নন্দ রাজবংশের প্রথম রাজা মহাপদ্মনন্দ ৩৪৫ থেকে ৩২৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্য্যন্ত মগধ রাজত্ব করেন। সেখান থেকেই পরে পাটলিপুত্রে গিয়ে সাম্রাজ্যস্থাপন করেছিলেন। সে সময় চন্দ্রদ্বীপ মহানন্দার অধীনে ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে এই বংশের শেষ রাজা ধননন্দ এবং চন্দ্রবর্মণকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেন।

৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গোপালচন্দ্র, ধর্মাদিত্য, নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদেব এই অঞ্চল শাসন করেন। ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। সম্ভবত ৬০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শশাঙ্ক চন্দ্রদ্বীপ অধিকার করেন। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর, সুযোগ্য শাসকের অভাবে সমগ্র বাংলাদেশে কোনো সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৫০ বৎসর পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘোর অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই সময়ের এই অবস্থাকে মাৎস্যনায় নামে অভিহিত হয়ে থাকে।

মাৎস্যন্যায় কালের শেষের দিকে বাংলাদেশের প্রবীন ও প্রাজ্ঞ নেতারা আত্মকলহ ত্যাগ করে, গোপাল নামক এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। এই গোপাল (প্রথম) থেকেই বঙ্গদেশে পাল বংশের শুরু হয়। এরপর উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব করেন- যথাক্রমে ধর্মপাল, দেবপাল, শূরপাল প্রথম, বিগ্রহপাল প্রথম, নারায়ণ পাল নারায়ণ পালের রাজত্বের শেষভাগে  ত্রৈলোক্যচন্দ্র (রাজত্বকাল ৯০০-৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর রাজত্বের শুরুর দিকে, চন্দ্রদ্বীপ (বাখরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) অধিকার করেন। শ্রীচন্দ্রের রামপাল তাম্রশাসন চন্দ্রদ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ তাম্রশাসনে দেখা যায়, দশ শতকের সূচনায় ওই  বংশের  ত্রৈলোক্যচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের রাজা হন। এরপর তাঁর পুত্র শ্রীচন্দ্র রাজত্ব লাভ করেন। এই সময় রাজ্যপাল
চন্দ্রদ্বীপের কিছু অংশ দখল করতে সক্ষম হন। এরপর  দ্বিতীয় গোপাল
এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপাল চন্দ্রদ্বীপের উপর কিছুটা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও- শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলন-মহীপাল প্রথম এরপর রাজত্ব করেন নয়াপাল, বিগ্রহপাল তৃতীয়, মহীপাল দ্বিতীয়, দ্বিতীয় শূরপাল,  রামপাল,. কুমার পাল, গোপাল তৃতীয়, মদনপাল গোবিন্দপাল

১১৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মদনপাল-এর রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল সেন বংশীয় রাজা
বিজয়সেনের  হাতে। মদনপাল বাংলা থেকে মগধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরপর তাঁর বংশের একজন সামন্ত গোবিন্দপাল গয়াতে রাজত্ব করতেন। মদনপালের পর তিনি কিছুদিন মগধে রাজত্ব করেছেন। ১৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বল্লালসেনের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। এরপর পাল সাম্রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে চন্দ্রদ্বীপ
সেন বংশের রাজাদের অধীনে চলে যায়।

চন্দ্রদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে পনের শতকের মধ্যভাগে। ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান বারবাক শাহ (১৪৫৯-৭৪) চন্দ্রদ্বীপে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। মির্জাগঞ্জের মসজিদবাড়িয়ার শাহী মসিজদ (৮৭০ হিজরী) তাঁর নির্মিত স্থাপত্যকীর্তি।

পনের শতকের শুরু দিকে, লক্ষণসেনের পৌত্র ধনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপকে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সাতক্ষীরার বাসুদেবপুর প্রাপ্ত ধনুজমর্দনের মুদ্রায় দেখা যায় তিনি ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপে রাজত্ব করেন। তিনি প্রথমে হিজলার গোবিন্দপুরে, পরে বাউফলের কচুয়ায় রাজধানী স্থাপন করেন। বাকলা নগর এখানেই গড়ে ওঠে।  ধনুজমর্দন-এর পরে রমাবল্লভ, কৃষ্ণবল্লভ, হরিবল্লভ, জয়দেব, কমলা রানী(বাকলার একমাত্র মহিলা রাজা) ও পরমানন্দ-এ সাত জন রাজা শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে প্রায় দুই লাখ লোকের মৃত্যু হয়। এই সময় রাজা জগদানন্দ বসুও এসময় পানিতে ডুবে মারা যান।

১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজা কন্দপনারায়ণ রাজত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় মগ পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এজন্য কন্দপনারায়ণ প্রথমে বাখরগঞ্জের বাসুরীকাঠি ও পরে বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে পাঠানদের সাথে একযুদ্ধে তিনি নিহত হলে, তাঁর পুত্র রামচন্দ্র সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রথমে ঝালকাঠির হোসেনপুরে ও পরে বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বরিশাল শহরের ১১ কি.মি পশ্চিমে দুর্গাসাগরের অদূরে সেসময়ের ভবনাদির ভগ্নাবশেষ এখনো অবশিষ্ট আছে। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘলদের হাতে স্বাধীন রাজা রামচন্দ্রের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে শাহ সুজা, বুজুর্গ উমেদ খান, কীর্তিনারায়ন, উদয় নারায়ন প্রমুখ বাকলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করেন। শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খান ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগীজ দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন।

আঠার শতকের প্রথমার্ধে বরিশালের ইতিহাসের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আগা বাকেরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বুজুর্গ উমেদপুর ও সেলিমাবাদ পরগণা করায়ত্ত করে এক বিশাল জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে নবাব আলীওয়ার্দী তাঁকে চন্দ্রদ্বীপ পরাগণার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বুজুর্গ উমেদপুরে তিনি একটি ব্যবসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় বাখরগঞ্জ।

১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অবস্থানকালে প্রতিপক্ষের হাতে আগা বাকের নিহত হন। এরপর তাঁর পুত্র আগা সাদেককে ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মীরন ও রাজবল্লভ নির্মমভাবে হত্যা করে। কারণ পিতা পুত্র দু'জনেই ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। আগা বাকেরের পর রাজবল্লভ ও তার বংশধরদের হাতে এই অঞ্চলের শাসনভার চলে যায়। পলাশী যুদ্ধের পর, বাকলা চন্দ্রদ্বীপের সাহসী জনতা, বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা চালায়।

কোম্পানি শাসনের গোড়ার দিকে চন্দ্রদ্বীপ ঢাকার একটি অংশ হিসেবে শাসিত হয়। বাখরগঞ্জের শাসনকাজ নির্বাহের জন্য ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে একজন সিভিল জজ নিযুক্ত করা হয়। তার সদর দফতর স্থাপিত হয় নলছিটির বারইকরণ। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবনের কমিশনারের দফতরও এখানে নিয়ে আসা হয়। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে এই কার্যালয়ও বাখরগঞ্জে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাখরগঞ্জ নামে নতুন জেলা গঠিত হয়। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে জেলা প্রশাসক মিঃ উইন্টাল বাখরগঞ্জ থেকে বর্তমান বরিশালে জেলা সদর দফতর স্থানান্তর করেন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালকে বিভাগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বরিশালের নামকরণের ব্যাপারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গবেষকরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য প্রদান করেছেন। সুলতানি আমলে বরিশালকে গিরদে বন্দর বলা হত। ইউরোপিয়রা গিরদে বন্দরকে গ্রেট বন্দর বলে আখ্যায়িত করত। গ্রেট বন্দর পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে। অন্যদিকে বরিশাল নাম নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। পর্তুগীজ ব্যবসায়ী মিঃ বেরি এক ললনার প্রেমাসক্ত হন। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। খবর শুনে প্রেমিকা শেলীও মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। এই বেরি ও শেলীর নাম থেকে পরবর্তীতে বরিশাল নামকরণ হয়। আবার কেউ কেউ বলেন বরিশালে এক সময় বড় বড় শাল বৃক্ষ জন্মাত। তাই এর নামকরণ বরিশাল হয়েছে। আবার কারো কারো মতে, প্রাচীন কাল থেকেই এখানকার খাল পুকুরে বড় বড় শোল মাছ পাওয়া যেত। সেখান থেকে বরিশাল নাম গৃহীত হয়েছে। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রসিদ্ধ লাভ করেছে সেটা হল ‘বরিসল্ট' থেকে বরিশাল নামের উৎপত্তি। তখন এ অঞ্চলের জনগণের প্রধান অংশ লবণ ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলো। লবণ ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্র ছিল গিরদে বন্দর। এখানে ছিল লবণের বড় বড় গোলা ও দক্ষিণ বাংলার লবণ শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি। বিদেশি বণিকরা গিরদে বন্দরকে ‘বরিসল্ট' বলত। বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নাম গৃহীত হয়। আস্তে আস্তে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ভৌগলিকভাবে বরিশাল নামে পরিচিতি লাভ করে।