আকাশবাণী কলকাতা

অল ইন্ডিয়া রেডিও/আকাশবাণী
ভারতের জাতীয় বেতার সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান।

আকাশবাণী'র নামকরণ
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের  রচনায় প্রথম 'আকাশবাণী' শব্দ পাওয়া যাব। ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন- ‘হইল আকাশবাণী অন্নদা আইল’। এখানে 'আকাশবাণী' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে- 'আকাশ থেকে প্রাপ্ত দৈববাণী' অর্থে।

বেতার অর্থে 'আকাশবাণী' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সুকুমার রায়। সন্দেশ পত্রিকার 'ভাদ্র ১৩২৯' (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯২২) সংখ্যায় সুকুমারের  রায়ের বেতার-বিষয়ক প্রবন্ধের নাম ছিল- 'আকাশবাণীর কল'। সুকুমার রায় লিখেছিলেন-
আমাদের গল্পে ও পুরাণে যে আকাশবাণীর কথা শুনতে পাই— এও যেন সেই আকাশবাণীর মতো। কোথাও কোনো আওয়াজ নাই, জনমানুষের সাড়া নাই, অথচ কলের মধ্যে কান দিলেই শুনি আকাশময় কত কণ্ঠের কত ভাষা, কত বিচিত্র গান আর কত যন্ত্রের সুর!”
ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ইউ এল বড়ুয়া-র লেখা ‘দিস ইজ় অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’ বইটি (১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে) থেকে জানা যায় যে, ১৯৩৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর মহীশূরে ‘আকাশবাণী’ নাম দিয়ে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। উল্লেখ্য, মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক ড গোপাল কৃষ্ণ তাঁর বাড়িতে ৩০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করেন। পরে ২৫০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার আমদানি করা হয়। মহীশূর পুরসভা ও জনগণের সহযোগিতায় পাঁচ বছর ধরে সেখান থেকে সম্প্রচার চলার পর ১৯৪১-এ মহীশূর স্টেট এটি অধিগ্রহণ করে। কুড়ি বছর ধরে মহীশূরের আকাশবাণী কেন্দ্র সুপরিচালিত ছিল। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র বেঙ্গালুরু কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকালে মহীশূরের মহারাজার ‘আকাশবাণী’ তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের অাগষ্ট মাসে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার জন্য ১০ কিলোওয়াটের একটি শর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার বসানো হয়। এই উপলক্ষে সেই বছরই ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার ১৬ অাগস্ট সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। তখন পত্রিকাটির  সম্পাদক ছিলেন নলিনীকান্ত সরকার। তাঁর অনুরোধেই শিরোনামহীন রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা স্বহস্তে লিখে দিয়েছিলেন কবি। কবিতাটির প্রথমেই ছিল “ধরার আঙিনা হ’তে ঐ শোনো / উঠিল আকাশবাণী।” কবিতাটির নীচে বাঁ দিকে তারিখ লেখা ছিল— ৫ অাগস্ট, ১৯৩৮।

রবীন্দ্রনাথ 'আকাশবাণী' শব্দটি সুকুমার রায় বা মহীশূরের বেতারকেন্দ্রের  'আকাশবাণী' নাম থেকে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই শব্দটি শিরোনামহীন কবিতাটিতে ব্যবহার করেছিলেন মাত্র।  এই নামটিই  অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হোক- রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে- এমন কোনো অনুরোধ বা নির্দেশও ছিল না। তবে রবীন্দ্রনাথে পাঠানো কবিতায় ব্যবহৃত 'আকাশবাণী' শব্দটি সে সময়ের কলকাতা  বেতারকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ভালো লেগেছিল বলে, তাঁর শব্দটি গ্রহণে সম্মত হয়েছিলেন।

আকাশবাণীর কালানুক্রমিক উন্নয়ন
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে, ব্রিটিশ ভারতে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি রেডিও ক্লাব এবং অন্যান্য রেডিও ক্লাবের সমন্বয়ে প্রথম ভারতে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক ডঃ শিশির কুমার মিত্র পদার্থবিদ্যা বিভাগের ঘরে ট্রান্সমিটার বসিয়ে ওয়্যারলেসে কথিকা, গান, আবৃত্তি সম্প্রচার শুরু করেন। সেই সম্প্রচারে উদ্বোধনী গান গেয়েছিলেন হীরেন্দ্রকুমার বসু, আর গানটি ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচিত 'ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে'।

এর সমর্থন পাওয়া যায় 'নলিনীকান্ত সরকারে স্মৃতিকথা' থেকে। তিনি তাঁর স্মৃতি কথায় লেখেছেন- কলকাতা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্সে কলেজে বেতার কেন্দ্র ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বেতারকেন্দ্রটি স্থাপন করেছিলেন- পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপক ডক্টর শিশিরকুমার মিত্র। এই বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে পাঁচদিন গান-বাজনা বক্তৃতা প্রচারিত হতো। এরপর হাইকোর্টের কাছে টেম্পল চেম্বার্সে 'সার্কনী ইন্টারন্যাশনাল মেরিন সার্ভিস-একটি বেতারকেন্দ্র স্থাপন করেছিল।

১৯২৬ থেকে ১৯২৭-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত কলকাতায় বেতারের যন্ত্র ও হেডফোন বিক্রির উদ্দেশ্যে চালু হয় খুদে রেডিয়ো স্টেশন। সে সময়ে প্রতিদিন দু'ঘন্টার সান্ধ্য অধিবেশন হতো। এই অধিবেশনে ইউরোপীয় প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জে আর স্টেপলটন, ভারতীয় প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে অমরকৃষ্ণ বসু। এই সময় মুম্বাইয়ের কয়েকজন ব্যবসায়ী 'ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি' নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন। ভারতীয় এই কোম্পানি গঠনে এগিয়ে পারসি ব্যবসায়ী এফ এম চিনয়। এই সময় জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিবিসির ই সি ডানস্টনকে। ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯২৬-এর ১৩ সেপ্টেম্বর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতার সম্প্রচার-বিষয়ক চুক্তি হয়। ওই বছরই ভারতে বেতার সম্প্রচারের বাণিজ্যিক সাফল্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য বিবিসির প্রতিনিধি হিসেবে আসেন সি সি ওয়ালিক। কলকাতার টেম্পল চেম্বার বিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চতলে একটি বেতার ট্রান্সমিশন স্টুডিয়ো গড়ে তোলেন তিনিও। এই সময় কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত ও নাটকের কয়েকটি অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতেন। এই অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সেই হীরেন্দ্রকুমার বসু।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে বেতার সম্প্রচারের প্রয়োজনীয় ট্রান্সমিটার বসানোর জন্য, কলকাতার কাশীপুর অঞ্চলে, টালা পার্কের গায়ে বেশ খানিকটা জায়গা মাসিক আড়াইশো টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।

প্রথম বেতারকেন্দ্র, বোম্বাই
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই (শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৩৩৩), ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেতার সম্প্রচারের চুক্তি হয়। এই চুক্তি বলে
Indian Broadcasting Company LTD (IBC)BC)C) দুটি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের অধিকার লাভ করে। এই চুক্তির পর, বোম্বাই বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই (শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৩৩৩। এই বেতারকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন ভরতের ভাইসরয় লর্ড আরউইন। এই কারণে ২৩শে জুলাই তারিখটি বর্তমানে ‘ভারতে সংগঠিত বেতার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দিন’ হিসেবে পালিত হয়।

গার্সটিন প্লেসে স্থাপিত আদি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কার্যালয়

দ্বিতীয় বেতারকেন্দ্র, কলকাতা
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬শে আগষ্ট (বৃহস্পতিবার, ৯ ভাদ্র ১৩৩৩), কলকাতা বেতারকেন্দ্র চালু হয়। জুলাই মাসে ডালহৌসি স্কোয়্যারের পশ্চিমে, নির্জন পরিবেশে ১, গারস্টিন প্লেসের পুরনো বাড়িটির দোতলা ও তিনতলা পাঁচ বছরের লিজে ভাড়া নেওয়া হয় মাসিক আটশো টাকায়। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আদি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কার্যালয়। দেড় কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার চালু করা হয়েছিল কাশীপুরের ঢালা পার্কের কাছে। এই কেন্দ্র থেকে প্রথম যে বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, তা হলো 'ক্যালকাটা কলিং'।

এই কেন্দ্রটির দ্বারোদঘাটন করেছিলেন গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন সুলতান চিনয়। স্টেশন ডিরেক্টর নিযুক্ত হন সি সি ওয়ালিক এবং ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালক, বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। ঘোষণা ও সংবাদপাঠের জন্য নিযুক্ত হন ১৯১১-র আইএফএ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগানের হাফব্যাক্ রাজেন্দ্রনাথ সেন।  নলিনীকান্ত সরকার তাঁর ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন –

উদ্বোধন দিবসে কলকাতা স্টুডিয়োতে অংশগ্রহণ করলেন রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুপ্রসিদ্ধ কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, বিখ্যাত গায়িকা আঙ্গুরবালা, প্রসিদ্ধ অন্ধগায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, প্রখ্যাত ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার, মধুরকণ্ঠী প্রফুল্ল বালা, সুরসিক সংগীতশিল্পী সিতাংশু জ্যোতি মজুমদার (বকু বাবু), প্রসিদ্ধ তবলাবাদক রাইচাঁদ বড়াল আর ১৯১১ সালের আই এফ এ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগান ক্লাবের অনতিক্রমনীয় হাফব্যাক রাজেন্দ্রনাথ সেন।”
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে গঠিত হয়েছিল- ‘বেতার নাটুকে দল’। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি ওই দলের সর্বপ্রথম নাটক অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘জমাখরচ’ প্রচারিত হয়েছিল। উল্লেখ্য অনুষ্ঠানের পরিচালক, বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার নাটকটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন এবং প্রধানচরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে বেতারের সাথে যুক্ত হন কাজী নজরুল ইসলাম। এই তথ্যটি পাওয়া যায়- ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ ঢাকায় অবস্থানরত কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা নজরুলের চিঠি থেকে।

এই সময়  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতারের সাথে যুক্ত হন। তবে তাঁর যুক্ততা খুব সহজে ঘটে নি। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র  ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে কণ্ঠ পরীক্ষা দেন। কিন্তু কলকাতা ব্রডকাস্টিং কোম্পানির প্রোগ্রামের প্রযোজক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার তাঁকে প্রাথমিক ভাবে বাদ দেন। পরে তিনি বীরেন্দ্রের বিশেষ ধরনের কণ্ঠের জন্য তাকে নাট্যদলে যুক্ত করে নেন। এই কারণে তিনি রেলওয়ের চাকরি ত্যাগ করে রেডিওতে যোগদান করেন। পরে তিনি নৃপেন মজুমদার নাটকের প্রযোজনা ও অভিনয় বিভাগের দায়িত্ব দেন। এই বছরের ২১ আগষ্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় প্রচারিত হয়েছিল পরশুরামের 'চিকিৎসা সঙ্কট'-এর নাট্যরূপ।

১৯২৮-এর শেষের দিকে ‘চিত্রা সংসদ’-এর সদস্য হয়ে যোগ দিয়েছিলেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার), বিজন বসু প্রমুখ গুণী ব্যক্তিরা। 

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে স্টেশন ডিরেক্টর সি সি ওয়ালিক কিছুদিনের মধ্যেই বিবিসি ফিরে যান। তাই ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর, মাসে কলকাতা কেন্দ্রের পার্ট টাইম ডিরেক্টর হয়ে আসেন মার্কনি কোম্পানির কলকাতা অফিসের বড় সাহেব জে আর স্টেপলটন। এই সময় স্টেশন এঞ্জিনিয়ার হন সুধীন্দ্রনাথ রায়।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতারকেন্দ্র অনুষ্ঠান-বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। জুন মাস থেকে ‘ছোটদের বৈঠক’-এর সূচনা হয়। প্রবর্তনায় ‘গল্পদাদা’ ছদ্মনামের আড়ালে ছিলেন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট যোগেশচন্দ্র বসু। সে সময় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হিসেবে রেকর্ডে  ভারতীয় ও পাশ্চাত্য গান বাজানো হতো। এর ভিতরে কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত উভয়ই ছিল।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতারে পক্ষ থেকে প্রকাশিত 'বেতার জগৎ' নামক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। এই পত্রিকার নাম দিয়েছিলেন বেহালার জমিদার বীরেন রায়। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। এই সময় তাঁর সহযোগী ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১‌৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী বেতার জগতের সম্পাদক পদ ত্যাগ করে বীরেন্দ্র সরকার -এর পরিচালিত নিউ থিয়েটার্স নামক চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। এরপর সম্পাদক হয়েছিলেন নলিনীকান্ত।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই নভেম্বর (মঙ্গলবার ২৬ কার্তিক ১৩৩৬ ) সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম  রেডিওতে আবৃত্তি করেছিলেন। এই তথ্য পাওয়া যায় বেতার জগৎ থেকে। এরপর নজরুল ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগষ্ট (মঙ্গলবার, ২০ শ্রাবণ ১৩৩৭) রাত ৮টায় 'দ্বিজেন্দ্রলাল রজনী' অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে অন্যান্য যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা হলেন- হরিদাস গোস্বামী, গৌরী চক্রবর্তী, সুষমা দেবী প্রমুখ।

কলকাতা বেতার কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক ছিলেন বিবিসি থেকে আগত সি সি ওয়ালিক
(C.C. Wallick) । ভারতীয় প্রোগ্রামের প্রযোজক ছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। নানা ধরনের সমস্যার কারণে এই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ (শনিবার ১৭ ফাল্গুন ১৩৩৬) থেকে আইবিসি'র সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় সকল কর্মচারী চাকরি হারিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে। এই অবস্থায় তৎকালীন ভারত সরকার বেতার সম্প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই সময় এই সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের নাম হয়- Indian State Broadcasting Service (ISBS) । নতুন প্রতিষ্ঠানে পুরানো কর্মচারীরা চাকরি পায়। তবে নতুন করে কর্ম বিন্যাস করা হয়।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে  নজরুলের  গান একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করেছিল। সে সময়ে যাঁরা গান রচিত হতো, সেগুলোর সাধারণ পরিচয় ছিল আধুনিক গান। নজরুলের বহু গান আধুনিক গান হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে বেতারে গীতিকারের নামানুসারে পৃথক মর্যাদা ছিল। প্রচারিত হতো নজরুলের গান। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ সংখ্যায় (শুক্রবার ৯ আশ্বিন ১৩৩৭) 'আমাদের কথা' বিভাগে একটি বিজ্ঞাপন থেকে এরূপ তথ্য পাওয়া যায়। বিজ্ঞাপনটি ছিল-

'কাজী নজরুল ইসলামের গান ও আধুনিক গানে পারদর্শ শ্রীযুক্ত উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবারকার বেতার আসরে যোগদান করবেন।'

এই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষামূলক বেতার সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল (মঙ্গলবার, ১৮ চৈত্র ১৩৩৬) থেকে। এই সময় এর নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’।’।

এই সময়ে বেতার নাটক প্রচারিত হতো প্রায় নিয়মিত। এসকল নাটকে অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সরযূবালা, শম্ভু মিত্র, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে ও বিকাশ রায়ের মত অভিনেতারা অভিনয় করতেন। এ্ছাড়া ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল অল্প-বিস্তর ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী।

'মহিষাসুরমর্দিনী'

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বেতার থেকে 'বসন্তেশ্বরী' নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানে বাণী কুমার চণ্ডীর শ্লোক আবৃত্তি করেন। এই অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের সাফল্য দেখে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ষষ্ঠীর ভোরে কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে দুই ঘণ্টার 'মহিষীসুরমর্দিনী' নামক একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। এই অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন ন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এই অনুষ্ঠানের ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এই অনুষ্ঠানে কয়েকটি গানে সুরযোজনা করেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র ও রাইচাঁদ। আর অধিকাংশ গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে জনপ্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমারকে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করেছিল। কিন্তু এই প্রচার জনমানসে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। ফলে শেষ পর্যন্ত আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সেই অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মূল মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারের ফিরে আসে।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পঙ্কজ কুমার মল্লিককে নিয়ে বাণীকুমার রচিত বিখ্যাত 'মহিষাসুর-মর্দিনী' অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন এবং বহুদিন এই অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর ভারত সরকার, ‘ইঞ্চকেপ’ কমিটির নির্দেশ মতো, ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৩ নভেম্বর দিল্লি থেকে কলকাতা বেতারে নির্দেশ আসে যাবতীয় কর্মসূচি বন্ধ করে দেবার। এই সময় বেতার পরিচালন দফতরের ভারপ্রাপ্ত স্যার জোসেফ ভোর, ভারতের গভর্নর জেনারেলকে প্রচারধর্মী এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের হাতে রাখার পরমার্শ দেন। গভর্নর জেনারেল তাতে সম্মত হন।

দুই বছর পরীক্ষামূলক স্তর পার করে এসে, ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে এই সম্প্রচার ব্যবস্থা স্থায়ী সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। এরপর কলকাতার শিল্পী ও কলাকুশলীর নব উদ্যোমে কলকাতা বেতারকেন্দ্রে অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর (শুক্রবার ১ পৌষ ১৩৩৯), বেতারে প্রচারিত হয়েছিল মন্মথ রায়ের রচিত
মহুয়া (নাটক)।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সংবাদ পরিবেশন শুরু হয়। সে সময়ে রাজেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন স্থানীয় সংবাদের দায়িত্বে। কিছুদিন পরে সংবাদ বিভাগে যেওগদান করেন বিজন বসু, বিভূতি দাস প্রমুখ।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ অগস্ট ভারতীয় বেতারের প্রথম ‘কন্ট্রোলার অব ব্রডকাস্টিং’ পদে কার্যভার গ্রহণ করেন বিবিসির লায়োনেল ফিলডেন।

উল্লেখ্য, ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার, ভারতে বেতার সম্প্রচার উন্নয়নের জন্য ৪০ লাখ রুপি বরাদ্দ করে। ভারতে বেতার সম্প্রচারের কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার জন্য, বেতার নিয়ন্ত্রক কমিটি বিবিসির পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সূত্রে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রকাস্টিং নিয়ন্ত্রক এবং বিবিসির বেতার গবেষণার প্রধান এইচ.এল. কির্কে ভারত ভ্রমণে করেন। এই ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেতার সম্প্রচারের জন্য স্থান নির্ধারণ করা। গুটি কয়েক বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বেতার সম্প্রচারের অধীনে আনা যায়, এই লক্ষ্য সামনে রেখে এঁরা জনবহুল এলাকাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যকে কারক্রকরীর করার লক্ষ্যে পুরানো বেতারকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন করা হয়।

তৃতীয় বেতারকেন্দ্র, দিল্লী ক

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি দিল্লি কেন্দ্র গণ্য হয় বেতার সম্প্রচারের সদর দফতর হিসেবে।   ২০ কিলোওয়াট মিডিয়াম তরঙ্গে নিয়মিত বেতার সম্প্রচার শুরু হয় এই কেন্দ্র থেকে।

৮ জুন (বৃহস্পতিবার ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৩) এই সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় All India Radio

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি (বৃ্হস্পতিবার ১৪ ফাল্গুন ১৩৪২)। রাত্রি: ৮.৩০। জগৎঘটক রচিত ' জীবনস্রোত ' গীতি-আলেখ্য প্রচারিত হয়েছিল। ৬ আগষ্ট (শুক্রবার ১২ শ্রাবণ ১৩৪৩) প্রচারিত হয়েছিল ' মীরা উৎসব' গীতি-আলেখ্য।

১৯৩৬-খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতারের সংগীত প্রযোজনার কাজে নিয়োজিত হন সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী এবং 'যন্ত্রীসংঘ'-এর প্রধান হিসেবে সুরেন্দ্রলাল দাস। একের পর এক বিভিন্ন গীতি আলেখ্য শ্রোতাদের উপহার দিতে থাকেন এঁরা।

চতুর্থ বেতারকেন্দ্র, পেশোয়ার
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সরকার পেশোয়ারে বেতারকেন্দ্র স্থাপন করে। এটি ছিল  ১.২৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে অশোককুমার সেন কলকাতা কেন্দ্রে যোগ দেন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে। কলকাতা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলিতে বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠায় এই মানুষটির ভূমিকা চিরস্মরণীয়।

পঞ্চম বেতারকেন্দ্র, লাহোর
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, পাঞ্জাব প্রদেশের সরকার লাহোরে বেতারকেন্দ্র স্থাপন করে। এটি ছিল  ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ। এই বেতারকেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর হারবার্ড এমাসন।

ষষ্ঠ বেতারকেন্দ্র, দিল্লী খ
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, দিল্লীতে প্রথম ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- ভারত সরকারের যোগাযোগ কমিটির সদস্য, থমাস স্টুয়ার্ড।

সপ্তম বেতারকেন্দ্র, বোম্বাই খ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি, বোম্বাইতে  ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- বোম্বাইয়ের গভর্নর রজার লুমলে।

অষ্টম বেতারকেন্দ্র, লক্ষ্ণৌ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল, লক্ষ্ণৌতে ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ স্থাপিত হয়। এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- উত্তর প্রদেশের গভর্নর হ্যারি হাইগ।
 
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের  ৮ মে (১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিম্পঙের 'গৌরীপুর লজ' থেকে সরাসরি শ্রোতাদের উদ্দেশে আবৃত্তি করে শোনান তাঁর সদ্য লেখা কবিতা 'জন্মদিন'। এই অনুষ্ঠানটি এক যোগে প্রচারিত হয়েছিল কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, লখনউ, লাহোর ও পেশোয়ার কেন্দ্র থেকে।

নবম বেতারকেন্দ্র, দিল্লী গ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন, দিল্লীতে প্রথম ৫ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।

দশম বেতারকেন্দ্র, মাদ্রাজ-ক
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন, মাদ্রাজে ১.২৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড এরস্কিন।

একাদশ বেতারকেন্দ্র, মাদ্রাজ-খ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন, মাদ্রাজে ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড এরস্কিন।

দ্বাদশ বেতারকেন্দ্র, কলকাতা -খ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট, কলকাতায় ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- বাংলার গভর্নর রবার্ট রেইড।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতা বেতারের শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারের শক্তি বাড়িয়ে ১০ কিলোওয়াট করা হয়। এই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আশীর্বাণী 'বেতার জগৎ'-এ প্রকাশের ইচ্ছেয় নলিনীকান্ত সরকার, সংগীত বিভাগের সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে সোজা শান্তিনিকেতন যান। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ কিছু লিখে দিতে পারেন নি। পরে শিরোনাম-বিহীন একটি কবিতা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতাটি ছিল-

'ধরার আঙিনা হতে ঐ শোনো উঠিল 'আকাশবাণী'।

ত্রয়োদশ বেতারকেন্দ্র, ত্রিচিনোপল্লী
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট, ত্রিচিনোপল্লীতে ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড এরস্কিন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধ ঘোষণার করে। এরপর ভারতীয় বেতারকেন্দ্রের সবকটি স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষার সংবাদ পরিবেশনার দায়ভার গ্রহণ করে দিল্লি কেন্দ্র। এই কারণে বাংলা সংবাদের জন্য কলকাতা থেকে দিল্লি যান রাজেন সেন ও বিজন বসু।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে দিল্লী থেলে 'এক্সটারনাল সার্ভিস' হিসেবে সম্প্রচার শুরু হয় পোস্তু ভাষার কার্যক্রম।

চতুর্দশ বেতারকেন্দ্র, ঢাকা
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর (শনিবার ৩০ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) ঢাকাতে  ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- বাংলার গভর্নর লর্ড জন হারবার্ট।
          [দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশ বেতার]
 
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সঙ্গীতানুষ্ঠানে নিষিদ্ধ হয় হারমোনিয়াম। এর আগে ওই বছর জানুয়ারি মাসে অশোককুমার সেনকে চিঠি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা গান বেতারে প্রচারে আপত্তি জানান। এর মূল কারণ ছিল, তাঁর গানে হারমোনিয়ামের ব্যবহার। বেতারের কন্ট্রোলার লায়োনেল ফিলডেনেরও হারমোনিয়াম অপছন্দ করতেন। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি পৌঁছনোর দেড়মাসের মধ্যেই তিনি সবকটি বেতার কেন্দ্রে হারমোনিয়াম বর্জনের নির্দেশ দেন। পরবর্তী প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল ভারতীয় বেতারে।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের শুরু দিকে রবীন্দ্রনাথ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৬ অাগস্ট থেকে প্রতি ঘণ্টায় রবীন্দ্রনাথের শারীরীক অবস্থার কথা ঘোষণা করা হয়। ৭ অগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এই দিন  সকাল আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত পনেরো মিনিট অন্তর চলে ঘোষণা। রবীন্দ্রানথের মৃত্যুর পর রাজপথে শবানুগমনের শোভাযাত্রার, ও শ্রাবণসন্ধ্যায় নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ধারাবিবরণী দেন। ওই দিন বেতারের সান্ধ্য অধিবেশনে কাজী নজরুল ইসলাম আবৃত্তি করেন সদ্যরচিত 'রবিহারা' কবিতাটি, এবং ইলা ঘোষ ও চিত্ত রায়কে সঙ্গে নিয়ে গেয়ে শোনান 'ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে' গানটি।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট 'প্রথম বাঙালি মহিলা ঘোষিকা' হিসেবে কলকাতা বেতারে যোগ দেন ইন্দিরা দেবী।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের অাগস্ট মাসে 'শিশুমহল' অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন ইন্দিরা দেবী এবং টানা ৩৭ বছর ধরে তার পরিচালনার এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, ১৪ আগস্ট রাত এগারোটায় কলকাতা বেতারে প্রাসংগিক কথিকা ও কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নেন অমল হোম, সজনীকান্ত দাস, প্রবোধ কুমার সান্যাল, নিরঞ্জন মজুমদার প্রমুখ। আর মধ্যরাতে ভারতের সব ক'টি বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারিত হয় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি থেকে জওহরলাল নেহেরুর ভাষণ  'Tryst with Destiny'. । এই সময় স্বাধীন ভারতের অংশে ছিল ৬টি বেতার কেন্দ্র। এগুলো হলো- দিল্লি, কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ, লখনউ ও তিরুচিরাপল্লি। এছাড়া কম শক্তিসম্পন্ন বেতার কেন্দ্র ছিলিল- মহীশুর, ত্রিবান্দ্রম, হায়দরাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ ও বরোদা-তে।

স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল কলকাতায় চালু হয় 'রিজিওনাল নিউজ ইউনিট' বা 'আঞ্চলিক সংবাদ বিভাগ'। ওই বছর থেকেই বিভিন্ন বেতারকেন্দ্রে চুক্তির ভিত্তিতে প্রযোজক নেবার ব্যবস্থা হয়।

১৯৫৭ থেকে কলকাতা বেতারে প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে বা ফেব্রুয়ারির গোড়ায় উদযাপিত হত 'বেতারসপ্তাহ' । এই ধারা চলেছিল ১৯৬২ পর্যন্ত। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ ভারতের সংশোধিত পঞ্জিকা অনুসারে গণ্য হয় নতুন বর্ষ, এবং ১ এপ্রিল 'অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো'র নাম পাকাপাকি ভাবে বদলে রাখা হয় আকাশবাণী

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মহীশূরের 'আকাশবাণী' অবলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে 'অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো'র অপর নাম 'আকাশবাণী' হতে আর কোনও আইনি বাধা রইল না। ১৯৫৭-এর ১ এপ্রিল থেকে সরকারি ভাবে ভারতীয় বেতার 'অল ইণ্ডিয়া রেডিয়ো' এবং 'আকাশবাণী'- দু'টি নামেই পরিচিতি পেয়েছে।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা অক্টোবর থেকে শুরু হয় বিভিধ ভারতী কার্যক্রম কলকাতা -গ থেকে।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর অধীনে শুরু হয় টেলিভিশন শুরু হয়। এই সম্প্রচারের প্রথম কেন্দ্র ছিল দিল্লি।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মিহিরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বেতারকেন্দ্রে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীনই আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার। বেতারের কর্মজীবনে বিভিন্ন সময়ে 'সবিনয়ে নিবেদন'-এর উত্তরদাতা, 'গল্পদাদুর আসর'-এর পরিচালক এবং এফএম তরঙ্গের উপস্থাপক হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে জনপ্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমারকে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করেছিল। কিন্তু এই প্রচার জনমানসে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। ফলে শেষ পর্যন্ত আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সেই অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মূল মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারের ফিরে আসে।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল, রেডিও ও টেলিভিশনকে পৃথক করা হয়। টেলিভিশনের জন্য সংগঠনের নাম হয় 'দূরদর্শন'।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই থেকে চেন্নাইতে শুরু হয় এফএম সম্প্রচার।


সূত্র: