মণিপুরী

ভারত ও বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী। এরা মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের তিব্বত-বর্মি শাখার কুকি-চীন গোত্রভুক্ত। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ময়মনসিংহ, কুমিলা এবং ঢাকায় এক সময় তাদের বসতি থাকলেও বর্তমানে নেই বললেই চলে। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের গণনায় দেখা যায় বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ২৪,৯০২ এবং ভারতে ১২৭,০২১৬ জন। বার্মাতেও এদের বসবাস রয়েছে। দেহের আকার মধ্যমাকার। মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক চ্যাপ্টা, গণ্ডদেশ উন্নত। চুল অকুঞ্চিত, পুরুষদের মুখমণ্ডলে দাড়ি উঠে না। এদের গায়ের রঙ চাপা তাম্রবর্ণের হয়।

ভাষাগত দিক থেকে মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত। মৈতেয় মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী।

মৈতেয় মণিপুরী
মৈতেয় মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতেয় পুরনো একটি ভাষা। অন্য দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ইন্দো-ইউরোপিয় পরিবারভুক্ত বাংলা ও অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। এই ভাষাভাষীরা তাদের ভাষা প্রাচীন দাবী করলেও এ বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই । পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতেয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র  আমলে (৩৩-১৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)। তখন মৈতেয় ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বা-র  শাসনামলে (১৫৯৬-১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে) আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু সপ্তম শতকে এক ব্রোঞ্জ মুদ্রার উপর মৈতেয় বর্ণমালার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার হয়। ফলে মৈতেয় বর্ণমালার প্রাচীননত্ব প্রমাণিত হয়। তবে এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায় নি। তবে ধারণা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় হাতে লেখা যে পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতেয় ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুনথক এবং নুমিত কাপ্পা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতেয় মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে

 আসছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী বর্ণের নাম। যেমন: বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা, আবার বাংলা ‘স’-এর মনিপুর প্রতিবর্ণ হচ্ছে ‘সম’ যার অর্থ চুল। ভারতের মনিপুর রাজ্যের বাক-ভাষা হিসেবে মনিপুরী সরকারি ভাবে স্বীকৃত।

প্রাগৈতিহাসিক ভাষা
প্রাগ্-ভাষা পরিবার : প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার
ভাষা পরিবার : ইন্দো-ইউরোপিয়ান
ভাষা উপ-পরিবার :   ইন্দো-ইরানিয়া ভাষা
শাখা :  ভারতীয়-আর্য ভাষা
উপশাখা : পূর্বাঞ্চলীয় আর্য ভাষা
ভাষাগোষ্ঠী : বাংলা-অহমিয়া ভাষা
আন্তর্জাতিক ভাষা সঙ্কেত
ISO 639-1: নাই
ISO 639-2: inc
ISO/FDIS 639-3: bpy

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
বাঙালির ভাষার নাম বাংলা।
ইংরেজি :
Bishnupriya

এটি একটি পূর্ব-ভারতীয় ভাষা বিশেষ। এর অন্য নাম ইমার ঠার
(Imar Thar) । উল্লেখ্য মণিপুরী ‘ইমার ঠার’ শব্দের অর্থ হলো
মায়ের ভাষা। {ইমার (মায়ের) ঠার (ভাষা)}। এই ভাষার লোকেরা নিজেদেরকে মণিপুরী নামে অভিহিত করে থাকেন। পক্ষান্তরে প্রাচীন মণিপুরের রাজধানী বিষ্ণুপুরের ভাষা হিসাবে এর নাম হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। এর দুটি আঞ্চলিক রূপ রয়েছে। এই দুটি রূপ হলো রাজার গাঙ এবং মাদাই গাঙ।

এই ভাষার লোকেরা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, বাংলাদেশের সিলেট জেলা, মায়ানমার এবং অন্যান্য দেশে বসবাস করে। এদের সংখ্যা আনুমানিক ৫ লক্ষ। এই ভাষার বিকাশ ঘটেছিল প্রাচীন ভারতের মনিপুর রাজ্যের লোকতাক
(Loktak Lake) হ্রদ-সংলগ্ন অঞ্চলে । এর সর্বপ্রাচীন নমুনা পাওয়া যায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে পণ্ডিত নভকেন্দ্র শর্মার রচিত খুমল পুরাণে । বর্তমানে এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা পাওয়া যায় না। লেখালেখির ক্ষেত্রে এঁরা বাংলা হরফ ব্যবহার করে থাকেন।

বিষ্ণুপ্রিয়া জনগোষ্ঠী
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের আদিভূমি ছিল ভারতের উত্তর পুর্বাঞ্চলের মণিপুর রাজ্যে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে নানান রাজনৈতিক এবং সম্প্রদায়গত সংঘর্ষের কারণে এরা নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৮১৯-১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরের অধিবাসী পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামের কাছাড়, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশে চলে আসে। অভিবাসী এই সব মণিপুরিদের অধিকাংশই ছিল
  মৈতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া এবং পাঙন(মণিপুরি মুসলিম) সম্প্রদায়ের। বিষ্ণুপ্রিয়াদের ভাষার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি এবং মৈতৈদের ভাষা মৈতৈ বা মীতৈ। ভারতের মণিপুর রাজ্যে মৈতৈরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মৈতৈ ভাষা সেখানে লিঙগুয়া ফ্রাংকা। ইমফাল, বিষ্ণুপুর ও নিংথৌখঙের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি যারা ছিল তারা প্রায় সবাই মৈতৈ ভাষা গ্রহণ করার ফলে মণিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে ভারতের সাম্প্রতিক সেন্সাস থেকে মণিপুরের জিরিবাম অঞ্চলে কয়েক হাজার বিষ্ণুপ্রিয়ার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।

ভারতের মণিপুরসহ বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বরাবর একটি আন্তঃজাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বের মূল প্রশ্ন ছিল- কে মণিপুরি আর কে মণিপুরি নয়। ভারতের মণিপুর অঞ্চলেই বিষ্ণুপ্রিয়া বা মৈতৈ পরিচিতির বা ভাষার উদ্ভব। যদিও বিষ্ণুপ্রিয়া এবং মৈতৈ এই দুটি জাতিকে বরাবর রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ও দলিল দস্তাবেজে ‘মণিপুরি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ভারতের ভাষানীতির ভিত্তি স্যার জর্জ গ্রিয়ারসনের ‘লিংগুস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের স্পষ্টভাবে ‘বিষ্ণুপুরীয়া মণিপুরি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

'বিষ্ণুপ্রিয়া' ভাষা-আন্দোলন
বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার জন্য আন্দোলন দানা বাঁধে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে জনগণনায়
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি জনসংখ্যা হলো ১১৪ জন (মণিপুর রাজ্য), অথচ এর ৬০ বছর আগে ১৮৯১ সনে স্যার জি.এ. গ্রীয়ার্সন মণিপুর রাজ্য এবং সিলেট জেলায় প্রায় ২৩,০০০ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই জনগণনা প্রকাশিত হওয়ার পর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার মানুষ বিক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। আসাম ও ত্রিপুরায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে এই ভাষা চালু করার জন্য, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, ‘নিখিল মণিপুরী মহাসভা’।  প্রাথমিক পর্যায়ে ভাষিক সংখ্যালঘু বিষয়ক কমিশনসহ নানান রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে পত্র ও স্মারকলিপিসহ নিয়মতান্ত্রিক মাধ্যমে বারবার বৈঠক হয়। কিন্তু সরকারের ঔদাসীন্য, ছলচাতুরী ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কারণে দুটি রাজ্যেই বিষ্ণুপ্রিয়া অবহেলিত দশায় রয়ে যায়।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে জনগণনায়
আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জের পাথারকান্দিতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের জনসংখ্যা মাত্র ১ জন নারী দেখানো হয়, অথচ সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের জনসংখ্যা ছিল ২২,০০০ এরও বেশী। ত্রিপুরায় কমপক্ষে ২০,০০০ বিষ্ণু্প্রিয়া মণিপুরির বিপরীতে গননা করা হয় মাত্র ১৩ জন পুরুষ। আর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের ঘনবসতিপুর্ণ অঞ্চল কাছাড়ের প্রায় ৬৬,০০০ এর জায়গায় লেখা ১৫,১৫৫ জন। বলাই বাহুল্য, এই জনগণনা সকল মণিপরি-ই প্রত্যাখ্যান করে। পরে এই বিষয়টি একটি গণ-আন্দোলনে রূপ লাভ করে।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই তারিখে আসামের কাছাড় জেলার বিষ্ণুপুরী ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল করে। এই সময় বিক্ষোভকারীরা আদমশুমারী-প্রতিবেদনের অনুলিপি প্রকাশ্যে পুড়িয়ে প্রতিবাদ করে।
২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ২-৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই
ভাষা দাবী সপ্তাহ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র গণসমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় জনগণনার জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোরদার বক্তব্য রাখা হয়।

১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়। জুলাই মাসেই জনসভা গুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং প্রতিটি সভায় ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের উপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়।
 

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে ভাষা আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠে। এই সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এই নিপীড়ন চলে নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য গ্রেফতারের তালিকা নিচে দেওয়া হলো

সরকার সাময়িকভাবে ভাষা আন্দোলনকারীদের স্তিমিত করতে পারলেও ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আবার তা জোরদার হয়ে উঠে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯-৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে আবার জনগণনা হয়। পূর্বের জনগণনা প্রতিবেদনের এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনার নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। এই গণনা পাথারকান্দির জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১০,১৬৪ জন। অর্থাৎ ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের পাথারকান্দির ১ জন নারী ১০ বছরে কোন পুরুষের সহায়তা ছাড়াই ১০,১৬৪ জন্মদান করেছে! আবার ১৯৬১ সনের নারীশূন্য ত্রিপুরায় ১৩ জন পুরুষ ১০ বছরে জন্ম দিয়েছে ৯৮৮৪ জনের!

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর কাছাড়ের সর্বত্র ৪৮ ঘন্টার গণঅনশন পালিত হয়।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬-৯ মার্চ আন্দোলনকারীরা ৭২ ঘণ্টার গণ-অনশন শেষ করে এবং ‘বিষ্ণুপুরী সেভেন পয়েন্ট এ্যাকশন কমিটি’ গঠন করে। উল্লেখ্য এই সময় ভাষার দাবির সাথে আরো ৬টি দাবি যুক্ত করা হয়।

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের সর্বত্র ‘সংখ্যালঘু বাঁচাও দিবস’ পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন বাঙালির মাতৃভাষা দিবস, সেই তারিখে ১৯৭৯ সালে সমগ্র কাছাড়ে পালিত হয় অবস্থান ধর্মঘট পালিত হয়।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া, শিক্ষাকার্যক্রমে বিষ্ণুপুরী মণিপুরীভাষা চালু করার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। কিন্তু অজানা কারণে ৮ ডিসেম্বর তা স্থগিত করা হয়। এর ফলে আবারো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ছাত্র ইউনিয়ন’ আন্দোলনের নামে।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বিষ্ণুপুরী মণিপুরী ভাষার সাহিত্য পরিষদ তাদের আন্দোলন সংক্রান্ত একটি দলিল তৈরি করে। এই দলিলটির নাম ছিল ‘লেট হিস্ট্রি এ্যান্ড ফ্যাক্টস স্পিক এ্যাবাউট মণিপুরী’। এই দলিলটি নিয়ে সাহিত্য পরিষদ দিল্লিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীর সাথে দেখা করেন। এই বৈঠক ব্যর্থ হলে, ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী স্টুডেন্ট্স ইউনিয়ন’ নতুন আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে।

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই বিপুল উদ্যোমে ভাষা দাবীদিবস পালিত হয়। এরপর আন্দোলন চলতে থাকে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ১২ ঘন্টা ‘রেল রোকো কর্মসূচি’। ২৭ জুলাই তারিখে সরকার আবারো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা চালুর জন্য আরো একটি নোটিফিকেশন করে এবং ৬ আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে তা আবার স্থগিত করে।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের ভেতর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা চালু করার দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেয়। ঐদিন শিলচর গান্ধিবাগ ময়দানে প্রায় দশহাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে এই চরমপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ঐ চরমপত্রকে কোনো গুরুত্ব না দেয়ায় ভাষা-আন্দোলন আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠে এবং ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি গণসংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সময়কালের মধ্যে অসংখ্যবার ২৪ ঘন্টা, ৩৬ ঘন্টা, ৪৮ ঘন্টা এবং ১০১ ঘন্টার রাজপথ রেলপথ অবরোধ, গনঅনশন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। এসব কর্মসূচির ফলে বরাক উপত্যকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

অবশেষে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ মে তারিখে ত্রিপুরা সরকার প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপুরী মণিপুরী ভাষা চালু করে।

সুদেষ্ণা সিংহ
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ই ফেব্রুয়ারি আসামের বিলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম বুলু। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার জন্য তিনি যখন শহীদ হন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩২।

আসাম রাজ্যে এই দাবিটি তখনো গৃহীত না হওয়া, ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ, শনিবারি, ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী স্টুডেন্ট্স ইউনিয়ন’ ৫০১ ঘণ্টার রেল অবরোধ কর্মসূচী দেয়। এই সময় আন্দোলনকারীরা করিমগঞ্জ থেকে আগত একটি ডাউন ট্রেন, আসামের করিমগঞ্জ জেলার কাল্কালিঘাটের গুংঘাঝারি রেল স্টেশনে অবরোধ করে। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিনা ঘোষণায় পুলিশ অবরোধকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করলে, প্রায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এই সময় সুদেষ্ণা সিংহ নাম জনৈকা আন্দোলনকারিণী গুলিবিদ্ধা হন এবং সকাল ১২.১০টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সুদেষ্ণা'এর সাথে অন্যান্য যে সকল সহকর্মী আহত হন, তাঁরা হলেন অরুন সিংহ(২৬), প্রমোদিনী সিংহ (২৫), কমলাকান্ত সিংহ (৪৫), দীপংকর সিংহ (২৫), প্রতাপ সিংহ (২৬), নমিতা সিংহ (৪০), রত্না সিংহ (২৪), বিকাশ সিংহ (২৭), শ্যামল সিংহ (২০) প্রমুখ।  এই ঘটনার পর আসাম ও ত্রিপুরা জুড়ে ব্যাপক গণ-আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে, আসাম সরকার সকল দাবি মেনে নেয়। বর্তমানে বিষ্ণুপুরী মণিপুরী ভাষার মানুষ প্রতিবৎসর ১৬ মার্চকে ‘শহীদ সুদেষ্ণা দিবস’ হিসাবে পালন করে থাকে।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার ১৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় শিক্ষাদান চালু করে। এরপর ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রীমকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ভারতে একটি স্বতন্ত্র ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে।


সূত্র :