বুধ
Mercury
জ্যোতির্বিজ্ঞান চিহ্ন :

সৌরজগৎ এর নিকটতম গ্রহ। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে চন্দ্রের পুত্র। পাশ্চাত্য Mercury শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে রোমান দেবতার নামানুসারে।

জ্যোতির্বিজ্ঞান মতে
সূর্যের দিক থেকে এই গ্রহের অবস্থান প্রথম সূর্য পৃথিবীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই গ্রহের অবস্থানের কারণে, একে অন্তর্গ্রহ (inferior planet) বলা হয়। এর কোনো উপগ্রহ নেই।
 

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

ভর: ৩.৩০১১x১০২৩কেজি
আয়তন:
৬.০৮৩x১০১০ কিমি
ব্যাসার্ধ: ২৪৩৯.৭ কিমি
পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল: ৭.৪৮×১০ কিমি

গড় ঘনত্ব: ৫.৪৩ গ্রাম/সেমি
বিষুব পৃষ্ঠীয় অভিকর্ষ: ৩.৯ মি/সে
কক্ষীয় পর্যায়কাল:
পার্থিব ৮৭.৯৬৯১)
অপসূর: ৬৯,৮১৬,৯০০ কিমি
অনুসূর: ৪৬,০০১,২০০ কিমি
অক্ষীয় পর্যায়কাল: পার্থিব ৫৯ দিন।
গড় তাপমাত্রা: ১৭৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ ৪৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাতে -১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সৌরজগতের পৃথিবীসদৃশ-গ্রহগুলোর (terrestrial planets) ভিতরে বুধ সবচেয়ে ছোট। এর আকার চাঁদের চেয়ে সামান্য বড়।

 

দিনের বেলায় সূর্যের তীব্র আলোর কারণে এই গ্রহটিকে দেখা যায় না। এই গ্রহটি দেখার উপযুক্ত সময় ভোরে বা গোধূলিতে। এছাড়া পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে বুধ চলে এলে এবং সূর্য পরিক্রমণকালে বুধকে দেখা যায়। যেমন- ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে, ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর এই অতিক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর বুধের অতিক্রমণ ঘটবে।

 

বুধের ভৌত গঠন
বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে ৭০% ধাতব এবং বাকি ৩০% সিলিকেট জাতীয় পদার্থ। ধারণা করা হয় এই গ্রহের কেন্দ্রটি বেশ বড় এবং লৌহ সমৃদ্ধ। সম্ভবত গ্রহটির প্রায় ৪২ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এর কেন্দ্রাঞ্চল। যেখানে পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চল মাত্র ১৭ ভাগ। এই কেন্দ্রকে ঘিরে রয়েছে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার পুরু
গুরুমণ্ডল (Mantle)

ধারণা করা হয়,
৩৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে বিপুল পরিমাণ ধূমকেতু এবং গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল। এই গ্রহে কোনো বৃহৎ গ্রহাণু বা এই জাতীয় কোনো মহাকাশীয় বস্তু বুধের পৃষ্ঠদেশে আঘাত হেনেছিল। এর ফলে এর গুরুমণ্ডলের বিশাল অংশ বুধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই সময় কেন্দ্রমণ্ডল অক্ষত থাকায় বুধ লৌহসমৃদ্ধ গ্রহে পরিণত হয়েছিল। গুরুমণ্ডলের পরে রয়েছে ১০০-২০০ কিলোমিটার পুরু ত্বক অঞ্চল। গুরুমণ্ডলের উপরিতল দ্রুত শীতল হয়ে যাওয়ার ফলে এর উপরিতলে নানা ধরনের খাঁচের সৃষ্টি হয়েছিল।

এই সংঘর্ষের কারণে ক্যালরিস অববাহিকাগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং একই কারণে সে সময়ে প্রচুর লাভা উদ্‌গীরণের মতো ঘটনা ঘটেছিল। এই লাভা ক্যালরিস অববাহিকার  (caloris basin) খাদগুলোকে ঢেকে দিয়েছিল। এরই প্রভাবে এ সকল খাদের তলদেশ সুষম অবয়ব লাভ করেছিল হয়েছিল। ক্যালরিস অববাহিকাগুলোরবেশ কয়েকটি শতাধিক কিলোমিটার পর্যন্ত প্রশস্ত অবয়ব তৈরি করেছিল। এর ভিতরে সর্ববৃহৎ খাদের ব্যাস প্রায় ১৩০০ কিমি। এর অপর একটি খাদ রয়েছে- স্কিনাকাস অববাহিকায়। এর ব্যাস প্রায় ১৬০০ কিমি।

এর সমতল ভূমিসমূহের আড়াআড়িভাবে বিপুল সংখ্যক সংকোচনজনিত ভাজ লক্ষ্য করা যায়। ধারণা করা হয়, যখন গ্রহের অভ্যন্তরভাগ শীতল হচ্ছিল তখন তা সংকৃচিত হতে শুরু করে এবং এর ফলে এর পৃষ্ঠতল পুনরায় ভিন্নভাবে গঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। এর ফলে এই ভাজগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল।
 
বুধ পৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রার কারণে এক সময় মনে করা হতো- এই গ্রহে বরফ নেই। সাম্প্রতিক কালে এর মেরু অঞ্চলের কিছু গভীর খাদে বরফের স্তর জমেছে। বুধ গ্রহের মেরুর সন্নিকটে অবস্থিত বরফ খণ্ড পৃথিবী থেকে প্রেরিত রাডার সংকেতকে প্রতিফলিত করে থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলগুলোতে বরফের পুরুত্ব মাত্র কয়েক মিটার।

বুধের বায়ুমণ্ডল
আকারে এই গ্রহটি অত্যন্ত ছোটো হওয়ায়, এর অভিকর্ষ বল অত্যন্ত কম। এই কারণে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় উপকরণগুলো ধীরে ধীরে মহাকাশে পালিয়ে যায়। তারপরেও এই গ্রহের হাল্কা বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব সব সময়ই লক্ষ্য করা যায় নিয়মিত গ্যাসীয় উপকরণ যুক্ত হওয়ার কারণ। বায়ুমণ্ডলের হাইড্রোজেন হিলিয়াম আধিক্য ঘটে সৌর বায়ু থেকে। সূর্যের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে সূর্য থেকে আগত আয়োনিত
হাইড্রোজেন হিলিয়াম পরমাণু বুধের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। এছাড়া বুধের ত্বকে বিদ্যমান পদার্থগুলোর তেজস্ক্রিয় ভাঙন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয়ে থাকে। একই ভাবে সোডিয়াম এবং পটাসিয়ামেরও সৃষ্টি হয়। অনেক সময় এর পৃষ্ঠদেশের সাথে ধূমকেতু বা উল্কার সংঘর্ষের কারণে বাষ্পের সৃষ্টি হয়। নতুন গ্যাসীয় উপকরণের সরবরাহ এবং তা মহাকাশে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, বুধের বায়ুমণ্ডলে হাল্কা বায়ুস্তর সব সময়ই থাকে।


 

মেরিনার ১০

বুধে অভিযান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) কর্তৃক প্রেরিত মহাকাশযান প্রকল্প মেরিনার-এর দশম মহাকাশযান 'মেরিনার-১০' বুধ গ্রহের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছিল। এই নভোযানটি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা নভেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়। এই নভোযানটি পাঠানো হয়েছিল শুক্র ও বুধ গ্রহের উদ্দেশ্য।

এই নভোযানটি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা নভেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়। এই নভোযানটি পাঠানো হয়েছিল
বুধ ও শুক্র  গ্রহের উদ্দেশ্য। এটি প্রথমে শুক্র গ্রহে উপস্থিত হয়। পরে শুক্র গ্রহের অভিকর্ষকে কাজে লাগিয়ে নভোযানটি বুধ গ্রহ পরিদর্শনের জন্য যাত্রা শুরু করে।

এই নভোযানটি তিনবার বুধের খুব সন্নিকটে যেতে পেরেছিল। নভোযানটি বুধের ৩২৭ কিমি কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথমবার বুধের কাছে যাওয়ার মাধ্যমে মেরিনার ১০, গ্রহটিতে একটি অভাবনীয় চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। এই সময় বুধের ধীর ঘূর্ণন বেগ ধরা পড়ে। দ্বিতীয়বার মেরিনার ১০ বুধের খুব সন্নিকটে যায় এবং এর পৃষ্ঠদেশের প্রচুর আলোকচিত্র গ্রহণ করে। তৃতীয় বার গ্রহটির চৌম্বক ধর্ম সম্বন্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত জানা সম্ভব হয়। উপাত্তগুলো থেকে বোঝা যায়, গ্রহটির চৌম্বক ক্ষেত্র অনেকটা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের মত যা গ্রহের চারপাশের সৌর বায়ুকে পথচ্যুত করতে পারে। তৃতীয়বার বুধের সন্নিকটে যাওয়ার পর এর জ্বালানী প্রায় ফুরিয়ে যায়। এর ফলে পৃথিবী থেকে এই অভিযানের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। অবশেষে পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অভিযানের কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। ধারণা করা হয় মেরিনার ১০ এখনও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং প্রতি কয়েকমাসে একবার করে বুধ গ্রহের সন্নিকটে যাচ্ছে।

মেসেঞ্জার


েরিনা নামক মহাকাশ যান প্রকল্প বন্ধ হ্য়ে যাওয়ার পর, বুধে গবেষণা কর্ম পরিচালনা করা হয় মেসেঞ্জার নামক প্রকল্প এবং এই পরিকল্পনার তত্ত্বাবধানে তৈরি মহাকাশ যান।  মেসেঞ্জার নামক
প্রকল্পের অধীনে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের কেপ ক্যানাভেরাল মহাশূন্য স্টেশন থেকে বোয়িং ডেল্টা ২ রকেটের মাধ্যমে একটি নভোযান প্রেরণ করা হয়েছিল। এই নভোযানটি মেসেঞ্জার নামেই পরিচিত। এই নভোযানটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যেন একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এটি বুধের কৃত্রিম উপগ্রহে পরিণত হয়।
 


সূত্র:
https://solarsystem.nasa.gov/planets/profile.cfm?Object=Mercury