হাবল টেলিস্কোপের ক্যামেরায় মঙ্গলগ্রহ

মঙ্গল (গ্রহ)
ইংরেজি : Mars
িিজ্ঞান চিহ্ন :

সৌরজগতের সূর্য-এর দিক থেকে চতুর্থ গ্রহ। পৃথিবী থেকে এই গ্রহটি লালচে দেখায়। এই কারণে একে অনেক সময় লাল গ্রহ বলা হয়। সৌরজগতের চারটি পৃথিবী সদৃশ গ্রহের (বুধ, শুক্র, পৃথিবী,  ও মঙ্গল) ভিতরে এই গ্রহটি সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। মঙ্গল গ্রহের পরে রয়েছে গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়।

এর ত্বক অনেকটাই
পৃথিবীর মত। এর অতি ক্ষীণ বায়ুমণ্ডল রয়েছে। এর ভূ-ত্বকে রয়েছে অসংখ্য খাদ, আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ। সৌরজগতের সর্ববৃহৎ পাহাড় এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্‌স। সর্ববৃহৎ গভীর গিরিখাতটিও এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। এছাড়া মঙ্গলের ঘূর্ণনকাল এবং ঋতু পরিবর্তনও অনেকটা পৃথিবীর মত।

মঙ্গলের মহাকাশীয় বৈশিষ্ট্য

মঙ্গলের ভৌত বৈশিষ্ট্য

এর দুটি উপগ্রহ আছে। এই উপগ্রহ দুটির নাম ফোবোস ও ডিমোস।

পাথফাইন্ডার থেকে তোলা মঙ্গলের উপরিতল

মঙ্গলের গঠন উপাদান
এর কেন্দ্রের ব্যাসার্ধ প্রায় ১,৪৮০ কিলোমিটার (৯২০ মাইল)। এই কেন্দ্রের মূল উপাদান লোহা। এর সাথে প্রায় ১৫% গন্ধক আছে। এই মিশ্রিত উপকরণটি তরলাবস্থায় আছে। এই অংশটি ঘিরে রয়েছে সিলিকেট দ্বারা গঠিত একটি ম্যান্টল। এই ম্যান্টেল গ্রহটির মূল কাঠামো ধরে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এই ম্যান্টল অংশটি মোটামুটিভাবে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এর উপরে রয়েছে ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) পুরু ত্বক। এই ত্বকের মূল উপাদান ব্যাংসাল্ট এবং সিলিকা সমৃদ্ধ পাথর। আর সবার উপরে রয়েছে পুরু ধূলিকণা। এর ধূলিকণার মূল উপাদান আয়রন অক্সাইড দ্বারা। এই আয়রন অক্সাইডের কারণে এর ত্বকের উপরিভাগ লালচে দেখায়। আর এই ধূলির আস্তরণের ভিতরে রয়েছে রাশি রাশি পাথর।

মঙ্গলের কোন অভ্যন্তরীণ চৌম্বক ক্ষেত্র নেই। কিন্তু কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এর ভূ-ত্বকের কিছু অংশ চুম্বকায়িত হয়ে আছে।
susceptible নামক চুম্বকধর্মী খনিজ পদার্থের কারণে এই চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়।

মঙ্গলের ত্বক পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা কিছু অধিযুগে ভাগ করেছেন। এর ভিতরে তিনটি অধিযুগকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো হলো

ধারণা করা হয়. নোয়াচিয়ান অধিযুগে এই গ্রহটিতে নানাবিধ যৌগিক পদার্থসমৃদ্ধ তরল পানির অস্তিত্ব ছিল। কালক্রমে ভারি পদার্থ অধঃক্ষেপিত হওয়ার ফলে, সৃষ্ট স্বচ্ছ পানি, গ্রহটির বায়ুমণ্ডলীয় কম চাপে বাস্পে পরিণত হয়।

২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নাসা এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মঙ্গলের দক্ষিণ মেরুতে যে পরিমাণ বরফ রয়েছে তা গলিয়ে দিলে সমগ্র গ্রহটি পানিতে ডুবে যাবে এবং এই জলভাগের গভীরতা হবে প্রায় ১১ মিটার (৩৬ ফুট) হবে। এছাড়া বরফের একটি পারমাফ্রস্ট
(permafrost) ম্যান্ট্‌ল মেরু অঞ্চল থেকে ৬০° অক্ষাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে। এছাড়া মঙ্গলের পুরু ক্রায়োস্ফেয়ারের (cryosphere) অভ্যন্তরে আরও বিপুল পরিমাণ পানি আছে। কোন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মাধ্যমে ক্রায়োস্ফেয়ার ধ্বংস হলে এই পানি বেরিয়ে আসতে পারে। এরকম একটি বিস্ফোরণ বহু আগে মঙ্গলের ভ্যালিস মেরিনারিস গঠিত হয়েছিল। ধারণা করা হয় প্রায় ৫০ লক্ষ বৎসর আগে এরকম একটি ঘটনার সূত্রে সারবেরাস ফোসি নামক একটি খাদ উন্মুক্ত হয়েছিল এবং এই সূত্রে একটি বরফের সাগর সৃষ্টি হয়েছিল। এই সাগরটিকে বিজ্ঞানীরা এলিসিয়াম প্ল্যানিটিয়া নামকরণ করেছেন। সম্প্রতি মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়ারে অবস্থিত মার্স অরবিটার ক্যামেরার মাধ্যমে মঙ্গলের কিছু উচ্চ রিজল্যুশন কিছু ছবির মাধ্যমে, মঙ্গলের পৃষ্ঠতলে তরল পানির অস্তিত্বের ইতিহাস সম্বন্ধে অনেকটাই বিস্তারিত জানা গেছে। সেখানে বন্যা সৃষ্টিকারী বিশালায়তন কিছু প্রাণালীর নিদর্শন পাওয়া গেছে। একই সাথে বেশ কিছু নদী ও শাখা নদীর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু মঙ্গলের আবহাওয়ার কারণে এসকল খাদে পানির হারিয়ে গেছে। এছাড়া আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং গভীর গিরিখাত দেখা যায়। এই গিরিখাতগুলো মঙ্গলের দক্ষিণ গোলার্ধের উঁচু অঞ্চলগুলোতে অবস্থিত এবং এদের মুখ বিষুবরেখার দিকে ৩০° অক্ষাংশে মেরুমুখী হয়ে অবস্থান করছে। এছাড়া এই গ্রহৈ হেমাটাইট এবং গোয়েথাইইট আকরিক পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য এই দুটি আকরিক তৈরির জন্য পানির উপস্থিত আবশ্যক।

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাডলার ও বিয়ার মঙ্গলের একটি মানচিত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। এ সময়ে তাঁর মানচিত্রে মঙ্গলের মূল মধ্যরেখা হিসেবে একটি রেখাকে বিবেচনা করে একে মঙ্গলের বিষুবরেখা নির্দিষ্ট করেন। তারপর গ্রহটির অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ তৈরি করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মেরিনাস ৯ মহাকাশযান মঙ্গলের বেশ কিছু উচ্চ রিজল্যুশনের ছবি পাঠায়। এই সূত্রে মঙ্গলের সাইনাস মেরিডিয়ানি নামক সাগরের উপর এয়ারি-০ নামক একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের সন্ধান পাওয়া যায় । পরবর্তীতে এই জ্বালামুখটিকে ০.০° অক্ষাংশ হিসাবে বিবেচনায় আনা হয়। এই জ্বালামুখটি এর আগে নির্বাচিত মূল মধ্যরেখার উপর অবস্থিত। অর্থাৎ পৃথিবীর যেমন গ্রিনিচ, মঙ্গলের এয়ারি-০ তেমনি ।

বর্তমানে মঙ্গলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক কাঠামোসমূহের নাম বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে রাখা হয়েছে। যে সকল কাঠামোসমূহের উচ্চ প্রতিফলন অনুপাত রয়েছে তাদের অধিকাংশেরই নাম আগেরটিই রাখা হয়েছে। আবার বেশ কিছু নাম রাখা হয়েছে বিষয়ের প্রকৃতি অনুসারে। যেমন: নিক্স অলিম্পিকা (অলিম্পাসের তুষার) নামক পর্বতটির আধুনিক নাম হচ্ছে অলিম্পাস মন্‌স (অলিম্পাস পর্বত)। মঙ্গলের বিষুবরেখা এর ঘূর্ণন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে, কিন্তু এর মূল মধ্যরেখা নির্দিষ্ট করা হয়েছে পৃথিবীর মত করেই।

মঙ্গলে যেহেতু কোন জলরাশি পূর্ণ মহাসাগর বা এই জাতীয় ছোটোবড় কোনো জলাশয় নেই। তাই সেখানকার বিভিন্ন উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য একটি শূন্য-উচ্চতার পৃষ্ঠতল ধরে নেওয়া হয়েছে। একে বলা হয়েছে গড় অভিকর্ষীয় পৃষ্ঠতল । মঙ্গলের যে উচ্চতায় বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিমাণ ৬১০.৫ প্যাসকেল (৬.১০৫ মিলিবার) সে উচ্চতাকে শূন্য উচ্চতা ধরা হয়। এই চাপ পৃথিবীতে সমুদ্র পৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ০.৬% -এর সমান।

মঙ্গলে অভিযান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গল, শুক্র এবং বুধ গ্রহে নভোযান পাঠানোর পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার নাম রাখা হয়েছিল মেরিনার। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম মেরিনার ১
(Mariner- 1) নামক একটি নভোযান প্রেরণ করে। এই থেকে শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মঙ্গল অভিযান।  মেরিনার সিরিজের নভোযানের নকশা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে Jet Propulsion Laboratory (JPL) নামক একটি প্রতিষ্ঠান। আর এর উৎক্ষপণের বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছিল National Aeronautics and Space Administration (NASA) । এই কারণে এই নভোযানের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয় NASA/JPL নামে। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মঙ্গলের উদ্দেশ্যে একটি মহাকাশ যান পাঠায়। এর নাম ছিল মার্স ১। এই নভোযানের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ই্‌উনিয়ন মঙ্গলগ্রহের নভোযান প্রেরণের সূচনা করেছিল। এই দুটি সিরিজের নভোযান ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য নভোযানের মাধ্যমে মঙ্গলের উপর গবেষণা চালানো হয়েছে। নিচে মঙ্গলগ্রহ নভোযান প্রেরণের কালানুক্রমিক তালিকা দেওয়া হলো।


তথ্যসূত্র
http://en.wikipedia.org/wiki/Mars