দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ এবং তিনি বাংলা সংকেত লিপি (শর্ট হ্যান্ড) ও স্বরলিপি প্রণেতাদের একজন।

১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ (বুধবার, ২৯শে ফাল্গুন ১২৪৬ বঙ্গাব্দ) জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মায়ের নাম সারদাসুন্দরী দেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

বাড়িতেই তাঁর বাল্যশিক্ষা হয় গৃহশিক্ষকের কাছে। এরপর তিনি ভর্তি হন সেন্ট পল’স স্কুলে। এই স্কুলে তিনি দুই বৎসর পাঠগ্রহণের পর স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি হিন্দু কলেজ -এ ভর্তি হন এবং ভর্তির বৎসরেই তিনি কলেজ ত্যাগ করেন।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি [শনিবার], তিনি যশোহরে নরেন্দ্রপুর-নিবাসী তারাচাঁদ চক্রবর্তীর কন্যা সর্বসুন্দরীকে বিবাহ করেন।

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বঙ্গানুবাদ করেন। এটি ছিল পদ্যানুবাদ। এরপর তিনি স্বত্ত্বাতত্ত্ব (তত্ত্ববিদ্যা) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
১৮৬৬-৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর তত্ত্ববিদ্যা (তিন খণ্ডে) প্রকাশিত হয়।

১৮৬৬ থেকে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদ অলংকৃত করেন। ব্রজসুন্দর মিত্রের তত্ত্বাবধানে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের সূচনাপর্বে তিনি পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা পরিভ্রমণ করেছিলেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে
পাবনা বিদ্রোহের সময় তাঁর জমিদারির আয় হ্রাস পায়। তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে “শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃসংস্থাপন” করার সুপারিশ করেছিলেন।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন স্বপ্ন-প্রয়াণ নামক রূপক-কাব্য।
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর স্ত্রী সর্বসুন্দরী দেবীর মৃত্যু হয়। এরপর তিনি আর বিবাহ করেন নি।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী ২৫ বৎসর তিনি
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেছে।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় অদ্বৈত মতের সমালোচনা
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় আর্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের ঘাত-প্রতিঘাত
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বাক্সের গঠন বিষয়ে বাক্সমিতি নামে একটি ইংরেজি পুস্তক রচনা করেন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনে তিনিই পৌরহিত্য করেছিলেন।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি [৪ মাঘ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ] মৃত্যবরণ করেন।

ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপির প্রচারে তাঁর শিষ্য শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তবে এই সময় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও স্বরলিপি প্রণয়নে গবেষণা করেছিলেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র রচিত 'ঐকতানিক স্বরলিপি' প্রকাশিত হওয়ার পর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেবেছিলেন প্রথম স্বরলিপি প্রণয়নের কৃতিত্ব তাঁর পাওয়া উচিৎ। এ বিষয়ে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে প্রায় স্বরলিপি-চোরের খাতায় নাম উঠিয়েছিলেন। তাঁর মতে

"বাংলায় প্রথম স্বরলিপি যে আমার রচিত, তাহা একেবারে নিঃসন্দেহ। শৌরীন্দ্র মোহন তাহার পরে তাড়াতাড়ি একটা স্বরলিপি প্রস্তুত করিয়া ছাপাইয়া দিল।"

-দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা (বিপিনবিহারী গুপ্ত সম্পাদিত বিবিধ প্রসঙ্গ। ১৩৭৩)।

সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন না যে,  শৌরীন্দ্রমোহনের প্রকাশিত স্বরলিপি ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র এবং তা ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তৈরি হয়েছিল।

এছাড়া তিনি হিতবাদী পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাঁর অপর ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতী নামে একটি নতুন পত্রিকা চালু করার প্রস্তাব দেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করলেও, পত্রিকাটি চালাতেন মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথই। তিনি ছিলেন বাংলা সংকেত লিপি বা শর্ট হ্যান্ড প্রবর্তনের এক অগ্রপথিক। তিনি কবিতার আকারে সংকেত লিপিও চালু করেন বাংলা গানে স্বরলিপির ব্যবহার প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ হিন্দু মেলা'র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। হিন্দু মেলা'র জন্য তিনি দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর রচিত ব্রহ্মসংগীত 'করো তাঁর নাম গান, যতদিন রহে দেহ প্রাণ' বহুবার ৭ পৌষের প্রার্থনায় গীত হয়েছে। ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ প্রার্থনাতেও তাঁর রচিত ব্রহ্মসংগীতগুলি বহুলভাবে গীত হতো।

জীবনের শেষ কুড়ি বছর দ্বিজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির সাহচর্যে জ্ঞানচর্চা ও লেখালিখির মাধ্যমে অতিবাহিত করেন।
শান্তিনকেতন-এর আশ্রমিকদের নিয়ে তিনি হাস্যোদ্দীপক চতুষ্পদী ছড়া রচনা করতেন। এই ছড়াগুলি প্রকাশিত হত শান্তিনিকেতন পত্রিকায়। তাঁর রসবোধ শান্তিনকেতনে সকলের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল।

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বড়োদাদা বলে ডাকতেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে মহাত্মা গান্ধী ও চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁরাও তাঁকে বড়োদাদা সম্বোধন করেন।

রচনাবলি:
বাংলা: ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩)
তত্ত্ববিদ্যা (১৮৬৬-৬৮)
সোনার কাঠি রূপার কাঠি (১৮৮৫)
সোনায় সোহাগা (১৮৮৫)
আর্যামি এবং সাহেবিয়ানা (১৮৯০)
সামাজিক রোগের কবিরাজি চিকিৎসা (১৮৯১)
অদ্বৈত মতের সমালোচনা (১৮৯৬)
ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধনা (১৯০০)
বঙ্গের রঙ্গভূমি (১৯০৭)
হারামণির অন্বেষণ (১৯০৮)
গীতাপাঠের ভূমিকা (১৯১৫)
প্রবন্ধমালা (১৯২০)।

ইংরেজি:
বক্সোমেট্রি (বাক্সমিতি) (১৯১৩)
অন্টোলজি (১৮৭১)
জ্যামিতি-সংক্রান্ত একটি বই।

দ্বিজেন্দ্রনাথের ৯টি সন্তানের ভিতর দুটি পুত্র সন্তান জন্মের পরপরই মৃত্যবরণ করে। অবশিষ্ট পাঁচ পুত্ররা ছিলেন
দ্বিপেন্দ্রনাথ, অরুণেন্দ্রনাথ, নীতীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও কৃপেন্দ্রনাথ। দুই কন্যার নাম সরোজা ও ঊষা।