ইন্দুবালা
সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেত্রী।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে অমৃতসর শহরে। তাঁর মা রাজাবালা কাজ করতেন সার্কাসে। রাজবালার সাথে মতিলালের প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। শেষপর্যন্ত মতিলাল তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু মতিলালের পরিবার এই বিবাহ মেনে নেয় নি। এক সময় মতিলালও যেন রাজবালার প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে রাজবালার এই সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। যতদূর জানা যায়, ইন্দুবালার জন্মের পরে তিনি আর সার্কাসে ফিরতে চান  নি।  এর পরে শুরু হয় রাজবালার জীবন সংগ্রাম। ফিরে আসেন কলকাতায়। সেই সময় তাঁকে আশ্রয় দেন জীবনকৃষ্ণ ঘোষ। মূলত কলকাতায় রাজবালার সঙ্গীতচর্চার শুরু হয়। তবে মতিলাল বসু তাঁর মেয়ে ইন্দুবালাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। কলকাতায় এলে তিনি তাঁকে বাড়িতে ডেকে পাঠাতেন।

রাজবালা ইন্দুকে প্রথম নার্স প্রশিক্ষণের জন্য পটলডাঙার একটি হাসপাতালে পাঠান। তবে ইন্দুবালার এই কাজ ভাল না লাগায় তিনি পালিয়ে বড়িতে চলে আসেন। শৈশবে মায়ের কাছে তিনি গান শিখেছিলেন। হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর, নতুন করে সঙ্গীতচর্চা শুরু করেন। মা ছাড়া তাঁর প্রথম সঙ্গীতগুরু ছিলেন গৌরীশঙ্কর মিশ্র। পরবর্তী সময়ে তিনি তালিম নিয়েছেন কালীপ্রসাদ মিশ্র, ইলাহি বক্স এবং সে কালের সেকালের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী গহরজান-এর কাছে। পরবর্তী সময়ে তিনি গিরীন চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, জামিরুদ্দিন খান এবং কাজী নজরুল ইসলাম-এর সান্নিধ্যে এসে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন।

বাঁধন সেনগুপ্তের 'ইন্দুবালা গ্রন্থে, ইন্দুবালার স্মৃতিচারণায় তাঁর শিল্পী হয়ে গড়ের উঠার কিছু চিত্র পাওয়া যায়। উল্লেখ্য বাঁধনসেন ইন্দুবালার অনুরোধেই তাঁর হয়েই এই আত্মজীবনী লিখেছেন। গ্রন্থের এক জায়গায় ইন্দুবালা বলছেন−
'দেখতে দেখতে আবার সেই জন্মাষ্ঠমীর দিন এলো।...গান চলছে। বাজনা চলছে।...ওস্তাদজী এসে আমায় চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেন, 'গাইবে?'...রাজী হয়ে গেলাম।...কিন্তু গাইব কী? চারপাশে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা কেউ হেঁজিপেজি নন। গহরজান, আগ্রাওয়ালি মালকা, নূরজাহান,...হুশনা, জানকীবাঈ, মৈজুদ্দিন...ভয়ে ভয়ে ইমন খেয়াল শুরু করলাম গান শেষ হতে শুধু যে বাহবাই পেলাম তা নয়, অনেকে মিলে আরও গাইতে অনুরোধ করলেন।...ঠুমরি শেষ করে ওঠার উদ্যোগ করছি, গহরজানের আদেশে থেকে যেতে হল। তিনি আরও গান শোনাবার ফরমায়েশ করলেন।...ভয়ে আনন্দে আরও দুখানা গান পরপর গাইলাম।'
১৯১৬ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় ইন্দুবালার প্রথম রেকর্ড। গান দু'টি ছিল 'আশা ফুরায়ে গেল' ও 'আর মুখে বলে কী হবে'। রেকর্ড নম্বর পি ৪৩০৬। ঘূর্ণ ৭৮ আরপিএম।  শুরুর দিকে গান গেয়ে তিনি কোনও অর্থ নিতেন না। তাছাড়া রেকর্ডে নামের পাশে লেখা থাকত অ্যামেচার। এই সময় তিনি বাংলা ও হিন্দি গান ছাড়াও তিনি উর্দু, ওড়িয়া, পঞ্জাবি গান গেয়েছেন প্রচুর।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে 'দি রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটারে' অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে।  এরপর থেকে গানের পাশাপাশি বিভিন্ন নাটকে ও সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। তিনি প্রথমে স্টার থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও মদনমোহন থিয়েটার এবং মিনার্ভা থিয়েটারেও কাজ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি হিন্দি ও পার্সি থিয়েটারেও অভিনয় করেন। সিনেমায় তাঁর প্রথম অভিনয় 'যমুনা পুলিনে' ছবিতে। এরপর তিনি মোট ৪৮টি ছবিতে অভিনয় করেন। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে ছিল 'নলদময়ন্তী', 'মীরাবাঈ', 'চাঁদসদাগর', 'বিল্বমঙ্গল' ইত্যাদি। এর মধ্যে বাংলা হিন্দি, উর্দু, পঞ্জাবি ও তামিল ভাষার ছবিও ছিল।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সেন্টার (পরবর্তী কালে যা অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে পরিচিত হয়) সম্প্রচার শুরু করে। এর দ্বিতীয় দিনেই ইন্দুবালা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য তিনি কলকাতা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ইন্দুবালা কুড়ি হাজার টাকায় একটি দোতলা বাড়ি ২১ নং যোগেন দত্ত লেনে। এর মাকে নিয়ে জীবনকৃষ্ণ বাবুর আশ্রিত ১৪ দয়াল মিত্র লেনের আশ্রয় ছেড়ে চলে আসেন। আমৃত্যু তিনি এই বাড়িতেই কাটান।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মহীশূর রাজ-দরবারের সভা-গায়িকা নির্বাচিত হন। সে সময় সফল গায়িকা হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে।

সম্মাননা:
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লী সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এইচএমভি তাঁকে 'গোল্ড ডিস্ক' দিয়ে সম্মানীত করে। এই বৎসরেই পান রবীন্দ্রসদন থেকে স্বীকৃতি।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে আকাশবাণীর (কলকাতা) পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রদত্ত সম্মান স্মারক প্রদান করে।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্দুবালার কণ্ঠে বাংলা গান

 


তথ্যসূত্র: