শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
(১৯০১-১৯৭৬)
বাংলা ভাষার কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮শে মার্চ মতান্বরে ২১শে মার্চ (সোমাবার, ৫ চৈত্র বা বৃহস্পতিবার ৮ চৈত্র ১৩০৭), বীরভূমের রূপসীপুরের জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ধরনীধর মুখোপাধ্যায়। মায়ের নাম হেমবরণী দেবী। তিন বৎসর বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বর্ধমানের মামা বাড়িতে বড় হয়ে ওঠেন। এরপর ধরনীধর পুনারায় বিবাহ করেন।
এই সময় তাঁর মাতামহী কাদম্বরী দেবীর কাছে প্রতিপালিত হন। উল্লেখ্য, তাঁর মাতামহ মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত কয়লা ব্যবসায়ী।

শৈলজানন্দের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বোলপুর হাই স্কুলে। তার পর তিনি ভর্তি হন উখরা এন্ট্রান্স স্কুলে। চোদ্দো বছর বয়সে তাঁর মাতামহ তাঁকে রানিগঞ্জ হাই স্কুলে নিয়ে যান। বছরখানেক সেখানে পড়াশোনার পর দেশের বাড়ি রূপসপুরে ফিরে আসেন। সেখানে নাকড়াকোঁদা হাই স্কুলে ভর্তি হন। পরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন রাণীগঞ্জ স্কুলে। অন্ডালে মাতামহের বাড়ির সখের ফুলের বাগানের পাশে একটি মাটির ঘর ছিল। তার নাম ছিল ‘মোহামেডান বোর্ডিং’। কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন সেই বোর্ডিং হাউসে। সেই সূত্রে নজরুলে সাথে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব  হয়েছিল। এই সময়ে তাঁর আরও দুজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। এঁরা হলেন- ছিনু ও শৈলেন ঘোষ।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ (১৩২২ বঙ্গাব্দে)  কবি কাজী নজরুল ইসলামের এবং নজরুল উভয়ই ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই সময় ইউরোপ জুড়ে চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মিত্রবাহিনীর পক্ষালম্বী ব্রিটিশরা যুদ্ধের জন্য তাদের উপনিবেশগুলো থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেছিল। এই সূত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। বঙ্গদেশ থেকে বাঙালি যুবকদের সৈন্য ব্রিটিশ সেনাবহিনীতে যোগদানের প্রজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল। নজরুল ইসলাম এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় গোপনে বাঙালি পল্টনে যোগাদানের জন্য নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় শৈলজানন্দ বাদ পড়েন। নজরুল ইসলাম এই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। এপর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার সময়ে শৈলজানন্দ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। সেই অবস্থাতে পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন।  
 
এরপর শৈলাজানন্দ ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পাশ করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কলেজের পড়া শেষ করেন নি। কলেজ ছেড়ে কিছুদিন তিনি শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শেখেন। এরপর  মাতামহের কয়লা কুঠিতে কিছুদিন কাজ করেন। কিছুদিন পর, 'বাঁশরী' পত্রিকায় 'আত্মঘাতীর ডায়রী' প্রকাশিত হলে, মাতামহ ক্ষু্দ্ধ হন এবং তাঁকে কয়লা কুঠি থেকে বিতারিত করেন।  এরপর নজরুল কলকাতায় মেসে থাকা শুরু করেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের শেষে (মাঘ ১৩২৬), নজরুল ইসলাম তাঁর বাহিনী থেকে যখন কলকাতায় আসেন, তখন কলকাতায় তিনি শৈলজানন্দের মেসে উঠেছিলেন। এই সময় তিনি  শৈলজানন্দের সাথে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে মুজফ্‌ফর আহমেদের সাথে দেখা করেন। কয়েক দিন বন্ধুর সাথে হইহুল্লোর করে সময় কাটিয়ে নিজ গ্রাম চুরুলিয়াতে যান। এবং সেখান থেকে আবার করাচি সেনানিবাসে ফিরে যান।  [সূত্র: 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে'/শৈলজানন্দ]

এরপরে বেঙ্গলি রেজিমেন্ট থেকে চূড়ান্ত বিদায় নিয়ে নজরুল করাচি থেকে সোজা চলে আসেন বন্ধু শৈলজানন্দের রামাকান্ত বোস স্ট্রিটের পলিটেকনিক বোর্ডিং-এ। এখানে এক চাকর নজরুলের এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করায় এবং নজরুলের অবস্থানে মেসের অন্যান্য বাসিন্দার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হওয়ায় তিনি নীরবে সে স্থান ত্যাগ করে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসে এসে ওঠেন।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে বার বৎসর বয়সী লীলাবতীকে বিবাহ করেন। এই সময় তাঁর বিবাহের বরযাত্রী হয়েছিলেন নজরুল ও শৈলেন ঘোষ। শৈলজানন্দের শ্বশুর করালীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বর্ধমানের ইকড়ার জমিদার। বিয়ের পরে শৈলজানন্দ শ্বশুরবাড়িতেই সংসার জীবন শুরু করেন। অবশ্য তাঁর বিমাতা অবশ্য নববধূকে নিয়ে রূপসপুরেই থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু শৈলজানন্দ যান নি। তিনি শ্বশুরের সাহায্যে কয়লার ডিপো খুলে জোড়জোনাকি কয়লাখনি অঞ্চলে যাতায়াত শুরু করেন। কয়লাখনিতে কুলিমজুর সরবরাহের কাজও তিনি করতেন। কুলিমজুরের খোঁজে তাঁকে সাঁওতাল পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হত। ফলে কয়লাখনির শোষিত শ্রমিক-মজুরদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
কয়লাখনির শ্রমিকদের জীবনযাপন অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন বিখ্যাত গল্প 'কয়লাকুঠি'। এই গল্পটি মাসিক বসুমতী পত্রিকার 'কার্তিক ১৩২৯'  (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত হয়। মূলত এই গল্পের মাধ্যমে গল্পকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি সস্ত্রীক কলকাতার ১১৫ আমহার্স্ট স্ট্রিটের শ্বশুরমশায়ের বাড়িতে চলে আসেন।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার হাজরা রোডে 'চার শিল্প গোষ্ঠী' নামক একটি সাহিত্য আড্ডার মাধ্যমে। এই আড্ডার চার সদস্য ছিলেন- গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসু। আনুষ্ঠানিকভাবে এই আড্ডার সূচনা হয়েছিল ৪ঠা জুন। এঁরা ১০/২ নম্বর পটুয়াটোলা লেনে তখন চলছিল 'কল্লোল' পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই সময় শৈলজানন্দ এক দিন 'প্রবাসী' পত্রিকায় একটি গল্প জমা দিতে বেরিয়েছেন। পথে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি শৈলজাননন্দকে নিয়ে গেলেন 'কল্লোল'-এর অফিসে যান। সেখানে গিয়ে গোকুল নাগ ও দীনেশ দাসের সঙ্গে আলাপ হয়। এঁরা 'কল্লোল'-এর প্রথম সংখ্যার জন্য শৈলজাকে একটি গল্প দিতে অনুরোধ করেন। শৈলজানন্দ তখন 'প্রবাসী'তে দেওয়ার জন্য আনা গল্পটা, তাঁদেরকে দেন। গল্পটির নাম ছিল 'মা'। পরে গল্পটি 'কল্লোল'- পত্রিকায় গানটি প্রকাশিত। এ সূত্রে পরে ধীর ধীরে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও মণীন্দ্রলাল বসুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে শৈলজানন্দের মাতামহ মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর আগে থেকেই তাঁর রক্ষিতা কৃষ্ণভামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের উপর ব্যাপক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধরণীধর চট্টোপাধ্যায়(শৈলজানন্দের মামা) কৃষ্ণভামিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রবল মদ্যপান শুরু করেন এবং ও এক বছরের মধ্যে লিভার নষ্ট হয়ে গিয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর ধরণীধরের একটি ডায়েরি থেকে শৈলজানন্দ কৃষ্ণভামিনীর অতীত জীবন ও অত্যাচারের কাহিনি সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে এই ডায়েরিতে লেখা অবলম্বন করে শৈলজানন্দ লেখেন তাঁর ‘আত্মঘাতীর ডায়েরী’ নামক একটি গল্প। গল্পটি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'বাঁশরী' পত্রিকায় গল্পটি ছাপা হয়। কৃষ্ণভামিনী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়িতে রাখা রিভলভার নিয়ে শৈলজাকে তাড়া করেন। এরপর প্রাণভয়ে শৈলজানন্দ সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কল্লোল পত্রিকার সহকারী সম্পাদক এবং পত্রিকা প্রকাশের মূল নীতিনির্ধারক গোকুলচন্দ্র মৃত্যুবরণ করেন। মূলত বাড়তি লোক রাখার সামর্থ না থাকায়- বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রণ কার্যের তদারক সবই গোকুলচন্দ্র একাই করতেন? গোকুল নাগের মৃত্যুর পর পত্রিকা সার্বিকভাবে সঙ্কটে পড়ে। সেই সাথে সদস্যদের ভিতরে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। এরই সূত্র ধরে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র ও মুরলীধর মিলে 'কালিকলম' নামে নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন।। এই পত্রিকায় শৈলজানন্দ ধারাবাহিকভাবে লেখেন 'মহাযুদ্ধের ইতিহাস' নামক উপন্যাস। এই পত্রিকা সম্পাদনার সময় এক বার অশ্লীল সাহিত্য রচনা ও প্রকাশের দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। শৈলজানন্দের 'দিদিমণি' ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'পোনাঘাট পেরিয়ে' গল্প দু’টির জন্য লেখকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগে শৈলজানন্দ, মুরলীধর ও শিশির নিয়োগীকে গ্রেফতার করা হয়। জামিন পেলেও জোড়াবাগান থানায় কেস চলেছিল বেশ কিছু দিন। পরে অবশ্য তিন জনকেই সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

শৈলজানন্দের কোনো সন্তানাদি না হওয়ায়, তিনি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে অল্পবয়সী একটি সুন্দরী মেয়েকে বিবাহ করেন। শৈলজানন্দের দ্বিতীয় স্ত্রী অবশ্য বেশি দিন বাঁচেননি। নিঃসন্তান হিসেবেই তাঁর মৃত্যু হয় রূপসপুরে। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি কবিতা, গল্প ও উপন্যাস রচনার জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেন। এই সময় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ তিনি প্রিয়নাথ এন গাঙ্গুলি পরিচালিত ' পাতাল পুরী' নামক চলচ্চিত্রের গল্প ও চিত্রনাট্যকার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আসেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে শৈলজানন্দের পরিচালিত ' নন্দিনী' নামক চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এটিই ছিল তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র।

জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি বেশ আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন। মূলত নানা জনের নানা অভাবে সঙ্কটে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সে কারণে সঞ্চয়ের নেশাও তাঁর ততটা তাঁর ছিল না। প্রতিবেশীর মাতৃহারা কন্যা নন্দিনীকে নিজের পালিতা কন্যা হিসেবে মানুষ করেছিলেন। শৈলজা ও লীলাবতীকে নিজের বাবা ও মা বলেই জানত নন্দিনী।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি, কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
 



সূত্র: