রানিগঞ্জ
ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক : ২৩°৬২' উত্তর ৮৭°১৩'পূর্ব।

ভারত প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম-বর্ধমান জেলা জেলার আসনসোল মহকুমার অন্তর্গত একটি ব্লক এবং থানা শহর। ব্লকের সদর সিয়ারশোল রাজবাড়ি। রানিগঞ্জ অজয় দামোদর নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত
রানিগঞ্জ ব্লক: এই ব্লকের গ্রামীণ এলাকা ছয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত। এগুলি হল আমড়াসোতা, এগারা, রতিবাটী, বল্লভপুর, জেমারি ও তিরাট। এই ব্লকের শহরাঞ্চল বাঁশড়া, চেলোদ, রতিবাটী, চাপুই, জেমারি (জে. কে. নগর টাউনশিপ), আমকুলা, মুরগাথুল, রঘুনাথচক, বল্লভপুর ও বেলেবাথান সেন্সাস টাউন দশটি নিয়ে গঠিত। ব্লকটি রাণীগঞ্জ থানার অধীনস্থ।  ব্লকের সদর সিয়ারশোল রাজবাড়ি।
রানিগঞ্জের নামের সঙ্গে আশপাশের কোন স্থানের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।  রানিগঞ্জ নামের উল্লেখ অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাওয়া যায়। সে সময়ে নিকটবর্তী মঙ্গলপুর ও রণাই নামক দুটি জনপদের নাম পাওয়া যায়। রানিগঞ্জের নামকরণ সম্বন্ধে কয়েকটি ভিন্ন অভিমত থাকলেও বর্ধমানের কোন রানীর সম্পর্ক সূত্রেই যে এই নামের প্রচলন হয় এ কথা সর্বজনবিদিত। তবে রানিগঞ্জের নামের সাথে কোন রানি জড়িত ছিলেন তা জানা যায় না। রানিগঞ্জ শহর এবং জনপদ সৃষ্টি হয়েছে কয়লাখনি স্থাপনের অনেক পরে। এই সময় রানিগঞ্জ ছিল মঙ্গলপুর থানা ও ডাকঘরের অধীনে।

রানিগঞ্জ মূলত কয়লা খনির জন্য বিখ্যাত। এই কয়লাখনি গড়ে ওঠার পূর্বে ওই অঞ্চল ছিল অরণ্যভূমি ও কৃষিক্ষেত্র। ১৮১৫ রুপার্ট জোনস্‌ এই স্থানে কয়লা উত্তোলনের জন্য এগারা গ্রাম পঞ্চায়েতে খনন কাজ শুরু করেন। এটাই ছিল ভারতবর্ষে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রথম কয়লাখনি। রুপার্ট জোনস্‌কে রুপার্ট জোনসকে ভারতের কয়লাখনি খননের জনক বলা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হতে পারেন নি। তাই ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানির কাছে খনিগুলি বিক্রয় করে।

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে থেকে দামোদর নদের জলপথে স্টিমার চলাচল শুরু হওয়ার ফলে রাণিগঞ্জের কয়লাশিল্পে বাণিজ্যিক উন্নতি ঘটে। এই বছরেই রানিগঞ্জে দ্বারকানাথ ঠাকুর আসেন। তিনি তাঁর বন্ধু উইলিয়াম কারের সঙ্গে যৌথভাবে গঠন করেন কার-টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। উল্লেখ্য এই কোম্পানি নীলচাষের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

তকিছুর পরেও কয়লা খনি প্রতিষ্ঠার পরই বৃহত্তর রানিগঞ্জের স্থানীয় পরিবেশের খুব একটি হেরফের ঘটে নি। বিষয়টি জানা যায় ফরাসি পর্যটক তথা ভূতত্ত্ববিদ ভিক্টর জাকমোঁর বিবরণ থেকে। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬মে তিনি কলকাতা থেকে মঙ্গলপুরে পৌঁছান। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী জানা যায়, সেই সময়ের রানিগঞ্জ অঞ্চলটি ছিল দূর্ভেদ্য জঙ্গলে ভরা। এই সময় রানিগঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো ছিল সিহারসোল রাজপরিবারের অধীনস্থ ।

১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কার-টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানির কয়লা খনিগুলি সত্তর হাজার টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে। এর মধ্য দিয়ে রানিগঞ্জে কয়লা বাণিজ্যে কার-টেগোর কোম্পানির যুগ শুরু হয়ে। এদের মাধ্যমে রানিগঞ্জে কয়লাখনির দ্রুত সম্প্রসার ঘটে। এই সমব রানিগঞ্জে ভিন্ন ভিন্ন মালিকানায় আরও কিছু কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সিয়ারসোল কয়লাখনি। এই কোম্পানিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে।

বিভিন্ন কয়লাখনিভিত্তিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সূত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে। এই সূত্রে কোম্পানিগুলোর ভিতরে বাণিজ্যক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা নিরসনের জন্য ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুরের  তত্ত্বাবধানে একটি যৌথভাবে কোম্পানি গঠন করা হয়। কোম্পানির নাম রাখা হয় বেঙ্গল কোল কোম্পানি। ওই কোম্পানির কেন্দ্রীয় কার্যালয় করা হয় এগারায় কার-টেগোর কোম্পানির নীল কারখানার কার্যালয়ের ভবনে। এটি ছিল ভারতের কয়লাশিল্পে প্রথম প্রশাসনিক কার্যালয়। কোম্পানি পরিচালনার জন্য সেই সময় দ্বারকানাথ ঠাকুর থাকতেন নারানকুড়ির বাংলোতে। এই কোম্পানি রানিগঞ্জের নারানকুড়ি ও দামালিয়া ঘাট থেকে দামোদর নদের জলপথ কয়লা নিয়ে যাওয়া হত কলকাতায় তবে দামোদর নদের নাব্যতার হেরফেরের কারণে সারা বছর সমানভাবে কয়লা পরিবহন সম্ভব হতো না।

রানিগঞ্জে রেলস্টেশন


১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। সম্ভবত রানিগঞ্জে রেলস্টেশন স্থাপনে সিয়ারসোল রাজার প্রভাব ছিল। এই রেলস্টেশন স্থাপনের পর রেলপথে কয়লা সরবরাহের জন্য রানিগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। এই কারণে মঙ্গলপুর থেকে থান ও ডাকঘর সরিয়ে রানিগঞ্জে আনা হয়। রানিগঞ্জের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করে, সিয়ারসোল রাজার উদ্যোগে আসনসোল থেকে  রানিগঞ্জ পর্যন্ত শাহি সড়কের সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি জিটি রোড নামে পরিচিত।

জঙ্গল পরিবেষ্টিত এবং প্রায় দুর্গম জনবসতি হিসেবে বিবেচিত রানিগঞ্জ জন-সমৃদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়। প্রাক্তন মঙ্গলপুর থানা থেকে জীবিকার সন্ধানে রানিগঞ্জে চলে আসে। স্থানীয় মানুষের শিক্ষার জন্য সিয়ারসোল রাজা, ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্কুলটির নামককরণ করা হয়
Searsol Raj.H.E School। এখানে H.E-এর E বর্ণটি কোন শব্দের সংক্ষেপ তা জানা যায় নি। স্কুলটি বর্তমান নাম সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুল। পরবর্তী সময়ে সাধারণ এই স্কুলটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে কাজী নজরুল ইসলামের জন্য। নজরুল তাঁর ১৭ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শুরুতে, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল সিয়ারসোল রাজ এইচ.ই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এই স্কুলের পাঠ শেষ না করেই তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাঙ্গালী পল্টনে যোগ দিয়েছিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সম্প্রসারণের কারণে রেলের বিভিন্ন কার্যালয় এবং কর্মচারীদের আবাসন নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জমির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সময় সিয়ারসোলের রাজা জমি প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়া। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় রানিগঞ্জ থেকে আসানসোলে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে রানিগঞ্জের গুরুত্ব কমে যায়। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে রানিগঞ্জ সরকারি ভাবে শহর হিসেবে স্বীকৃতি পায় । ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে রানিগঞ্জে পৌরসভা গঠন করা হয়। তবে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পৌরসভার কার্যক্রম শুরু হয়। এই পৌর সভার প্রথম ভারতীয় হিসেবে পৌরপ্রধান হন জগন্নাথ ঝুনঝুনওয়ালা। পরবর্তী সময়ে কাঁকসা, রানিগঞ্জ ও নিয়ামতপুর এই তিনটি থানাকে যুক্ত করে রানিগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হয়েছিল। এর ভিতরে নিয়ামতপুর থানা ছিল আসনসোল মহকুমার অধীনে। এই মহকুমা প্রতিষ্ঠার সময় সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে
রানিগঞ্জে কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল ইট ও টালির নির্মাণের কারখানা বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে রানিগঞ্জে খনিবিষয়ক বিদ্যালয় 'ইভনিং মাইনিং স্কুল' স্থাপিত হয়

ইতিপূর্বে
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় রানিগঞ্জ থেকে আসানসোলে স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে রানিগঞ্জের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। ক্রমে ক্রমে রানিগঞ্জ অপেক্ষা আসানসোল গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাই ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে রানিগঞ্জ মহকুমার মর্যাদা হারায় এবং আসানসোলকে মহকুমা শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।


সূত্র : :::
http://www.wbgov.com/
http://www.mapsofindia.com/