মনোমোহন থিয়েটার
খ্রিষ্টীয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত একটি নাট্যমঞ্চ।

এই থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মনোমোহন পাঁড়ে। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধে তৎকালীন এমারেল্ড থিয়েটার বাড়িতে, কোহিনূর নামক অপর একটি থিয়েটার দল তাদের কার্যক্রম সচল রেখেছিল। মনোমোহন পাঁড়ে  লক্ষাধিক টাকায় এই থিয়েটারটি কিনে সেখানে মনোমোহন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এটি কোহিনূর নামেই চালু হয়েছিল। পরে মিনার্ভা মঞ্চের লোকজন নিয়ে গিয়ে মিনার্ভার নামে অভিনয় শুরু করেন।

এই থিয়েটারের নাম মনোমোহনের দেওয়া হয়েছিল ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর (বুধবার ১৫ ভাদ্র ১৩২২)। এই দিন অভিনীত হয়েছিল ভীষ্ম, ধ্রুবচরিত্র-বড়ো নাটক এবং জন্মাষ্টমী, নন্দবিদায়, চতুরালী প্রভৃতি ছোট গীতিনাট্য। সেই সময় থেকে চুনীলালদেব, তিনকড়ি এখানে যোগ দেন। এই সময়  দানীবাবু ২৫০ টাকা বেতনে ম্যানেজার ছিলেন।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার ২৪ ভাদ্র ১৩২২) মঞ্চটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এই দিন মঞ্চস্থ হয়েছিল গিরিশ ঘোষের 'কালাপাহাড়' এবং সুরেশচন্দ্র রায়ের'রূপোর ফাঁদ' নাটক দিয়ে। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন তারাসুন্দরী, দানীবাবু, প্রিয়নাথ ঘোষ প্রমুখ। ১৯১৭ পর্যন্ত খুবই সাফল্যের
সঙ্গে এই থিয়েটার চলেছিল। এরপর থেকে এই থিয়েটারের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এই অবস্থার ভিতরে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই থিয়েটার চালিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই সময়ের ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাটক ছিল

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ। 'দেবলা দেবী'। নাট্যাকার নিশিকান্তরায়। খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ। 'পারদর্শী'। নাট্যকার পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ। 'হিন্দুবীর'। নাট্যকার সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই তিনটি নাটক ছাড়া 'পানিপথ', 'বিষবৃক্ষ' নাটক অল্প-বিস্তার সমাদর পেয়েছিল।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে মনোমোহন থিয়েটার তার অভিনয় চালিয়ে যায়। এরপর থেকে এর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় পড়ে যায়। এই সময়

মনোমোহন পাঁড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এই অবস্থায় শিশিরকুমার ভাদুরী মনোমোহন থিয়েটার লিজ নিয়ে 'নাট্যমন্দির' প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্য দিয়ে মনোমোহন থিয়েটারের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ৬ আগষ্ট নাট্যমন্দিরে মঞ্চায়িত যোগেশ চৌধুরীর সীতা নাটকেএই অবস্থায় শিশিরকুমার ভাদুরী অভিনয়ে অভিভূত হয়ে রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁকে থিয়েটারের নবযুগের প্রবর্তক বলে ঘোষণা করেন।

এই থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাস থেকে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছিল প্রবোধচন্দ্র গুহের মাধ্যমে। প্রবোধচন্দ্র গুহ এককভাবে মনোমোহন থিয়েটারের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে একাধিক সফল নাটক মঞ্চস্থ করেন। এই সময়ে এই থিয়েটারে নাট্যকার হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন নিশিকান্তবসু রায়, শচীনসেনগুপ্ত, মন্মথ রায়ের মতো গুণী নাট্যকারবৃন্দ।

মনোমোহন থিয়েটারে দ্বিতীয় পর্বের উদ্বোধন হয়েছিল ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২রা জুন (রবিবার, ১৯ জ্যৈষ্ঠ্য ১৩৩৬)। উদ্বোধনের পর মঞ্চস্থ হয়েছিল শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নাটক-রক্তকমল। এই নাটকের মোট নয়টি গানের সবগুলোই ছিল- কাজী নজরুল ইসলামের রচিত। এই নাটকে পূরবী চরিত্রে ইন্দুবালার গাওয়া গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী (দাদামশায়), বিশ্বনাথ ভাদুড়ি (পতিতপ্রসন্ন), সরযূবালা (মমতা) অভিনয় প্রমুখ।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর (মঙ্গলবার ১০ পৌষ ১৩৩৬), মনোমোহন থিয়েটারে মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত 'জাহাঙ্গীর' নামক একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ওই নাটকে বাদীগণের গান হিসেবে নজরুলের রচিত একটি নতুন গান পরিবেশিত হয়েছিল। বাদীরা গানটি পর্যায়ক্রমে ভেঙে ভেঙে পরিবেশন করেছিল। এই গানটি হলো- রঙ-মহলের রঙ-মশাল মোরা [তথ্য]।  এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন দানীবাবু (জাহাঙ্গীর), নির্মলেন্দু (সাজাহান), শশিমুখী নূরজাহান), দুর্গাদাস যশোবস্ত সিংহ)।  অল্পবয়সী আওরঙ্গজেব এবং হসিয়ার চরিত্রে আঙ্গুরবালা ও ইন্দুবালা।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বরে (মঙ্গলবার, ১৬ পৌষ ১৩৩৬), মঞ্চস্থ হয়েছিল মন্মথ রায়ের রচিত মহুয়া নাটক। এই নাটকের ১৪টি গান ছিল কাজী নজরুল ইসলামের রচিত।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মে (শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৭), রবীন্দ্রনাথের 'মুক্তির উপায়' গল্প অবলম্বনে রচিত নাটক অভিনীত হয়েছিল।


সূত্র: