সংস্কৃতির সকল উপাদানের সমন্বয়ে যে সামগ্রিক রূপ প্রকাশ পায়,
তাই সভ্যতা। এর ভিতরে রয়েছে সংস্কৃতির চর্চা এবং এর বস্তুবাচক ব্যবহারিক উপকারণসমূহ।
মানুষের সাথে মানুষের সাথে আচরণ, শিল্পের চর্চা, ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি সংস্কৃতির
চর্চা। মানুষের জীবন-যাপনে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চর্চার জন্য, প্রয়োজন কিছু
বস্তুবাচক পরিকাঠামো। যেমন ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। একটি সুনুর্দিষ্ট সময়ের
নিরিখে একটি সুনির্দিষ্ট সমাজের সাংস্কৃতিক চর্চা এবং এর সাথে সম্পর্কিত বস্তবাচক
পরিকাঠামোর সামগ্রিক রূপ হলো সভ্যতা।
ধরা যাক একটি গানের স্কুল। যেখানে গান শেখানো বা শেখাটা হচ্ছে সংস্কৃতির অংশ। কারণ,
এর ভিতরে রয়েছে মানবিক আচরণগত বিষয়। কিন্তু স্কুলটা সংস্কৃতি নয়। এই একটি বস্তুবাচক
গৃহকাঠামো মাত্র। কিন্তু সভ্যতার বিচারে স্কুল ঘরটি সভ্যতার অংশ। গানের চর্চা আছে
বলেই স্কুল তৈরি হয়েছে, আবার স্কুল তৈরিই হয়েছে গানের জন্য। প্রসঙ্গক্রমে ধরা যাক,
পাথর যুগের আদিম দশার কথা। যখন হোমো গণের কোনো প্রজাতিই আগুন জ্বালানো শেখেনি। এরা
কাঁচা মাংস খেতো। এটা ছিল সেই যুগের মানুষের খাদ্য-সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মানুষ
পাথরের কুঠার তৈরি করতে পারতো। অর্থাৎ শিকার করার কার্যক্রমও ওই যুগের মানুষের
সংস্কৃতির অংশ ছিল। কিন্তু ওই কুঠারটি কি সংস্কৃতি? বস্তুবাচক যে কোনো উপকরণ
সংস্কৃতির উপকরণ হতে পারে। কিন্তু বস্তুটিকে সংস্কৃতি বলা যাবে না। এই অবস্থায়
শিকার এবং শিকারের উপকরণ উভয় মিলে তৈরি হবে সভ্যতা।
মানুষের আচরণগত বিষয়ের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক, তাই যেখানেই একটি সমাজের মানুষ যাক
না কেন, সে তার সংস্কৃতিকে বহন করে নিয়ে যায়। কিন্তু স্থানান্তরের কারণে সভ্যতার
অনেক কিছু ফেলে আসতে হয়। এই কারণে যাযাবর শ্রেণির জনগোষ্ঠী কোনো সভ্যতা গড়ে তুলতে
পারে না। কারণ, এদের সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক কোনো বস্তুবাচক স্থায়ী উপকরণ সৃষ্টি হয় না।
এই বিচারে বলা যায়, সভ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অবশ্যই কোনো সংস্কৃতির
স্থায়ী বস্তুবাচক দশায় উপস্থাপিত হতে হবে। সভ্যতার পরিচয় তুলে ধরার জন্য স্থাপত্য
পরিচয় বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আমরা প্রস্তরযুগের সংস্কৃতি অনুমান করি, প্রস্তর
সভ্যতার বস্তুবাচক উপকরণ থেকে। সিন্ধু সভ্যতার নৃত্যশীলা নারীর মূর্তি দেখে অনুমান
করি, এই সভ্যতার সংস্কৃতিতে নাচের চর্চা ছিল, মূর্তি বানানোর সংস্কৃতিও ছিল। এই
সময়ের রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি ইত্যাদি দেখে মানবিক আচরণের যে ধারণা পাই, তা ও সময়ের
মানুষের সংস্কৃতির আভাষ মাত্র। আর এই আভাষ পাচ্ছি, বস্তুবাচক উপকরণ দেখে। এখানকার
ঘরবাড়ি, মূর্তি, রাস্তাঘাট সংস্কৃতি নয়। এ সবই সভ্যতার অংশ। কারণ সভ্যতা মানুষের
আচরণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত সকল বস্তুবাচক উপকরণের সামগ্রিক রূপ।
যেহেতু মানুষের সভ্যতা নির্ভর করে, মানুষের অবস্তুবাচক মানবিক আচরণ এবং আচরণের সাথে
সম্পর্কিত বস্তুবাচক উপকরণের সামগ্রিক রূপ রেখায়, তাই সভ্যতার বিবর্তন চোখে পড়ে।
সভ্যতার অন্যতম অংশ সংস্কৃতি, কিন্তু অবস্তুবাচক। তাই সরাসরি প্রাচীন সংস্কৃতিকে
দেখা যায় না। প্রাভীন সভ্যতার বস্তুবাচক উপকরণের মধ্য দিয়ে প্রাচীন সংস্কৃতিকে
উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু তা অনেক সময়ই হয়ে উঠে অনুমান নির্ভর। ধরা যাক, ৩০ হাজার
খ্রিষ্টপূর্বাব্দে একটি নারীর ভাস্কর্য পাওয়া গেল। ধরে নেওয়া যেতে পারে মূর্তিটি,
দেবীর, হতে পারে মূর্তিটি নিতান্তাই শিল্পকর্মের আনন্দের জন্য করেছেন। হতে পারে
রাজার আদেশ সম্রাজ্ঞীর জন্য মূর্তিটি। এই ভাবনার ভিতর দিয়ে সংস্কৃতির রূপ পাল্টাবে।
যখন দেবী মূর্তির কথা ভাবা হবে, তখন দেবী-পূজার সংস্কৃতির কথা উঠে আসবে। যখন
নিতান্তই শিল্পকর্ম হিসেবে মূর্তিটিকে ভাবা হবে, তখন শিল্পচর্চার-সংস্কৃতির কথা
ভাবতে হবে। আর যখন রাজার আদেশ সৃষ্ট সম্রাজ্ঞীর মূর্ত ভাবা হবে, তখন রাজতন্ত্রে
সংস্কৃতির কথা উঠে আসবে। আর সামগ্রিক রূপরেখা হবে, ৩০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে
মানুষ মূর্তি তৈরি করার কৌশল জানতো। এই ধারণার সাথে আবিষ্কৃত মূর্তির নমুনা যুক্ত
করে বলা হবে ৩০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সভ্যতা।
মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারা
এক সময় মানুষ বলতে বুঝাতো হোমো স্যাপিয়েন্সদের। কারণ তখন ধারণা ছিল, একমাত্র
এরাই আগুন জ্বালানো শিখেছিল, পাথুরে অস্ত্র তৈরি করতে পারতো, কিম্বা শিল্প কর্ম করতে
পারতো। কিন্তু দেখা গেল এই জাতীয় কর্মকাণ্ড হোমো স্যাপিয়েন্সদের আবির্ভাবের বহু আগে
থেকেই হোমো গণের কতিপয় প্রজাতি করতে পারতো। যে বুদ্ধিমত্তার বিচারে হোমো গণের বিশেষ
প্রজাতিকে হোমো স্যাপিয়েন্স বলা হয়েছে। সে বিচারে হোমো গণের অনেক প্রজাতিকেই হাজির
করা যায়।
হোমো গণের সকল প্রজাতিগুলোকে যদি মানবগোষ্ঠী হিসেব বিবেচনা করি, তাহলে- প্রাথমিকভাবে
মানবসভ্যতাকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ভাগ দুটি হলো-
সূত্র