সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন
বৈদিক থেকে গান (খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-৬০০ অব্দ) থেকে খ্রিষ্ট বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক সময়ের ভিতরেভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যে ক্রমবিবর্তনের রূপ রেখা তৈরি হয়েছিল, তা কার্যত দুটি পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। এই পদ্ধতি দুটি হলো- উত্তর ভারতী সঙ্গীত পদ্ধতি এবং দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতি।

উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সনাতন ধারার সাথে মুসলমান সঙ্গীত সাধকদের দ্বারা চর্চিত সঙ্গীতের ধারার মিশ্রণে একটি মিশ্র ধারার উদ্ভব হয়েছিল। বিশেষ করে- হযরত আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ) অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভার সংস্পর্শে এসে উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই মিশ্র ধারাকে সমৃদ্ধধারার পথকে সুপ্রশস্ত করে দিয়েছিল। তিনি আরব-পারশ্যের সঙ্গীতের ধারাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সংযোজনের পাশাপাশি সনাতন রাগগুলোরও পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। হযরত আমির খসরুর পরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে মিশ্র ধারা এবং সনাতন ধারা উভয় প্রচলিত ছিল। উভয় ধারাকে সমৃদ্ধতর করেছিলেন মিঞা াসতানসেন (১৫০৬-১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দ)। এরই ভিতরে ধীরে ধীরে প্রাচীন প্রবন্ধ গান থেকে বিকশিত হয়েছিল ধ্রুপদ ও খেয়াল। এই ধারা দুটি থেকে পরবর্তী সময়ে উদ্ভব হয়েছিল- টপ্পা, ঠুমরি, সাদ্রা ইত্যদি নানা ধরনের আধা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।  ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত এই সকল ধারার নানা পরিবর্তন ঘটেছিল। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরুদের মধ্য রাগ-নিরূপণ এবং উপস্থাপনে অল্প-বিস্তর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছিল। সঙ্গীতগুরুরাও এই দশা থেকে উত্তোরণের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এই সমসস্যা থেকে উত্তোরণের কোনো সুষ্ঠু উপায় তাঁদের হাতে ছিল না। কার্যত এই দশা থেকে উত্তোরণের জন্য প্রথম ফলপ্রসু উদ্যোগ গ্রহণ করেন বিষ্ণু নারয়ণ ভাতখণ্ডে (১৮৬০-১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনের মাধ্যমে উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নব্যধারার সূচনা করেছিলেন।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিশেষ দক্ষত অর্জনের পর, ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে 'জ্ঞান উত্তেজক মণ্ডল' নামক সঙ্গীত-মণ্ডলে যোগদান করেন। উল্লেখ্য এই মণ্ডলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধনাঢ্য পারশিক বণিকরা। এই মণ্ডলের সাথে উল্লেখযোগ্য যাঁরা ছিলেন- তাঁরা হলেন ওস্তাদ তনরস খান, ওস্তাদ ইনায়েৎ হুসেন খান, ওস্তাদ মোহাম্মদ রহমত খান, ওস্তাদ নিশার হুসেন খান, ওস্তাদ নাথান খান, ওস্তাদ আমান আলী খান, ওস্তাদ বন্দে আলী খান, ওস্তাদ আলি হুসেন খান রাওজি বুওবা বেলবায়ুগকার প্রমুখ।

লক্ষণীয় বিষয়ে এই মণ্ডলের অধিকাংশই ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত মুসলমান সঙ্গীতগুরুরা। এঁদের অধিকাংশই গান শিখেছিলেন পারিবারিক পরিমণ্ডলে এবং ঘরানাভিত্তিক গুরুপরম্পরা অনুসরণে রাগ পরিবেশন করতেন। এঁরা গান শিখতেন মুখে মুখে এবং গুরুদের কঠোর অনুশাসনে শেখার ফলে, এঁদের গান ঘরানাভিত্তিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল।

প্রথম দিকে ভাতখণ্ডেজিও এই ধারার বাইরে ছিলেন না। তবে তিনি ঘরানাভেদে রাগের নানা রূপকে একটি আদর্শিক রূপ খুঁজে পাওয়ার জন্য, সেই সাথে রাগের বর্গীকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। এই ভাবনা থেকে তিনি ওস্তাদ নাজির খানের নানা ধরনের খেয়াল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষণার তালিকায় ছিলেন সারেঙ্গী বাদিকা অঞ্জনীবাই মালপেকার এবং অচহন বাই। এছাড়া তিনি জয়পুরের ওস্তাদ মোহাম্মদ আলী খানের পুত্র আশাক আলী খানের গাওয়া খেয়াল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।

এই সময় তিনি সর্বভারতীয় সঙ্গীতের রূপরেখা অনুতধাবনের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারণা লাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সেই সূত্রে তিনি ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সঙ্গীত সফরে বের হন। তাঁর এই সঙ্গীত-সফরে প্রথম বেছে নিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় মাদ্রাস তথা চেন্নাই, তাঞ্জোর, মাদুরা এতায়পুরম, বাঙ্গালোর এবং মহিসুর। এই সময় তিনি এই সকল অঞ্চলের বিভিন্ন সঙ্গীত গুরুদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শ্রী সুব্রারাম দিক্ষিতার এবং ভেঙ্কটামাখিন। এছাড়া তিনি এই অঞ্চলের গ্রন্থাগার সমূহের গ্রন্থাদি পাঠ করেন। এই সফরে তিনি
দক্ষিণ ভারতের পণ্ডিত ব্যঙ্কটমুখীর ৭২টি মেল দেখে, উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে ঠাট-এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

১১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব ভারতের সঙ্গীত সফর শুরু করেন। এই পর্যায়ে তিনি নাগপুর ও কলকাতা ভ্রমণ করেন। তিনি ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সঙ্গীতজ্ঞ রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। কথিত আছে তিনি বাংলায় লিখিত কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'গীতসূত্রসার' পাঠ করার জন্য বাংলা ভাষা শিখেছিলেন।
সে সময় তিনি বাংলা লোকগান এবং বিষ্ণুপরী ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিষয়ে অবগত হন। উত্তর ও পূর্ব ভারতের এই অভিযান শেষে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির নাম স্বরমালিকা।

কলকাতা ভ্রমণ শেষে তিনি জগন্নাথপুরীর তীর্থযাত্রীদের সাথে বিজয়নগর যান। সেখানে তিনি মহারাজার রাজকীয় গ্রন্থাগার পরিদর্শন করেন। এই পর্‌যায়ের ভ্রমণের শেষে তিনি হায়দ্রাবাদ ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি কাশীনাথ আপ্পেরতুলশির সাথে পরিচিত হন। এছাড়া তিনি সাক্ষাৎ করেন ওস্তাদ গুলাম ঘোর খানম ওস্তাদ আব্দুল করিম খান, ওস্তাদ আলী বক্স এবং মুহাম্মদ সিদ্দিকী'র সাথে।

১৯০৮-১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে শেষ সঙ্গীত-সফরে বের হন। এই সময় তিনি জবলপুর, এলাহাবাদ, বেনারস, আগ্রা, দিল্লী, মথুরা, জয়পুর, বিকানের এবং উদয়পুর ভ্রমণ করেন। এলাহাবাদে তিনি পীতমলাল গোসাইয়ের কিছু উল্লেখযোগ্য শিষ্য, মথুরার গণেশী লাল, দিল্লীর পান্নালাল গোস্বামী প্রমুখের সাথে দেখা করেন। এই সময় তিনি বহু শিল্পীদের গান শোনেন। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- ধ্রুপদীয়া ওস্তাদ জাকিরউদ্দীন খান এবং তাঁর ভাই উদয়পুরের আল্লাবন্দে খান।

এই অভিযানকালে তিনি প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থাদি সংগ্রহ ও পাঠ করেন। একই সাথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কলাকারদের কাছে রক্ষিত বন্দেশ ও সুর সংগ্রহ করেন। এই সকল সুরকে ধরে রাখার জন্য তিনি একটি স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতি বর্তমানে হিন্দুস্থানী স্বরলিপি নামে পরিচিত। তিনি তাঁর সংগৃহীতে গানের সুর এই স্বরলিপিতে রচনা করেছিলেন। তিনি মারাঠী, সংস্কৃতি এবং হিন্দি ভাষায় সঙ্গীত বিষায়ক মূল্যবান গ্রন্থাদি প্রণয়ন করেন।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওস্তাদ মৌলা বক্স গিয়াস খানের আমন্ত্রণে বরোদা যান। সেখানে ভাতেখণ্ডে বরোদার মহারাজা গায়কোয়ার-এর অতিথি হিসেবে রাজবাড়িতে থাকেন। এই তিনজন একটি সঙ্গীত সম্মেলেনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এই সূত্রে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন, প্রথম ১৯১৬
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০-২৫ মারচ, বরোদা কলেজের কেন্দ্রীয় মিলানায়তনে প্রথম সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলেন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে দক্ষিণ ভারত-সহ বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। দিনের বেলা এই মিলনায়তনে এছাড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিবিধ বিষয়ের নিয়ে সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। অন্যদিকে বরোদার লক্ষ্মী ভিলা রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষে, ভারতের নানা প্রদেশের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে রাগের ব্যবহারিক বিষয় উপস্থাপন করেন। এই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন রাজা নওয়াব আলী খান। এই সভায় সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনের একটি কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে। এই সম্মেলনে উল্লেকযোগ্য অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন- ই. ক্লিমেন্টস, কে.বি. দেবল, সুব্রামা পণ্ডিতার, ওস্তাদ জাকিরুদ্দীন খান, জমিদার হিরজিভাই, ওস্তাদ ফৈয়াজ হুসেন খান, আতা হুসেন খান, নাসির হুসেন খান, ভাস্কর বুয়া গোখলে, ওস্তাদ আবদুল্লাহ খান, আলতাফ হুসেন খান, জি, ভিলাবতিকার।

এই সম্মেলনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে নানাবিধ তর্ক-বিতর্কের জন্ম নিলেও কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নি।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে গোয়ালিয়রের মহারাজা মাধব রাও সিন্দিয়া পণ্ডিত ভাতেখণ্ডে-কে, তাঁর প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। এই সূত্রে তিনি গোআয়লিয়রে গেলে, মহারাজা গোয়ালিয়র সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের জন্য সঙ্গীতজ্ঞ নির্বাচনের বিষয় উত্থাপন করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, রাজা ভাইয়া পুচওয়ালে, কৃষ্ণরাও দাতেয়, ভাস্কর রাও খণ্ডেপেরকার, ভাষ্কর বুয়া, বিষ্ণুনারায়ণ পটবর্ধন প্রমুখ। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে মাধব সঙ্গীত বিদ্যালয়ের উদ্বোধন হয়।

সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন, দ্বিতীয় ১৯১৮
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্থে ভাতখণ্ডের সাথে রামপুরের নওয়াব হামিদ আলি খানের সাক্ষাৎ হয়। নবাবের উৎসাহে  দিল্লীর  কংগ্রেস প্যাণ্ডেলে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর (শনিবার) দ্বিতীয় সঙ্গীত সম্মেলন শুরু হয়। শেষ হয়েছিল ১৭ই ডিসেম্বর।

উল্লেখ্য, সে সময় রামপুর ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। রামপুরের এই নবাব পরিবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মূলত এই পরিবার তানসেনের উত্তরপুরুষদের সঙ্গীতচর্চাকে নানাভাবে উৎসাহিত এবং লালন করতে। এই পরিবারের দরবারে এই ঘরানার বেশ কয়েকজন সঙ্গীত শিল্পী প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ ওয়াজির আলী খান। তিনি ছিলেন বীণাবাদক, সেতারবাদক এবং ধ্রুপদশিল্পী। এছাড়া তিনি নবাবের সঙ্গীতগুরুও ছিলেন। এছাড়া দরবারে স্থান পেয়েছিলেন ধ্রুপদীয়া ওস্তাদ কালে নাজির খান, সুরসিঙ্গার বাদক প্রিন্স সাদাত আলী খান (চনমন সাহেব), রবাব বাদক ওস্তাদ মোহম্মদ আলী খান, সরলা দেবী চৌধুরী, সস্ত্রীক তায়াবজি, পণ্ডিত ডি.কে ।

এই সম্মেলনে একটি হিন্দুস্থানী সঙ্গীতদের একটি কেন্দ্রীয় একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর নামকরণ করা হয়-
Central Academy of Hindusthani music। পরে এর নামকরণ করা হয়েছিল সঙ্গীত নাটক একাডেমি। এই সম্মলেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বৃজ কৃষাণ কাউল। এই সম্মেলেন ভাতেখণ্ডে বিতর্কিত রাগ-বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে একটি আদর্শ জায়গায় পৌঁছার জন্য সকল প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের একত্রিত করেন।

এই আসরের উল্লেখ্যোগ্য বিষয় ছিল সারং, কানাড়া এবং টোড়ি অঙ্গের রাগসমূহের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করা। এর ভিতরে সারঙ্গ অঙ্গের রাগগুলো ছিল-
মধুমাদ সারং  বৃন্দাবনী সারং, মিঞা কি সারং, বড়হংস সারং, সামন্ত সারং, শুদ্ধ সারং, গৌড় সারং, লঙ্কাদহন সারং

কানাড়া অঙ্গের রাগগুলো ছিল- দরবারী-কানাড়া, আড়ানা, বাগেশ্রী, সাহানা, নায়েকী কানাড়া, কৌশিকী কানাড়া, মুন্দ্রিক, হুসেনী কানাড়া, সুহা কানাড়া, সুঘরাই কানাড়া।

টোড়ি অঙ্গের রাগগুলো হলো- শুদ্ধ টোড়ি, বিলাসখানি টোড়ি,  গুর্জরী টোড়ি, দেশী, জৌনপুরী টোড়ি, গান্ধারী টোড়ি, আশা টোড়ি, লক্ষ্মী টোড়ি, লাচারী টোড়ি

সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন, তৃতীয় ১৯১৯
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বেনারসে সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বেনারসের মহারাজা। এই আয়োজনের সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিষ্ণনারায়ণ ভাতখণ্ডে। দ্বিতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে ভাতখণ্ডের উদ্যোগে সারঙ্গ, কানাড়া এবং টোড়ি অঙ্গের বেশকিছু রাগ-বিষয়ক বিতর্কের অবসান হয়েছিল। এই সম্মেলনেও ভাতখণ্ডে একই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে এই সম্মেলনেও সকল রাগ বিষয়ক মতানৈক্যের পূর্ণাঙ্গ সমাধান হয় নি।

এই সম্মেলনে অধিকাংশ কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত শিল্পীরা ছিলেন- ওস্তাদ ফৈয়াজ হুসেন খান, ওস্তাদ আল্লাবন্দে খান, ওস্তাদ মুশারফ খান (বীণাবাদক), ওস্তাদ ইমদাদ খান ও তাঁর পুত্ররা (বীণাবাদক),
ওস্তাদ সাদিক আলি খান (বীণাবাদক), ওস্তাদ ইনায়েত খান (সুরবাহার), ওস্তাদ ফিদা হুসেন খান (সরোদ), ওস্তাদ মুসতাক হুসেন খান, ওস্তাদ আল্লাদিয়া খান, ওস্তাদ বরকতউল্লাহ খান, ওস্তাদ হাফিজ আলি খান (সরোদ), পণ্ডিত গণপত রাও, ওস্তাদ চাঁদ খান, একনাথ পণ্ডিত।

বেনারস সম্মেলন নানা কারণে সফলভাবে শেষ করা যায় নি। বিশেষ করে আর্থিক সংকট এই সম্মেলনের জৌলুস অনেকটা ম্লান করে দিয়েছিল। ফলে ৪র্থ সম্মেলনের আয়োজন করতে প্রায় ৫ বৎসর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের ভিতরে ইন্দোরের মহারাজ হোলকার ইন্দোরে সঙ্গীত সম্মেলনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। এ বিষয়ে সম্মেলন পরিষদ বিজয়নগর থেকে আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। কিন্তু অনেকে ইন্দোরে সম্মেলনে রাজি হন নি। এছাড়া কলকাতায় সম্মেলন করার কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়।

সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলন, চতুর্থ ১৯২৫
এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ৯-১৪ জানুয়ারি, লক্ষ্ণৌর কায়সার বাগে। যুক্তপ্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী রাই উমানাথ বালি লক্ষ্ণৌতে চতুর্থ সঙ্গীত সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই সম্মেলন ফলপ্রসু করার জন্য তিনি বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরে ভাতখণ্ডে এই চতুর্থ সম্মেলনের জন্য সার্বিকভাবে সকলের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন। এই সময় আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন রাই রাজেশ্বর বালি উত্তর প্রদেশের গভর্নর উইলিয়াম মরিস। এছাড়া উত্তর প্রদেশের তালুকদার এবং জমিদাররা আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। এই সার্বিক প্রচেষ্টা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সঙ্গীতগুণীরা এই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এঁদের অনেকে এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত (কণ্ঠ ও বাদযন্ত্র) পরিবেশন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে মোট ১০০জন সঙ্গীতশিল্পী  সঙ্গীত (কণ্ঠ ও যন্ত্র) পরিবেশন করেছিলেন।

এছাড়া সঙ্গীতে সম্ভবনাময় শিল্পীদের নির্বাচন করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। এই কমিটির বিচারকরা ছিলেন- পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে, ঠাকুর মোহাম্মদ নওয়াব আলি খান, শ্রী শিবেন্দ্র নাথ বসু, অধ্যাপক প্রেম বল্লভ যোশী এবং এসএন কর্নাদ।

এই সম্মেলনের আলোচ্য তালিকায় ১৫টি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর সারমর্ম ছিল-

১. ভারতীয় রাগ-রাগিণীর বাদী স্বর, সমবাদী স্বর, অনুবাদী স্বর, বিবাদী স্বরের ব্যাখ্যা এবং রাগে এগুলোর প্রয়োগ বিধি।
২. রাগ পরিবেশনের সময়।
৩. রাগ এবং রস
৪. প্রাচীন এবং আধুনিক নৃত্যকলা
৫.  স্বরলিপি ভিত্তিক রাগচর্চা
৬. কতিপয় রাগের আরোহ, অবরোহ, বাদী স্বর, সমবাদী স্বর, অনুবাদী স্বর, বিবাদী স্বরের প্রয়োগ বিধি। এই তালিকায় ছিল ৪টি অঙ্গের রাগ। এগুলো হলো- বিলাবল, মল্লার, কানাড়া এবং টোড়ি।
৭. বিধি মোতাবেক বর্তমান (সে সময়ের বিচারে) সময়ের রাগের চর্চা করা।
৮. প্রাচীন এবং আধুনিক তাল পদ্ধতির তুলনমূলক বিচার
৯. সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বিষয়ক পত্রিকার প্রকাশ
১০. যথার্থ সঙ্গীত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় স্থাপন
১১. উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গীতের মেলবন্ধনে উদ্যোগ গ্রহণ
১২. শিল্পকলার উত্তম পদ্ধতি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া
১৩. ভারতীয় সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্যোগ
১৪. ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের আধুনিক সঙ্গীতের উপযোগী করে তোলা
১৫. ভারতীয় সম্রাট, যুবরাজ, রাজন্যবর্গের রাজদরবারের সঙ্গীতের ইতিহাস এবং একই সাথে হরিদাস স্বামী, তানসেন, গোপাল নায়ক প্রমুখের উল্লেখযোগ্য কীর্তি সম্পর্কে গবেষণা। এবং ভারতীয় সঙ্গীতে বিদেশী সঙ্গীতের প্রভাব

এই সম্মেলনের লক্ষ্য এবং বিষয় সম্পর্কে ১৭টি দফা প্রকাশ করা হয়েছিল, তার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল- ভারতীয় সঙ্গীতের উন্নয়ন, সহজ পদ্ধতিতে সঙ্গীত শিক্ষা, উত্তরভারতীয় তাল এবং রাগের যথার্থ শিক্ষা প্রদান, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় রাগের মেলবন্ধন, সারাদেশের জন্য একটি আদর্শ স্বরলিপি পদ্ধতির উন্নয়ন, নতূন রাগ তৈরি এবং তা মূল ধারার রাগসঙ্গীতে যুক্ত করা, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক দেশী্যয় বাদ্যযন্ত্রের উন্নয়ন, প্রথম মানের শিল্পীদের শিল্পকর্মের সংরক্ষণ,  প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থের সংরক্ষণ এবং ভারতীয় সঙ্গীতের যথাযথ ইতিহাস প্রণয়ন, একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার স্থাপন, যেখানে প্রাচীন ও আধুনিক সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থের সংরক্ষণ, এবং শিক্ষার্থীদের কাছে সুপ্রাপ্যতার জন্য প্রকাশের ব্যবস্থা করা, আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে শ্রুতির মান নির্ধারণ এবং রাগসমূহে তার ব্যবহার বিষয়ক শিক্ষা প্রদান, প্রসিদ্ধ সঙ্গীতের জীবন এবং এদের সাথে সঙ্গীতের কালানুক্রমিক-বিষয়ক গবেষণা, সঙ্গীত চর্চা ও গবেষণার জন্য তহবিল গঠন, আদর্শিক ভারতীয় সঙ্গীত  একাডেমী গঠন।

এই সম্মেলনের  অনুষ্ঠান সূচী