বাংলাদেশের ইতিহাস

প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারত বর্ষে মানুষের আগমন।
ধারণা করা হয় প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো (Homo) গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকা ইথিওপিয়া অঞ্চলে। আর ১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর আগে মূল প্রজাতি থেকে একটি উপ-প্রজাতি পৃথকভাবে বিকশিত হয়। এই প্রজাতিটি হলো Homo sapiens idaltu। আধুনিক মানুষ বলতে মূল প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়- Homo sapiens sapiens নামক উপ-প্রজাতি হিসেবে।

নেগ্রিটোদের আগমন
১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর থেকে ৬০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা আফ্রিকাইথিওপিয়া অঞ্চল থেকে
Homo sapiens sapiens -এর একটি দল এশিয়া এবং ইউরোপে প্রবেশ করে। এদের একটি দল ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল, এদেরকে বিজ্ঞানীরা নামকরণ করেছেন নেগ্রিটো এরা ছিল খর্বাকার এবং এদের গায়ের রঙ ছিল কালো। মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো। এদের মাথার গড়ন ছিল লম্বাটে এবং নাক ছিল চ্যাপ্টা। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এদের ১২টি জাতিগোষ্ঠী এখনো আলাদাভাবে নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে মূল ভূখণ্ডে এরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। এই যুগে নেগ্রিটোরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো অমসৃণ পাথর। এদের নিদর্শন পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যাকায়, দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর মানুষ

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের the Telegraph, March, 2008 সংখ্যায় এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- প্রাক্‌-ঐতিহাসিক বঙ্গদেশে মানুষের পদচারণা শুরু হয়েছিল প্রায় ২০,০০০ বৎসর আগে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।  কিন্তু ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলো ২০,০০০ বৎসরের পুরানো। এরা কৃষিকাজ জানতো না। ধারণা করা যায়, প্রাচীন প্রস্তরযুগে এরা আগুনের ব্যবহার জানতো না। এরা গুহাবাসী ছিল বা বড় বড় গাছের নিচে দলবদ্ধভাবে বাস করতো। এদের প্রধান খাদ্য ছিল বন্য পশুপাখি। এছাড়া খাওয়ার উপযোগী ফলমূল ও লতা আহার করতো।

মুর্শিদাবাদ থেকে প্রাপ্ত ২০,০০০ বৎসরের পুরানো নমুনাগুলো। সূত্র :  the Telegraph, March, 2008

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে দুর্গাপুরে কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এসব নমুনাকে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০০ বৎসরের পুরানো হিসেবে দাবি করেছিলেন।  খ্রিষ্টপূর্ব ১০-৬ হাজার বৎসরের ভিতরে এই মধ্য এই মধ্য প্রস্তরযুগের ব্যাপ্তীকাল ধরা হয়। মধ্য প্রস্তরযুগে নেগ্রিটোরা মুর্শিদাবাদ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে তাদের বসতিকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল।  মধ্য প্রস্তরযুগের  নেগ্রিটোরা পাথরের ফলা তৈরি করে তীরের মাথায় ব্যবহার করতে শিখেছিল। মাটির তৈরি পাত্র তৈরির কৌশল তারা শিখেছিল বটে। কিন্তু কুমোরের চাকা তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। এযুগের  নেগ্রিটোদের প্রধান খাবার ছিল বন্য পশু-পাখি। তবে তারা কিছু প্রাণীকে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছিল। এই সময় কৃষিকাজের চেষ্টা তারা করেছিল, কিন্তু পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে নি।

প্রোটো-অস্ট্রালয়েড-দের আগমন
আফ্রিকা থেকে অপর একটি দল প্রায় ৬৫ হাজার বৎসর আগে অন্যান্য মহাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই দ্বিতীয় দলটি প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। ৫০-৬০ হাজার বৎসর আগে এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার বৎসর আগে, এরা সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এদেরকে সাধারণভাবে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলা হয়। ভারতবর্ষের বেশকিছু আদিবাসী প্রোটো-অস্ট্রালয়েড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরা ছিল অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের সদস্য। এই ভাষা পরিবারের কিছু ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায় পূর্ব ভারতের কোল, ভিল, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ জনগোষ্ঠীর ভিতরে। এই বিচারে অনেক সময় এদেরকে অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীও বলা হয়।

প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা বঙ্গদেশ বা ভারতবর্ষে কোন সময় থেকে আসা শুরু করেছিল, তা সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না। ধারণা করা এরা ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি  নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো  নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। এই বিচারে ভারতের মধ্য-প্রস্তরযুগের সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল নেগ্রিটো আর প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণে। 

দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয়দের আগমন
ভারতের আদি জনগোষ্ঠীতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের দ্বারা। কিন্তু সে প্রভাবকে ম্লান করে দিয়েছিল দ্রাবিড় জাতির মানুষ। খ্রিষ্টপূর্ব ৬-৫ হাজার বৎসর আগে এরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এদের উত্তর-পশ্চিম ভারতে নগরপত্তন ঘটিয়েছিল। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সিন্ধু সভ্যতা। আয়তনের বিচারে এই সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে অনেক বড়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল আয়তন সব মিলিয়ে ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার।

এর কিছু পরে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করেছিল মোঙ্গোলীয় মহাজাতির মানুষ। ভাষাতাত্ত্বিকরা এই নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহকে সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার সদস্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। হিমালয়ের পিকিং মানবগোষ্ঠীর (হোমো এরেক্টাস) উত্তরসূরী এবং হোমো স্যাপিয়েন্স (আধুনিক মানুষ) -দের ভাষার সংমিশ্রণে এই ভাষা পরিবারের আদি রূপ সৃষ্টি হয়েছিল। এরা বসবাস করতো চীনের ইয়াংজি, হুয়াং হো প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। খ্রিষ্ট-পূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে প্রাগ্ সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের মানুষ চীন এবং অন্যান্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অঞ্চলভেদে এই আদি ভাষা থেকে নানা ধরনের ভাষার উদ্ভব ঘটে। এদের একটি দল মূল চীনের মূল ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে রয়ে যায়। এদের অপরাপর অংশ, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেই সূত্রে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে, খ্রিষ্টপূর্ব ২১০ অব্দের দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার, বিভিন্ন অংশে এবং ভারতের হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে চলে আসে। তিব্বতের দিকে চলে আসা জনস্রোত হিমালয়ের উচ্চভূমিতে বসতি স্থাপন করে। অন্যদিকে এদের অপর দল মেকং নদী, মায়ানমারের ইরাবতী নদী তীরগুলোতে বসতি স্থাপন করে। এদের একটি দল খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চীন-মায়ানমার সীমান্তের শান অঞ্চলে (বর্তমানে শান মায়ানমারের একটি প্রদেশ) এসে বসতি স্থাপন করেছিল। শান অঞ্চলের আদিবাসীরা এই নবাগতদের খুব ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের কারণে এদেরকে উৎখাতও করতে পারে নি। শান অঞ্চলে এরা প্রায় ৩০০ বৎসর বসবাস করে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে পরে এদের একটি শাখা ভারতের মণিপুর এবং মায়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী কাবাও উপত্যাকায় চলে আসে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। এই সময় মায়ানমারের আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত বার্মিজদের সাথে সম্প্রীতি গড়ে উঠে এবং উভয় জাতির ভাষা এবং সংস্কৃতি উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এরপর এদের একটি শাখা মায়ানমারের স্যাগায়িং প্রদেশের খ্যাম্পাট অঞ্চলে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টীয় ১৪শ শতকের মধ্যভাগে এরা মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের ভারত সীমান্ত বরাবর বসতি স্থাপন করে।  খ্রিষ্টীয় ১৬শ শতকের দিকে বর্তমান ভারত প্রজাতন্ত্রের মায়ানমার সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধাপে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে প্রথম যে মিজো ভাষার লোকেরা প্রথম প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে কুকি বলা হয়। ভারতে প্রবেশকারী এই জাতি গোষ্ঠীর দ্বিতীয় দলকে নব্য কুকি নামে অভিহিত করা হয়। আর এই জাতি সত্তার সর্বশেষ যে দলটি ভারতে প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে অভিহিত করা হয় লুসাই নামে। কুকি, নব্য কুকি এবং লুসাইদের সম্মিলিত নাম হলো মিজো। তিব্বত, মিজোরাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল দিয়ে এরা ধীরে ধীরে পাহাড়ি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক ভৌগোলিক পরিচয়ের বিচারে এরা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে
তিব্ব্বত, সিকিম, ভুটান, নেপাল এবং বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায়। এদের সাথে হিমালয় সংলগ্ন সমতল অঞ্চলের দিকে নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সাথে মোঙ্গোলীয় মহাজাতির মানুষের রক্তের মিশ্রণ ঘটেছিল। গারো, হাজং এবং বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকায় এর প্রভাব পড়েছিল।

আর্যভাষাভাষীদের আগমন
এরপর আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে। ক্রমে ক্রমে এরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। ধারণা করা এদের দ্বারা তাম্রযুগের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে। আর লৌহযুগের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গদেশেও একই সময় তাম্র এবং লৌহের ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

আর্য-অনার্য সংমিশ্রণ
আগের জনগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে অনার্য নামে চি্হ্নিত করা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানীরা অনার্য নামধারী ভারতবর্ষের আদিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেননেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মোঙ্গোলীয়  জাতিগোষ্ঠীর লোকদেরকে। বঙ্গদেশের জনগোষ্ঠীকে একনিষ্ঠভাবে এমন কোনো জাতি সত্তার ভিতরে ফেলা যায় না। বঙ্গদেশের আদিবাসী হিসাবে প্রথম যে নামগুলো উচ্চারিত হয়, তা হলো কোল, ভিল, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে এদের সাথে মিশেছিল
দ্রাবিড় আর্যরা। ফলে বহু আগে থেকে এই অঞ্চলে একটি ভাষাগত এবং দেহগত মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি হয়েছিল। এই কারণে দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে বাঙালিদের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রধান শ্রেণিগুলোর ভিতরে ফেলা যায় না। কিন্তু আর্য-অনার্য ভাষার মিশ্রণে বঙ্গভাষার আদিরূপ সৃষ্টি হয়েছিল। ভাষাবিজ্ঞানীরা একে বলে থাকেন প্রাকৃতভাষা। উভয় মিলে এদেরকে বলা যেতে পারে 'বঙ্গীয় প্রাকৃত জন'।

হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতের মতে দীর্ঘতমা মুনি বলিরাজের অনুমতিক্রমে সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচটি সন্তান উৎপন্ন করেন এঁরা হলেন অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। এর ভিতরে 'বঙ্গ' নামক সন্তান বঙ্গদেশের পত্তন করেছিল। আর্র সময় বঙ্গের সীমা কতটুকু ছিল, তা জানা যায় না। বঙ্গ-রাজার রাজত্বের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।

বঙ্গ বা বাঙলা নামের ইতিহাস
ঐতিহাসিকদের অনেকে মনে করেন,  বঙ্গ শব্দটির তিব্বতি ভাষা থেকে আগত। ভোটাচীন বা তিব্বতি ভাষায়
Bans-Po বা Bons (বঙস) শব্দের অর্থ হলো আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে স্থান বা জলাভূমি। বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন নিম্ন পলিময় আর্দ্র এই অঞ্চলকে বঙস বলা হতো। পরবর্তী সময়ে বঙস থেকে বঙ্গ শব্দটি গৃহীত হয়েছে। তবে এই ধারণা অনুমান মাত্র।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর বাঙ্গালা ভাষার অভিধান- মতে, বর্তমানে যাকে পূর্ববঙ্গই বলা হয়, প্রাচীনকালে তার নাম ছিল বঙ্গ। সে সময় পশ্চিমবঙ্গ ছিল গৌড় বা রাঢ়। সংস্কৃতিতে পূর্ব ও মধ্যবঙ্গকে বঙ্গ বলা হতো। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে উৎকীর্ণ এবং তাঞ্জোর হতে আবিষ্কৃত একটি প্রশস্তিমালায় 'বঙ্গলম' শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বঙ্গলম শব্দটি হতে আরবি ও ফার্সিতে 'বাঙ্গালা' শব্দটি প্রবেশ করেছিল। মোগল সম্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল-এর মতে, এই অঞ্চল পূর্বে আল দ্বারা বেষ্টিত ভূমি ছিল। কথিত আছে প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ চওড়া 'আল' নির্মাণ করতেন।  এই আল থেকে 'বাঙ্গালা' নামের উৎপত্তি। কিন্তু একথা আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই এই যুক্তি মানেন না। কারণ খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক বা তারও আগের উৎকীর্ণ শিলা ও তাম্রলিপি, প্রাচীন গ্রন্থাদি ও ভ্রমণ কাহিনি ইত্যাদিতে 'বঙ্গ' ও 'বঙ্গাল' শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই বঙ্গদেশের নামের সঙ্গে 'আল' যুক্ত করে অথবা অন্য কোনো কারণে 'বঙ্গাল' নামের উদ্ভব হয়েছে, তা মেনে নেয়া যায় না।  মোগলদের দেয়া সুবা-বাংলা নামের অনুকরণে পর্তুগিজরা বাংলাদেশকে 'বেঙ্গলা' নামে অভিহিত করত। পরবর্তীকালে বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল ব্রিটিশ অধিকারে আসার পর ইংরেজরা এই দেশকে 'বেঙ্গল' নাম দেয়। তবে একথা মানতেই হবে যে, প্রাচীনকালে 'বাংলা' নামের কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা ভৌগোলিক এলাকা ছিল না। মূলত বঙ্গ শব্দের অপভ্রংশই হলো বাংলা।

বঙ্গদেশের বিকাশ
গুপ্তযুগের পূর্বে বাংলাদেশের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন গ্রন্থে বিচ্ছিন্নভাবে বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের যে সকল নাম পাওয়া যায়, তা থেকে বিশেষ কিছু জানা যায় না। যেমন মহাভারতের দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা, কর্ণের কয়েকটি অভিযান থেকে বঙ্গের কতিপয় রাজা ও জনপদের নাম পাওয়া  যায়। এ থেকে ধারণা করা যায়, মহাভারতের যুগে বঙ্গদেশে একাধিক রাজ্যে বিভাজিত ছিল। অসংখ্য নদনদী এবং বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন এই অঞ্চলে কোনো একক বড় রাজ্য গড়ে উঠে নি। অনুমান  করা যায়, ছোট ছোট জনগোষ্ঠী নিয়ে ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। বৃহৎ রাজ্য গড়ে তোলার জন্য কোনো স্থানীয় রাজা বড় ধরনের উদ্যোগও গ্রহণ করেন নি, প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার জন্য। প্রাচীনকালের মূল যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল নদী পথের সূত্রে।

উয়ারী-বটেশ্বর'-এ প্রাপ্ত রৌপ্যমুদ্রা ও পাতিল

এর পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজারা একালের বঙ্গদেশে (অখণ্ড বাংলা) এক সময় রাজত্ব করতো। তার নমুনা পাওয়া যায় প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলোর সূত্রে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা অনুসারে 'উয়ারী-বটেশ্বর' নমুনাকেই প্রাচীনতম নমুনা হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বের ভারতবর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। কারণ ভারতবর্ষের প্রকৃত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। এই সূত্রে উত্তরভারতে ১৬টি মহাজনপদের নাম পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীরের জন্মের আগে, এই সকল মহজনপদের নাম পাওয়া যায় 'ভগবতীসূত্র' এবং 'অঙ্গুত্তরনিকাই' নামক দুটি গ্রন্থে। এই জনপদগুলো বিস্তৃত ছিল কাবুল থেকে দাক্ষিণাত্যের গোদাবরী নদী পর্যন্ত। এই জনপদগুলো হলো কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি বা বৃজি, মল্ল বা মালব, চেদী, বৎস বা বংশ, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, শুরসেন, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার ও কম্বোজ। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য রাজ্যগুলো ছিল কপিলাবস্তুর শাক্য রাজ্য, রামগ্রামের কোলিয় রাজ্য, পিপপ্পলিবনের মৌর্য রাজ্য, ভগ্গ ও আল্লাকাপ্পার বুলি রাজ্য, কেশপুত্তের কালামস রাজ্য, বৈশালীর লিচ্ছবি রাজ্য, মিথিলার বিদেহ রাজ্য।

উল্লিখিত মহাজনপদগুলোরে ভিতরে ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলের নাম পাওয়া যায় না। যেমন
আসাম, বঙ্গদেশ, উড়িষ্যা, গুজরাট, সিন্ধু, পাঞ্জাব ইত্যাদির নাম নেই। ধারণা করা যায়, বুদ্ধের সময় ভারতের আসাম, বঙ্গদেশ এবং উড়িষ্যা অঞ্চলে ছোটো ছোটো রাজ্য ছিল। আর মহাজনপদের রাজারা উত্তর-ভারতের কয়েকটি অংশ জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য লড়াই করেছে এবং জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তাদের বিষয় ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এই সকল রাজ্যের নামকরণে ভাষার কোনো ভূমিকা ছিল না।  ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। এই জনপদগুলোর নাম ছিলগৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, পুণ্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্র, রাঢ়। এই জনপদগুলোই অখণ্ড বঙ্গদেশের আদিরূপ ছিল।

বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বঙ্গদেশের জনপদগুলোকে নানারূপ বর্ণনায় পাওয়া যায়। ঐতেরিয় ব্রাহ্মণে পুণ্ড্রদেরকে উত্তরবঙ্গের বর্বর অধিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায় ধর্মসূত্রের রচয়িতা বৌদ্ধায়নের গ্রন্থ থেকে। কালক্রমে এই সকল অঞ্চলের জনগোষ্ঠী আর্যদের আচার আচরণের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে। মহাভারতে পুণ্ড্র ও বঙ্গের অধিবাসীদের 'সুজাত' ক্ষত্রিয় নামে অভিহিত করা হয়েছে। রামায়ণে বঙ্গকে সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময়ে বঙ্গের ক্ষত্রিয়দের সাথে অযোধ্যার ক্ষত্রিয়দের রাজনৈতিক সুসম্পর্ক ছিল। মহাভারতের বন পর্বে দেখা যায়, ভীমের কাছে পুণ্ড্র, বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্তের রাজারা পরাজিত হয়েছিলেন। জৈন গ্রন্থ 'উপাঙ্গ'-এ আর্যসভ্যতার তালিকায় বঙ্গ এবং রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।  দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বঙ্গ-অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এ গ্রন্থে। জৈন গ্রন্থ মতে, তাঁদের ধর্মগুরু মহাবীরের সাথে রাঢ় অঞ্চলের মানুষ হীন আচরণ করেছিল।