বিগব্যাং
[অভিধান:
বিগব্যাং]
মহাবিশ্বের
সৃষ্টিবিষয়ক এবং বিবর্তন বিষয়ক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এই তত্ত্ব
অনুসারে− প্রায় ১৩৮০ কোটি বৎসর আগে একটি অত্যন্ত ঘন, উৎতপ্ত এবং দশা থেকে
মহাবিশ্ব
উৎপন্ন হয়েছিল । যা পরবর্তী সময়ে দ্রুত প্রসারিত হয়ে আজকের মহাবিশ্বের রূপ নিয়েছে।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে
বেলজিয়ামের পদার্থ বিজ্ঞানী
জর্জ লেমিটর
( Georges Lemaître)
প্রথম বিগব্যাং তত্ত্ব প্রকাশ করেন।
এই তত্ত্ব অনুসারে প্রায় ১৫০০ কোটি বৎসর আগে, মহাবিশ্বের সকল বস্তু আন্তঃআকর্ষণে একটি বৃহৎ পরমাণুতে
(Supper Atom)
পরিণত হয়।
জর্জ লেমিটর
এই পরমাণুটির নাম দিয়েছিলেন আদিম পরমাণু
(primæval-atom)
।
এই পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মতবাদকে
সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন
এডুইন পাওয়েল হাবল
(Edwin Powell Hubble)।
তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন
জর্জ গ্যামো।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব: এই ত্ত্ত্ব
অনুসারে, মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটি অতি ঘন এবং অতি উষ্ণ অবস্থা থেকে। এই
অবস্থায় সময়, স্থান, পদার্থ এবং শক্তি একটি বিন্দুতে সংকুচিত ছিল। এই বিন্দু থেকে
একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে প্রসারিত হওয়া শুরু করে। এই বিস্ফোরণের সূত্রে
মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ, শক্তি, স্থান এবং সময়ের সৃষ্টি করে। এটি কোনো সাধারণ
বিস্ফোরণ নয়; এটি ছিল স্থান-কালের নিজস্ব প্রসারণ।
উল্লেখ্য এই সময় কোন স্থান ও কালের অস্তিত্ব ছিল না। অসীম ঘনত্বের এই মহাপরমাণুর
ভিতরে বস্তুপুঞ্জের ঘন সন্নিবেশের ফলে এর তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল- ১০১৮
কেলভিন।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্মলগ্নকে যদি ০ সময় ধরা যায়, তা হলে, সেই সময়ই বিগব্যাং শুরু এবং
শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর ফলাফলের বিচারে- বিগ
ব্যাং-এর পরের ১ সেকেন্ডে আনা হয়, এর অনুষঙ্গ হিসেবে।
বিগব্যাং-এর পরবর্তী ০-১ সেকেন্ডের মধ্যে যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, বিজ্ঞানীরা তা কালানুক্রমে কয়েকটি
অন্তঃযুগে ভাগ করেছেন। ভাগগুলো হলো-
- প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ : প্লাঙ্ক যুগ: ০ থেকে ১০-৪৩ সেকেণ্ড:
বিগব্যাং-এর ০
সেকেন্ড থেকে ১০-৪৩
সেকেন্ড সময়কে প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ (Planck
epoch) বলা হয়। এই সময় প্রাকৃতিক সকল বল একীভূত ছিল। বিজ্ঞানীরা এই বলের
নামকরণ করেছেন অতি বৃহৎ বলে (super
force) । এই সময়
মহাবিশ্ব
সম্প্রসারিত হয়েছিল মাত্র-১০-৩৫ মিটার। উল্লেখ্য এই দূরত্বকে বলা হয়
১ প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্য। এই সময় তাপমাত্রা ছিল ১০৩২
কেলভিন।
- বৃহৎ একীকরণ অন্তঃযুগ : ১০-৪৩ থেকে ১০-৩৬
সেকেণ্ড: জ্যোতির্বিজ্ঞানীর এই সময়ের নাম দিয়েছেন বৃহৎ একীকরণ অন্তঃযুগ (Grand
unification epoch)। এই সময় উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ ছিল ১০১৫
গিগা ভোল্ট। আর তাপমাত্রা ছিল ১০২৭
কেলভিন।
এই সময় অতি বৃহৎ বলের অন্তর্গত
সবল নিউক্লিয়ার বল,
দুর্বল
নিউক্লীয় বল,
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল মিলিত হয়ে ইলেক্ট্রো-নিউক্লিয়ার বল
(electronuclear force)
সৃষ্টি করেছিল। আর পৃথক বল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল
মহাকর্ষীয় বল । এই বলের প্রভাবে মহাবিশ্ব সর্বোচ্চ সংকোচন মাত্রায়
পৌঁছেছিল। তখন ঘনত্বের বিচারে
মহাবিশ্বের
প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে বস্তু ছিল ৫´ ১০+৯৩
গ্রাম।
ধারণা করা হয়, এই সময় তৈরি হয়েছিল প্রাথমিক স্তরের
অতিপারমাণবিক কণার ভিতরে দুটি
বোসন কণা- এক্স এবং ওয়াই বোসন। এই দুই কণা ক্ষয় হয়ে তৈরি হয়েছিল দুটি
কোয়ার্ক
কণা (আপ এবং ডাউন) এবং বলবাহী কণা
লেপ্টনের দুটি কণা। একই সাথে তৈরি হয়েছিল এদের প্রতিকণাসমূহ
(antiparticles) । প্রতিকণার
সাথে মূল কণার সংঘর্ষে উভয় কণাই ধ্বংস হয়ে গেলে- থেকে গিয়েছিল শুধু
কোয়ার্ক ও
লেপ্টন কণাগুলো।
- প্রসারণ অন্তঃযুগ : ১০-৩৬ থেকে ১০-৩২
সেকেণ্ড: বিগব্যাং-এর পরবর্তী এই সময়কে বলা হয় প্রসারণ অন্তঃযুগ
(inflationary epoch) এই সময়ের
মধ্যে তাপমাত্রা নেমে আসে ১০২৭ থেকে ১০২২
কেলভিনে।
এই সময় মহাবিশ্ব
দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে, ইনফ্লেশন তত্ত্ব প্রথম
প্রস্তাব করেন পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান গুথ।
[বিস্তারিত:
প্রসারণ অন্তঃযুগ ]
- দুর্বল অন্তঃযুগ: ১০-৩২ থেকে ১০-১২ সেকেণ্ড:
বিগব্যাং-এর পরবর্তী এই সময়কে বলা হয় বিদ্যুৎচুম্বকীয়-দুর্বল অন্তঃযুগ
(Electroweak epoch) । কারণ এই
সময়
দুর্বল নিউক্লীয় বল
ও
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল একত্রিত হয়ে, এই বলটি তৈরি হয়েছিল। ফলে
সবল
নিউক্লিয়ার বল স্বতন্ত্র বল হিসেব আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই সময় তৈরি হয়েছিল
উৎতপ্ত কোয়ার্ক-গ্লুয়োন
কণা। এছাড়া তৈরি হয়েছিল
বোসন
শ্রেণির তিনটি কণা। এগুলো হলো- ডব্লিউ এবং জেড বোসন কণা এবং
হিগস বোসন
কণা।
- কোয়ার্ক অন্তঃযুগ: ১০-১২
থেকে ১০-৬ সেকেণ্ড: বিগব্যাং-এর পরবর্তী এই সময়কে বলা হয় কোয়ার্ক
অন্তঃযুগ (Quark epoch)
। এই সময়
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ও
দুর্বল
নিউক্লীয় বল পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র দুটি বল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে এই
সময়েই প্রথম চারটি প্রাকৃতিক মৌলিক বল স্বতন্ত্রভাবে বস্তুজগতের উপর প্রভাব
বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এই সময় তৈরি হয়েছিল বিপুল পরিমাণ
কোয়ার্ক,
ইলেক্ট্রন
ও নিউট্রিনো। কিন্তু এই সময়ে তাপমাত্রা ছিল ১০১২কেলভিন। আর শক্তির
পরিমাণ ছিল ১০০ মেগাভোল্ট। এই উচ্চ তাপমাত্রায় কোয়ার্ক কণা থেকে
হ্যাড্রোন
তৈরি অসম্ভব ছিল।
কোয়ার্ক
ছাড়াও সৃষ্টি হয়েছিল
লেপ্টন এবং
প্রতি-কণাসমূহ। তবে মূল কণা ও প্রতিকণার সংঘর্ষে উভয় কণা নিশ্চিহ্ন হয়ে
গিয়েছিল। এই সংঘর্ষের কারণে কোয়ার্ক কণা থেকে
মেসোন ও
ব্যারিয়ন
কণার সৃষ্টি হয়েছিল।
- হ্যাড্রোন অন্তঃযুগ: ১০-৬ থেকে ১ সেকেণ্ড:বিগব্যাং-এর
পরবর্তী এই সময়কে বলা হয়
হ্যাড্রোন অন্তঃযুগ (Hadron epoch)
। এই সময় তাপমাত্রা ১০১২
কেলভিন
থেকে ১০১০
কেলভিন-এ
নেমে এসেছিল। এই সময় কোয়ার্ক কণাগুলো থেকে সৃষ্টি হয়েছিল প্রচুর
হ্যাড্রোন কণা। শুরু দিকে
হ্যাড্রোন এবং প্রতি-হ্যাড্রোন কণা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে পরস্পরের সংঘর্ষের
মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দ্রুত তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে এই
প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
- লেপ্টন অন্তঃযুগ: ১ সেকেন্ড থেকে ১০ সেকেন্ড: বিগব্যাং-এর পরবর্তী
এই সময়কে বলা হয় লেপ্টন অন্তঃযুগ
(Lepton epoch) । মূলত ১ সেকেণ্ড থেকে ১০ সেকেণ্ডের ভিতরে তাপমাত্রা ১০১০
কেলভিন
থেকে ১০৯
কেলভিন-এ
নেমে এসেছিল। এই সময়য়ের ভিতরে
লেপ্টন এবং
প্রতি লেপ্টনের ভিতরে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের পরে সামান্য কিছু লেপ্টন থেকে
গেলেও বাকি কণা
ফোটন কণায় পরিণত হয়। এর ফলে লেপ্টনের সংখ্যা কমে যায়; অবশিষ্ট থাকে মূলত ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো।
এই প্রক্রিয়া উৎপন্ন শক্তি ফোটনকে উৎতপ্ত করেছিল।
মহাবিশ্ব ফোটন কণায় ভরে গিয়েছিল। এই কারণে লেপ্টন অন্তঃযুগের পরের সময়ের নাম
দেওয়া হয়েছে ফোটন অন্তঃযুগ
(Photon epoch)। ফোটন অন্তঃযুগ হলো বিগ ব্যাং-এর ১০ সেকেন্ড থেকে ৩.৮ লক্ষ বছরের মধ্যে সেই সময়, যখন আলোর কণা (ফোটন) সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। মহাবিশ্ব ছিল গরম প্লাজমা, আলো আটকে থাকত। শেষে পরমাণু গঠিত হলে আলো মুক্ত হয়
বিগ ব্যাং-এর প্রমাণ। বিগ ব্যাং তত্ত্বের
পক্ষে বেশ কিছু শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে। যেমন:
- মহাবিশ্বের প্রসারণ: ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে
এডুইন পাওয়েল হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে
— মহাকাশের
গ্যালাক্সিগুলো
পরস্পর থেকে ক্রমন্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর মতে, আদিতে
মহাবিস্ফোরণের ফলে
গ্যালাক্সিগুলো
সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগব্যাং-কেই সমর্থন করে। এই
ভাবে বিস্ফোরণের ফলে যে বিকিরণ সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে
প্রমাণ করা যায় নাই। ফলে, বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়।
- মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি
(CMB):
১৯৬৫ সালে পেনজিয়াস
(Arno Penzias)
ও উইলসন (Robert
Wilson) বিগব্যাং-এর সাথে আম্পর্কিত বিকিরণের
অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।
- মৌলিক উপাদানের প্রাচুর্য:
মহাবিশ্বে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং লিথিয়ামের অনুপাত বিগ ব্যাং
নিউক্লিওসিন্থেসিসের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলে।
- গ্যালাক্সির গঠন ও বিবর্তন:
দূরবর্তী গ্যালাক্সির পর্যবেক্ষণ দেখায় যে মহাবিশ্ব সময়ের সাথে বিবর্তিত
হয়েছে, যা বিগ ব্যাং মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বকেই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়।
সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, বিগ ব্যাং-এর ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় ১৩.৭৯৮
±০.০৩৭০০ কোটি বৎসর আগে। বর্তমানে মোটাদাগে বলা হয় এই ঘটনা ঘটেছিল ১৩৮০ কোটি
বৎসর আগে।
- বিগ ব্যাং-এর সীমাবদ্ধতা ও প্রশ্ন:
যদিও বিগ ব্যাং তত্ত্ব ব্যাপকভাবে গৃহীত, এটি কিছু প্রশ্নের উত্তর
দেয় না। যেমন-
- বিগ ব্যং-এর পূর্বাবস্থা: বিগ
ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
- প্রসারণের কারণ:
প্রসারণের পেছনের শক্তি সম্পর্কে
স্পষ্টভাবে যায় নি।
- ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি: মহাবিশ্বের প্রায় ২৭% ডার্ক
ম্যাটার এবং ৬৮% ডার্ক এনার্জি। এই শক্তিগুলো
প্রকৃতি এখনো অজানা।
বিগব্যং-এর পরবর্তী পর্ব-
ফোটন অন্তঃযুগ
(Photon epoch)। এর
বিগব্যাং-এর
১০ সেকেন্ড থেকে
৩৮০,০০০ বৎসর।
বর্তমান সময় থেকে এর সময় দূর্ত্ব ১৩৭৯.৯৬২ কোটি বছর।
সূত্র: