নক্ষত্র
[অভিধান: নক্ষত্র]
বানান বিশ্লেষণ: ন্+অ+ক্+ষ্+অ+ত্+র্+অ
উচ্চারণ:
nok.kʱot̪.t̪ro (নোক্.খোত্.ত্রো)
শব্দ-উৎস: সংস্কৃত নক্ষত্রম্>বাংলা নক্ষত্র
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: নক্ষ্(গতি) + অত্র (অত্রন্)}
পদ: বিশেষ্য

ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা{ | মহাকাশীয় বস্তু | প্রাকৃতিক লক্ষ্যবস্তু | এককঅংশ | দৈহিক-লক্ষ্যবস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা | } অর্থ:
অভ্যন্তরীণ তাপীয়-নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার দ্বারা শক্তি বিকীরণ করে, এমন উত্তপ্ত গ্যাসীয় মহাকাশীয় বস্তু।
প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতে, নক্ষত্র স্থির নয়। অর্থাৎ এর গতি আছে। এই অর্থে মহাকাশের দীপ্তিময় লক্ষ্যবস্তু সমূহকে নক্ষত্র বলা হয়েছে।
ইংরেজি:
star
সমার্থক শব্দাবলি:
ঋক্ষ, খেট, চন্দ্রধারা, জ্যোতিষ্ক, তারক, তারকা, তারা, নক্ষত্র, ভ, সিতারা।

নক্ষত্র-বিষয়ক সুচি

বর্ণালী অনুসারে নক্ষত্র-শ্রেণিকরণ
ছুটন্ত মুক্ত-নক্ষত্র
নক্ষত্রগুচ্ছ
নক্ষত্র তালিকা

অতি দানবতারা (supergiant)
অতি-নবতারা (Supernova)
কার্বন তারা (Carbon Star)
গ্রহান্বিত নীহারিকা (Planetary nebula)
নবতারা (Nova)

প্রদীপ্ত তারা (Flare star)
বাদামী বামন (brown dwarf)
বিষম তারা (variable star)
লাল দানব তারা (red giant star)
লাল বামন তারা (red dwarf star)
শ্বেত বামন তারা (white dwarf star)
নিউট্রন তারা (neutron star)
কৃষ্ণগহ্বর (black whole)
কৃষ্ণবামন (black dwarf)
কোয়েসার (quasar)

ইংরেজি: star

নক্ষত্রেরর উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন:
মহাকাশে ভাসমান বিপুল পরিমাণ আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুকণা মহাকর্ষীয় বল দ্বারা আকর্ষিত হয়ে যখন ঘনীভূত হতে থাকে, তখনই নক্ষত্র-ভ্রূণের জন্মের সম্ভাবনা দেখা দেয়। উল্লেখ্য, এই বস্তুপুঞ্জের
প্রায় শতকরা ২২ থেকে ২৮ ভাগ থাকে হিলিয়াম ও সামান্যকিছু ভারী কণা। বাকি ৭০-৭২ ভাগ থেকে হাইড্রোজেন। মহাকাশের কোনো কোনো অংশে এরূপ বস্তুকণা বিশালাকারের মেঘের জন্ম দেয়। এই মেঘের গ্যাসীয় কণাগুলো মহাকর্ষীয় বল দ্বারা পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থেকে। কখন কখনো এই বস্তুকণাগুলোকে সঙ্কুচিত করতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখে, অতিনবতারার বিস্ফোরণ বা গ্যালাক্সিসমূহের আন্তঃসংঘর্ষ।

আণবিক মেঘ থেকে যখন যখন একবার কোনো নাক্ষত্রিক ভ্রূণের জন্ম হয়, তখন দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত ওই ভ্রূণ
আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুকণাকে আকর্ষণ করে বড় হতে থাকে। শুরুর দিকে প্রতিটি ভ্রূণে নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি। এই শক্তির বলে নক্ষত্রভ্রূণ তার সংগৃহীত গ্যাসের চাপ এবং চৌম্বক চাপকে নিজের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করে। নক্ষত্র সৃষ্টির এই দশাকে বলা হয় প্রাক্-নক্ষত্র (Protostar) প্রাক্-নক্ষত্রের সংগৃহীত গ্যাস নক্ষত্রভ্রূণের কেন্দ্রের দিকে সঙ্কুচিত হতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রমে ক্রমে এই ভ্রূণটি অল্প ভর বিশিষ্ট প্রাক্-নাক্ষত্রিক দশায় পৌঁছায়। সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের জন্য  প্রাক্-নক্ষত্র পর্যায় অতিক্রম করতে প্রায় ১০ লক্ষ বৎসর প্রয়োজন হয়।

প্রাক্-নক্ষত্রের প্রবল আকর্ষণে যখন প্রচুর
গ্যাসীয় পদার্থের সমাবেশ ঘটে, তখন এর মধ্যস্তরে ঘন বস্তুর সমাবেশের কারণে ভ্রূণটি অস্বচ্ছ হয়ে উঠে। এই সময় বস্তুর ঘনত্ব দাঁড়ায় ১০-১৩ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। এই অবস্থায় কেন্দ্রের সংকোচন বন্ধ হয়ে যায় এবং গ্যাস ভ্রূণের অস্বচ্ছ অংশে প্রবেশ করে পাক খেতে থাকে। এর ফলে শকওয়েভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভ্রুণের কেন্দ্রে প্রচুর উত্তাপ সঞ্চালিত হতে থাকে। এই তাপমাত্রা যখন ২০০০ কেলভিনে পৌঁছায় তখন হাইড্রোজেন অণু ভেঙে যায়। ফলে হাইড্রোজেন এবং সেই সাথে হিলিয়াম আয়োনিত হয়ে যায়। এই সময় ভ্রুণ একটি স্থিত দশায় চলে যায়। এর পরেও যদি বাইরে থেকে আগত বস্তুরাশি যদি প্রবেশ করতেই থাকে, তাহলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বাস্তবে নক্ষত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাইরে থেকে বস্তুরাশি প্রবেশ করতেই থাকে এবং ঘনত্ব বাড়তেই থাকে। এই ঘনত্ব দাঁড়ায় ১০-৮ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার-এ পৌঁছায়, তখন তাপ ও চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় এই নাক্ষত্রিক ভ্রূণকে ঘিরে তৈরি হয় নাক্ষত্রিক বলয় তৈরি হয়।

প্রাক্-নক্ষত্রের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ১০
কেলভিন অতিক্রম করে তখন ডিউটেরিয়াম সংশ্লেষণ ঘটা শুরু করে। তবে এই তাপমাত্রা বজায় থাকার জন্য প্রয়োজন হয়ে প্রাক্-নক্ষত্রের ভিতরে বস্তুর ব্যাপক সমাবেশ। সেই কারণে কম ভরের প্রাক্-নক্ষত্রের কেন্দ্রে ডিউটেরিয়াম সংশ্লেষণ শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ হয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন ১০ কেলভিন বা  ১ কোটি কেলভিন তাপমাত্রা। মূলত সৌরভরের .০৮ গুণ কম ভরের মহাকাশীয় গ্যাসপুঞ্জের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ১ কোটি কেলভিনে উন্নীত হতে পারে না। এই কারণে এগুলো নক্ষত্রে পরিণত হয় না। ফলে এরা সঙ্কোচনজনীত তাপ হারিয়ে একসময় শীতল হয়ে যায়। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণজনীত কারণে এই জাতীয় গ্যাসপুঞ্জ জমাটবদ্ধ গোলক হয়ে মহাকাশে বিরাজ করে। এদেরকে সাধারণভাবে বলা হয়- বাদামী বামন (brown dwarf)

 

নক্ষত্রের অপ্রধান ও প্রধান ধারা
নক্ষত্রের প্রধান পরিচয় হলো- এর নিজস্ব আলো ও তাপ আছে। এই বিচারে বাদমী বামন তারাকেও নক্ষত্র বলা হয়। বাস্তবতা হলো বাদমী বামন তারা তার নিভন্ত চুল্লির শক্তি অনুসারে এই তাপ ও আলো প্রদান করে না। এই জাতীয় তারা কখনও যথার্থ নক্ষত্রগুণ লাভ করতে পারে নি। তাই এদেরকে বলা হয় অ-প্রধান ধারার তারা। পক্ষান্তরে যে সকল তারা যথার্থ নক্ষত্র হয়ে আত্মপ্রকাশ করে তাদেরকে প্রধান ধারার নক্ষত্র বলা হয়। ভরের বিচারে প্রধান ধারার তারার সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো- সৌর ভরের বিচারে .০৭৫ গুণ। প্রধান ধারার নক্ষত্রগুলোকে ভরের বিচারে নিম্ন ও উচ্চ মানে ভাগ করা হয়। যে সকল নক্ষত্রের ভর সৌর ভরের ১.৫ গুণের কম হয়, তাদেরকে নিম্নস্তরের প্রধান তারা বলা হয়। আর সৌরভরের  ১.৫ গুণের বেশি ভরের নক্ষত্রকে বলা হয় ভারি তারা।

ভর ছাড়াও প্রধান ধারার তারার প্রকৃতি বিচার করা হয়, আরও কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ধারণ করা হয়, সূর্যকে আদর্শ ধরে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিতরে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়- ভর, ব্যাসার্ধ, উজ্জ্বল্য এবং উপরিতলের  তাপমাত্রা। এই সব বৈশিষ্ট্যানুসারে- নক্ষত্রগুলোকে ৭টি  শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো-
O, B, A, F, G, K M

শুধু ভরের বিচারে নক্ষত্রগুলোকে চারটি সাধারণ ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো-

নক্ষত্র প্রকৃতি ভর ব্যাসার্ধ তাপমাত্রা ঔজ্জ্বল্য উদাহরণ
O6 ৪০ ১৮      
B0 ১৮ ৭.৪      
B5 ৬.৫ ৩.৮      
A0 ৩.২ ২.৫      
A5 ২.১ ১.৭      
F0 ১.৭ ১.৩      
F5 ১.৩ ১.২      
G0 ১.১ ১.০৫      
G2      
G5 ০.৯৩ ০.৯৩      
K0 ০.৭৮ ০.৮৫      
K5 ০.৬৯        
M0 ০.৪৭        
M5 ০.২১        
M8 ০.১৩        


নক্ষত্র সৃষ্টির প্রথম ধাপ

বস্তুপুঞ্জের সঙ্কোচনে (নক্ষত্রের ভ্রূণদশায়) পারস্পরিক সংঘর্ষে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই তাপমাত্রা যখন প্রায় ১ কোটি কেলভিনে উন্নীত হয়, তখন বস্তুপুঞ্জের অভ্যন্তরে নিউক্লীয় বিক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রোটন-প্রোটন চক্র পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম রূপান্তর ঘটে। ২টি হাইড্রোজেন নিউক্লেই 1H (প্রোটন) বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এর ফলে তৈরি হয় দুটি ডিউটেরিয়াম(deuteririum) -এ পরিণত হয়। একই সাথে তৈরি হয় একটি পজিট্রন এবং একটি নিউট্রিনো। নিউট্রিনো মহাকাশে পালিয়ে যায়।
 

1
1
H
 
1
1
H
 
→  2
1
D
 
e+
 
ν
e
 
0.42 MeV

এই পর্যায়ে পজিট্রন এবং ইলেকট্রনের সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। এই শক্তি দুটি গামা রশ্মি ফোটন দ্বারা বাহিত হয়
e
 
e+
 
→  γ  1.02 MeV


দ্বিতীয় ধাপ : প্রথম ধাপে উৎপন্ন
১ ডিউটোরিয়াম আরও একটি সাধারণ হাইড্রোজেনের সাথে মিলিত হয়ে হিলিয়াম (3He)-তে পরিণত হয়। এটি মূলত হিলিয়াম-এর একটি আইসোটোপ। এই সময় আরও তৈরি হয় দুটি প্রোটন এবং ১টি নিউট্রন এবং একই সাথে গামা রশ্মি নির্গত হয়।

2
1
D
 
1
1
H
 
→  3
2
He
 
γ  5.49 MeV

তৃতীয় ধাপ: দ্বিতীয় ধাপে উৎপন্ন হিলিয়াম (3He)-এর সাথে একটি হাইড্রোজেন  নিউক্লেই 1H (প্রোটোন) যুক্ত হয়ে হিলিয়াম (4He) উৎপন্ন করে। সব মিলিয়ে ৪টি হাইড্রোজনে মিলিত হয়ে হিলিয়াম (4He) তৈরি হয়। এই মিলনের ফলে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা হলো-

41H → 4He + 2e+ + 2γ + 2νe (26.7 MeV)

প্রকৃত পক্ষে এই পর্যায়ে একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই জাতীয় নক্ষত্রকে প্রধান ধারার নক্ষত্র বলা হয়। উল্লেখ্য আমাদের সূর্য প্রধান ধারার নক্ষত্রের একটি উদাহরণ। প্রধান ধারার নক্ষত্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির প্রক্রিয়ায় যে সকল উপাদান তৈরি হয়, তা পর্যায়ক্রমে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু নিউট্রিনো কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না, তাই এই কণা সূর্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। মূলত এই নিউট্রিনোর পরিমাণ থেকে এই জাতীয় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ঘটিত বিক্রিয়ার হার সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

১. যে সকল নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের সাধারণত ০.০৭৫ গুণ হয়ে থাকে। এরা লাল বামন তারা (red dwarf star) তে পরিণত হয়। এই নক্ষত্রগুলো শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করে।

২.
যে সকল নক্ষত্রের
ভর সৌরভরের ০.৫ থেকে ১০ গুণ বেশি, তাদের কেন্দ্রের হিলিয়াম প্রজ্জ্বলিত হওয়ার পূর্বে এদের বাইরের হাইড্রোজেন স্তর জ্বলে উঠে এবং একটি লাল দানব তারা (red giant star)-য় পরিণত হয়। এই শ্রেণির নক্ষত্রের উল্লেখযোগ্য নমুনা হলো- আর্দ্রা (Betelgeuse)

লাল দানব তারা থেকে উৎপন্ন নক্ষত্র সমূহ
যে সকল নক্ষত্রের ভর সৌরভরের ০.৫ থেকে ৩০ গুণ বেশি, তাদের কেন্দ্রের হিলিয়াম প্রজ্জ্বলিত হওয়ার পূর্বে এদের বাইরের হাইড্রোজেন স্তর জ্বলে উঠে, সে নক্ষত্রগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে লাল দানব তারা (red giant star) বলা হয়।

লাল দানব তারার অভ্যন্তরভাগ অতি সঙ্কোচনের কারণে, যখন এর আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১০ এবং ঘনত্বের পরিমাণ ১০ গ্রাম/বর্গ সেন্টিমিটার হয়, তখন নক্ষত্রের ভিতরে জমে থাকা হিলিয়ামের দহন শুরু হয়। প্রথাবস্থায় হিলিয়াম সংযোজিত হয়ে লিথিয়াম পরে রেলিয়াম-৮ তৈরি করে।
4He + 4He + 92 keV → 8*Be

এরপর বেরিলিয়াম-৮ এর সাথে আরও একটি হিলিয়াম-এর সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি হয় কার্বন-১২ তৈরি করে। এই অবস্থায় হিলিয়াম ঝলক (helium flash)- এর সৃষ্টি হয়

4He + 8*Be + 67 keV → 12*C

সব মিলিয়ে চূড়ান্ত বিষয়টি দাঁড়ায়-

34He → 12C + γ + 7.2 MeV

হিলিয়াম দহন শেষে নক্ষত্রটি শ্বেত বামন (white dwarf)  নক্ষত্রে পরিণত হয়।

প্রধান ধারার নক্ষত্রের ভরের উপর নক্ষত্রের বিবর্তনের প্রকৃতি নির্ভর করে। যদি কোনো নক্ষত্রের মোট ভর সূর্যের ১.৪৪ গুণের সমান বা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে ওই নক্ষত্র শ্বেত বামন (
white dwarf) তারায় পরিণতি হয় [চন্দ্রশেখর সীমা সূত্রানুসারে]। তবে কিছু অল্প ঘনত্বের লাল দানব তারার হিলিয়াম ঝলক-এর সময় বিপুল পরিমাণ তেজ নক্ষত্রের বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণের ফলে ওই তেজ আবার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই তেজের নির্গমণ এবং অভ্যন্তরে গমনের প্রক্রিয়াটি একটি সুষম সময় অনুসরণ করে ঘটতে থাকে। ফলে এক ধরনের স্পন্দনের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় নক্ষত্রটিকে বলা হয় শেফালি বিষমতারা (cepheid Variable star)আবার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে হিলিয়াম থেকে কার্বন তৈরির সময় যখন তাপমাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, তখন নক্ষত্রের বহিরাংশের কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তা বলয়াকারে মূল নক্ষত্রকে ঘিরে থাকে। এই অবস্থায় ওই নক্ষত্রকে বলা হয় গ্রহান্বিত নীহারিকা (Planetary nebula)

সূর্যের ১.৪৪ গুণের সমান বা তার চেয়ে কম বা ভরের শ্বেত বামন নক্ষত্রগুলোর মাধ্যাকর্ষণজনিত সঙ্কোচন এক সময় বন্ধ হয়ে যায় এবং অভ্যন্তরে তাপ ক্রমে ক্রমে হ্রাস পায়। একসময় তাপ ও আলোপ্রদানের ক্ষমতা হারিয়ে এই নক্ষত্রগুলো মৃত্যবরণ করে। এই অবস্থায় এই মৃত নক্ষত্রগুলো কালো বর্ণ ধারণ করে। এই অবস্থায় এই নক্ষত্রগুলোকে কৃষ্ণবামন (
black dwarf) বলা হয়। এই নক্ষত্রের কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায় না। সম্ভবত মহাজাগতিক অন্ধকারে এই নক্ষত্র মিশে থাকার জন্য, এই নক্ষত্রকে শনাক্ত করা যায় নাই। তবে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস করা হয়, এই নক্ষত্রের অস্তিত্ব আছে।

 

সূর্যের চেয়ে ভারি নক্ষত্রের বিবর্তনের ধারা

সূর্যের ১.৪৪ গুণের সমান বা তার কম ভরের নক্ষত্রের শেষ দশা বড় জোর কৃষ্ণ বামন তারা হতে পারে। কিন্তু সূর্যের ১.৪৪ গুণের বেশি হলে- নক্ষত্রে পরিবর্তন ঘটতে থাকে নানা ভাবে। সূর্যের ১.৪৪ গুণের বেশি ভর বিশিষ্ট নক্ষত্রের বাইরের স্তরের উপরিভাগে জমে থাকা গ্যাসে থাকে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং কার্বন। এই ৩টি উপাদান দুটি স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। এর কেন্দ্রে জমা হয় কার্বন। আর বাইরের স্তরে থাকে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম। এই অবস্থায় নক্ষত্রের কেন্দ্রে কোনো বিক্রিয়া ঘটে না। নক্ষত্র ক্রমাগত সঙ্কুচিত হওয়ার সাথে সাথে এর কেন্দ্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হতে থাকে। নক্ষত্রের কেন্দ্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে, দুটি ঘটনা হতে পারে। ঘটনা দুটি হলো

    ১. কেন্দ্রীয় বিক্রিয়ার সূত্রপাত
    ‌২. অতি-নবতারা হিসাবে বিস্ফোরিত হওয়া।

 

যে সমস্ত নক্ষত্রের ভর সূর্যের চেয়ে বেশি কিন্তু তা সূর্যের চেয়ে ৩ গুণ ভারি, তাদের নতুন জীবন শুরু হয়, নতুন পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। উপরের আলোচিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ভারি নক্ষত্রগুলো তাদের সঞ্চিত হাইড্রোজেন পুড়িয়ে প্রথমে শ্বেত বামন তারায় পরিণত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়েও হতে পারে না কারণ, কেন্দ্রের কার্বনের সঞ্চয় পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে, নক্ষত্রটি কার্বন তারা (Carbon star)-য় পরিণত হয়। এরপর কেন্দ্রের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির জন্য, এক সময় কার্বন দহন শুরু হয়। ফলে ভারি নক্ষত্রের আবার নতুন জীবন শুরু হয়।।


কার্বন দহন প্রক্রিয়া (
Carbon-burning process)

কার্বন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে যখন কার্বনের ঘনত্ব  > 3×109 kg/m3 হয় এবং ক্রম সঙ্কোচনের কারণে এর অভ্যন্তরের তাপমাত্রার প্রায় 5×108 K or 50 keV -এ উন্নীত হয়, তখন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে কার্বনের দহন শুরু হয় এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। কার্বন-১২ পুড়ে তৈরি হয় অক্সিজেন-১৬।

12
6


C
 
+ 4
2

He

16
8

O

+ γ (+7.162 MeV)

 

এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় নিওন (Ne), সোডিয়াম (Na), ম্যাগনেশিয়াম (Mg)। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হতে পারে ম্যাগনেশিয়াম এবং অক্সিজেন।  নিচে এই বিক্রিয়াগুলো দেখানো হলো

12
6
C
 
12
6
C
 
→ 
20
10
Ne
 
4
2
He
 
4.617 MeV
12
6
C
 
12
6
C
 
→ 
23
11
Na
 
1
1
H
 
2.241 MeV
12
6
C
 
12
6
C
 
→ 
23
12
Mg
 
−  2.599 MeV

বিকল্পে

12
6
C
 
12
6
C
 
→ 
24
12
Mg
 
γ 
13.933 MeV
12
6
C
 
12
6
C
 
→ 
16
8
O
 
4
2
He
 
−   0.113 MeV

কার্বন দহনের শেষ  অক্সিজেন, নিওন (Ne), সোডিয়াম (Na), ম্যাগনেশিয়াম (Mg) এর ভারি কণা নক্ষত্রের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে। ফলে এই কণাগুলো ক্রমান্বয়ে শীতল হয়ে মৃত নক্ষত্রে পরিণত হয়।
 

নিওন দহন প্রক্রিয়া (Neon-burning process)
কার্বন দহনের শেষে নক্ষত্রের কেন্দ্রে জমা হয় অক্সিজেন, নিওন , সোডিয়াম ম্যাগনেশিয়াম। এই সময় নক্ষত্রের সংকোচনের ফলে এর অভ্যন্তরে বস্তুর ঘনত্ব এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই দুটি উপাদানের বৃদ্ধির ফলে নিওন দহন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর জন্য তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় 1.2×109 K or 100 KeV এবং ঘনত্বের প্রয়োজন হয় 4×109 kg/m। এই অবস্থায় নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রথমে নিওন গামা রশ্মি ত্যাগ করে হিলিয়াম তৈরি করে। পরে এই হিলিয়ামের সাথে নিওন বিক্রিয়া করে ম্যাগনেশিয়াম তৈরি করে। নিচে বিক্রিয়াটি দেখানো হলো।

20
10
Ne
 
γ 
→ 
16
8
O
 
4
2
He
20
10
Ne
 
4
2
He
 
→ 
24
12
Mg
 
γ

আবার নিওন-২০ এর সাথে নিউট্রোন যুক্ত হয়ে নিওন-২১ তৈরি করে। পুনরায়  নিওন-২১-এর সাথে হিলিয়াম-৪ যুক্ত হয়ে তৈরি হয় ম্যাগনেশিয়াম-২৪। নিচে বিক্রিয়াটি দেখানো হলো।

20
10
Ne
 
→ 
21
10
Ne
 
γ
21
10
Ne
 
4
2
He
 
→ 
24
12
Mg
 
n

অক্সিজেন দহন প্রক্রিয়া (Oxigen-burning process)
নিওন দহনের ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্রে জমা হয় অক্সিজেন এবং ম্যাগনেশিয়াম। এর কেন্দ্রের ঘনত্ব যখন
1010 kg/m3 হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে 1.5×109 K বা 130 keV  উন্নীত হয়, তখন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে অক্সিজেনের দহন শুরু হয়।  এই নতুন বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হবে সিলিকন।

16
8
O
 
16
8
O
 
→  28
14
Si
 
4
2
He
 
9.594 MeV
      →  31
15
P
 
1
1
H
 
7.678 MeV
      →  31
16
S
 
n  1.500 MeV
      →  30
14
Si
 
1
1
H
 
0.381 MeV
      →  30
15
P
 
2
1
D
 
2.409 MeV

বিকল্পে

      →  32
16
S
 
γ
      →  24
12
Mg
 
4
2
He

সিলিকন দহন প্রক্রিয়া (Silicon-burning process)
নক্ষত্রের
 অভ্যন্তরের তাপমাত্রা যখন ২.৭-৩.৫
×106 K-এ উন্নীত হয়, তখন সিলিকনের দহন শুরু হয়। এই পর্যায়ে সিলিকনের সাথে হিলিয়াম যুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে তৈরি হতে থাকে, গন্ধক, আর্সেনিক, ক্যালসিয়াম, টাইটেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, লৌহ।

28
14
Si
 
4
2
He
 
→ 
32
16
S
32
16
S
 
4
2
He
 
→ 
36
18
Ar
36
18
Ar
 
4
2
He
 
→ 
40
20
Ca
40
20
Ca
 
4
2
He
 
→ 
44
22
Ti
44
22
Ti
 
4
2
He
 
→ 
48
24
Cr
48
24
Cr
 
4
2
He
 
→ 
52
26
Fe

ক্রোমিয়াম-এর দহন শেষে তৈরি হয় লৌহ-৫২। কিন্তু এই লৌহ অচিরেই হিলিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে নিকেল-৫৬ তৈরি করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র ১ দিনে।

52
26
Fe
 
4
2
He
 
→ 
56
28
Ni

নিকেল-৫৬- এর অর্ধ জীবন মাত্র ৬.০২ দিন। এটি বিটা রশ্মি নির্গত হয় কোবাল্ট-৫৬। এর নতুন অর্ধ-জীবন ৭৭.৩ দিন। এই সময় পার হয়ে কোবাল্ট-৫৬ পরিবর্তিত হয় লৌহ-৫৬। এর পরে নিকেলের সাথে হিলিয়াম বিক্রিয়া করে কিছু দ্স্তাও তৈরি হয়। কিন্তু কেন্দ্রে লৌহ বেশি পরিমাণে জমা হয়।

56
28
Ni
 
4
2
He
 
→ 
60
30
Zn

সিলিকন থেকে দস্তা তৈরির পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর পর, এক সময় নক্ষত্রের শক্তি শেষ হয়ে যায়। নতুন কোনো বিক্রিয়া করার মতো তাপ না থাকায়, নক্ষত্রটি একসময় লৌহ সমৃদ্ধ একটি নক্ষত্রে পরিণত হয়।

লৌহ সমৃদ্ধ নক্ষত্রের পরিণতি
লৌহ সমৃদ্ধ নক্ষত্রের ভিতরে আর নতুন কোনো চুল্লি জ্বলে উঠে না। ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্রে অসম্ভব চাপের সৃষ্টি হয়। এই প্রবল চাপ নক্ষত্রটি ধরে রাখতে পারে না। ফলে এক সময় নক্ষত্রটি নিজের অভ্যন্তরীণ চাপেই বিস্ফোরিত হয়। নক্ষত্রের এই দশাকে অতি-নবতারা বলা হয়। এর ফলে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে।
  • সূর্যের চেয়ে ২ বা ৩ গুণ ভারি নক্ষত্রগুলো এই বিস্ফোরণের পর লৌহসমৃদ্ধ নক্ষত্রটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হবে।
  • লৌহ নক্ষত্রের ভর যখন ৩ গুণের চেয়ে বেশ ভারি হবে, তখন তা কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবে। ১৩৬০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে এরূপ একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল আমাদের ছায়াপথ নামক গ্যালাক্সি।

সূত্র :
তারা পরিচিত। মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশান। ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪
বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান বিশ্বকোষ।
১-৫ খণ্ড।

http://en.wikipedia.org/wiki/
contemporary Astronomy/ Jay M. Pasachoff 2nd edition
A Brief history of time / Stephen Hawking
Essays about Univesre/Boris A. Vorontrov-Vel'Yaminov/Mir Pulishers Moscow/1985