বাংলা লিপি
ইংরেজি : bangla
script


বাংলা ভাষার নিজস্ব লেখন পদ্ধতির নাম বিশেষ। এই লিপি প্রধানত বাংলাঅসমীয়া ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে ধাকে। অবশ্য বাংলা ভাষার জন্য ব্যবহৃত লিপির সাথে অসমীয়া ভাষার বাংলা লিপির দুটি ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। এই লিপি দুটি হলো

               
বাংলা র = অসমীয়া ৰ
                অসমীয়া ৱ -এর সমতূল্য কোনো বাংলা বর্ণ নেই। 

এই দুটি ভাষা ছাড়াও অসমীয়া, মণিপুরি, চাকমা ইত্যাদি আদিবাসীদের ভাষার লিখন পদ্ধতিতে এই লিপি ব্যবহৃত হয়। এই লিপি ডান থেকে বামে অনুভূমিক নির্দেশে লেখা হয়। লিখন পদ্ধতির বিচারে বাংলা লিপি
আবুগিদা 

ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে বাংলা লিপির ইতিহাস নিয়ে কেউ তেমন উচ্চাবাচ্য করেন নি। এই বিষয়ে প্রথম গবেষণা শুরু করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তিনি তাঁর  '
Origin of the Bengali script' গ্রন্থে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর এই ব্যাখ্য প্রায় সবাই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে মহাস্থানগড় থেকে ব্রহ্মীলিপিতে লেখা শিলালিপি উদ্ধার হলে, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ব্যাখ্যা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। এই সূত্রে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রমোদলাল পাল ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়ার্টার জার্নালে 'The Development of the Bengali script' শিরোনামে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে একই জার্নালে এনএস চক্রবর্তী প্রকাশ করেন  'The Origin and Development of the Bengali script' শিরোনামে আরও একটি প্রবন্ধ। এই বছরেই ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে জেমস্ প্রিন্সেপ (James Prinsep) অশোকের শিলালিপি নিয়ে গবেষণার সূত্রে,  ব্রাহ্মীলিপি'র ধারণা দেন। এরপর তিনি বেশকিছু প্রাচীন লিপি থেকে পাঠোদ্ধারে সক্ষম হন।   

সম্রাট অশোক যখন তাঁর কথা জন-সাধারণের মধ্যে প্রচারে জন্য, পাথরের লিখার ব্যবস্থা করেন, তখন ভারতবর্ষে খরোষ্ঠীলিপি
ব্রাহ্মীলিপি'র ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। এর ভিতরে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল খরোষ্ঠীলিপি, পক্ষান্তরে মধ্যভারত থেকে পূর্ব-ভারত জুড়ে প্রচলিত ছিল ব্রাহ্মীলিপি। পাকিস্তানের 'শাহবাগচহি' ও 'মানসেবা'য় অশোকের দুটি অনুশাসন লিপিতে খরোষ্ঠীলিপি লিপির ব্যবহার দেখা যায়। এই দুটি অনুশাসন লিপি ছাড়া অশোকের বাকি সব অনুশাসন লিপিই  ব্রাহ্মীলিপিতে উৎকীর্ণ । কিন্তু বঙ্গদেশে খরোষ্ঠীলিপির প্রচলন একেবারেই ছিল না, একথা বলা যায় না। বাংলায় প্রাপ্ত কুষাণ স্বর্ণমুদ্রায়, পশ্চিমবঙ্গের বেড়াচাঁপা ও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পোড়ামাটির সিল ও মৃৎপাত্রে খরোষ্ঠী লিপির নমুনা পাওয়া গেছে। তারপরেও বলা যায়, বাংলালিপি সৃষ্টির ক্ষেত্রে খরোষ্ঠী লিপির কোনো প্রভাব নেই।

 

ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে নেপালের তরাই অঞ্চলের পিপ্রাবা থেকে। ধারণা করা হয়, এই লিপিটি গৌতম বুদ্ধ -এর নির্বাণকালের (৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কিছু পরে। এই লিপির উৎকর্ষরূপ পাওয়া যায় ব্রাহ্মীবর্ণমালায় লিখিত সম্রাট অশোক -এর শিলালিপি থেকে। এরপর ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষের লোকেরা ব্রাহ্মীলিপি পড়তে ভুলে যায়। কথিত আছে, দিল্লির সুলতান ফিরিজশাহ তুঘলক অশোকের শিলালিপি পাঠ করার জন্য, বেশকিছু শিলালিপি দিল্লীতে এনেছিলেন। কিন্তু সুলতানের লিপি গবেষকরা এর পাঠোদ্ধার করতে পারেন নি।

বিস্তীর্ণ ভারত
বর্ষে এই লিপি প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন স্থানের লিপিকারদের হাতে এই লিপি নানা রূপ লাভ করেছিল।  খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ব্রাহ্মীলিপি ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন লিপির সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গদেশে এই লিপি অল্পবিস্তর প্রচলিত ছিল।  এ পর্যন্ত বঙ্গদেশে ৯টি ব্রাহ্মীলিপির নমুনা পাওয়া গেছে। এর ভিতরে ৮টি পাওয়া গেছে উত্তরবঙ্গে আর ১টি পাওয়া গেছে দক্ষিণ বঙ্গে। ধারণা করা এই লিপিটি  মৌর্য যুগের শেষে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০-১৮৫ অব্দ) লেখা হয়েছিল।

মৌর্যবংশের রাজত্বের শেষের দিকে একাধিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এদের ভিতরে মগধে শুঙ্গ বংশীয়রা প্রতিষ্ঠিত হলেও, মগধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজবংশ (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ থেকে ১৯৬ খ্রিষ্টাব্দ) স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এর ভিতরে স্বল্প সময়ের জন্য কান্ব রাজবংশ (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩-২৮ অব্দ)-এর শাসনকাল পাওয়া যায়। এই সময় দেশীয় রাজাদের কোন্দলের ফলে, ভারতে একক শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠিত হয় নি। এই সুযোগে বিদেশীরা ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক, শক, পহ্লব, কুষাণ। এদের ভিতরে কুষাণ আমলে ব্রাহ্মীলিপি সামান্য পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ধারাকে কুষাণলিপি নামে অভিহিত করা হয়। এই পরিবর্তনের সময়কাল ধরা হয়, ১০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ।

দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন ও উত্তর আর্যাবর্তে কুষাণ সাম্রাজ্য পতনের পর খ্রিষ্টীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে গুপ্তরাজবংশীয় রাজগণ ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রীগুপ্ত (২৪০-২৮০ খ্রিষ্টাব্দ) -কে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। পূর্বভারতে কুষাণলিপির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলে (২৪০ থেকে ৫১০ খ্রিষ্টাব্দ)। এই যুগে প্রাকৃত ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয়। এর ফলে সংস্কৃত ভাষার চর্চা বৃদ্ধি পায়। এই সময় থেকে প্রস্তরলিপির অবসান ঘটে। নতুন প্রযুক্তিতে তাম্রলিপির প্রচলন হয়। তামার পাত হাল্কা এবং বহনযোগ্য বলে, এই লিখন পদ্ধতির ফলে গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগারের সূচনা ঘটায়। এছাড়া ভুর্জপত্র ও তালপত্রে লেখার সূচনাও এই সময় ঘটে। ফলে আগের আমলের পাথরে গায়ে লেখার কারণে যে রূপ লিপিশৈলী ছিল, এই যুগে লেখার মাধ্যমের কারণে বেশ পরিবর্তিত হয়েছিল। এই সময় কুষাণলিপি লিপিকারদের হাতে নানা রূপ লাভ করতে থাকে।

 

গুপ্তোত্তর যুগে বঙ্গদেশে গুপ্তলিপির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল গুপ্তোত্তর স্বাধীন রাজ্য বঙ্গ গৌড় (৫১০ থেকে ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এ। এরপর এই ধারা চলতে থেকে শশাঙ্ক (৬০৬ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) -এর রাজত্বকালেও। বঙ্গদেশে প্রাপ্ত এই সময়ের লিপির নমুনা পাওয়া যায়, মেদেনীপুরে প্রাপ্ত শশাঙ্কের তাম্রলিপিতে এবং ফরিদপুরে প্রাপ্ত ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব ও গোপচন্দ্রের তাম্রলিপিতে। এই সময় গুপ্তলিপির সরলাকার রেখাগুলো বক্র হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে গাঙ্গেয় সমভূমিতে এর বক্ররূপের বিকাশ ঘটে সর্বাধিক। লিপি-বিজ্ঞানীরা এই বিশেষ প্রকৃতির কুটিল (বক্র অর্থে) বর্ণশৈলী অনুসারে এর নাম করেন 'কুটিললিপি'। এই কুটিললিপির প্রভাব ভারতবর্ষে প্রায় সকল অঞ্চলেই প্রভাব ফেলেছিল। কুটিললিপির বক্রতার সাথে অতিরিক্ত রেখা যুক্ত হয়ে বাংলা লিপির আদি রূপ দৈরি হয়েছিল রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) আমলে। লিপিবিজ্ঞানীরা এই স্তরের লিপিকে বলে থাকেন 'আদি নাগরি লিপি'। এই আদি নাগরি লিপি থেকে আদি বাংলা লিপির উদ্ভব হয়, পাল রাজবংশের বিগ্রহ পাল (৮৫৫-৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) নারায়ণ পাল (৮৫৪-৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ)-এর রাজত্বকালে। আদি বাংলা লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় কম্বোজ রাজ ন্যায়পাল দেবের ইরদা দানপত্রে এবং প্রথম মহিপালের বানগড় লিপিতে।

খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীর শেষদিকে আদি বাংলা বর্ণ লিপি স্বতন্ত্ররূপ লাভ করতে থাকে। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকের শেষে বা দ্বাদশ শতকের গোরার দিকে খোদাই করা বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপিতে বিভিন্ন বর্ণের আরও বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । এছাড়া কয়টি লিপিতে বাংলা লিপির পুরানো নিদর্শন মেলে। যেমন

খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতকের দিকে বাংলা বর্ণামলা বঙ্গদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যায় এই লিপি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিষ্টীয় ১৩ শতক থেকে উড়িষ্যায় স্বতন্ত্রভাবে লিপি বিকশিত হয়। মূলত এই সময়েই বাংলা লিপি থেকে উড়িয়া লিপি পৃথক হয়ে যায় । খ্রিষ্টীয় ১৩-১৫ শতক পর্যন্ত বঙ্গদেশ, আসাম, ত্রিপুরায় বাংলা লিপি একই ছিল। খ্রিষ্টীয় ১৬ শতকের দিকে বাংলা লিপির সাথে র বর্ণের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া এর আসামি লিপিতে অসমীয়া ৱ লিপি যুক্ত হয়। এরপর থেকে বাংলা লিপি বাংলা ভাষাভাষীদের নিজস্ব লিপিতে পরিণত হয়। 

একনজরে বাংলা লিপির ধারা

চর্যাগীতি  ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লেখা হয়েছিল যে লিপিতে, তার লিখিত রূপ পাওয়া গেলেও, পুরো বাংলা বর্ণমালার নমুনা পাওয়া যায় নি। ১২শ-১৩শ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী সময়ের লিপি চর্যাগীতি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ পাওয়া যায়অবশ্য বিভিন্ন লিপিকারদের হাতে এই বর্ণটির হেরফের ঘটায়, কোন বর্ণটি আদর্শ ছিল তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না তবে মোটামুটিভাবে এ ক্ষেত্রে যে রূপটিকে ধরা যেতে পারে তা নিচের ছকে দেখানো হল।

 

সম্ভবত এই সময়ে বাংলা ব্যাকরণ রচনায় কেউ হাত দেন নি। যদিও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সংস্কৃত ভাষা মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পণ্ডিতরা নিজেদের ভাষাকে ব্যাখ্যা করতেন সংস্কৃত ব্যাকরণানুসারে এবং তাঁর দেবানাগরীর বর্ণমালা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন।

এই সকল প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের বানানরীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল বিবিধ কারণে এই কারণগুলোকে আমরা যেভাবে নির্দেশিত করতে পারি, তা হলো-

চ +চ=চ্চ, চ +ছ্= চ্ছ

কিন্তু কিছু কিছু যুক্তধ্বনি এমন প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, যেগুলো থেকে মূল বর্ণের সন্ধান পাওয়া সম্ভব ছিল না যেমন- ক+ষ=ক্ষ, ঞ +চ =ঞ্চ, হ +ম=হ্ম ইত্যাদি  অবশ্য এই চিহ্নগুলোর চেহারা বর্তমানের চিহ্নগুলোর মতো ছিল না। অবশ্য এই যুক্তবর্ণ সৃষ্টিতে দেবনাগরী লিপির বিশেষ ভূমিকা ছিল।

                        চর্যাগীতি              আধুনিক বাংলা

    চীএ                   চিত্ত

    মহাসুহ                মহাসুখ

 

এই জাতীয় প্রাচীন শব্দের ব্যবহার বর্তমানে নেই তাই এই বানানে লিখার রীতিও উক্ত শব্দগুলোর সাথে সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে


বাংলা ফন্ট ও লিপির প্রাথমিক আদর্শরূপ 

এক সময় মুদ্রণজগতে কঠিন পদার্থ দিয়ে বর্ণ প্রকাশের যে উপকরণ তৈরি হতো তাকে সাধারণভাবে ফন্ট বলা হতো। এর সাথে একালের কম্পিউটারে মুদ্রণোপযোগী বর্ণচিহ্ন (character) আদি কালের ফন্টের সাথে মেলানো যায় না। মূলত প্রতিটি বর্ণের রয়েছে নিজস্ব অবয়ব। মুদ্রণজগতে প্রতিটি বর্ণকে শুধু অবয়ব দিয়ে বিচার করা হয় না। এর সাথে বিবেচনা করা হয়, এর আকার, অবয়ব শৈলী। ধরা যাক একালে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বাংলা ফন্ট 'SolaimanLipi'। এটি বাংলা বর্ণমালার একটি ফন্ট।

সে কালের ফন্ট বস্তু হিসেবে বহন করা যেতো, একটি দুটি বা পুরো বর্ণমালার সেট ক্রয় করে মুদ্রণযন্ত্রে ব্যবহার করা যেতো। তাই একালের লিপি বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করে থাকেন অস্থাবর 
 

ষোড়শ শতকে পর্তুগীজ মিশনারিরা বাংলাদেশে ধর্মপ্রচার করতে এসে- ধর্ম প্রচারের জন্য পর্তুগীজ বাংলা শব্দকোষ নামক একটি অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন এটিই হলো প্রাচীনতম দ্বিভাষিক বাংলা অভিধান ঢাকার পর্তুগীজ মিশনারীদের অধ্যক্ষ মানোয়েল দ্য আসাসুম্পসাঁও (Manoel da Assumpcao) রোমান অক্ষরে সর্বপ্রথম বাংলা থেকে বাংলা অভিধান রচনা করেছিলেন এর নাম ছিল ‘Vocabulario em idioms Bengala e Partuguez, dividedo em duas parts’ তখনও এদেশে মুদ্রণযন্ত্রের জন্য কোন বাংলা হরফ তৈরি হয় নি এই কারণে, এই বইটি মুদ্রিত হয়েছিল রোমান হরফে উল্লেখ্য বইটি ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে লিসবন শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই বইটির গুরুত্ব অসমান্য হলেও- বইটি বাংলা হরফে মুদ্রিত না হওয়ার কারণে, বাংলা বর্ণমালায় এর কোনো প্রভাব পড়ে নি    
The Evolution of the Printed Bengali Character from 1978 to 1978/ Fiona Georgina Elisabeth Ross/Proquest LLC (2017)

 নাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের A Grammar of the Bengal Language) নামক গ্রন্থ মুদ্রিত বাংলা বর্ণমালা

বাংলাবর্ণের মুদ্রিতরূপের গোড়া পত্তন ঘটেছিল ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের ( (১৭৫১-১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ) A Grammar of the Bengal Language নামক গ্রন্থের মাধ্যমে এই গ্রন্থের চতুর্থ পাতায় বাংলা বর্ণমালার একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬টি। এই তালিকায় অ-এর সাথে অনুস্বর ও বিসর্গ ছিল। কিন্তু পৃথক চন্দ্রবিন্দু ছিল না। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। এতে ড়, ঢ়, য় ছিল না।

এই গ্রন্থের জন্যই প্রথম তৈরি করা হয়েছিল ঢালাই করা ধাতব বাংলা ফন্ট উল্লেখ্য এই ফন্টের জন্য ছাঁচ তৈরি করেছিলেন উইলকিনস এবং পঞ্চানন কর্মকার এই ফন্টের সাহায্যে মুদ্রিত বাংলা বর্ণ একটি আদর্শ রূপ লাভ করেছিল বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রকাশকদের হাতে এর রূপ পাল্টে গিয়েছিল বিবিধভাবে মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে বাংলা সরল বর্ণগুলোর আকারে যতটা হেরফের ঘটেছিল, তার চেয়ে বেশি হেরফের ঘটেছিল যুক্তবর্ণের ক্ষেত্রে তখন লেখকরা যা লিখতেন, প্রকাশকরা সে লিখাকে প্রকাশের সময় ধাতব ফন্টের নকশাতে প্রায়ই পরিবর্তন করতেন ফলে, লেখকের বানান ও প্রকাশকের ফন্ট মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন একটি মিশ্র বানানরীতির সৃষ্টি করেছিল

 

নাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণের শব্দ লিখিত হয়েছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতিনীতি অনুসারে উল্লেখ্য, এর আগে বাংলা শব্দ লিখা হতো উচ্চারণ অনুসারে হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত-প্রেমীদের তৃপ্ত করেছিল কিন্তু সেকালের যে সকল বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সংস্কৃতের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে, বাংলাকে পৃথক ভাষা হিসাবে উপস্থাপন করার কথা ভাবতেন, তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেন নি এই টান-পোড়নে বাংলা বানানরীতি বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলেছিল বহুদিন ধরে অবশ্য, বাংলা বর্ণে বই প্রকাশিত হচ্ছে, এই আনন্দে প্রথম দিকে বাঙালিরা উদ্বেলিত ছিলেন আবার বিশৃঙ্খল বানান রীতির কারণে শিক্ষিত মানুষেরা ধীরে ধীরে হতাশ হয়েও পড়েছিলেন বাংলা বানানরীতির এই অরাজকতা থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়-ঊনিশ শতকে এই সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বাংলা বানানরীতির পরিবর্তনে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে- হাতে-কলমে কাজে নেমে পড়েন

 

 

এরপর বাংলা বর্ণামালার বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি পূর্বে প্রচলিত বাংলা বর্ণমালায় কিছু বর্ণ বাদ দিয়ে, কিছু বর্ণ যুক্ত করে, নতুন ভাবে সাজালেন।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর 'বর্ণপরিচয়' প্রথম ভাগ-এ বর্ণমালার এই বিন্যাস সম্পর্কে 'বিজ্ঞাপন' অংশে জানালেন

'বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ প্রচারিত হইল। বহূকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ কার ও দীর্ঘ কারের প্রয়োজন নাই; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এজন্য, ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা হইয়াছে। ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদের মধ্য অথবা অন্তে থাকিলে ড়, ঢ়, য় হয়। ইহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ের পরস্পরের ভেদ আছে, তখন উহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই উচিত; এই নিমিত্ত,  উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ক ও ষ মিলিয়া ক্ষ হয়, সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ; এজন্য, অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।'

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগে যেভাবে বাংলা বর্ণমালাকে সাজিয়েছিলেন, তার হলো

স্বরবর্ণ (১২টি): অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৯, এ, ঐ, ও ঔ।
ব্যঞ্জনবর্ণ (৪০টি): ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, ব, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়, ং, ৎ, ঃ, ঁ।

বিদ্যাসাগরের এই সংস্কার অনুসারে বাংলা বর্ণমালা এই সজ্জায় ছিল বহুদিন। কিন্তু বাংলা বর্ণের উল্লিখিত সকল বর্ণ থাকা উচিৎ কিনা, তা নিয়ে গুঞ্জন ছিল সে সময়েও। তা ক্রমে ক্রমে প্রকট হয়ে উঠলে, ধীরে ধীরে সংস্কার করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সংস্কারের আগে থেকেই বাংলা ভাষার লেখকরা স্বরবর্ণের '৯' বর্ণটি ব্যবহার বাদ দিয়েছিলেন। ফলে স্বরবর্ণ ১১টিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। এর বাইরে অন্তস্থ ব এবং ৎ নিয়ে অনেকদিন তর্ক থাকলেও অন্তস্থ ব এবং ৎ বাংলা বর্ণমালা থেকে বাদ পড়ে যায়। এর ফলে বর্তমানে বাংলা বর্ণামালার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯টি।

আধুনিক বাংলা বর্ণমালা

সংস্কৃত ভাষার বর্ণবিন্যাসের আদলে বাংলা বর্ণমালা স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সেটে বিভক্ত। স্বরবর্ণের সেটে রয়েছে ১১টি বর্ণ। এগুলো হলো , , , , , , , , , , এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সেটে রয়েছে ৩৮টি বর্ণ। এগুলো হলো
 

ক-বর্গ :        ৫টি
চ-বর্গ : ৫টি
ট-বর্গ :       ৫টি
ত-বর্গ :     ৫টি
প-বর্গ :   ৫টি
অন্তঃস্থ ধ্বনি   ৪টি
উষ্ম-ধ্বনি :   ৪টি
তাড়নজাত :  ড় ঢ় ২টি
পরাশ্রয়ী ং ঃ ঁ  ৩টি
 

মোট

৩৮টি

 

বাংলা লিখন পদ্ধতিতে উল্লিখিত বর্ণগুলো ছাড়াও আরও কিছু চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এর ভিতরে রয়েছে স্বরবর্ণের কারচিহ্ন এবং যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের চিহ্ন।
দেখুন:


সূত্র :