'... সেদিন সকালেও ট্রেতে আমার চা এসেছে। সেই কয়েদী ওভারসীয়ারটি আমায় বলল যে 'টি-পটের তলাটা একবার দেখে নিবেন। টি-পট্‌টা তুলতেই দেখতে পেলাম যে একখানা পত্র চাপা আছে,- নজরুলের পত্র। লিখেছে, আমার কথা সে সব শুনেছে। আমি বহরমপুর বদলী হতে পারি না? তার পরে লিখেছে তার সময় ভালোই কাটছে। শ্রীপূর্ণ দাস (মাদারীপুরের) একখানা নাটক লিখে দেওয়ার জন্যে তাকে অনুরোধ করেছেন। তাই লিখছে সে তখন। শ্রীপূর্ণ দাস বাইরে গিয়ে একটি চারণ দল গঠন করবেন। সেই চারণ দলের অভিনয়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন নাটকখানার। নজরুলের এই নাটক লিখিত হয়েছিল, তার পাণ্ডুলিপি জেল হতে বাইরে নিরাপদে পৌঁছেও গিয়েছিল, কিন্তু তার পরে নাকি পাণ্ডুলিপিখানা হারিয়ে যায়। নজরুল ইসলামের একটা সৃষ্টি এইভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।'

• জাতের নামে বজ্জাতি সব [জাতের বজ্জাতি] [তথ্য]
  ব্রহ্মমোহন ঠাকুর তাঁর 'নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা গ্রন্থে' গানটির 'রচনার স্থান ও কাল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন-'বহরমপুর জেলে ১৯২৩ সালের ১৮ই জুন থেকে ২০ জুলাই-এর মধ্যে লেখা'।

জুলাই ১৯২৩ (১৬ আষাঢ়- ১৫ শ্রাবণ ১৩৩০)
এই মাসে নজরুল যথারীতি বহরমপুরে জেলে ছিলেন। জেলের উন্নততর খাবার ও পরিবেশে নজরুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটেছিল। এই সময় তাঁর রচিত ও প্রকাশিত ২টি কবিতার কথা জানা যায়। কবিতাটি হলো-

• ইন্দু-প্রয়াণ। ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] কবিতাটি ' ইন্দু-প্রয়াণ' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর সাথে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- 'বহরমপুর জেল শ্রাবণ, ১৩৩০। উল্লেখ্য, কবি শরদিন্দু রায়ের অকালমৃত্যু উপলক্ষে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন।
• অভিশাপ কবিতাটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। কল্লোল পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩০ সংখ্যায় 'অভিশাপ' শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। দোলন-চাঁপার প্রথম সংস্করণ [আশ্বিন ১৩৩০ বঙ্গাব্দ (আগষ্ট ১৯২৪) কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

এই মাসে প্রকাশিত গান একমাত্র গান ছিল-

• জাতের নামে বজ্জাতি সব [জাতের বজ্জাতি] [তথ্য]
  গানটি তিনটি পত্রিকায় প্রকাশতি হয়েছিল। পত্রিকাগুলো হলো-

  ১. বিজলী। ৪ঠা শ্রাবণ ১৩৩০ (২০ জুলাই ১৯২৩) সংখ্যা। শিরোনাম 'জাত জালিয়াত'।
  ২. বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা  শ্রাবণ ১৩৩০ (আগষ্ট ১৯২৩)
  ৩. উপাসনা শ্রাবণ ১৩৩০ (আগষ্ট ১৯২৩)।

অক্টোবর ১৯২৩ (১৪ আশ্বিন- ১৪ কার্তিক ১৩৩০)
এই মাসে নজরুল যথারীতি বহরমপুরে জেলে ছিলেন। এই সময় দুর্গা পূজা উপলক্ষে নজরুল একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এই নাটকটি জেলের কয়েদদের নিয়ে অভিনীত হয়েছিল। নজরুল নিজেও নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন। এই নাটকটির সন্ধান পাওয়া যায় নি।

দোলন চাঁপা
১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে (অক্টোবর ১৯২৩) মাসে 'দোলন-চাঁপা' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর প্রকাশক ছিলেন শ্রী শরচ্চন্দ্র গুহ, বি, এ, আর্য পাবলিশিং হাউস, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা।  মুদ্রক রজনীকান্ত রাণা, চেরী প্রেস লিমিটেড, ৯৩/১এ বহুবাজার স্ট্রিট, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৬৫৪। মূল্য এক টাকা চার আনা।

দোলন চাঁপা'র প্রথম সংস্করণে মোট ২১টি কবিতা ও গান স্থান পেয়েছিল। নিচে  রচনাগুলোর প্রথম প্রকাশের সময়-সহ বর্ণানুক্রমিক তালিকা দেওয়া হলো-

1. অবেলার ডাক। প্রবাসী পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০ সংখ্যায় 'অবেলার ডাক' শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। [পৃষ্ঠা: ১৭৯-১৮২]
2. অভিশাপ। কল্লোল পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩০ সংখ্যায় 'অভিশাপ' শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
3. আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। কল্লোল পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাব্যের মুখবন্ধরূপে যুক্ত হয়েছিল।
4. আশা [গান। আমি শ্রান্ত হয়ে আস্‌ব যখন [তথ্য]
5. আশান্বিতা। কল্লোল পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩০ সংখ্যায় 'আশান্বিতা' শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
6. উপেক্ষিত। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
7. কবি-রানি। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
8. চপল সাথী । কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
9. দোদুল দুল্। প্রবাসী চৈত্র ১৩২৯। শিরোনাম: দোদুল্ দুল। শিরোনামের নিচে লেখা ছিল- '[আরবী "মোতাকারিব" ছন্দ] [পৃষ্ঠা: ৮৬৩-৮৬৪]।
10. বেলাশেষে। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
11. পউষ । প্রবাসী পত্রিকার 'পৌষ ১৩২৯' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম: 'পউষ'। [পৃষ্ঠা ৩৩৪] [গান: পউষ এলো গো! [তথ্য]
12. পথহারা। প্রবাসী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩২৯ সংখ্যায় 'পথহারা' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। [পৃষ্ঠ: ২৭৭]  [গান: বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে [তথ্য]]
13. পিছু-ডাক। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
14. পুবের চাতক। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
15. পূজারিণী। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
16. ব্যথা-গরব। বসুমতী পত্রিকার চৈত্র ১৩২৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
17. মুখরা। কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
18. শেষ প্রার্থনা। প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল। [গান: আজ চোখের জলে প্রার্থনা মোর [তথ্য]
19. সমর্পণ। ভারতী পত্রিকার চৈত্র ১৩২৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
20. সাধের ভিখারিনী। [গান: তুমি মলিন-বাসে থাক যখন [তথ্য]
21. সে যে চাতকই জানে
কবিতাটি প্রথম দোলন-চাঁপা গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।

এই ২১টি কবিতার ভিতরে নজরুল দুটি ৪টি কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন। কিম্বা গান হিসেবেই রচনা করেছিলেন। এই গানগুলো দোলনচাঁপাতেই প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। গানগুলো হলো-

• গান
  • আজ চোখের জলে প্রার্থনা মোর [তথ্য]
    দোলন চাঁপা'র শিরোনাম শেষ প্রার্থনা।
  • আমি শ্রান্ত হয়ে আস্‌ব যখন [তথ্য]
    দোলন চাঁপা'র শিরোনাম আশা।
  • তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কব [তথ্য]
    দোলন চাঁপা'র শিরোনাম কবি-রানি।
  • তুমি মলিন-বাসে থাক যখন [তথ্য]
    দোলন চাঁপা'র শিরোনাম সাধের ভিখারিনী।

এই মাসে (মতান্তরে নভেম্বর) বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস কারামুক্ত হন। এই ঘটনা উপলক্ষে নজরুল রচনা করেছিলেন 'পূর্ণ-অভিনন্দন' শীর্ষক একটি গান। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে (শ্রাবণ ১৩৩১) প্রকাশিত ভাঙার গান গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

• পূর্ণ-অভিনন্দন [এসো অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র!]  [তথ্য]

নভেম্বর ১৯২৩  (১৫ কার্তিক- ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৩০)
এই মাসে বেশ নজরুল বহরমপুর জেলে বেশ হইহুল্লোড় করে অন্যান্য রাজবন্দীদের নিয়ে মেতে ছিলেন। এই সময় নজরুলের রচিত একটি কবিতার কথা জানা যায়। কবিতটি হলো-

• আলতা-স্মৃতি: ছায়ানট কাব্যে অন্তর্ভুক্ত এই কবিতাটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে 'বহরমপুর জেল/অগ্রহায়ণ ১৩৩১'। সম্ভবত তারিখটি হবে অগ্রহায়ণ/১৩৩০।

• মরমী। বরিশাল। আশ্বিন ১৩২৭।  মোসলেম ভারত পত্রিকার 'ফাল্গুন ১৩২৭' (ফেব্রুয়ারি ১৯২১) সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিল।  'কোন মরমীর মরম ব্যথায়' এর স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৩০ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২৩) সংখ্যায়।

এই মাসে রচিত রচনা

• আলতা-স্মৃতি: কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকার 'পৌষ ১৩৩০' সংখ্যায়। ছায়ানট কাব্যে অন্তর্ভুক্ত এই কবিতাটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে 'বহরমপুর জেল/অগ্রহায়ণ ১৩৩১'। সম্ভবত তারিখটি হবে অগ্রহায়ণ/১৩৩০।

জানুয়ারি (১৬ পৌষ-১৭ মাঘ ১৩৩০)
কুমিল্লা থেকে ফিরে আসার পর, নজরুলকে কারাবিধি ভঙ্গের মামলায় ৯ জানুয়ারি (বুধবার, ২৪ পৌষ ১৩৩০) পুনরায় আদালতে হাজির হতে হয়।  মামলা পরবর্তী তারিখ দেওয়া হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। কারামুক্তি এবং কারাবিধির মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও কুমিল্লার ঘটনার কারণে নজরুল মানসিক ভাবে স্বস্তিতে ছিলেন না। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানেও যোগ দেওয়ার কোনো সংবাদও পাওয়া যায় না। এই মাসে নজরুলের রচিত বা প্রকাশিত কোনো রচনার সন্ধান পাওয়া যায় না।

ফেব্রুয়ারি ১৯২৪ (১৮ মাঘ- ১৭ ফাল্গুন ১৩৩০)
৭ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার, ২৪ মাঘ ১৩৩০), আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলে, নজরুল এই মামলা থেকে মুক্তি পান। এই সময় কুড়িগ্রামের মাহফুজুর রহমান তাঁকে কুড়িগ্রাম যাওয়ার আমন্ত্রণ করেন। মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য কুড়িগ্রাম যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন।

কুড়িগ্রামে নজরুল
কুড়িগ্রামের হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত ঐক্যের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। মাহফুজুর রহমানের রচিত 'কুড়িগ্রামে কবি নজরুল ও নজরুলের সন্নিধান' প্রবন্ধ [সূত্র: নজরুল-স্মৃতিচারণ। রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত। পৃ: ১৬৩-২১০] থেকে জানা যায়, প্রায় একই সে সময় কুড়িগ্রামে প্রতিবৎসর হিন্দু ছাত্রদের সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হতো স্কুল প্রাঙ্গণে আর মুসলমান ছাত্রদের বাৎসরিক মিলাদ মহফিল হতো বোর্ডিং হাউসের নিকটবর্তী কাচারী সংলগ্ন কাচারি সংলগ্ন জুমা মসজিদে। স্কুলের প্রধান  শিক্ষক ইন্দুভূষণ রায়ের তত্ত্ববধানে উভয় আয়োজন হতো। এর জন পূজা ও মিলাদ মহফিলের জন্য দুটি পৃথক কমিটি হতো। সাধারণত সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানের পরের দিন মিলাদ মাহফিল হতো।  বাৎসরিক অনুষ্ঠানে সে সময়ের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা আমন্ত্রিত হতেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে আগে মিলাদ মাহফিলে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় ছিলেন- ড, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, স্যার আজিজুল হক, গারাডোবের পাদ্রী, জমিরউদ্দীন বিদ্যাবিনোদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন 'বিদ্রোহী' কবিতার স্রষ্টা হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম।

• ১৫ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার, ৩ ফাল্গুন ১৩৩০), নজরুল কলকাতা থেকে দার্জিলিং মেল ধরে রাত ৩টায় পার্বতীপুর স্টেশনে পৌঁছান। তারিখের বিচারে তা ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি।
   
• ১৬ ফেব্রুয়ারি (শনিবার,১১ ফাল্গুন ১৩৩০),  রাত ৩টায় পার্বতীপুর স্টেশন থেকে মাহফুজুর রহমান খান এবং তাঁর সাথিরা নজরুলকে সাথে নিয়ে কুচবিহারগামী মিটারগেজ রেলগাড়িতে রওনা দেন। রংপুর স্টেশনে গাড়িটি পৌঁছেছিলো ভোর বেলা। এরপর এঁরা তিস্তা জংশনে পৌঁছান এবং সেখান থেকে গাড়ি বদল করে থেকে ন্যারোগেজের ট্রেনে কুড়িগ্রামে পৌঁছান। ওই দিনই কুড়িগ্রাম হাইস্কুলের বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন।
  
  কথা ছিল এই মিলাদ মাহফিলের পর নজরুল কলকাতায় ফিরে যাবেন। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের অনুরোধে পরের দিন অপর একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে রাজি হয়ে কুড়িগ্রামে থেকে যান।
   
• ১৭ ফেব্রুয়ারি (রবিবার, ৫ ফাল্গুন ১৩৩০), নজরুল কুড়িগ্রাম শহরের বাজার এলাকায় আয়োজিত পূর্বনির্ধারিত জনসভায় কংগ্রেসের আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। এই জনসভা হয়েছিল বিকাল ৪টায়। এই অনুষ্ঠানে জনতার অনুরোধে তাঁর রচিত কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। এরপর স্থানীয় ছাত্রদের সাথে সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে মত-বিনিময় করেন। এই আলোচনা সভা শেষে তিনি কলকাতার উদ্দেশ্যে‌ রওনা দেন।
   
• ১৮ ফেব্রুয়ারি (সোমবার, ৬ ফাল্গুন ১৩৩০),কলকাতায় ফিরে এই দিনই দিলীপ কুমার রায়  ইউরোপ গমন উপলক্ষে রচনা করেন 'সুর-কুমার নামক কবিতা।
   
• সুরকুমার। কবিতা। ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)]-এ গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- কলিকাতা/৪ ফাল্গুন, ১৩৩৩।

২৩ ফেব্রুয়ারি (শনিবার, ১১ ফাল্গুন ১৩৩০)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদেনীপুর শাখার একাদশতম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য নজরুল মেদিনীপুর যান। নজরুল মেদেনীপুরে চারদিন ছিলেন। এই সময় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদেনীপুর শাখার পক্ষ থেকে এবং মেদনীপুরের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

• মেদেনীপুরের প্রথম দিন [২৩ ফেব্রুয়ারি (শনিবার, ১১ ফাল্গুন ১৩৩০)]। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদেনীপুর শাখার একাদশতম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল মেদেনীপুর কলেজ প্রাঙ্গণে। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. নরেন্দ্রনাথ লাহা। এদিন সন্ধ্যায় ক্ষীরোদাপ্রসাদের রচিত 'প্রতাপাদিত্য' নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল।। এই অনুষ্ঠানে নজরুল অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
• মেদেনীপুরের দ্বিতীয় দিন [২৪ ফেব্রুয়ারি (রবিবার, ১২ ফাল্গুন ১৩৩০)] এই দিন সকালের অধিবেশনে পরিষদের পক্ষ থেকে নলিনী পণ্ডিতের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিকালের অধিবেশনে পরিষদের পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলকে অভিনন্দন জানিয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ভাষণ দেন। প্রত্যুত্তরে নজরুল কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
• মেদেনীপুরের তৃতীয় দিন [২৫ ফেব্রুয়ারি (সোমবার, ১৩ ফাল্গুন ১৩৩০)। মেদিনীপুরের নারীরা মেদেনীপুর কলেজে নজরুলে পৃথকভাবে সংবর্ধনা দেন বিকেল বেলা। সন্ধ্যায় মেদেনীপুর বাংলা স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় শহরের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নজরুলকে অভিনন্দন জানানো হয়।
• মেদেনীপুরের চতুর্থ দিন [২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার, ১৪ ফাল্গুন ১৩৩০)। মেদেনীপুর ঈদগাহ মাঠে স্থানীয় মাওলানারা নজরুলকে সংবর্ধনা দেন এবং কোরান পাঠ করে, তাঁকে আশীর্বাদ করেন।

• রৌদ্র-দগ্ধের গান। ছায়ানট কাব্যে অন্তর্ভুক্ত এই কবিতাটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে- 'সমস্তিপুরের ট্রেন-পথে ফাল্গুন ১৩৩০'।

• বিদায়-মাভৈঃ। ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] কবিতাটি ' বিদায়-মাভৈঃ' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর সাথে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- 'কলিকাতা/চৈত্র ১৩৩০'।

'সংবাদপত্র পাঠে জানিতে পারিলাম যে, বাঙ্গালার নবযুগের তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাহেবের সহিত জনৈক বিদুষী সম্ভ্রান্ত হিন্দু মহিলার শুভ-বিবাহ স্থির হইয়াছে।'

এই সংবাদ থেকে অনুমান করা যায় যে, সংবাদটি কিছু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৬ এপ্রিল (বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৩৩১) নজরুলের বন্ধু নলিনাক্ষ সান্যালের বিয়ে থেকে একরকম বিতারিত হয়ে, কলকতায় ফিরে আসেন এবং বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সমস্ত আয়োজন শেষে নজরুল সমস্তিপুরে যান এবং  গিরিবালা দেবী ও আশালতা'কে সাথে নিয়ে কলকাতার অদূরে বালীগ্রামে, ড, অবনী চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে থাকা ৬ নম্বর হাজী লেনের একটি বাড়ি ভাড়া করা বাসায় ওঠেন।

এই সময় এই বিবাহে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস মাসুদা রহমান। তিনি এই বিবাহের সকল আর্থিক সমস্যা মিটিয়েছিলেন। এছাড়া এই বিবাহে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সে কারণে তিনি তাঁর প্রভাব কাটিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, শ্রীরামপুরের সাবরেজিস্ট্রার কাজী মাহমুদ-উর-রহমানের স্ত্রী, সরকারি উকিল খান বাহাদুর মাজাহারুল আনোয়ারের কন্যা। এছাড়া লেখিকা হিসেবে তাঁর খ্যাতিও পেয়েছিলেন।

এই বিবাহের প্রধান সমস্যাগুলো ছিলো-

• হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিবাহের সামাজিক ও পারিবারিক বাধা। এই বিবাহে নজরুলের পারিবারিক বাধা ছিল না। ধর্মীয় কারণেও মুসলমান সম্প্রদায়েরও সম্মতি ছিল। মুসলমানদের অনেকে উৎসাহী ছিলেন যে, নজরুল হিন্দু কন্যাকে বিবাহ করে তাঁকে ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানাবেন। অবশ্য গোঁড়া মুসলমানদের সে আশা পূর্ণ হয় নি। এই বিবাহের পর আশালতা এবং তাঁর মা গিরিবালা নিষ্ঠার সাথে হিন্দুধর্মেকে মান্য ও অনুসরণ করেছেন। অন্যদিকে গিরিবালা ও আশালতার পূর্ণ সমর্থনে বিবাহ হয়েছিল এবং এঁদেরকে পারিবারিক ও সামাজিক তীব্র বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। পারিবারিকভাবে কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারের সবাই এই বিবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। বিরজাসুন্দরী এই বিবাহ বন্ধ করার জন্য কলকাতায় এসে আশালতা এবং গিরিবালাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু গিরিবালার দৃঢ়তার মুখে বিরজাসুন্দরী ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। এই বিবাহে প্রবলভাবে বাধা দিয়েছিলেন আশালতার খুড়ততো ভাই বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত। এই বিবাহের বিরোধিতা করে বৈকালী পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করেছিলেন। সামাজিকভাবে এই বিবাহে অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর বাইরে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী সরলা দেবী বাধা দিয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজেই পারাবরিক বাধা অগ্রাহ্য করে- ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর [১৮ আশ্বিন ১৩১২ বঙ্গাব্দ]  ডাঃ পেয়ার মলকে বিবাহ করেছিলেন এবং বিবাহের পর তিনি স্বামীর সাথে পাঞ্জাবে চলে যান।
   
• নজরুল-আশালতার বিবাহের আইনগত বাধা ছিল। প্রথম বাধাটি আসে বিবাহরীতি নিয়ে। পাত্র-পাত্রী মুসলমান এবং হিন্দু হওয়ায় বিবাহটা কোন রীতিতে হবে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের অবসান হতে পারতো, যদি আশালতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন। কিন্তু নজরুল সেটা চান নি। ফলে প্রথাগতভাবে হিন্দু বা ইসলামী রীতিতে বিবাহটা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এই বিতর্ক এড়ানোর অপর একটি উপায় ছিল রাষ্ট্রীয় 'সিভিল ম্যারেজ' বিধানে। এই বিধানে বিবাহ হওয়াটা অসম্ভব ছিল, কারণ আশালতার বয়স তখনও ১৮ বৎসর পূর্ণ হয় নি। এই দুই বিধিতে বিবাহ অসম্ভব হয়ে পড়লে, আহলুল কিতাব অনুসারীদের বিবাহ বিধির আশ্রয় নেওয়া হয়। এই বিধিতে আসমানী কিতাবধারীদের মধ্যে প্রচলিত ধর্মাচারীদের বিধি অনুসারে বিবাহ হতে পারে। পরে নজরুল এবং উপস্থিত মুসলমানরা হিন্দু ধর্মকে আসমানী কিতাবধারীদের অনুরূপ বিবেচনা করে বিবাহ-রীতি অনুসরণ করা হয়। এককথায় ইসলামী রীতিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। এই বিবাহের কাজীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন, মঈনউদ্দীন হুসায়েন। সাক্ষী হয়েছিলেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন এবং অন্য একজন ব্যক্তি।