কাজী নজরুল ইসলামের
২১ বৎসর অতিক্রান্ত বয়স
 ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (সোমবার ২৪শে মে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ২০ বৎসর বয়স পূর্ণ হয়েছিল। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার ২৫শে মে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) ২১ বৎসরের সূচনা হয়। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার ২৪শে মে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) ২১ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল।


গত বছরের শেষদিন পর্যন্ত কলকাতার ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র অফিসঘর ছিল নজরুলের বাসস্থান। নজরুলের ২১ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শুরু হয়েছিল এই অফিস ঘরেই। লেখালেখির সূত্রে যৎসামান্য প্রাপ্তিই ছিল তাঁর একমাত্র উপার্জনের উৎস। তাঁর বসবাসের জন্য ঘর ভাড়া দিতে হতো না বলে, কিছুটা স্বস্তি ছিল।

২১ বৎসর বয়সের নজরুল

জুন ১৯২০ (১৮জ্যৈষ্ঠ-১৬ আষাঢ় ১৩২৭)।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস থেকে নজরুল তাঁর নিয়মিত কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাফিজের কবিতা অবলম্বনে গান রচনা করা শুরু করেছিলেন। এই সূত্রে রচিত প্রথম গানটি ছিল-'দুঃখ কি ভাই হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিব ফিরে'। গানটি সম্পর্কে আগের ২০ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। গানটি ' মোসলেম ভারত ' পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭ (জুন-জুলাই ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। গানটি ছিল নজরুলের সঙ্গীতজীবনের দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয়। জুন মাসের শুরু থেকেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র অফিসঘর তথা নজরুলের তৎকালীন বাসস্থানে আগের মতো জমজমাট সাহিত্য-আড্ডা অব্যাহত ছিল। এরই ভিতরে মোসলেম ভারত, বকুল, অঙ্কুর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১টি গান, ২টি কবিতা, ১টি গল্প ও ১টি প্রবন্ধ। এগুলো হলো-

জুলাই ১৯২০ (১৭ আষাঢ়-১৫ শ্রাবণ ১৩২৭)
নবযুগ ও নজরুল
কাজী নজরুল ইসলাম  ও রাজনীতিবিদ কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ যুগ্ম সম্পাদনায় নবযুগ পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই, কলকাতার ৬ নম্বর টার্ন স্ট্রিট থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। উল্লেখ্য, ফজলুল হক নিজ অর্থে এই পত্রিকাটি প্রকাশ করছিলেন। তবে পত্রিকাটিতে সম্পাদকের নাম থাকার বদলে ফজলুল হকের নাম থাকতো পরিচালকের হিসেবে।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের প্রথম দিকে, ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটস্থ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র অফিসঘরে থাকতেন কাজী নজরুল ইসলামমুজাফ্ফর আহমদ। এঁরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে নিজেদের মতো একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা ভেবেছিলেন। সে সময়ে এঁদের প্রধান পরামর্শক ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক ওয়াজিদ আলী। এছাড়া সিলেট নিবাসী ফজলুল হক শেলবর্ষী ও মঈনুদ্দীন হোসাইন এই পত্রিকার পরামর্শ ছিলেন।

একই সময়ে ফজলুল হক তাঁর কৃষক-প্রজা পার্টি'র মুখপত্র হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা এই সময়ে ভাবছিলেন। ফজলুল হকের সমস্যা ছিল পত্রিকা পরিচালনা এবং লেখার জন্য উপযুক্ত লেখকের অভাব। এই অবস্থায়  ফজলুল হক, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের শরণাপন্ন হন এবং ফজলুল হক তাঁকে ২২ নম্বর টার্নার স্ট্রিটের বাসভবনে মোজাম্মেল হককে ডেকে পাঠান। এই সময় তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশের সম্পাদনা এবং অন্যান্য বিষয়ের জন্য উপযুক্ত লোকের অভাবের কথা মোজাম্মেল হককেবলেন। এই আলোচনায় মোজাম্মেল হক পত্রিকার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম, মুজাফ্ফর আহমদ-সহ আরও কিছু লোকের কথা বলেন। এরপর এঁদের সবাইকে নিয়ে ফজলুল হক একটি সভা ডাকেন।

ফজলুল হক তাঁর ২২ নম্বর টার্নার স্ট্রিটের বাসভবনে নতুন পত্রিকার জন্য আলোচনা সভায় উপস্থিত হন কাজী নজরুল ইসলাম, মুজাফ্ফর আহমদ, মোজাম্মেল হক, নবনূর পত্রিকার প্রাক্তন ম্যানেজার উমেদ আলী মিয়া, নূর লাইব্রেরির মালিক মঈনুদ্দীন হোসাইন, সিলেট নিবাসী ফজলুল হক শেলবর্ষী ও করুণা বাঁশদোহার। মোজাম্মেল হক ছাড়া বাকি ছয় জনকে সম্পাদক পদে নেওয়া হয়েছিল। এঁদের প্রত্যেকের বেতন নির্ধারিত হয়েছিল মাসিক ৬০ টাকা। উল্লেখ্য, ওয়াজিদ আলী'র নামে পত্রিকার ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছিল।

এই আলোচনা শেষে পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হয় কাজী নজরুল ইসলামমুজাফ্ফর আহমদকে। প্রথম পত্রিকার নাম নির্বাচন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। শেষপর্যন্ত নজরুলের প্রস্তাব অনুযায়ী পত্রিকার নাম রাখা হয় 'নবযুগ'।

এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য তিনি একটি প্রেস কিনেছিলেন। তবে এই প্রেসটি পত্রিকা প্রকাশের উপযোগী ছিল না। তাই ফজলুল হক অনেক টাকা করে প্রেসটিকে পত্রিকা প্রকাশের উপযুক্ত করে তোলেন।  এই সময় লেখক ও সাংবাদিক ওয়াজিদ আলী ব্যক্তিগত সমস্যা দেখিয়ে এই পত্রিকার সংশ্রব ত্যাগ করেন। তবে তিনি তাঁর নামে পত্রিকার ছাড়পত্র গ্রহণে আপত্তি করেন নি।

পত্রিকা প্রকাশের বড় অসুবিধা ছিল সংবাদসমূহ পত্রিকার উপযোগী বাংলা ভাষায় লেখা। এরূপ লেখায় ফজলুল হক অভ্যস্ত ছিলেন না। এই সমস্যা অন্যান্য সম্পাদকদেরও ছিল। এই কারণে সে সময়ে সম্পাদকীয় লেখার জন্য সে সময়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ভাবা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত  ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই, কলকাতার ৬ নম্বর টার্ন স্ট্রিট থেকে কাজী নজরুল ইসলামমুজাফ্ফর আহমদের পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়েছিল। তবে সম্পাদক হিসেবে এঁদের নাম পত্রিকায় থাকতো না। কিন্তু প্রধান পরিচালক হিসেবে ফজলুল হকের নাম ছাপ হতো।

সে সময়ে সংবাদপত্রের জন্য সংবাদ লেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। তা সত্তেও নজরুলের সংবাদ তৈরির কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং নজরুলের সংবাদ লেখন এবং শিরোনামের গুণে পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তবে এই পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের লেখা সম্পাদকীয় সরকারে রুদ্র রোষে পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা ও গণজাগরণ-বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হওয়ার জন্য, ব্রিটিশ সরকার পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার সতর্ক করে দেয়।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলনের পক্ষে এবং ব্রিটিশ বিরোধী লেখা প্রকাশের জন্য ' নবযুগ পত্রিকা' জামানত বাতিল হয়ে যায়। পরে ফজলুল হক জামানতের দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু এর কিছুদিন পর ফজলুল হকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে কাজী নজরুল ইসলামমুজাফ্ফর আহমদ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে এক বছরের মধ্যে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এই পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়গুলো নজরুলের যুগবাণী নামক প্রবন্ধ-গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যে সকল রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো-

নবযুগ' পত্রিকার সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত থাকলেও এই সময়ের ভিতরে নজরুলের ১টি গান ১টি কবিতা এবং ২টি গল্প বিভিন্ন পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় (জুলাই) মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো- আগষ্ট ১৯২০ (১৬ শ্রাবণ- ১৫ ভাদ্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
১লা আগষ্ট (রবিবার ১৬ শ্রাবণ ১৩২৭ ) ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক মৃত্যুবরণ করেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় নজরুল নবযুগ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এই সময় কলকাতায় বাল গঙ্গাধর তিলক-এর মৃত্যুতে স্বদেশীদের কাছে পরম বেদনার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। তারই স্মরণে রচনা করেছিলেন।
'লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য (স্মৃতি) '। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর (কার্তিক ১৩২৯)মাসে প্রকাশিত যুগবাণী প্রবন্ধ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
মোসলেম ভারত পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৭ সংখ্যায় (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর), কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের কবিতার প্রশংসা করেন এবং পত্রিকার সম্পাদককে একটি পত্র লেখেন। পরে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলের সাথে মোহিতলাল মজুমদারের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আগষ্ট মাসের শেষের দিকে বা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমভাগে। এই সময় মোহিতলাল নেবুতলার ক্যালকাটা হাইস্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন।  এই সময় নজরুলের সাথে অন্যান্যদের আড্ডা হতো ৩২, কলেজ স্ট্রিটে, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের গজেন ঘোষের সাহিত্যের আসরে। এছাড়া নজরুল এই সময় বিভিন্ন আসরে গান গাওয়ার জন্যও যেতেন। এই মাসে নজরুলের ৩টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।

নবযুগ প্রকাশের পর জুলাই মাসের শেষের দিকের '' বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিস থেকে নজরুল ইসলাম ও মোজাফ্ফর আহমদ মার্কুইস লেনের একটি বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। তবে এই বাসাটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ছিল। তাই সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে নজরুল ও মুজাফ্ফর আহমদ ৬ টার্নার স্ট্রিটে নবযুগ অফিসের কাছে একটি একতলা পাকা বাড়িতে চলে আসেন। অবশ্য এই সময় '' বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসের সাহিত্য-আড্ডায় তাঁদের নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল। এই আড্ডায় যাঁরা প্রায় নিয়মিত যোগ দিতেন- নজরুল ইসলাম, মোজাফ্ফর আহমদ, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শশাঙ্কমোহন সেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।

এই মাসে পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা
সেপ্টেম্বর ১৯২০ (১৬ ভাদ্র- ১৪ আশ্বিন ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলনের পক্ষে এবং ব্রিটিশ বিরোধী লেখা প্রকাশের জন্য 'নবযুগ পত্রিকা' জামানত বাতিল হয়ে যায়। পরে ফজলুল হক জামানতের দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রে নজরুল কংগ্রেসের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। 'নবযুগ' পত্রিকার জামানত বাতিলের কারণে, কংগ্রেসের প্রতি নজরুল সে অনুরক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছিলে। ইতিমধ্যে প্রচারিত হয়েছিল যে, কংগ্রেসের  ৩৭তম অধিবেশন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে। এই অধিবেশনে উপস্থিত থাকার জন্য, সাংবাদিক হিসেবে যোগদানের উদ্যোগ নেন। ৪-৫ সেপ্টেম্বর (সোম-মঙ্গল, ১৯-২০ ভাদ্র ১৩২৭) কলকাতায় কংগ্রেসের এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।  এই অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন লালা লাজপৎ রায়। অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীজহরলাল নেহেরু উপস্থিত ছিলেন। নজরুল ও মুজাফ্ফর আহমদ নবযুগের প্রতিনিধি হিসেবে এই অধিবেশনে  যোগদান করেছিলেন।

নবযুগ প্রকাশিত হওয়ার পর নজরুল, মুজাফ্ফর আহমদ-সহ কয়েকজনের সাথে ' বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র সার্বক্ষণিক সম্পর্কের ব্যাঘাত ঘটেছিল। এই সূত্রে  নজরুল ও মুজাফ্ফর আহমদ সমিতির ভবনে না-থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তাঁরা নতুন বাসস্থানের সন্ধান করা শুরু করেন। এবং শেষ পর্যন্ত মার্কুইস লেনের একটি বাড়িতে উঠেছিলেন। এখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে  মুজাফ্ফর আহমদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর এঁরা কয়েকদিনের জন্য নবযুগ পত্রিকার অফিসের ( ৮, টার্নার স্ট্রিটের বাসায়) কাটিয়েছিলেন। এরপর নবযুগ পত্রিকার কাছেই ৮/এ, টার্নার স্ট্রিটের বাসায় এঁরা উঠে আসেন। এই বাড়িতে থাকার সময় নজরুল সহজাত গুণে বস্তির নানা জনের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। প্রসঙ্গে, মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থের লিখেছেন-
'...জামিন বাজেয়াপ্ত হওয়ায় 'নবযুগ' তখন সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। আমর! তাই কয়েকদিন 'নবযুগ' আফিসেও (৬, টার্নার স্ট্রীটে) ছিলেম। তারপরে আমরা যে-বাড়ীটি ভাড়া নিয়েছিলেম তার কিছু বর্ণনা এখানে না দিলেই নয়। বাড়ীটির নম্বর ছিল ৮/এ, টার্নার, 'নবযুগ' আফিস হতে মাত্র এক-দু? মিনিটের পথ দূরে। টার্নার স্ট্রীটের এখন নাম নওয়াব আবদুর রহমান স্ট্রীট। অন্ধকার বাই লেনের ভিতরে একটি খোলার বস্তীর মধ্যেখানে ছিল ৮/এ নম্বরের ছোট্ট একতলা পাকা বাড়ীটি। তখনকার দিনে ভাড়া ছিল মাসিক দশ টাকার কিছু কম। বাড়ীটিতে জলের কল, পায়খানা, রান্নাঘর ইত্যাদি সবই ছিল। খানিকটা উঠোনও ছিল বাড়ীতে। বস্তিটি ছিল মুসলমানদের। বয়স্কা মহিলাদের মধ্যে নজরুল তো খালা (মাসী) পাতিয়ে নিল। যাঁর গায়ের রং ফরস৷ছিল তাঁকে সে রাঙা খালা ডাকত । এই খালারা মাঝে মাঝে আমাদের খাওয়ার সময়ে তাঁদের রান্নাকরা তরকারিও আমাদের দিয়ে যেতেন।'
এই বাড়িতে থাকার সময় সে সময়ের অনেক সাহিত্যিক সাংবাদিকরা আড্ডা দেওয়ার জন্য আসতেন। এছাড়া আড্ডা দেওয়ার জন্য নজরুলও  ' বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসে যেতেন। এই মাসে নজরুলের ২টি কবিতা ও ১টি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। অক্টোবর ১৯২০ (১৫ আশ্বিন- ১৫ কার্তিক ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে দুর্গাপূজা উপলক্ষে নবযুগ পত্রিকার অফিস ছুটি হয়ে যায়। এই ছুটি কাটানোর জন্য অক্টোবরের ১-২ তারিখে (রবি-সোম, ১৫-১৬ আশ্বিন)  নজরুল এবং মুজাফ্ফর আহমদ বরিশালে শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের ভাগ্নে ওয়াজির আলী ও ইউসুফ আলীর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময়  আবুল কাশেম ফজলুল হক ও বরিশালে ছিলেন। নজরুল এবং মুজাফ্ফর আহমদ বরিশালে দু'দিন কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এই সময় নজরুল ৪টি গান রচনা করেন। এই ৪টি গান হলো-

গান:
নজরুল এবং মুজাফ্ফর আহমদ বরিশাল থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন অক্টোবর মাসে ৩ তারিখে (মঙ্গল, ১৭ আশ্বিন ১৩২৭)। বাকি সময় তিনি 'নবযুগ' পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান।

এই মাসে নতুন ১টি গান এবং ২টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়া পূর্বে রচিত ১টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো- নভেম্বর ১৯২০ (১৬ কার্তিক-১৫ অগ্রহায়ণ ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
নজরুল বরিশাল থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর তিনি ৩টি গান ও ৩টি কবিতা রচনা করেন। এগুলো হলো-

ডিসেম্বর ১৯২০ (১৬ অগ্রহায়ণ-১৬ পৌষ ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনা এবং সমসাময়িক নানাবিধ কারণে নজরুল বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সম্ভবত পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ফজলুল হকের সাথে তাঁর কিছুটা মতানৈক্য ঘটেছিল। এই অবস্থা থেকে নজরুলকে কিছুদিন কলকাতার বাইরে থাকার পরমার্শ দেন ' মোসলেম ভারত' পত্রিকার পরিচালক আফজাল-উল হক। তাঁদের পরামর্শে নজরুল অগ্রহায়ণ (ডিসেম্বর) মাসের দিকে কলকাতা ত্যাগ করে দেওঘর যান। উল্লেখ্য, দেওঘর বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশের দেওঘর জেলার জেলাসদর। সে সময়ে দেওঘর ছিল সাঁওতাল পরগণার অংশ। দেওঘরে থাকার ব্যবস্থা হিসেবে 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার পরিচালক আফ্‌জালুল হক, নজরুলের সাথে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুসারে নজরুল দেওঘরে যা কিছু রচনা করবেন, তার সবই ' মোসলেম ভারত'-এ প্রকাশিত হবে এবং এর জন্য নজরুলকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা দেওয়া হবে। অবশ্য দেওঘরে থাকাকালীন রচিত গানগুলো 'মোসলেম ভারত' ছাড়াও সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

দেওঘরে যাওয়া উপলক্ষে এঁরা নজরুলের বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানে আশ্বিন  মাসে বরিশালে রচিত 'বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন্ সুদূরের নিজন-পূর' গানটি নজরুল পরিবেশন করেছিলেন। রেলপথে দেওঘর যাওয়ার সময়, কিছু হিন্দু-পাণ্ডা তাঁকে একরকম জোর করে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যান। পরে নজরুল নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে রক্ষা পান। এরপর পাণ্ডারা তাঁকে দেওঘরের রাজনারায়ণ বসুর বাড়িতে পৌঁছে দেন। সেখানে একদিন কাটিয়ে, নজরুল ডা. কার্তিক বসুর স্যানেটেরিয়ামে একটি কটেজ ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন।

এই সময় স্যানেটেরিয়ামের তত্ত্ববধায়ক ছিলেন 'ব্যবসা বাণিজ্য' পত্রিকার সম্পাদক শচীন্দ্র বসুর বড় ভাই। তবে শচীন্দ্র বসুর স্ত্রী কুমুদিনী বসু দেওঘরে ছিলেন। উল্লেখ্য  কুমুদিনী বসু ছিলেন 'সঞ্জীবনী' পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা এবং রাজনারায়ণ বসুর দৌহিত্রী। এঁরা সবাই সাহিত্যচর্চা করতেন বলে, সকলের সাথে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল। এই সময় নজরুলের জন্য রান্নার কাজে হিরণা গ্রামের আব্দুল্লাহ নামক একটি ছেলে এঁরাই ঠিক করে দিয়েছিলেন।

একটি ঘটনার সূত্রে দেওঘরের বসু পরিবারের সাথে নজরুলের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। ঘটনাটির সঠিক সময় জানা যায় না। ঘটনাটি হলো- একদিন রাত্রে রাজশাহী থেকে আগত একটি যুবক তাঁর যুবতী সঙ্গিনীকে সাথে নজরুলে বাসায় আসেন এবং তাঁরা নিজেদেরকে দম্পতি হিসেবে পরিচয় দেন। রাত্রে তাঁদের থাকার জায়গা নেই বিবেচনা করে, নজরুল এই বাসায় তাঁদের রাত্রী যাপনের ব্যবস্থা করে দেন। পরদিন ঘটনক্রমে জানা যায় যে এঁরা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন না। এই নিয়ে দেওঘরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই বিষয়ে  কুমুদিনী বসু নজরুলকে দোষারোপ করে প্রচার করেন যে, নজরুল জেনেশুনে এই যুবক-যুবতীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই বিষয়টি চরম আকার ধারণ করলে, কুমুদিনী বসু'র সাথে নজরুলের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে কুমুদিনী বসু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। দেওঘর থেকে নজরুল ফিরে আসার সময় কুমুদিনী বসু নজরুলের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, নজরুল দেখা করেন নি।  আরও পরে কুমুদিনী বসু, তাঁর মেয়ের জন্মদিনে নজরুলে বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

দেওঘরের গিয়ে তিনি ভীষণ অর্থকষ্টে পড়েন। তাই ১৯ ডিসেম্বর (রবিবার, ৪ পৌষ ১৩২৭), সেখান থেকে (ডা. কার্তিক বসুর স্যানেটোরিয়াম) নজরুল সবুজপত্র পত্রিকার পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে জরুরি-ভিত্তিতে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি টাকা পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন।
[পত্র-নমুনা]

দেওঘরে থাকাকালে নজরুলের রচিত ৩টি গান ও দুটি কবিতার কথা জানা যায়। এগুলো হলো- এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় এই মাসে প্রকাশিত হয়েছিল হাফিজের অনূদিত ২টি গজল। মোসলেম ভারত পত্রিকার পৌষ ১৩২৭ (ডিসেম্বর ১৯২০-জানুয়ার ১৯২১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি গজল। পরে গজল দুটি  নির্ঝর কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। গজল দুটি হলো- জানুয়ারি ১৯২১  (১৭ পৌষ- ১৭ মাঘ ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
দেওঘরে থাকার সময় নজরুলের কাছ থেকে উল্লিখিত ৩টি গানের ২টি এবং ২টি কবিতা পেয়ে 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার পরিচালক আফজাল-উল হক বিরক্ত হন। তিনি আশা করেছিলেন, অখণ্ড অবসরের থাকায়, নজরুল প্রচুর কবিতা ও গান রচনা করবেন। এই সময় আফজাল-উল হক তাঁকে নিয়মিত টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। ফলে দেওঘরে নজরুল আথিক সঙ্কটে পড়েন। এছাড়া কলকাতার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে বাস করতে গিয়ে নজরুল হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। এই অবস্থায় মুজফ্‌ফর আহমেদ এবং তাঁর বন্ধু ইমদাদুল্লাহ দেওঘরে নজরুলের সাথে দেখা করার জন্য যান। সেখানে নজরুলের আর্থিক দুরবস্থা দেখে, মুজফ্‌ফর আহমেদ তাঁর বন্ধু ইমদাদুল্লাহর কাছ থেকে টাকা ধার করে, নজরুল এবং তাঁর রান্না ছেলে আব্দুল্লাহকে কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং মুজফ্ফর আহমেদের ১৪/২ চেতলা হাট রোডে বাসায় উঠেন।

উল্লেখ্য, নজরুল যখন দেওঘর গিয়েছিলেন, তখন নজরুল এবং মুজফ্ফর আহমেদ থাকতেন ৮/এ টার্নার স্ট্রিটের বাসায়। নবযুগ ত্যাগ করে নজরুল দেওঘরে চলে যাওয়ার পর, নবযুগ পত্রিকার শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল জানুয়ারি মাসে। ইতিমধ্যে মুজাফ্ফর আহমদ নবযুগ পত্রিকার কাজ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। এই সময় তিনি ৮/এ টার্নার স্ট্রিটের বাসা ছেড়ে দেন। এই সময় ফজলুর রহমানের অানুকুল্যে ১৪/২ চেতলা হাট রোডে একটি বাসা পেয়ে যান এবং সেখানে গিয়েই উঠেন। উল্লেখ্য, ফজলুর রহমান ছিলেন মুজাফ্ফর আহমদ সন্দীপ কার্গিল হাইস্কুলের সহপাঠী। তিনি তখন ২৪ পরগণা জেলা-বির্ডের অফিসে চাকরি করতেন।

দেওঘর থেকে নজরুলের ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে আফজাল-উল হক, ১৪/২ চেতলা হাট রোডের বাসায় এসে নজরুলের সাথে দেখা করেন। তিনি নজরুলের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবেন এই আশ্বাস দিয়ে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির অফিসে নিয়ে যান।  জানুয়ারি মাসের শেষের কয়েকদিন নজরুল এই অফিসেই কাটান। এই সময় ছোটদের পাঠ্য বইয়ের প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয়। উল্লেখ্য, এই আলী আকবরের সূত্রেই নজরুলের জীবনে প্রথম বিবাহের বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিষয়ে যথাসময়ে আলোচনা করা হবে।

এতসব ঝঞ্ঝাটের ভিতরে এই মাসে প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের অনুদিত হাফিজের ২টি গজল, ১টি কবিতা. ৩টি গল্প। এছাড়া পূর্বে প্রকাশিত ১টি  গানও এই মাসে প্রকাশিত হয়েছিল নারায়ণ পত্রিকায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণের সূত্রে ফার্সি ও উর্দু গজলের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। কিছু কিছু ফার্সি গজলের অনুবাদও করেছিলেন। তখন হয়তো গান হিসেবে বাংলায় গজলের ভাবনা ছিল না।  তিনি মৌলিক গজল-গান রচনা করেছিলেন আরও পরে। ফেব্রুয়ারি ১৯২১ (১৭ পৌষ-১৮ মাঘ ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
আগেই উল্লেখ করেছি. ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসেই 'নবযুগ' পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নজরুলের এই পত্রিকার ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর  মুজাফ্ফর আহমদও পদত্যাগ করেছিলেন। ফজলুল হক  এই পত্রিকাটিকে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে বর্ধমানের আবুল কাসেমের উপর তিনি এই পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই সময় প্রধান লেখক হিসেবে আনা হয়েছিল প্রিয়নাথ গুহ। দেওঘর থেকে ফিরে আসার পর, ফজলুল হক পত্রিকার প্রচার বৃদ্ধির জন্য নজরুলকে আবার আহ্বান করেন। নজরু্লও রাজি হয়ে গেলেন। নজরুল এই পত্রিকার সাথে যুক্ত হওয়ার পর, পত্রিকার প্রচার বাড়ে নি। বরং তাঁর লেখার জন্য সরকার পত্রিকার পরিচালককে তিন বার সতর্ক বার্তা পাঠায়। ফলে মন খুলে লেখার উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেছিলেন। লেখালেখির বিতৃষ্ণার মধ্যেও নজরুল ৩টি গান এবং ২টি কবিতা রচনা করেন।

পূর্বে রচিত বা প্রকাশিত রচনা

মার্চ ১৯২১ (১৭ ফাল্গুন- ১৮ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)
প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে নজরুলের কোনো ধরাবাঁধা উপার্জন ছিল না। ফলে তিনি অত্যন্ত আর্থিক সংকটে ছিলেন। তা ছাড়া ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থায় তিনি মন খুলে লিখতেও পারছিলেন না। সব মিলিয়ে নজরুল অনেকটাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত  অবস্থায় ছিলেন। এর ভিতরে তাঁর রচিত ১টি গান ও ১টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া পূর্বে রচিত দুটি গান প্রকাশিত হয়েছিল এই মাসে।

এ মাসে প্রকাশিত নতুন গান ও কবিতা পূর্বে রচিত যে সকল রচনা এই মাসে যে প্রকাশিত হয়েছিল- এপ্রিল ১৩২১ (১৯ চৈত্র ১৩২৭-১৭ বৈশাখ ১৩২৮)
গত মাসের অস্থিরতা এই মাসে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এই অবস্থায় পাঠ্য-পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খান তাঁকে নানাভাবে পাঠ্যবই লেখার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। কিন্তু নজরুল এ ব্যাপারে ততটা উৎসাহ দেখান নি। নজরুলের এই মানসিক অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য, আলী আকবর খান তাঁকে তাঁর দেশের বাড়ি কুমিল্লায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এক্ষেত্রে আফজাল-উল হকও  নজরুলকে উৎসাহিত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নজরুল আলী আকবরের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের শেষে (এপ্রিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুল আলী আকবরের সাথে  চট্টগ্রাম মেল-ট্রেনে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। রেলপথে যাওয়ার সময় তিনি একটি গান রচনা করেন। গানটি হলো-
ঐ সর্ষে ফুলে লুটালো কার [ [তথ্য]
রচনাকাল: 'ট্রেনে কুমিল্লার পথে/চৈত্র ১৩২৭।' গানটি ছায়ানট প্রথম সংস্করণে [বর্মণ পাবলিশিং হাউস, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯২৫ আশ্বিন ১৩৩২। অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল-নীল-পরী। পৃষ্ঠা ৪৪]
সম্ভবত এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে (সোমবার, ২২ চৈত্র ১৩২৭) আলী আকবর কবিকে সাথে নিয়ে, কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে ওঠেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী ছিলেন- বিরজাসুন্দরী নজরুলকে পুত্রস্নেহে কাছে টেনে নেন। নজরুলও তাঁকে মায়ে স্থানে বসিয়েছিলেন। এই সময় ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বৌদি (প্রয়াত বসন্তকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী) গিরিবালা সেনগুপ্তা তাঁর কন্যা আশালতা সেনগুপ্তাকে (দোলন বা দুলী) নিয়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের আশ্রয়ে ছিলেন। কান্দিরপাড়ে অবস্থানকালে  বিরজাসুন্দরীকে নজরুল মা সম্বোধন করার পাশাপাশি গিরিবালাকে মাসিমা সম্বোধন করেছিলেন। এই সময় আশালতার বয়স ছিল ১৩ বৎসর। পরে আশালতার সাথে নজরুলের বিবাহ হয়েছিল। কবি তাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা
 

দৌলতপুরের এই বাড়িতে নজরুল উঠেছিলেন

৫ এপ্রিল  (মঙ্গলবার, ২৩ চৈত্র ১৩২৭) আলী আকবর নজরুলকে সাথে নিয়ে, তাঁর গ্রামের বাড়ি  দৌলতপুরে যান। আলী আকবরের পরিবারের কর্ত্রী ছিলেন, তাঁর বিধবা মেজ বোন একতারুন্নেসা। এই বোনের কন্যা সৈয়দা খাতুনকে দেখে নজরুল মুগ্ধ হন। আলী আকবর বিষয়টি বুঝতে পরে তাঁর এই ভাগ্নীর সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দেন। মুগ্ধ কবি সৈয়দা খাতুনের নাম দিলেন 'নার্গিস'। তিনি এই প্রিয়ার জন্য লিখলেন, বেশ কিছু কবিতা ও গান। বৈশাখ মাসে তিনি সম্ভবত 'নার্গিস'কে নিয়ে রচনা করেছিলেন একাধিক কবিতা গান। ১-২৪ মে ১৩২১ (১৮ বৈশাখ-১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮ পর্যন্ত) পর্যন্ত)
১০ই জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত তিনি কুমিল্লার দৌলতপুরেই কাটান। এই ১০ দিনে নজরুল একাধিক প্রেমের কবিতা রচনা করেছিলেন । এগুলো হলো- বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় তিনটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল এই পত্রিকার জন্য 'ইংলিশম্যান; পত্রিকার ম্যাগাজিন সেকশান থেকে অনুবাদ করেছিলেন। এই অনূদিত নিবন্ধগুলো হলো- বৈশাখ থেকে ১০ই জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত তিনি কুমিল্লার দৌলতপুরেই কাটান। তাঁর ২১ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শেষ-প্রান্ত পার হয়েছিল  'নার্গিস'-এর সাথে প্রণয়ের মধ্য দিয়ে।
সূত্র: